bibidho-biva-ekti-nakshatra

বিভা একটি নক্ষত্রের নাম
ফিচার
নন্দিনী নাগ


প্রায় তিনশো এগার আলোকবর্ষ দূরের, আমাদের সূর্যের চেয়ে আকারে প্রায় দেড়গুণ বড়, ১.২ গুণ ভারী এবং ৬.২১ বিলিয়ন বছর বয়সী একটি নক্ষত্রের নাম বিভা। এই নাম কেবল বাঙালি বা ভারতীয়দের ডাকনাম নয়, নক্ষত্রটির আন্তর্জাতিক পরিচিতি এই নামেই। দুনিয়ার দরবারে নক্ষত্রের এমন বাংলা পরিচয়ের পেছনে রয়েছে আর এক তরুণ বাঙালির অবদান। সেই তরুণের কাছে ‘বিভা’ তো আসলে বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া এক জ্যোতিষ্ক, এক অবহেলিত বিস্মৃত তারকা। বহুবছর ধরে জমে থাকা অন্ধকার তার গায়ে। দু’হাজার উনিশে, ‘সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’র ছাত্র অনন্য ভট্টাচার্য যখন ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ইউনিয়ন’ আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় জিতে দূর আকাশের এই নতুন নজরে আসা নক্ষত্রটির নাম রাখার অধিকার অর্জন করে, প্রায় এক শতাব্দী ধরে অনাদরে ফেলে থাকা নামটি তখন কিছুটা হলেও আলোকপ্রাপ্ত হয়। অথচ এই অবহেলা তাঁর প্রাপ্য ছিল না।

নামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল তাঁর কর্মজীবন, নিজের প্রজ্ঞার জ্যোতিতে সারাজীবন আলোকিত করে গেছেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাক্ষেত্র, অথচ তিনি নিজে আজীবন বঞ্চিত থেকে গেছেন প্রাপ্য স্বীকৃতির আনন্দটুকু থেকে। তিনি বিভা চৌধুরী, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য গবেষণার জন্য যিনি পরিচিত আন্তর্জাতিক গবেষক মহলে। তাঁকে ভুলে গেছে দেশ, এমনকি তাঁর নিজের রাজ্যবাসীও মনে রাখেনি। যদি না পরাধীন ভারতে জন্মগ্রহন করতেন, যদি না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এদেশে বসে গবেষণা করতেন, তবে তো তিনি সমর্থ হতেন গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে, যদি না তাঁকে প্রায় শেষ হয়ে আসা গবেষণার কাজ বন্ধ করে না দিতে হত এই সংকটে, তবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাপকদের তালিকায় এযাবৎকালে একমাত্র যে বাঙালিনীর নাম থাকতে পারত। তিনি কখনও নিযুক্ত হননি এদেশের বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রগুলির কোনও সম্মানীয় উচ্চপদে, এমনকি দেশের তাবৎ মহিলা বিজ্ঞানীদের জীবন এবং কাজ সংক্রান্ত প্রামাণ্য গ্রন্থতেও তাঁর স্থান হয়নি।

যে বছর রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি বাঙালিকে বিশ্ববাসীর সামনে মাথা সোজা করে দাঁড়ানোর সুযোগ এনে দিল, সেই বছরই হুগলি জেলার ভান্ডাররহাটির জমিদার পরিবারে জন্ম বিভা চৌধুরীর। আদতে তাঁদের পারিবারিক পদবি চট্টোপাধ্যায় হলেও জমিদার হিসাবে প্রাপ্ত ‘চৌধুরী’ উপাধিতেই পরিবারের সকলে পরিচিত ছিলেন। বঙ্কুবিহারী ও উর্মিলাদেবীর পাঁচ কন্যা এবং এক পুত্রের মধ্যে বিভা ছিলেন তৃতীয় সন্তান। পেশায় চিকিৎসক বঙ্কুবিহারী চৌধুরী, বরিশালের ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েকে বিবাহ করায় পরিবারচ্যুত হয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং আপার সার্কুলার রোডে (বর্তমান আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোড) বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এতে আখেরে ভালোই হয়, তাঁর সন্তানেরা প্রত্যেকে কলকাতার নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান আর বিজ্ঞান পায় বিভা চৌধুরীর মতো একজন সাধিকাকে।

কলকাতার অন্যতম প্রাচীন মেয়েদের স্কুল বেথুনে পড়া শেষ করে স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন বিভা। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে তৃতীয় মহিলা হিসাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান উনিশশো ছত্রিশে। প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়েছিলেন চামেলি দত্ত, উনিশশো তেত্রিশে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত পড়াশোনার শেষে বিভা চৌধুরী যখন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন তখন প্রাথমিক কণিকা সংক্রান্ত (elementary particle) গবেষণা ছিল একেবারে আঁতুরঘরে। পরমাণুর ভেতরটা গড়ের মাঠের মতো ফাঁকা আর তার মাঝখানে থাকে নিউক্লিয়াস। সেই নিউক্লিয়াসটি আবার ঠাসা প্রোটন নামের এক পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত কণিকা দিয়ে, রাদারফোর্ডের আলফা কণা বিক্ষেপণ সংক্রান্ত পরীক্ষা থেকে পাওয়া এই জ্ঞানটুকু নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা কাটিয়ে দিয়েছেন অনেকগুলো বছর। উনিশশো বত্রিশে চ্যাডউইক যখন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন কণিকার অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন, তখন কণাপদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় এল জোয়ার। কারন এতকাল ধরে নিউক্লিয়াসকে ভাঙার জন্য উপযুক্ত কোনও হাতিয়ার ছিল না বিজ্ঞানীদের হাতে। নিউক্লিয়াস পজিটিভ তড়িৎধর্মী হওয়ায় আলফা কণার মত পজিটিভ তড়িগ্রস্ত কণা নিউক্লিয়াসের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারে না, বিকর্ষণে ছিটকে যায়। ফলে নিউক্লিয়াসের ভেতরের খবর আসতে পারে না বাইরে, আমাদের কাছে থেকে যায় অজানা। নিউট্রনের আবিষ্কার সেই সমস্যা মেটাল। নিস্তড়িৎ অথচ ভারী হওয়ায় নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে বিভিন্ন মৌলের হৃদয় বিদীর্ণ করা সম্ভব হল। এর ফলে আরও নতুন নতুন প্রাথমিককণার অস্তিত্ব খোঁজার জন্য গবেষণায় গতি এল সারা পৃথিবী জুড়েই।

বিভা চৌধুরী আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে উৎসুক এবং ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই গবেষণার জন্য সহজতর কোনো বিষয় বেছে না নিয়ে, উচ্চশক্তির কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার জন্য আগ্রহী হন এবং সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক ডক্টর দেবেন্দ্র মোহন বোসের অধীনে গবেষণা করতে চেয়ে আবেদন করেন।

সময়টা মেয়েদের জন্য সবদিক থেকে ভীষণই খারাপ ছিল, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পুরুষপ্রধান উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা সত্বেও মেয়েদের পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করত নানা অজুহাতে, যার মধ্যে প্রধান এবং হাস্যকর অজুহাতটি ছিল পুরুষ সহপাঠীদের চিত্তচাঞ্চল্য। ঠিক এই অজুহাতে না হলেও, দেবেন্দ্র মোহন বোসের গবেষণাগারের দরজাও সহজে খুলে যায়নি বিভা চৌধুরীর জন্য। তাঁর যুক্তি ছিল মেয়েদের দিয়ে করানোর উপযোগী কোনও প্রজেক্ট তাঁর কাছে নেই। অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাস ছিল, ছেলে আর মেয়েদের শিক্ষার ধরণ এবং ক্ষেত্র আলাদা হবে, যে কাজ ছেলেরা করতে পারবে, উপযুক্ত মেধা থাকা সত্বেও মেয়েরা তার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। ডক্টর বোস ছিলেন বিভা চৌধুরীর নিকটাত্মীয়। খ্যাতনামা ডাক্তার নীলরতন সরকারের জামাতা ছিলেন দেবেন্দ্র মোহন বোস, আর নীলরতন সরকার ছিলেন বিভা চৌধুরীর নিজের মেসোমশাই। অর্থাৎ কিনা নিজের মেধাবী শ্যালিকাকেও খুশিমনে তাঁর অধীনে গবেষণা করার অনুমতি দেননি পদার্থবিজ্ঞানের এই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক। স্বজনকে পোষণ না করে বরং বঞ্চনা করতেই তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন।

অবশ্য এমন ঘটনা তখন সারা পৃথিবীতেই আকছার ঘটেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, সারা বিশ্ব যাঁকে পদার্থবিজ্ঞানের একজন মাইলফলক বলে স্বীকার করে, সেই বরেণ্য ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডও তার ক্লাসের একমাত্র ছাত্রী সিসিলিয়াকে(Cecilia. H.Payne, যিনি পরবর্তীকালে স্বনামধন্য জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবেন) সামনের বেঞ্চে ক্লাসের সকলের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বসতে বাধ্য করতেন। শুধু তাই নয়, প্রতিদিনই ক্লাসে এসে ছাত্রীটিকে সকলের সামনে নানা কটু কথা বলে হেনস্থা করতেন, যা তাঁকে ক্লাসভর্তি ছাত্রদের সামনে উপহাসের পাত্রী করে তুলত। এসবই ছিল মেয়ে হয়েও সিসিলিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়তে আসার ধৃষ্টতা দেখানোর মাশুল।

এমন দৃষ্টান্ত এদেশেও আছে। নোবেল জয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সিভি রামনও প্রথম দিকে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’ এ ছাত্রীদের ভর্তি নিতে অসম্মত ছিলেন। বিভা চৌধুরীর থেকে দু’বছর আগে জন্মানো আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী কমলা সোহোনি(Kamala Sohonie) কেও ডক্টর রামনের লিঙ্গ বৈষম্য নীতির শিকার হতে হয়েছিল। বম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করে আসা মেধাবী ছাত্রী কমলাকে, পরবর্তীকালে যিনি হবেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট খেতাবপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় মহিলা, প্রথমে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এ ভর্তি হতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল। পরে অবশ্য কমলার জেদের কাছে হার মানতে হয় সিভি রামনকে। রামনের অফিসের সামনে সত্যাগ্রহ ধর্ণায় বসে কমলা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ আদায় করে নেন।

শেষ পর্যন্ত হয়তো বা পারিবারিক চাপেই ডিএম বোস বিভাকে তাঁর অধীনে গবেষণা করতে দিতে স্বীকৃত হন। বছরখানেক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গবেষক হিসাবে কাজ করেছিলেন বিভা। ১৯৩৮ সালে ডিএম বোস যোগ দিলেন বোস ইনস্টিটিউটে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধীনে গবেষণারত সমস্ত ছাত্রছাত্রীসমেত। বোস ইনস্টিটিউটে বিভা চৌধুরী গবেষণা করেছেন ১৯৪২ সাল পর্যন্ত।

তিনি গবেষণা করছিলেন সেইসময়ের নিরিখে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে, যে কাজের জন্য নিষ্টা আর পরিশ্রমের সঙ্গে প্রচুর সাহসেরও প্রয়োজন হয়। চৌধুরী এবং বোস পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণ করতে চাইছিলেন এমন একধরনের সাবঅ্যাটমিক প্রাথমিক কণার অস্তিত্ব, যার সম্পর্কে জাপানি পদার্থবিজ্ঞানী ইউকাওয়া, যিনি আরও কিছু বছর পরে এই গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হবেন, তিনি তখন কেবলমাত্র ভবিষ্যৎবানী করেছেন।

পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে অতি ছোট্ট জায়গায় ঠাসাঠাসি করে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন। প্রোটন কণাগুলো ধনাত্মক তড়িৎধর্মী হয়েও এত ছোট জায়গায় নিজেদেরকে বিকর্ষণ না করেও কীভাবে একসাথে থেকে যায়, সেটা এখন সকলেই জানেন। ‘মহাবল’ বা ‘নিউক্লিয় বল’ নামে এক প্রবল পরাক্রমশালী বল তাদের বেঁধে রাখে। সেই বল এতই শক্তিশালী যে তার সামনে বিকর্ষণ বলের ঝগড়াঝাঁটি, ঠেলাঠেলি মাথাই তুলতে পারে না। এই বলের বাহক হিসাবে যে মৌল কণিকাকে কল্পনা করা হল, তাকে সেই সময়ে বলা হত ‘মেসোট্রন’। কারণ গননা করে দেখা গেছিল, তখনও পর্যন্ত ধরা না দেওয়া এই অজ্ঞাত কণার ভর হতে হবে ইলেকট্রনের চেয়ে বেশি কিন্তু প্রোটনের থেকে কম। ইলেকট্রন আর প্রোটনের মাঝামাঝি ভরের কণা বলে ইউকাওয়া এর নাম দিয়েছিলেন মেসোট্রন। পরে অবশ্য ভারতীয় বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা এই কণার নামকরণ করেন ‘মেসন’, যে নামেই এখন পরিচিত কণাটি।

‘মেসন’ নামক এই কণাটির আবিষ্কারের গুরূত্ব এটাই যে, এর অস্তিত্ব প্রমাণ হলে, নিউট্রন প্রোটনের মধ্যেকার অনেক রহস্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে। জানা যাবে কীভাবে নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন এবং প্রোটন কণার অবিরাম রূপান্তর ঘটে চলেছে, ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে পরমাণুর নিউক্লিয়াসটির স্থায়ীত্বের কারন, মহাবলের(strong force) অধীনে কীভাবে ঘটে সাবঅ্যাটমিক কণাদের ক্রিয়া-বিক্রিয়া, ব্যাখ্যা করা যাবে তাও। বহির্বিশ্ব থেকে যে মহাজাগতিক রশ্মি এসে পৌঁছায় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে, তাতে মেসন কণার অস্তিত্ব খুঁজে বার করার জন্য ডক্টর বোসের তত্ত্বাবধানে বিভা চৌধুরী হিমালয়ের দূষণমুক্ত পরিবেশকে বেছে নিয়ে সেখানেই পাড়ি জমালেন। মেসন কণার আয়ু অত্যন্ত কম, মহাজাগতিক রশ্মির ধাক্কায় জন্মানো মেসন কণিকা ভীষণ রকম অস্থায়ী। সবচাইতে দীর্ঘজীবি মেসনও এক মাইক্রোসেকেন্ড (এক সেকেন্ডের লক্ষ ভাগের একভাগ) সময়ের একশো ভাগের একভাগ সময় বাঁচে। ওইটুকু আয়ুকালে তারা পৃথিবীর পৃষ্ঠে এসে এসে পৌঁছতে পারে না, কাজেই তাদের খোঁজ করতে হলে যেতে হবে অনেক বেশি উচ্চতায়। বিভা চৌধুরীও তাই মেসনকে ধরার জন্য ফাঁদ পাততে ঘাঁটি গাড়লেন হিমালয়ের কোলে। উনচল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ, এই তিনবছর দার্জিলিং, সান্দাকফুর বিস্তীর্ন অঞ্চলে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে তিনি সম্ভাব্য কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন।

চৌধুরী-বোস জুটি পরীক্ষামূলকভাবে মেসনের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ফটোগ্রাফিক ইমালশন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। ব্যবহার করা ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলোকে ডেভেলপ করার পর বিশ্লেষণ করে তাঁরা দুই ধরনের অজানা কণিকার অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন, যাদের একটি ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় দুশোগুণ এবং অপরটি প্রায় তিনশো গুণ ভারী। মেসন নামের এক বিশেষ প্রকারের কণার খোঁজ করতে গিয়ে দুটো আলাদা রকমের কণা এসে ধরা দেওয়াতে তাঁদের সন্দেহ হল, হয়তো বা তাঁদের কাজটাতে কোথাও ত্রুটি রয়ে গেছে। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী মাত্রই এখন বুঝবেন তাঁদের গবেষণা সঠিক পথেই চলেছিল, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে একটি নয়, দুটি আলাদা গোষ্ঠীর কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। যে গোষ্ঠীদুটি পরবর্তীকালে পরিচিত হবে ‘পাই’ (π) মেসন শ্রেণি এবং ‘মিউ’ লেপটন শ্রেণির কণিকা হিসাবে। আরও পরে অবশ্য মেসন কণার আরও একটা পরিবারকে নিয়ে সফল গবেষণা করবেন বিভা চৌধুরী, সে অন্য প্রসঙ্গ।

আপাতত ফিরে আসা যাক উনিশশো বিয়াল্লিশে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় কাঁপছে পৃথিবী, ফলে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগানের দারুণ অভাব। বোস-চৌধুরী জুটি, মেসন কণার খোঁজ করতে ব্যবহার করেছিলেন ‘হাফটোন’ প্রকৃতির ফোটোগ্রাফিক প্লেট, যার বিশ্লেষণী ক্ষমতা স্বভাবতই কম। নিঃসংশয় হবার জন্য পরীক্ষাগুলো আবারও করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় ফটোগ্রাফিক প্লেটের যোগানের অভাবে তাঁরা তা করতে পারলেন না। ফলে এই গবেষণা তাঁদের বন্ধ করে দিতে হল। ‘মেসন’ কণিকার অস্তিত্ব খোঁজার ক্ষেত্রে তাঁদের এই পথপ্রদর্শনকারী পরীক্ষা সংক্রান্ত পর পর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল পৃথিবী বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’-এ, উনিশশো চল্লিশ সালে। পরবর্তীকালে এই পরিত্যক্ত গবেষণার সূত্র ধরে, একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী পাওয়েল, ‘পাই’ মেসন এবং ‘মিউয়ন’ কণার অস্তিত্ব প্রমাণ করেন, যাদের ভর বোস-চৌধুরীর গবেষণালব্ধ কণাদুটির ভরের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। পাওয়েল কাজটি করেছিলেন আরও সাতবছর পরে, যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে। সেই সময় তিনি উচ্চ বিশ্লেষণী ক্ষমতাযুক্ত ‘ফুলটোন’ ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করার সুবিধা পেয়েছিলেন।

পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস জানে, এই কাজের জন্য পাওয়েল উনিশশো পঞ্চাশে নোবেল পুরস্কার পান। তার আগের বছর মেসন সহ প্রাথমিক কণা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য নোবেল পেয়েছেন ইউকাওয়া। পরপর দু’বছরে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল যে গবেষণার জন্য, সেই গবেষণার পথিকৃৎ ছিলেন এক বাঙালি কন্যা, তাঁকে কি ভুলে যাওয়া যায়! পাওয়েল অবশ্য তাঁর গবেষণারপত্রে চৌধুরী-বোসের এই পথপ্রদর্শনকারী গবেষণাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

মেসন কণা সংক্রান্ত গবেষণা বন্ধ হয়ে যাবার পর বিভা চৌধুরী ছাড়লেন বোস ইনস্টিটিউট, পাড়ি দিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, এবারে তিনি ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিলেন গবেষক হিসাবে। এখানে গবেষণার বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘মহাজাগতিক রশ্মি’কে (cosmic ray)। মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে মানুষের কৌতূহল বেশ পুরনো।

পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বহির্বিশ্ব থেকে অবিরত আছড়ে পড়ছে নাম না জানা অচেনা রশ্মি। এই রশ্মির স্বরূপ বোঝার জন্য ১৯১২ সালে এক দুঃসাহসিক অভিযানের আয়োজন করেছিলেন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী ভিএফ হেস (V.F Hess)। বেলুনে চড়ে হেস তেরো হাজার ফিট উচ্চতায় পাড়ি দিয়েছিলেন মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, মাটি থেকে উচ্চতা যত বাড়ছে বায়ুমন্ডলের আয়নিত হওয়ার প্রবণতা তত বেড়ে চলেছে। এর কারণ হিসাবে তিনি পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা আয়নিত কণিকার স্রোতকেই দায়ী বলে মনে করেন এবং এই রশ্মির নামকরণ করেন ‘আলট্রা গামা রেডিয়েশন’। পরবর্তীকালে আরও এক বিশিষ্ট আমেরিকান বিজ্ঞানী মিলিকান এই রশ্মির নাম রাখেন ‘কসমিক রে’, যাকে আমরা মহাজাগতিক রশ্মি বলছি। নামকরণ তো হলো, কিন্তু এই রশ্মির প্রকৃতি নিয়ে মতান্তর দূর হল না। বৈজ্ঞানিক মহল দ্বিধাবিভক্ত, একদল মনে করেন মহাজাগতিক রশ্মি আসলে নিস্তড়িৎ গামা রশ্মি, অপর দল ‘হেস’ এর অনুসারী, অর্থাৎ তাঁদের মতে বহির্বিশ্ব থেকে আসা এই রশ্মি আসলে আহিত কণার স্রোত। অবশেষে বিরোধের নিষ্পত্তি হল উনিশশো তিরিশে, যখন বিশিষ্ট পদার্থবিদ কম্পটন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন মহাজাগতিক রশ্মি আসলে পৃথিবীর ওপর নিরন্তর বর্ষিত হতে থাকা আহিত কণার (charged particle) স্রোত।

এবার আমরা ফিরব উনিশশো পঁয়তাল্লিশে, যখন বিভা চৌধুরী ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের জন্য বোস ইনস্টিটিউট ছেড়ে পা রাখছেন ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির কসমিক রিসার্চ ল্যাবরেটারিতে। এবারে তিনি শিক্ষক হিসাবে পেলেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ব্ল্যাকেটকে (P.M.S Blackett), যিনি আর চার বছর বাদেই নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হবেন।

ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল, ‘Extensive air showers caused when cosmic rays enter the earth’s atmosphere from interstellar space’।

এই এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার বিষয়টাকে সংক্ষেপে একটু জেনে নিলে, বিভা চৌধুরীর গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে সুবিধা হবে।

পৃথিবীর বাইরে থেকে যে আয়নিত কণার ধারাবর্ষণ হয়ে চলেছে, তাকে বলা হয় প্রাথমিক মহাজাগতিক রশ্মি। এতে থাকে প্রোটন কণা মানে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে আরও ভারী বিভিন্ন পরমাণুর নিউক্লিয়াস। এরা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করা মাত্রই সংঘর্ষে লিপ্ত হয় বায়ুমন্ডলে থাকা বিভিন্ন কণার সঙ্গে। এর ফলে জন্ম নেয় আরও অনেক মৌলিক কণিকা এবং গামা রশ্মি। মৌলিক কণিকাগুলো হয় সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণির মেসন এবং লেপটন, যাদের আয়ু এক মাইক্রো সেকেন্ডেরও অনেক কম। ফলে তারা আবার দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে গামা রশ্মির শক্তি থেকে জন্ম নেয় ইলেকট্রন-পজিট্রন যুগল। অর্থাৎ প্রাথমিক মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে থাকা আয়নিত কণার অভিঘাতে সৃষ্টি হয় বহু কণিকার। প্রাথমিক মহাজাগতিক রশ্মির ধাক্কায় বায়ুমন্ডলে এই দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রচুর মৌল কণিকার জন্ম হওয়ার ঘটনাকে বলা হয় ‘এয়ার শাওয়ার’। দ্বিতীয় পর্যায়ে উৎপাদিত কণিকার সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন এমনকি বিলিয়নও হতে পারে। এমন বিপুল পরিমাণ কণিকা উৎপাদন হলে তাকে ‘এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার’ বলা হয়। এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার অবশ্য পর্যবেক্ষণ করা যায় একমাত্র উঁচু পর্বতে, কারণ আয়ু অত্যন্ত কম হওয়ার জন্য ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছানোর অনেক আগেই এইসব কণিকারা বিনষ্ট হয়ে যায়।

বিভা চৌধুরীর গবেষণার বিষয়টি আকৃষ্ট করেছিল সমসাময়িক বিজ্ঞানীমহলকে। অভিজাত সংবাদপত্র ‘দ্য ম্যানচেস্টার হেরাল্ড’ এ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ছবি এবং সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা দীর্ঘ নিবন্ধ। ‘দ্য ম্যানচেস্টার হেরাল্ড’ বিভা চৌধুরীকে পশ্চিমি দুনিয়ার সামনে উপস্থাপিত করেছিল এই প্রত্যয়ে, ‘Meet India’s new woman scientist, she has an eye for cosmic rays.’ ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে চারবছর দক্ষতার সঙ্গে গবেষণার কাজ শেষ করে বিভা চৌধুরী গবেষণাপত্র জমা দেন উনিশশো উনপঞ্চাশে, আর সেই বছরই দেশে ফিরে এসে ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ (TIFR) এ কাজে যোগ দেন, যেখানে তিনি সাতান্ন সাল পর্যন্ত টানা গবেষণার কাজ করে গেছেন। তাঁর গবেষণাপত্রে কোনওরকম ত্রুটি না থাকা সত্বেও, কোনও এক অজ্ঞাত কারনে ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে তাঁকে আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, উনিশশো বাহান্নতে তিনি উপাধিটি লাভ করলেন।

ডক্টর বিভা চৌধুরী তাঁর গবেষক জীবনের সবটা জুড়ে কাজ করে করে গেছেন মহাজাগতিক রশ্মির এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার নিয়ে। আরও গুছিয়ে বলতে গেলে, মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে থাকা আদি কণিকা এবং তাদের সঙ্গে সংঘাতের ফলে জন্ম নেওয়া আদি কণিকাদের নিয়ে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে এই কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ বোঝার জন্য নিচের আলোচনাটি জরুরি।

আমাদের এই গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ডটা চার রকম বলের (force) অধীন। আমরা যতরকমের বলের উপস্থিতি অনুভব করি বা বহিঃপ্রকাশ দেখি না কেন, তারা ঘুরে ফিরে এই চারটি শ্রেণির মধ্যেই এঁটে যায়। এদের মধ্যে মহাকর্ষ বল আর তড়িৎচুম্বকীয় বল মোটামুটিভাবে আমজনতার কাছে পরিচিত। এই যে আমরা টিকটিকির মত পৃথিবীর গায়ে লেপটে আছি, মহাশূন্যে হারিয়ে যাচ্ছি না, সেটা যে মহাকর্ষ বলের দাক্ষিণ্যে সম্ভব হচ্ছে, সেই কথাটা সকলেই জানেন। আর সেই সঙ্গে এটাও জানেন মহাকর্ষ বলের চোখরাঙানিতেই সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর এ হেন চরকিপাক। মহাকর্ষ বলের প্রকৃতি কেবল আকর্ষণ জাতীয়, এ কেবল সবাইকে কাছে টানে, দূরে ঠেলে না কাউকে। দুটো তড়িৎগ্রস্ত কণা কিংবা চুম্বকের দুই মেরু যে বলে নিজেদের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে সেটা হল তড়িৎচুম্বকীয় বল। পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনগুলো যে নিউক্লিয়াসের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, সেটা সম্ভব হয় এই বলের শাসনে। এই দুটি পরিচিত বল ছাড়া রয়েছে মহাবল (strong force) এবং হীনবল (weak force)। এক সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যকে এককোটি ভাগে ভেঙে তার একটা টুকরো নিয়ে তাকে আবার দশ হাজার ভাগে ভেঙে তার একটা টুকরো নিলে যত ক্ষুদ্র হয়, সেই অবর্ণনীয় ক্ষুদ্র পরিসরে মহাবল এবং হীনবল কাজ করে বলে এদের পরিচয় আমরা কখনও পাইনা।

ডালটনের সময়ে মানুষ জানত পরমাণুই হল পদার্থের ক্ষুদ্রতম উপাদান, একে আর ভাঙা যায় না। এরপর বেশ কিছুদিন পৃথিবী এই ধারণা আঁকড়ে ধরে থেকে গেছিল যে পরমাণুকে দুটো টুকরো করা যায়, ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াস, যা প্রোটন দিয়ে তৈরি। চ্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করার পর জানা গেল নিউক্লিয়াসকেও ভাঙা যায়। এখন আমরা জানি, প্রোটন বা নিউট্রনও অবিভাজ্য নয়, তারা তৈরি হয় কোয়ার্ক এবং অ্যান্টিকোয়ার্ক দিয়ে। এত সমস্ত সাবঅ্যাটমিক কণার উপস্থিতি স্বীকার করে নেবার পর স্বভাবতই তাদের শ্রেণিবিভাগ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল, কোন ধরনের বলের অধীনে কোন জাতীয় কণা সক্রিয় হয় সেসব না জানতে পারলে কণা-পদার্থবিজ্ঞানকে বোঝা সম্ভব হবে না। মহাবলের অধীনে যারা সক্রিয়তা দেখায় তাদের বলা হয় হ্যাডরন(Hadron)। এরা আবার দুই শ্রেণির হতে পারে। যেসব হ্যাডরন দুটি কোয়ার্ক বা তার বিপরীত কণা অ্যান্টি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি তাদের বলা হয় মেসন। অর্থাৎ মেসনকে ভাঙলে কোয়ার্ক বা অ্যান্টিকোয়ার্ক যাই পাওয়া যাক না কেন, তার সংখ্যা দুইয়ের বেশি হবে না। আর যেসব হ্যাডরনের ভেতরে তিনটি করে কোয়ার্ক বা অ্যান্টিকোয়ার্ক থাকে তারা হল বেরিয়ন। এবারে লেপটনের প্রসঙ্গে আসা যাক। এরা একেবারে মৌলিক কণিকা, এদের আর ভাঙা যায় না। লেপটনরা, মহাবল ছাড়া বাকি তিনটে বলের অধীনে ক্রিয়া করে। আমাদের পরিচিত একটি লেপটন হল ইলেকট্রন। এছাড়াও ‘মিউ’, ‘টাও’ আর নিউট্রিনোরাও লেপটন গোষ্ঠীর।

চৌধুরী-বোস জুটি মেসন কণার সাথে আরও একটি যে কণার অস্তিত্ব পেয়েছিলেন তাঁদের ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলোতে, সে হল এই ‘মিউ’ লেপটন। এসব কণাগুলোর উপস্থিতি সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী তো করলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা, কিন্তু যতক্ষণ না তাদের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই তত্ত্ব স্বীকৃত হবে না। সারা পৃথিবী জুড়ে তাই গবেষকরা উঠে পড়ে লেগেছিলেন এই কণাগুলোর উপস্থিতি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার কাজে। বাঙালি মেয়ে বিভাও সেই কাজ করে গেছেন তৎকালীন প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

ভারতবর্ষে মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণা প্রথম শুরু হয় কলকাতায়, ডক্টর দেবেন্দ্রমোহন বোসের হাত ধরে। কণা-পদার্থবিজ্ঞানে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার অভিজ্ঞতা ছিল ডক্টর বোসের, কারণ প্রথম জীবনে তিনি ‘ক্লাউড চেম্বার’ এর আবিষ্কর্তা উইলসনের সঙ্গে একসাথে গবেষণা করেছিলেন। ক্লাউড চেম্বার হল আয়নিত কণার উপস্থিতি নির্ধারক যন্ত্র (partie detector)। কোনও আয়নিত কণা এর ভেতরে প্রবেশ করলে তার উপস্থিতি এবং গতিপথ নির্ণয় করা যায় এর সাহায্যে। বলাই বাহুল্য, ‘ক্লাউড চেম্বার’ এর আবিষ্কার, কণা-পদার্থবিদ্যার গবেষণাকে ত্বরান্বিত করেছিল। সেইসময়ের সেরা শিক্ষক ডিএম বোসের কাছেই মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণায় হাতেখড়ি হয়েছিল বিভা চৌধুরীর।

কসমিক রে সংক্রান্ত গবেষণার দ্বিতীয় অধ্যায়টি শুরু করেছিলেন ডক্টর হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, ‘টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’এ। তাঁর উদ্যোগে একঝাঁক তরুণ গবেষক কসমিক রে সংক্রান্ত গবেষণার জন্য TIFR এ যোগ দিয়েছিলেন। জানা যায়, ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে বিভা চৌধুরীর ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য জমা দেওয়া গবেষণাপত্রটি যাঁরা পরীক্ষা করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম, উইলসনের (J.G.Willson) কাছে ডক্টর হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা বিভা চৌধুরীর সম্পর্কে মতামত চেয়েছিলেন। আশা করা যায় উইলসনের গোপন মতামত সদর্থকই ছিল, ফলে ভাবা তাঁকে TIFR এ গবেষক হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। বিভা চৌধুরী ছিলেন TIFR এর প্রথম মহিলা গবেষক।

TIFR এ ডক্টর চৌধুরীর গবেষণা জীবনটিও বর্ণময়। বিভা চৌধুরী সহ অন্যান্য সদস্যদের গবেষণার ফসল হিসাবে আবিষ্কৃত হয় মেসন পরিবারের আরও এক সদস্য ‘কে’(K) মেসন কণিকার বেশ কিছু প্রকারভেদ। এখানে কাজ করাকালীন তিনি আরও একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণার অংশীদার হয়েছিলেন। ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে কোলার স্বর্ণখনিতে হওয়া মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণাটির কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। মাটি থেকে সাতশো ফুট নিচে, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তাঁর নিজের তৈরি কণার উপস্থিতি নির্ধারক যন্ত্রের (partie detector) সাহায্যে তিনি উচ্চ শক্তি সম্পন্ন মৌলিক কণিকার খোঁজ চালিয়ে গেছেন। এই কাজে তাঁর সঙ্গী ছিল TIFR এর একটি দল। সাফল্যের সঙ্গে এই গবেষণা শেষ করেছিলেন তিনি।

TIFR ছাড়ার পর ডক্টর চৌধুরী একবছর ইউরোপ এবং আমেরিকাতে কাটান। এইসময় তিনি মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন ‘অতিথি শিক্ষক’ হিসাবে পড়ান এবং ডক্টর উইলসনের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণাও করেন। দেশে ফিরে আসার পর তাঁর গবেষণা জীবনের পরবর্তী অধ্যায়টি শুরু হয় আহমেদাবাদের ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরী’(PRL)তে। এখানে তিনি বেশ কিছু বছর কাজ করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত মনের মতো কাজ করতে না পারায় পদত্যাগ করেন। কোলার স্বর্ণখনির পরীক্ষাটি সফল হওয়ায় ডক্টর চৌধুরী মাউন্ট আবুতে ক্যাম্প করে এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার এর রেডিও ফ্রিকোয়েন্সী রেডিয়েশন নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। PRL এর তৎকালীন ডিরেক্টর, ডক্টর বিক্রম সারাভাই তাঁর পরিকল্পনাটি অনুমোদনও করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ডক্টর বিক্রম সারাভাইয়ের অকাল প্রয়াণে তাঁর এই নতুন গবেষণা প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়, নতুন ডিরেক্টরের অনুমোদন না পাওয়ায়। এরপরই তিনি PRL ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে ‘হাই এনার্জি ফিজিক্স’ সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেন ‘সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ এ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছুদিন কাজ করেন, তারপর যোগ দেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ কালটিভেশন অফ সায়েন্স’ এ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি একজন সক্রিয় গবেষক ছিলেন।

শুধুমাত্র সফল গবেষকই নন, ডক্টর চৌধুরী একজন খুব ভাল শিক্ষকও ছিলেন। যেসব ছাত্রেরা তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করতেন তাঁরা ডক্টর চৌধুরীর শিক্ষকতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তেমনই একজন ছাত্র ডক্টর যোগেশ সাক্সেনা যাঁকে ভারতের ‘প্লাজমা’ গবেষণার ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব বলে জানে বৈজ্ঞানিক মহল, সেই ডক্টর সাক্সেনাকে নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন তিনি।

এমন মণীষা যাঁর, তাঁকে কোনও জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র কখনও ডিরেক্টর হিসাবে যোগ্য বিবেচনা করেনি, এমন কী তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান ‘বোস ইনস্টিটিউট’ও ব্রাত্য করে রেখেছে তাঁকে! ডক্টর ডিএম বোস অবসর নেবার পর ‘বোস ইন্সটিটিউট’ এর দায়িত্ব বর্তায়, প্রফেসর শশাঙ্ক ভট্টাচার্যের ওপর। প্রফেসর ভট্টাচার্য ডক্টর চৌধুরীকে ছাত্রাবস্থা থেকেই চিনতেন, এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করতেন। ডক্টর বিভা চৌধুরী উপস্থিত থাকতেও তাঁকে ‘বোস ইন্সটিটিউট’ এর ডিরেক্টর হিসাবে যোগদান করতে হওয়ায় তিনি অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করেন এবং পরিচিত মহলে সেই নিয়ে নিয়মিত আক্ষেপও প্রকাশ করেন।

এদেশের তিনটি সায়েন্স একাডেমির একটিও বিভা চৌধুরীকে সদস্য হিসেবে মনোনীত করেনি কখনও, তিনি কি এই পদের জন্যেও যথেষ্ট যোগ্য ছিলেন না! উত্তর জানা নেই। এমনকি দীর্ঘদিন সফলতার সঙ্গে TIFR এ কাজ করা সত্বেও ডক্টর হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা কিন্তু কোনোদিনই বিভা চৌধুরীকে একজন প্রথম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞানী বলে মনে করেননি। ‘ইন্ডিয়ান একাদেমি অফ সায়েন্স’ এর উদ্যোগে অল্প কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ, ‘The Women Scientists Of India’. ভিক্টোরিয়ার আমল থেকে শুরু করে একশ জন ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানীর জীবনকথা সেখানে থাকলেও আশ্চর্যজনকভাবে বাদ পড়ে গেছেন বিভা চৌধুরী। জানা নেই, এই বিস্মৃতি কি অনিচ্ছাকৃত! কিংবা এর আড়ালে প্রকৃত কারণ কি?

ডক্টর চৌধুরী ছিলেন ভীষণ নম্র ভদ্র ভালোমানুষ। খ্যাতির প্রত্যাশী তিনি কখনোই ছিলেন না। পদার্থবিজ্ঞানকে ভালোবেসে সারাজীবন নীরবে কাজ করে উনিশশো একানব্বইয়ের ২রা জুন নীরবে বিদায় নিয়েছেন তিনি। তিনি এবং তাঁর ভাইবোনেরা প্রত্যেকেই অবিবাহিত ছিলেন, ফলে তাঁর জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে জানানোর জন্য কোনও পারিবারিক উত্তরাধিকার নেই। তাঁর নিজের বাড়ি ভান্ডারহাটির মানুষজনও জানেন না তাদের ঘরের মেয়ে কত বড় মাপের মানুষ। দেশে ফিরে আসার পর যেসব গবেষণাপত্র তিনি তৈরি করেছিলেন, সেগুলি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করার কোনও উদ্যোগ না নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন দেশীয় জার্নালে, যার অনেকগুলিরই হদিশ এখন পাওয়া যায় না। পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকদের কাজের জন্য গবেষণাপত্রগুলি সংরক্ষণের কোনওরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিন্তু এমন তো নয় যে বাঙালি যোগ্য ব্যক্তিকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনের রীতি রেওয়াজ ধরে রাখেনি, তাহলে বিভা চৌধুরীর ক্ষেত্রে এই অনীহা কেন? বাংলাতেও তাঁকে নিয়ে বই বা পত্রপত্রিকাগুলো সরব নয়, একমাত্র রণতোষ চক্রবর্তীর ‘বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বিজ্ঞানী’ বইটিতে তাঁর সংক্ষিপ্ত একটি জীবনী আছে। বিভা চৌধুরীর গবেষণা এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে এখনই বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। আরও দেরি করা হলে আগামী প্রজন্মের কাছে ‘বিভা’ কেবল দূরের আকাশের একটি নক্ষত্রের নাম হয়েই থেকে যাবে।

তথ্যসূত্র:
‘A Jewel Unearthed: Bibha Chowdhuri’
By Dr Rajinder Singh (University of Oldenburg) &
Dr. S.C Roy (exChairman, dept of Physics, Bose Institute)


এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *