micro-story-nakshatra

নক্ষত্র
কাকলি দেবনাথ


উজ্জ্বল, মেঘহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রোহিণী। ঠাকুমার দেওয়া তার এই নাম। ঠাকুমা বলেছিল আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম রোহিণী। সেই বালিকাবেলা থেকেই তার এই আকাশ দেখার শখ। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে নিজেকে খুঁজে বেড়াত। প্রতিমুহূর্তে পরখ করত নিজের উজ্জ্বলতা। অন্য তারাদের থেকে তাকে নিষ্প্রভ লাগছে না তো!

ঠাকুমা বলেছিল, দক্ষ রাজের সাতাশটি মেয়ে ছিল। অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আদ্রা, বিশাখা, স্বাতী …। এই সাতাশ কন্যা তাদের উজ্জ্বলতায় শুধু যে বীর চন্দ্রের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাই নয়। মহা বিশ্বের আরও অনেক বীরপুরুষ নির্দিষ্ট ব্যবধানে তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। কিশোরীবেলায় ঠাকুমার মুখে শোনা এই কল্পকাহিনী দিয়েই শুরু হয়েছিল রোহিণীর নক্ষত্র হওয়ার যাত্রা। একটু বড় হতেই বুঝতে পেরেছিল। সে একা নয়। তার আশেপাশে সবাই এই নক্ষত্র হওয়ার দৌড়ে সামিল। স্কুলের খাতায় কে কটা নক্ষত্র পেল তা নিয়ে চলত রেষারেষি। যে যত বেশি স্টার পেল তার হাসি তত চওড়া। মাধ্যমিকে স্টার মার্কসের জন্য বাবা-মায়ের সে কী তীব্র আকাঙ্খা! শুধু আকাঙ্খা বলাটা বোধহয় ভুল হল। বলা ভালো- নাওয়া, খাওয়া, ঘুম ভুলে রোহিণীকে প্রস্তুত করা। এ যেন শুধু মাত্র রোহিণীর পরীক্ষা নয়। বাবা মায়েরও অগ্নীপরীক্ষা।

স্কুল-কলেজের গন্ডী পেরিয়ে রোহিণী এসে পড়ল আরও বৃহৎ জগতে। এ জগতে সবাই উর্ধমুখী। সবাই ছুটছে। একে অপরকে ঠেলে ছুটে চলেছে। কোথাও কোনও সামান্য বাধা মেনে নিচ্ছে না। প্রয়োজনে এক বন্ধু অন্য বন্ধুর পিঠে বসিয়ে দিচ্ছে ছুরি। রাজনীতি থেকে শিক্ষাজগৎ, ব্যবসা থেকে চিকিৎসা জগৎ সবজায়গায় চলছে নক্ষত্র হওয়ার লড়াই। রুপোলি পর্দার নক্ষত্রদের মত হতে চায় সবাই। চকচকে, ঝকঝকে উজ্জ্বল জীবন। প্রত্যেকের মনের কোণে সুপ্ত ইচ্ছা – সে নিজে থাকবে অন্যের ধরা ছোঁয়ার বাইরে একদম শীর্ষে, নক্ষত্র হয়ে। ঘাড় তুলে শ্রদ্ধা মিশ্রিত চোখে সবাই দেখবে তাকে। তার চারপাশে ঘুরে বেড়াবে স্তাবকের দল। সে হাসলে অন্যেরা হাসবে।

ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় তার পাশে বসত রিক্তা। রোহিণীর সঙ্গে খুব ভাব ছিল। কিন্তু অঙ্ক পরীক্ষায় রিক্তা পেল তিনটি স্টার। রোহিণী মাত্র একটা। রোহিণীর মনে আছে রেগে গিয়ে সে রিক্তার চুলে চুইনগাম লাগিয়ে দিয়েছিল। শুধু কি ছোটবেলায়? বড় হয়েও কত বার হয়েছে এমন। যখনই দেখেছে কেউ তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তখনই রোহিণী তার বিষাক্ত দাঁত নখ বার করেছে। এত করেও শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে পারেনি সে। যত উপরে উঠেছে তার উপরেও কেউ রয়েছে। এই ইঁদুর দৌড়ের প্রাপ্তি হল হাজার রকমের রোগের বোঝা, ওষুধ আর প্রেসক্রিপসন।

বড্ড ক্লান্ত লাগে এখন। রাতে ঘুম হয় না। প্রতিমুহূর্তে হেরে যাওয়ার ভয় কুঁরে কুঁরে খায়। ডাক্তার বলেছেন, রোহিণীকে কোথাও ঘুরে আসতে। তাতে তার মানসিক চাপ কমবে। রোহিণী মনে মনে হাসে। শরীরটাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়ত সম্ভব। কিন্তু মন?… সেখানে তো প্রতিনিয়ত চলেছে প্রতিযোগিতার লড়াই। সেটা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবে সে।

বহুদিন পর গ্রামের বাড়িতে এসেছে রোহিণী। খোলা আকাশের নীচে বসেছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পাশে ইজিচেয়ারে বসে আছে ঠাকুমা। রোহিণী আলতো করে মাথা রাখল ঠাকুমার কোলে। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, “আমার আর নক্ষত্র হওয়া হল না ঠাম্মি। বড় কঠিন এই পথ। বড্ড পিচ্ছল। মুহূর্তের ভুলে ঝরে পড়ার ভয়।“

রোহিণীর মাথায় হাত বুলিয়ে ঠাম্মি হাসে। বলে, ” নক্ষত্র হওয়া তো পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ। শুধু ইচ্ছে থাকা চাই।“

ঠাম্মির কথায় রোহিণীর কপাল কুঁচকে ওঠে। কী বলতে চাইছে ঠাম্মি! ও আচ্ছা, ঠাম্মি হয়ত বলতে চাইছে, মরে গেলেই তো মানুষ আকাশের তারা হয়ে যায়। সেটা তো সত্যিই খুব সহজ কাজ। হ্যাঁ, আত্মহত্যার মত সহজ আর কী আছে! রোহিণী সেই পথই বেছে নেবে।

ঠাকুমা রোহিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ”নক্ষত্র কী করে বলত?”

রোহিণী হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “কী করে?”

“নক্ষত্র এই বিশ্বকে আলো আর উত্তাপ দুটোই দেয়। নিজের যতটুকু আছে সবটা বিলিয়ে দেয়। বিনিময়ে কিচ্ছু চায় না। শুধুই দিয়ে যায়। তাই তো আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। “

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *