binodan-smritir-studiopara-part-7

স্মৃতির স্টুডিওপাড়া – পর্ব ৭
ফিল্ম রিভিউ
প্রিয়ব্রত দত্ত


হাঁটুর ওপর লুঙ্গি গুটিয়ে দৌড়ে আসছে যিশুদা


যিশু দাশগুপ্ত কোনও দিন কেউকেটা হতে চাননি। চাননি সেলিব্রিটি হতেও। চেয়েছিলেন সংসারের বড়দার মতো ডালে ভাতের দায়িত্ব নিয়ে পারিবারিক পরিমণ্ডলে হৈ হৈ করে বেঁচে থাকতে।

বাংলা সিরিয়ালের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া পরিচালক যিশু দাশগুপ্তর শুরুটা কঠিণ সংগ্রামের এবড়ো খেবড়ো অলিগলি দিয়ে। যিশুদাদের পারিবারিক ব্যাবসা ছিল সিনেমার শুটিং এ ক্যামেরার ও আলোর সরঞ্জাম সরবরাহ করা।

সেটা তখন জানতাম না। রমরমিয়ে দূরদর্শনে চলছে কুয়াশা যখন। দুর্ধর্ষ টিআরপি। সন্তোষপুর স্টেডিয়ামে গোটা ইউনিট নিয়ে খুঁটি পুঁতেছেন যিশুদা। বাইপাসের ধারে মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারির ঠিক উল্টো দিকে এখন যেটি কিশোরভারতী স্টেডিয়াম, তখন তাহাকে বলা হতো সন্তোষপুর স্টেডিয়াম। নামে স্টেডিয়াম, আসলে খাটাল। খাঁ খাঁ ঘেরা মাঠ। একটি ঘাসও অবশিষ্ট রাখেনি গরুতে ছাগলে। মাঠের একটা গেট আছে বটে, কিন্ত সেটা আপনিই খোলে আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। বাইপাস তখনও বৈভবের বেথলেহেম হয়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে নতুন নগরী। স্থানীয় ছেলেরাই ওই খাটালে বল পেটায়। আবার মাঝে মধ্যে বাঁশ কাপড় খাটিয়ে, মাইকে ফু দিয়ে ‘ হ্যালো হ্যালো টেস্টিং টেস্টিং…করতে করতে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে বড় ও মাঝারি মাপের কয়েকটা ফুটবল প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয়। শীতে ক্রিকেট। মূলত জেলা স্তরের খেলাগুলিই হতো ওখানে। সন্তোষপুর, অজয়নগর, মুকুন্দপুর তখন গ্রাম। শহুরে সালংকারা হয়ে ওঠেনি তখনও।

ওই ধ্যাদধ্যাড়া গোবিন্দপুরের খাটালের মতো মাঠকে মূলধন করেই বাংলা টেলি ও টলি ইন্ডাস্ট্রিকে নতুন দিগন্তের দিশা দিলেন এখনকার আকাশ আট চ্যানেলের প্রয়াত প্রাণপুরুষ প্রযোজক অশোক সুরানা। গোটা সন্তোষপুর স্টেডিয়ামটাকে স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে তৈরি করে ফেললেন আস্ত অস্থায়ী স্টুডিও। একজন অবাঙালি বাংলা বিনোদন জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে সেই প্রথম গোটা ইন্ডাস্ট্রিকে টালিগঞ্জের বৃত্তের বাইরে নিয়ে এলেন। অশোক সুরানার তখনকার আকাশ বাংলার যাবতীয় সিরিয়াল ও টেলিফিল্মের শুটিং ওখানেই হতো। একটা স্টুডিওর যাবতীয় সুযোগ সুবিধা মজুত রেখেছিলেন অশোকজি। অন্য প্রযোজকদেরও শুটিং এর জন্য ভাড়া দিতেন। অশোক সুরানার উদ্ভাবনী উপ-কাহিনি পরবর্তীতে বলব। এখন ফিরে আসি যিশুদায়।

সন্তোষপুর তখন যিশুদারও ঘরবাড়ি। তবে টেলিফিল্মের জন্য টালিগঞ্জেও টহল দিতে হত। রোজকার মতো সেদিনও টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় টক্কর দিতে গেছি। ইন্দ্রপুরী হয়ে এনটিওয়ান এ ঢুঁ মারব। শেষে টেকনিশিয়ান। যিশুদাই বলেছিলেন চলে আসতে। একটা টেলিফিল্মের শুটিং করবেন। টেলিফিল্মের নামটা এখন আর মনে নেই। অভিনয় করেছিলেন শ্রীলেখা মিত্র, কুণাল মিত্র, পীযূষ গাঙ্গুলিরা। এক নম্বর ফ্লোরে শুটিং চলছে। পা টিপে আলো আধারির মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম। একটা শট শেষ হল। ক্যামেরা জায়গা বদল করবে। আমিও অবস্থান বদল করে যিশুদার দিকে এগবো, দু পা গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখি পরিচালক যিশু দাশগুপ্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে পাশে দাঁড় করানো লাইট সহ একটি ক্যামেরা স্ট্যান্ড ঘাড়ে তুলে হাঁটতে শুরু করেছেন। আমাকে দেখে চোখের ইশারায় অনুসরণ করতে বললেন। জাস্ট একটা কুলির মতো সামান্য ঝুঁকে দশ মনি ক্যামেরা স্ট্যান্ডটাকে পিঠ আর ডান কাঁধে চাপিয়ে ফ্লোরের এ মাথা থেকে ও মাথায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন। রেখেই লুপ বোর্ডে প্লাগ গুঁজে আলো জ্বেলে পজিশন ফিক্স করতে লেগে গেলেন। দরদর করে ঘামছেন। সেই অবস্থাতেই ছুটে গিয়ে আরও একটা স্ট্যান্ড ঘাড়ে বয়ে নিয়ে এসে আর এক কোণে রেখে আলো সেট করতে শুরু করলেন। আমি পেছন পেছন ঘুর ঘুর করছি। ভাবছি, কি কিপটে রে বাবা! নিজের প্রোডাকশন বলে খরচ বাঁচানোর জন্য নিজেই ঘাড়ে করে ক্যামেরা বইছে!

চা দিয়েছে তোকে? ঘামে ভেজা দাড়ি ভর্তি ভূতের মতো মুখ ঘুরিয়ে বললেন যিশুদা। ভাত-ডাল খেয়ে যাবি। যিশুদা কখনও লাঞ্চ, ডিনার এসব বলতেন না। বলতেন ডাল-ভাত, রুটি-তরকারি এইসব। তার কারণ আছে। বলছি।

আমি বললাম, এই তো সবে এলাম। ও আমি ঠিক নিয়ে নেবো। কথার মাঝে একটা প্রকান্ড পেডেস্ট্রাল ফ্যান ঘাড়ে তুলে মনিটর যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে গিয়ে সন্তর্পনে রাখলেন। কাঁধের তোয়ালে দিয়ে নিজের মুখের ঘাম মোছার বদলে ফ্যানের স্ট্যান্ডে লেগে যাওয়া ঘাম মুছতে লাগলেন যত্ন করে। বোর্ডে প্লাগ লাগিয়ে সুইচ অন করে বললেন, ওই প্লাস্টিকের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বোস। ঘেমে গেছিস!

দশাসই চেহারার যিশুদা তখন রীতিমতো হাঁফাচ্ছেন। আর কুলকুল করে ঘামছেন। ইউনিটের অন্যরাও ছুটোছুটি করে লোকেশন প্রস্তুত করছেন। শ্রীলেখা, কুণালদা ফ্লোরের আর এক দিকে পাখার সামনে বসে এক মনে পরবর্তী শটের স্ক্রিপ্ট পড়ছেন। আমি দুটো চেয়ার টেনে যিশুদার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আগে তুমি বসো। ঘেমে চান করে গেছ। প্রোডাকশনের লোক থাকতে তুমি কেন ঘাড়ে করে স্ট্যান্ড বইছো?

অভ্যাস… বুঝলি অভ্যাস… এই ফ্লোরে মৃণালদা (সেন) শুটিং করছেন। ক্যামেরায় কে কে মহাজন। আমি ইকিউপমেন্ট সাপ্লায়ার। ঘাড়ে করে লাইটের স্ট্যান্ড বইতাম। অবসর পেলেই কে কে স্যারের লাইট করা দেখতাম। আমি আজকে যা হয়েছি তা দুজন মানুষের জন্য। এক সেই সময়ে ভারতের অন্যতম সেরা সিনেমাটোগ্রাফার কে কে মহাজন আর দুই সেরা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের জন্য।

সমরেশ মজুমদার? কিভাবে?

তেরো পার্বন শুরু হয়েছে। যোছনদা (দস্তিদার) ডিরেক্টর। তখন সিরিয়াল বস্তুটা লোকে ঠিক জানত না, খায় না মাথায় দেয়। আস্তে আস্তে বোধগম্য হচ্ছে। আমি যোছনদাকে ক্যামেরা আর লাইট সাপ্লাই করতাম। যোছনদাদের একটা বন্ধুর দল ছিল। উনি, সমরেশদা, অরিজিৎদা(গুহ), রমাদা (রমাপ্রসাদ বণিক)…. সমরেশদা তেরো পার্বনের ওয়ান লাইনার লিখতেন। রোজ সকাল থেকে লোকেশনে হাজির থাকতেন। একদিন হয়েছে কী, যাদবপুরের কাছে যে বাড়িটায় শুটিং হতো, সেখানে গিয়ে দেখি তখনও শুটিং শুরু হয়নি। কেন? না ক্যামেরাম্যান আসেননি। শরীর খারাপ আসতে পারবেন না। যোছনদা তো মাথার চুল ছিঁড়ছেন। বহু খুঁজেও অন্য কোনও ক্যামেরাম্যান পাওয়া যাচ্ছে না। থমথমে মুখে পায়চারি করছেন সমরেশদা। আমি এগিয়ে গেলাম সমরেশদার কাছে। বললাম, আমি ক্যামেরা অপারেট করতে পারি। আমি কি একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি? যোছনদা শুনে বললেন, এটা বিয়ে বাড়ি নয়। সিরিয়াল। ক্যামেরাই গল্পটা বলবে। আমি কাঁচুমাচু মুখে বললাম, আমাকে শিনটা বুঝিয়ে দিলে আমি ঠিক শট নিতে পারব। যোছনদা তাও আমার ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। সমরেশদা বললেন, দেখি তুমি কি কর। প্রাথমিকভাবে উনিই শটটা বুঝিয়ে দিলেন। আমি লুক থ্রু করলাম। ওঁরা সব মনিটরের সামনে গিয়ে বসলেন। আমি তার আগে শটের সিকোয়েন্স বুঝে নিজেই স্ট্যান্ড সরিয়ে আলো সাজিয়ে নিলাম। আমার লাইট করা দেখে জোছনা একটু নরম হলেন। ওই-ই ক্যামেরাম্যান যিশু দাশগুপ্তর হাতেখড়ি। সমরেশদা সেদিন সাপোর্ট না করলে আমি আজ এই জায়গায় আসতেই পারতাম না। আর কে কে মহাজন। অত বড় সিনেমাটোগ্রাফার আর এদেশে জন্মাবে না। আলোর বিজ্ঞান আমি ওঁর কাছ থেকেই শিখেছি। আমার আগ্রহ দেখে উনি আমাকে লাইট অ্যাডজাস্ট করতে দিতেন। তাই ইন্দ্রপুরীর এই ফ্লোরে কাজ থাকলে সেইসব পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। নিজেকে থাপড়ে একবার ঝালিয়ে নিই।

লাঞ্চ ব্রেক দিলেন। বললেন, চ… একসঙ্গে দুটো ডাল ভাত খাই।

ইন্দ্রপুরীর দ্বিতীয় গেট পেরোলেই বট গাছের গুঁড়ি ঘিরে লাল রঙের বেদি দেওয়া যে চাতালটা আছে, ফ্লোর থেকে বেরিয়ে যিশুদা আমাকে নিয়ে সেখানেই বসলেন। কোনও পরিচালক সুলভ অহংকার নেই। না চিনলে অন্য কোনও টেকনিশিয়ানের মধ্যে যিশুদাকে আলাদা করা মুশকিল।

যিশুদার জন্য ডিম-ভাত। বেদির ওপর বাবু হয়ে বসে ভাতে তরকারি মাখতে মাখতে একটা ডিম হাতে তুলে নিয়ে বললেন, জানিস প্রিয়, একদিন ছিল মা সুতো দিয়ে একটা সিদ্ধ ডিমকে ছয় টুকরো করে দিত। আমরা ভাই বোনেরা ওই একটা টুকরো পাতের ওপর রেখে সেটা দেখতে দেখতে নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে আলু সিদ্ধ ভাত খেতাম। আর আজ মাথার ওপর এসি না চালিয়ে শুলে ঘুম হয় না।

থিয়েটার করতাম। যিশুদা মঞ্চে আমার অভিনয় দেখেছিলেন। কুয়াশা যখন ধারাবাহিকে একটা চরিত্রের জন্য আমাকে নির্বাচনও করেছিলেন। একদিন সন্তোষপুর স্টেডিয়াম গেছি। যেতাম ২০৬ নম্বর রুটের বাস ধরে। শিয়ালদা থেকে বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়তাম। স্টেডিয়ামের গেটের কাছেই ছিল ২০৬ এর গুমটি। ঘুম ঘুম চোখে ফ্লোরে ঢুকছি। মনিটারে যিশুদা। লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে। আমাকে দেখেই যিশুদা বলে উঠলেন, এই যে ঘন্টু এসে গেছে। মেক আপ। ওকে কস্টিউম পরিয়ে টাচ দিয়ে দে তো। তোর কোনও ডায়লগ নেই বুঝলি। বিকলাঙ্গ। আমি সেই সময় চোরাবালি নামে একটি নাটকে বিকলাঙ্গ যুবকের চরিত্রে অভিনয় করি। ওই ধরনের চরিত্র। আমার তখন ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। আমি এক দৌড়ে ফ্লোর ছেড়ে সোজা মাঠে। নিস্তার নেই। দেখি হাঁটুর ওপর লুঙ্গি গুটিয়ে দৌড়ে আসছে যিশুদা!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *