onubad-khuley-dao

খুলে দাও
মূল রচনা – সাদাত হসন মন্টো
অনুবাদ – চুমকি ভট্টাচার্য
চিত্র সৌজন্যে – উইকিপিডিয়া

লেখক পরিচিতি — ( ১৯১২-১৯৫৫) নিজের মৃত্যুর এক বছর আগে যিনি লিখতে পারেন, “এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মন্টো। আর তার বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প লেখার সমস্ত কৌশল।” – তিনি তো চিরকালের কিসসাওয়ালা। দেশভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও যিনি শুনিয়ে চলেছেন হাড়হিম করা গল্প। যাঁর লেখনীর নৈপুণ্য সমাজের নানা স্তরের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের চাবিকাঠি, তিনি আর কেউ নন আঁধারে একফালি আলোকরেখা সাদাত হসন মন্টো।

অমৃতসর থেকে স্পেশাল ট্রেন দুপুর দুটোয় ছেড়ে আট ঘণ্টা পর মুঘলপুরা পৌঁছাল। পথে বেশ কিছু যাত্রী খুন হল। অনেকে আহত হল। আর দু-চারজন এদিক-ওদিক কোথায় যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল কে জানে!

সকাল দশটা। শরণার্থী শিবিরের ঠান্ডা মেঝেতে পড়ে থাকা সিরাজুদ্দীন যখন চোখ মেলে চারপাশের পুরুষ, নারী আর শিশুদের বিক্ষুব্ধ সমুদ্র দেখল তখন তার ভাবনা-চিন্তা করার অবশিষ্ট ক্ষমতাও লোপ পেল। সে যেন আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। সিরাজুদ্দীন অনেকক্ষণ ঘোলাটে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। একে তো ক্যাম্পের চারদিকে অনবরত শোরগোল চলছে কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছুই যেন বৃদ্ধ সিরাজুদ্দীনের কানে ঢুকছে না। সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কেউ তাকে দেখলে মনে করবে যে সে কোনও গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু তা তো নয়। তার কোনো অনুভূতি, বিচারবুদ্ধি যেন আর কাজ করছে না। তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বই যেন শূন্যে ঝুলে রয়েছে।

ঘোলাটে আকাশের দিকে লক্ষ্যহীন, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই যেন সূর্যের সঙ্গে তার দৃষ্টির সংঘাত ঘটলো। তীব্র আলোর ঝলকানি তার সত্ত্বার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়তেই সে জেগে উঠল। একের পরে এক ছবি যেন তার মনের আয়নায় ভেসে উঠছে- লুট, আগুন ধরানো, পড়ি-মরি করে দৌড়, স্টেশন, গুলিবৃষ্টি, রাত, সাকীনা…

সিরাজুদ্দীন তখনই উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মত তার চারপাশে ক্রমশ ফুঁসলে ওঠা জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে পথ করে এগোতে থাকে।

‘সাকীনা! সাকীনা!’ বলে চিৎকার করতে করতে পুরো তিন ঘন্টা সে শিবিরের চারদিকে তন্নতন্ন করে খোঁজে। কিন্তু, তার একমাত্র যুবতী কন্যার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। চারদিকে যেন কান-ফাটা আওয়াজ। কেউ নিজের বাচ্চাকে খুঁজছে, কেউ মা, বউ, অথবা মেয়ের সন্ধানে বেরিয়েছে। শেষমেশ ক্লান্ত সিরাজুদ্দীন এক জায়গায় বসে পড়ে। সে স্মৃতি খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করে কোথায় আর কখন তার সঙ্গে সাকীনার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। কিন্তু যতবারই মনে করার চেষ্টা করে, ততবারই তার মন সাকীনার মায়ের ক্ষতবিক্ষত লাশের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। তার সমস্ত নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছিল! সিরাজুদ্দীন আর কিছুই ভাবতে পারে না।

সাকীনার মা মরে গেছে। সিরাজুদ্দীনের সামনেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। কিন্তু সাকীনা কোথায় গেল, যার কথা ভেবে তার মা মরতে-মরতে বলেছিল,

-আমার কথা ভেবো না। সাকীনাকে নিয়ে এখনই এখান থেকে পালিয়ে যাও।

সাকীনা তো তার সঙ্গেই ছিল। দুজনে খালি পায়েই পালাচ্ছিল। সাকীনার দোপাট্টা খুলে পড়েছিল। দোপাট্টা তোলার জন্য সিরাজুদ্দীন থামতে চাইলে সাকীনা চিৎকার করে বলেছিল,

-আব্বাজি, ছেড়ে দিন!

সিরাজুদ্দীন দোপাট্টা তুলে নিয়েছিল।

এই ভাবতে ভাবতে তার নজর পড়ল কোটের খোলা পকেটের ওপর। পকেটে হাত দিতেই এক টুকরো কাপড় বেরিয়ে এল। সাকীনার সেই দোপাট্টা…

কিন্তু, সাকীনা কোথায় গেল?

সিরাজুদ্দীন তার ক্লান্ত স্মৃতি যতই হাতড়ায়, কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারে না। সে কী সাকীনাকে সঙ্গে করে স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল? সে কী তার সঙ্গেই গাড়িতে সওয়ার হয়েছিল? রাস্তায় যখন গাড়ি থেমেছিল আর দাঙ্গাবাজরা গাড়ির ভেতরে ঢুকে এল, তখন কী সে নিজে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল? তখনই কী তারা সাকীনাকে নিয়ে চলে যায়?

যার কোনও উত্তর নেই এমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন সিরাজুদ্দীনের মনকে অবশ করে দেয়। তার সহানুভূতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু চারদিকে যে জনসমুদ্র ক্রমশ আরও প্রসারিত হচ্ছে, তারা সকলেই তো সহানুভূতি চাইছে। সিরাজুদ্দীন কাঁদতে চাইল, কিন্তু তার চোখ তাতে সায় দিল না। কে জানে চোখের জল কোথায় হারিয়ে গেছে!

ছ’দিন পরে যখন তার হুঁশ কিছুটা ফিরে এসেছে তখন সে কয়েকজনের সন্ধান পেল যারা তাকে সাহায্য করার জন্য তৈরি। তারা আটজন নওজোয়ান। তাদের লরি ছিল, বন্দুক ছিল। সিরাজুদ্দীন তাদের জন্য হাজার বার প্রার্থনা করে অবশেষে সাকীনার বর্ণনা দিল,

-ফর্সা রং, খুব সুন্দরী। আমার মত নয়, ওর মায়ের মত দেখতে। বয়েস সতের হবে। বড় বড় চোখ, কালো চুল, ডানগালে মোটা একটা তিল… আমার একমাত্র মেয়ে। সন্ধান দিলে খুদা তোমাদের মঙ্গল করবেন।

স্বেচ্ছাসেবক সেই যুবকেরা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে বৃদ্ধ সিরাজুদ্দীনকে আশ্বস্ত করে বলল, যে যদি তার মেয়ে বেঁচে থাকে, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে তারা তার কাছে ফিরিয়ে আনবে।

সেই আট যুবক চেষ্টার কসুর করেনি। প্রাণ হাতে নিয়ে তারা অমৃতসর গেল। অনেক মহিলা, পুরুষ আর বাচ্চাকে উদ্ধার করে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দিল। দশ দিন পার হয়ে গেলেও তারা সাকীনার সন্ধান পেল না।

একদিন তারা যখন হারিয়ে যাওয়া মানুষদের উদ্ধার করে আনার জন্য নিজেদের লরি নিয়ে আবার অমৃতসরে যাচ্ছে, তখন ছেহরতার কাছে রাস্তায় একটা মেয়েকে পথ চলতে দেখতে পেল। লরির আওয়াজ শুনে মেয়েটি ঘাবড়ে গিয়ে ছুটতে শুরু করল। স্বেচ্ছাসেবকেরা মোটর থামিয়ে সবাই গাড়ি থেকে নেমে তার পিছু নিল। চাষের ক্ষেতে তারা মেয়েটাকে ধরে ফেলল। খুব সুন্দরী ছিল সে। তার ডান গালে একটা মোটা তিল। একটা ছেলে তাকে বলল,

-ভয় পেয়ো না… তোমার নাম সাকীনা?

মেয়েটার রং যেন আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে কোনও উত্তর দিল না। কিন্তু যখন সব ছেলেরাই তাকে ভরসা দিয়ে আশ্বস্ত করল, তখন তার মনের ভয় দূর হল। সে স্বীকার করল যে সে-ই সিরাজুদ্দীনের মেয়ে সাকীনা।

সেই আট স্বেচ্ছাসেবী যুবক নানাভাবে সাকিনার মন ভালো করার চেষ্টা করছিল। তাকে খাবার খাইয়ে, দুধে চুমুক দিইয়ে লরিতে বসিয়ে দিল। তাদের মধ্যে একটি ছেলে নিজের কোট খুলে তাকে দিয়ে দিল কারণ দোপাট্টা না থাকায় মেয়েটি খুব লজ্জা পাচ্ছিল আর বারবার দু’হাত দিয়ে নিজের বুক ঢাকার নিষ্ফল চেষ্টা করছিল।

বেশ কয়েকদিন কেটে গেল…সিরাজুদ্দীন সাকীনার কোনও খবর পেল না। বিভিন্ন শিবির আর দপ্তরে চক্কর দিয়ে তার দিন কাটে। কিন্তু কেউ তার মেয়ের সংবাদ দিতে পারে না। অনেক রাত পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক যুবকেরা যাতে তার মেয়েকে খুঁজে পায় তার জন্য সে প্রার্থনা করতে থাকে। সেই আট নওজোয়ান যারা তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে সাকীনা যদি বেঁচে থাকে তা হলে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা তাকে খুঁজে বার করবে।

একদিন সিরাজুদ্দীন শরণার্থী শিবিরে আবার সেই স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের দেখতে পেল। তারা তাদের লরিতে বসে ছিল। সিরাজুদ্দীন দৌড়াতে দৌড়াতে লরির কাছে যখন পৌঁছল, গাড়ি তখন সবে চলতে শুরু করেছে। সে জিগ্যেস করল,

-বেটা, আমার সাকীনার কোনও খবর পাওয়া গেল?

তারা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল,

-পাওয়া যাবে, পাওয়া যাবে।

লরি গতি বাড়ালো।

সিরাজুদ্দীন আরও একবার সেই যুবকদের সাফল্য কামনায় প্রার্থনা করাতে তার মনের ভার যেন একটু হালকা হল।

সেদিন সন্ধ্যায় সিরাজুদ্দীন শিবিরে যেখানে বসে থাকে, তার আশেপাশেই কোথাও যেন গোলমালের আওয়াজ টের পেল। চারটে লোক কিছু একটা জিনিস যেন বয়ে নিয়ে আসছে। সে জিগ্যেস করে জানল যে একটা মেয়েকে রেল লাইনের পাশে বেহুঁশ অবস্থায় পাওয়া গেছে। লোকেরা তাকেই উঠিয়ে নিয়ে এল। সিরাজুদ্দিনও তাদের পেছন পেছন চলতে শুরু করল। যারা মেয়েটিকে বয়ে নিয়ে আসছিল, তারা হাসপাতালের কর্মীদের হেফাজতে তাকে দিয়েই সরে পড়ল। সিরাজুদ্দীন কিছুক্ষণ শিবিরের হাসপাতালের বাইরে কাঠের থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঘরে কেউ ছিল না। শুধু একটা স্ট্রেচারের ওপর কারও দেহ পড়ে আছে। সিরাজুদ্দীন অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে স্ট্রেচারের কাছে পৌঁছোতেই হঠাৎ ঘরের আলো জ্বলে উঠল। সিরাজুদ্দীন সেই দেহটার ফ্যাকাশে মুখে জ্বলজ্বল করতে থাকা তিলটি দেখেই চিৎকার করে উঠল, -সাকীনা!

যে ডাক্তার ঘরের আলোটা জ্বালিয়েছিলেন, তিনি সিরাজুদ্দীনকে দেখে বললেন,

-কী হয়েছে?

সিরাজুদ্দীনের গলা থেকে কোনোমতে যেন স্বরটুকু বেরোল,

-জি আমি, জি আমি ওর বাপ।

ডাক্তার স্ট্রেচারে পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকালেন। নাড়ি দেখলেন। তারপরে সিরাজুদ্দীনকে বললেন,

-খিড়কি খুলে দাও।

সাকীনার মুমূর্ষু শরীরটা যেন সামান্য কেঁপে উঠল। দুর্বল হাতগুলো দিয়ে সে তার সালোয়ারের দড়ি খুলে ফেলে তা নিচে নামিয়ে দিল।

বৃদ্ধ সিরাজুদ্দীন আনন্দে চিৎকার করে উঠল,

-বেঁচে আছে! আমার মেয়ে বেঁচে আছে!

ডাক্তারের মাথা থেকে পা পর্যন্ত তখন ঘামে ভিজে উঠেছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *