micro-story-nona-bali

নোনা বালি
বিতস্তা ঘোষাল


দরজা খোলার আর পায়ের মৃদু শব্দে পারমিতা বুঝতে পারল ছন্দা এল। মাঝের ঘরে বিছানায় বসে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে আলতো স্বরে সে বলল – ‘কিরে, আজ এত তাড়াতাড়ি? বারোটা এখন ও তো বাজেনি?’ উত্তর না দিয়ে ছন্দা মাঝের ঘরে টেবিলে পড়ে থাকা হটপট থেকে একটা রুটি হাতে নিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। আর তখনি শান্তু কাগজ ওলটাতে ওলটাতে বলে উঠল, ‘ছন্দা এলি? বাঁচালি। কত দিন যে চা খাইনি!’ পারমিতা একটু বিরক্ত, ‘এই চা টা শেষ করো আগে। এখনো মুখেই তোলোনি’। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্নানে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

ছন্দা রুটি নিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর তা আবার হটপটে রেখে রান্নাঘরে ঢুকল। বৌদি স্নান করে এসে পুজো করে খেয়ে অফিস বেরোবে, তার আগেই টেবিলে থালা-বাটি রেখে ঠাকুর ঘরটা মুছে দিতে হবে। থালা নিয়ে বেসিনের সামনে গেল বটে কিন্তু কল খুলে দাঁড়িয়ে আনমনে জল ঘাঁটতে লাগল- ভালো লাগছে না। কদিন থেকেই শরীরটা ঠিক জুতের নেই। সারা শরীরে বেশ ব্যথা, জ্বর জ্বর একটা ভাব। এই মাসে এর মধ্যেই দশদিন কামাই হয়ে গেছে। বৌদি মুখে কিছু বলে না, কিন্তু নিজের-ই খারাপ লাগে, নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল ছন্দা। তখনি শান্তু আবার বলল, ‘ছন্দা, চা চা করে গলা শুকিয়ে গেল যে…’

ছন্দা কল বন্ধ করে মৃদু স্বরে উত্তর দিল, ‘ছন্দা মরে গেছে,’ বলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। নীরবে গ্যাসে জল বসিয়ে সে বাসন মাজতে লাগল।

পারমিতা স্নান সেরে ঠাকুরঘরে ঢুকে চুপচাপ ন্যাকড়া ভিজিয়ে সিংহাসনের সামনেটা মুছে নিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে প্লেটে বাতাসা দিয়ে বলল, ‘জগতের ভাল করো মা, মানুষের ভাল করো, পৃথিবীর ভালো করো’।

দুই বাচ্চার মা, মধ্য তিরিশের ছোটোখাটো চেহারার ছন্দার খুব বিরক্ত লাগে বৌদির এই প্রার্থনায়, রাগ ও হয়। বৌদি কি বোকা নাকী ন্যাকা! ওই পাথরের ঠাকুর জগতের কি ভাল করবে? বৌদির নিজের ই বা কি ভাল ঘটেছে! দিন-রাত অশান্তি লেগেই থাকে। তাও ঘটা করে বলা- , মানুষের কোন ভালটা হচ্ছে? সেও আগে নিয়ম করে দুবেলা ঠাকুর পুজো করত, পালা পার্বনে উপোসও। সবাই বলে উপোস করলে নাকী সংসারের মঙ্গল হয়। তা বরটা যেদিন ট্রেনে কাটা পড়ল তাদের কি ভাল হয়েছিল? খারাপ তো ছিল না লোকটা! দোষের মধ্যে কাজ কর্ম কিছুই করত না। তাকেই গতর খাটিয়ে সংসার চালাতে হতো। কিন্তু বস্তীর অন্যান্য বৌদের মত তাকে কখনো বরের হাতে মার খেতে হয়নি, এমনকি কোনোদিন চেঁচিয়ে বকেওনি তাকে। উল্টে সেই তাকে গাল দিত বিশ্ব কুড়ে বলে। আর তাই শুনে সে বলত, আমার ঝিঙ্কু সোনা চুপ করো, চেঁচালে তোমায় বাজে দেখায় সোনা…’।

প্রথমে ছন্দা বুঝতে পারত না ঝিঙ্কু কাকে বলে তার বর। তবে কি অন্য কোনো মেয়ের সাথে ভাব হয়েছে তার, আর নামেই ডাকছে তাকে? শুনে তার কি হাসি!

‘আরে বাবা তোমাকেই তো বলি, ঝিঙ্কু মানে জান না? সুন্দর গো সুন্দর’।

ছন্দা পড়াশোনায় ক্লাস ফাইভ, নিয়ম করে খবরের কাগজ পড়ে। সে অবাক হয়ে বলে, এমন শব্দ জীবনেও শুনিনি, পড়িও নি।

সে বলে, ‘তোমার পড়ার বাইরেও শব্দ আছে আছে বাবুসোনা’।

তবু ছন্দার বুকের চিনচিনানিটা গেল না। পরদিন কাজে এসে বৌদির মেয়ে ঋ কে জিজ্ঞেস করে জেনেছে ‘এটার কোনো মানে নেই। আদর করে যেমন সোনা মনা পুচু বলে ডাকে লোকে তেমনি কেউ কেউ মজা করে এই শব্দটা ব্যবহার করে।‘

শুনে ছন্দা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। বরটা তাকে ভালোই বাসে। সে লোকটা কিনা ভোরবেলা ওপাড়ে যেতে গিয়ে…। ভাবতে ভাবতেই চা বানিয়ে দাদাকে দিল সে।

মাঝের ঘরে খাবার বাড়তে বাড়তে পারমিতা বলল-‘ছন্দা একটা অমলেট করে দে না সোনা’।

ছন্দা কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে ভেজে দিয়ে গেল।

পারমিতা মুখে দিয়েই বলে উঠল, ‘নুন দিতে আবার ভুলে গেছিস? কি হয়েছে বল তো তোর! শরীর খারাপ নাকী? ক’দিন ধরেই দেখছি কি যেন ভেবে চলেছিস’।

ছন্দার চোখের সামনে তখন পাশের ঘরে সদ্য হওয়া বাচ্চাটার মুখ ভেসে উঠল। সে তার জানলার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল একটা হাত সাদা বালির মত কিছু বাচ্চাটার ঠোট ফাঁক করে গলায় ঢেলে দিচ্ছে। পুচকেটা তখনো চোখ খোলেনি। মেঝের উপর শোয়ানো অপুষ্ট সরু দুটো খুদে হাত একবার নাড়িয়ে ওয়াক তুলেই ঝিমিয়ে গেল।

বাচ্চাটার মা রাস্তায় শুয়ে গড়াগড়ি দিতে দিতে তারস্বরে কাঁদছিল, ‘মেরে ফেললগো …এবারেরটাও গেল…’। বস্তীর লোক জড়ো হয়ে কি যেন বলছিল। ছন্দার গা বমি করছিল। সে অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর শুনলো এই নিয়ে তিনবার মেয়ে, তাই…।

তারপর থেকেই ছন্দার শরীর ভাল নেই। দিন রাত চোখ জ্বালা করেই যাচ্ছে…।

সে এখন অবাক হয়ে হাতের সামনে রাখা কৌটো টার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল … সেখানে চিকচিক করছে সাদা বালির মত নুন।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *