micro-story-bharat-mata

ভারতমাতা
অভীক মুখোপাধ্যায়


অনন্যার বুক ধুকপুক করছে। শ্রাবণী ম্যাম ওকে স্টাফরুমে ডেকেছেন। স্কুল শেষ হলে। আজ পঁচিশে জানুয়ারি। কাল প্রজাতন্ত্র দিবস। স্কুলে বড় মাপের অনুষ্ঠান হবে। ফ্ল্যাগ হয়েস্টিং, প্রভাতফেরি, সারাদিন নাটক, আবৃত্তি। স্কুলেই খাওয়াদাওয়া।

অনন্যা নাটকে অভিনয় করবে। কিরণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নাটক ‘ভারতমাতা’। হেডস্যার নিজে নাটক চয়েজ করেছেন। রিহার্স করিয়েছেন। এসব দায়িত্ব শ্রাবণী ম্যাম পালন করেন। এবারে শ্রাবণী ম্যাম ম্যাটারনিটি লিভে ছিলেন। বেবি গার্ল হয়েছে। স্টুডেন্টরা নাম অবধি জেনে গেছে। ভালোনাম – আদিতা। ডাকনাম ঝুড়ি। ‘কী মিষ্টি, না!’ অনন্যা ভাবে মনে মনে।

ও ভারতমাতার রোল পোট্রে করবে। কোনো ডায়লগ নেই। কিন্তু স্থির হয়ে থাকা, চোখের এক্সপ্রেশন আর টানা চিন-আপ স্ট্যান্ডিং পজিশন চাট্টিখানি কথা নয়। হেডস্যার বলেছেন, “এবারে সামনে মাধ্যমিক তো, তুই এই রোলটাই কর।”

শ্রাবণী ম্যামকে অনন্যার খুব ভালো লাগে। টানাটানা চোখ, লম্বা, ফরসা ধপধপ করছে। কেমন বয়কাট চুল। জিন্স, টপ প’রে স্কুলে আসেন। এই নিয়ে গোড়ার দিকে খুব ঝামেলা হয়েছিল। স্কুল কমিটির অবজেকশন ছিল। ম্যাম মাথা নোয়ায়নি। মিডিয়া ফিডিয়া এসে গিয়েছিল।

ম্যাম হিস্ট্রি পড়ান। ফটাফট ইংরাজি বলেন। গ্রামের দিকের স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর এগুলো খুব ইমপ্যাক্ট ফেলে। ওঁর পড়াবার ধরণটাই আলাদা। হয়ত সুলতানা রাজিয়ার কথা বলছেন, মাঝে টুক করে বলে দিলেন যে, রাজিয়ার পর ভারত শাসনকারী দ্বিতীয় নারী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। মেয়েদের সমস্যা, নারী-স্বাধীনতা নিয়ে সবসময়ে সোচ্চার উনি। বলেন যে, যেটা জন্মসূত্রে পাওয়া, তা ভালো হলে অহঙ্কার বা খারাপ হলে দুঃখ করার মতো কিচ্ছু নেই।

অনন্যা স্বপ্ন দেখে – বড় হয়ে শ্রাবণী ম্যামের মতো টিচার হবে। সাবজেক্ট আলাদা হতেই পারে। কিন্তু আদর্শ হবেন শ্রাবণী ম্যাম।

সচরাচর গ্রামের স্কুলগুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষকই আসেন বাইরে থেকে। এসএসসি রিক্রুটমেন্ট চালু হওয়ার পর থেকেই এই ট্রেন্ড। তাই শেষ পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ার পর কাউকেই তেমন দেখা যায় না। স্টাফরুমে ঢুকে অনন্যা দেখল, শ্রাবণী ম্যাম আর বহ্নিশিখাদি বসে আছেন। বহ্নিশিখাদি নিজের ফোন থেকে কোনও ভিডিও চালিয়ে ম্যামকে দেখাচ্ছে। বহ্নিশিখা ক্লাস টুয়েলভের আর্টস্। ও-ও নাটকে আছে। ডাকাতদলের সাপোর্টিং রোলে।

ম্যাম ভিডিয়ো থেকে মাথা না তুলেই বললেন, “হোয়াট রাবিশ! এটা কোনো চয়েজ হল?”

স্টাফরুমে ঢোকার জন্য নক করা যায় না। বলতে হয়, “আসব?” অনন্যা তা-ই করল।

শ্রাবণী ম্যাম বললেন, “এসো।”

“ম্যাম, আমাকে ডেকেছিলেন?”

“হমমম্… বলছি যে, কালকের নাটকে ভারতমাতার রোলটা তুমি করবে না! ঠিক আছে?”

“করব না? কিন্তু হেডস্যার তো নিজে আমা…”

“সব শুনেছি। আমি ছিলাম না বলেই উনি এসব দেখভাল করেছেন। আর তাই পছন্দটাও ওঁর ইচ্ছেমতো হয়েছে। কিন্তু আমি বলছি, তুমি রোলটা প্লে করবে না।”

“কিন্তু…”

“কোনো কিন্তু নেই। রিহার্সালের ভিডিয়ো এই দেখলাম। দিস ইজ মাই ডিসিশন! অ্যান্ড দিস ইজ ফাইনাল!”

ভয় পাওয়া হরিণীর মতো কাঁপে অনন্যার চোখের তারা। ও বলে, “কিন্তু আমার ভুলটা কোথায়?”

হাতে ধরা পেনটার মুখে ঢাকনাটা লাগিয়ে অনন্যার চোখে চোখ রাখলেন শ্রাবণী ম্যাম। শীতল কন্ঠে বললেন, “ছবিতে কখনো দেখেছ ভারতমাতা বেঁটে, মোটা, কালো? রোলের সিলেকশনের জন্য একটা মিনিমাম এইস্থিটিক সেন্স যে কেন থাকা দরকার – সেটা এখন বুঝলাম। রাবিশ!”

বহ্নিশিখা অনন্যার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে না পেরে মাথা নামিয়ে নিল। ভারতমাতা কাঁদছেন যে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *