micro-story-chhitmahol

ছিটমহল
অনিন্দিতা সান্যাল


আমরা যে পাড়াটায় থাকতাম সেটি মুসলমান পাড়া। কাজিপাড়া। স্বাধীনতার আগেই সম্পত্তি আদান প্রদান করে ওপার বাংলার হিন্দুরা এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে। যদিও রাস্তার নাম একই রয়ে গেছে। পাড়ার প্রতিটা বাড়ি যেন গোটা একটা উপন্যাস। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, রোমাঞ্চ, একতা, অনৈক্য সবকিছু ভরপুর। বাবার ছোটবেলার বন্ধু মাধুকাকুদের বাড়ির লোকেদের জীবন সত্যিকারের গল্প। মাধুকাকুর বাবা কাস্টমসে চাকরি করতেন। সব কটা ছেলেমেয়ে ভালো লেখাপড়া করে কৃতী। বাঁটুলকাকু বাদে। বাঁটুলকাকু স্পেশাল বাচ্চা। বাবা কাকাদের সাথে খেলতো। তারপর সন্ধ্যে হলে বাবা কাকা বাড়ি ফিরে পড়তে বসতো। বাঁটুলকাকু হন্তদন্ত হয়ে নটা নাগাদ এসে বলতো তোরা কাল খেলতে যাবি তো? তারপর বাবা চাকরি পেল, বিয়ে করলো। বাঁটুলকাকু বছরের পয়লা তারিখে আসতো। বাবা বাঁটুলকাকুকে ডায়েরী, ক্যালেন্ডার দিত। বাঁটুলকাকু হেসে বলতো এই যে আমাকে দিলি, তোর বউ তোকে বকবে না তো!

মাধুকাকুর আরেক দাদা অরুণকাকু। এমনিতে ভালো। উদার হাতে খরচ করেন। ঠিক হয়েছে ক্লাবের আড্ডার চায়ের খরচা উনি দেবেন। সেইমত একশ টাকা দিয়েছেন। বারো টাকা ফেরত এসেছে। অরুণকাকু দু টাকা ফেরত নিয়ে বাকি দশ টাকা আর নিত না। কারণ খুচরো পয়সা জলে ধোওয়া যায়, নোট যায় না। শুচিবাই এমন স্তরে পৌছে গেছে যেখানে দাঁড়িয়ে অরুণকাকু মাটির ভয় টাকা হাতে নিত না। কাঞ্চনকাকু ওই বাড়ির ছোটছেলে। ব্যাঙ্কে চাকরী করতো, সদ্য রিটায়ার করেছে। চোষা আমের মত চেহারায় আবলুশ কাঠের মত গায়ের রং, টেরিকাটা চুল। কিন্তু পাত্রী চাই হেমা মালিনীর মত। এখনো ওনার বিয়ের দেখাশোনা চলছে।

এরপর আসি ওই বাড়ির আসল মানুষটার গল্পে। মাধুকাকুর বড়দা বিশ্বনাথ জ্যেঠু। একেবারে খাঁটি খদ্দরের ছিট। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সব কটা লাল বই পড়ে ফেলেছিলেন। মায়ের গয়না চুরি করে পার্টি ফান্ডে দিয়ে এসেছিলেন। নকশাল জামানায় পুলিশের হাতে রাম পিটুনী খেয়ে মাথা সটকে গেছিলো। ঠিক করলেন সর্বহারা হয়েই জীব কাটাবেন। এইভেবে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে রিক্সা কিনলেন, নিজে চালাতে শুরু করলেন। বড়বাড়ির ছেলের রিক্সায় পাড়ার কেউ উঠতো না। বৌ ছেড়ে চলে গেল। উনিও বেগতিক বুঝে রিক্সা বেঁচে দিয়ে আগের মতন অফিসবাবু হয়ে গেলেন। সমাজের অসহযোগিতায় সে অর্থে সর্বহারা হয়ে ওঠা হলো না। এই পাঁচ ভাইয়ের পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হবে। নতুন প্রজন্ম তাই চায়। বাড়িটার খোলনলচে বদলে যাবে। এই মানুষগুলোর নামের সাথে চন্দ্রবিন্দুও জুড়ে যাবে। শুধু অমলিন রয়ে যাবে গল্পগুলো। লোকমুখে বেঁচে থাকবে একটা খুব পুরনো পাড়া……আমাদের পাড়া

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *