ইন্দ্রনীল সান্যাল
এই গল্প ভারতবর্ষের এমন এক গ্রামকে নিয়ে, যেখানকার মানুষ মূলত কৃষিকর্মের সঙ্গে যুক্ত। ফসল ভাল হয় না বলে জোয়ান ছেলেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছে। উপার্জন বলতে শহর থেকে আসা টাকা। এখানে লোকের হাতে কাজ নেই, গ্রামের দশ কিলোমিটারের মধ্যে রেলওয়ে স্টেশন বা হাইওয়ে, ব্যাঙ্ক বা থানা, মোবাইল পরিষেবা বা পোস্ট অফিস, স্কুল বা কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস নেই। অফিস বলতে পার্টি অফিস আর গ্রাম পঞ্চায়েত।
এমন গ্রাম সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে। ভাষাগত সুবিধের জন্যে গল্পটি ফেলা হল বাংলা, বিহার, ঝাড়খন্ড বা উড়িষ্যার মত কোনও একটি রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায়। মায়াবাদ নামের কাল্পনিক গ্রামটি সারা বছর শুনশান পড়ে থাকে মানচিত্রের একটা ফুটকি হয়ে। কাঁচা রাস্তায় ধুলো ওড়ে, গাঁওবুড়োরা তেমাথার বটতলায় বসে হুঁকো খায়, বাড়ির বউ-ঝিরা এক গলা ঘোমটা দিয়ে নদী থেকে জল আনতে যায়। কম বয়সী বেকার যুবক নদীর ধারে বসে গান গায়, ‘মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে, উগলে হিরে মোতি…’
টেলিফোন, যাকে আজকাল ল্যান্ডলাইন বলা হয়, মায়াবাদে এসেছে। এসেছে বিদ্যুৎও। তবে সব জায়গায় নয়। আলো, পাখা এবং টেলিফোন আছে মায়াবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হরেরাম শর্মার বাড়ি, পঞ্চায়েত সদস্যদের বাড়ি এবং পার্টি অফিসে। গ্রামের মধ্যে মাত্র সাত আটটা পাকা বাড়ি। হরেরাম শর্মা এবং পঞ্চায়েত সদস্যরা বাড়িগুলির মালিক। এই রকম একটি পাকা বাড়ির একতলা ভাড়া নিয়ে তৈরি হয়েছে মায়াবাদ থানা। মাসখানেক আগে পুলিশের বড়বাবু অজয় হোসেন এবং মেজবাবু গোপাল মণ্ডল এসেছিল। হরেরামের সঙ্গে মাসিক তিন হাজার টাকা ভাড়ার চুক্তি হয়েছে। নতুন বিল্ডিং তৈরি হলেই ওরা বাড়ি ছেড়ে দেবে।
রবিবার রাত আটটা নাগাদ মেজবাবু মায়াবাদ থানার দরজার মুখে টুলে বসে ঝিমোচ্ছিল। এমন সময় একটা মাঝবয়সী লোক হাঁকপাঁক করতে করতে এসে বলল, ‘স্যর, একটা এফআইআর করব।’
গোপাল আড়চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘থানাটা যে এখানে সেটা জানলে কী করে?’
লোকটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ গোপালের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওই বাচ্চাগুলো বলল।’
থানা থেকে একটু দূরে চারটে বাচ্চা ছেলেমেয়ে গুলি খেলছে। দুটি বউ রাস্তার ধারে বসে বিড়ি ফুঁকছে। গোপালদের দেখে ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকোল।
গোপাল নিচু গলায় লোকটাকে বলল, ‘থানায় ঢুকলে বড়বাবুকে প্রণামী দিতে হয়। সেটা জানো তো?’
বড়বাবু ফাইলে মুখ গুঁজে গুজগুজ ফুসফুস শুনছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘এত রাতে কে এসেছে? গারদে ঢুকিয়ে রুলের গুঁতো দে!’
লোকটার চোখ ভয়ের চোটে গোল গোল হয়ে গেছে। শালিখ পাখির মত সন্তর্পণে পা ফেলে থানায় ঢুকে অজয় হোসেনের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘গুড নাইট স্যর। আই নিড ওয়ান এফআইআর।’
অজয়ের গলার আওয়াজের মত চেহারাও জমকালো। খাকি উর্দি, মাথা ভর্তি টাক আর কলপ করা কুচকুচে কালো গোঁফ দেখলে ভয় আর ভক্তি, দুটোই করে। লোকটার দিকে তাকিয়ে অজয় বলল, ‘কোথায় থাকা হয়?’
‘স্যর, আই অ্যাম এ রেসিডেন্ট অফ বেগুয়া। ভিলেজ বেগুয়া, পোস্ট অফিস ছোটা বেগুয়া, পুলিশ স্টেশান বড়া বেগুয়া। ডিস্ট্রিক্ট…’
বেগুয়া যে পাশের রাজ্যে, এই ধারণা অজয়ের আছে।
সে বলল, ‘এখানে কেন? বেগুয়া থানায় যাও।’
‘ইনসিডেন্স এখানেই হয়েছে স্যর। অন্য থানায় যাব কেন?’
অজয় বুঝল লোকটা টেঁটিয়া আছে। নিয়মকানুন জানে। সে বাঘডাকা গলায় হাঁক পাড়ল, ‘নাম কী?’
‘মাই নেম ইজ অবধেশ শর্মা। সেক্স মেল, এজ ফিফটি, ইংলিশ টিচার ইন বেগুয়া গরমিন্ট হাই স্কুল। ওয়াইফের নাম মিতা শর্মা। এজ ফর্টি ফাইভ, সেক্স ফিমেল, অকুপেশান হাউসওয়াইফ।’
‘তোমার বউয়ের সেক্স জিজ্ঞাসা করা হয়নি। বাজে না বকে কাজের কথা বলো।’
‘উই ডোন্ট হ্যাভ এনি ইস্যু স্যর। ইস্যু বোঝেন তো? আই মিন… আমাদের বাচ্চাকাচ্চা নেই। অনেক চেষ্টা করেছি। সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তখন থেকে আই অ্যাম ট্রাইং হার্ড স্যর! ডে ইন অ্যান্ড ডে আউট! বাট নো রেজাল্ট!’
‘থানায় কেন এলে? এখন কী হয়েছে?’ দাবড়ানি দিল অজয়।
কপালের ঘাম মুছে অবধেশ বলল, “আমরা বাই বাস কলকাত্তা যাচ্ছিলাম। ওখানে এক ডগটরসাব আছেন। একদম ধন্বন্তরী। লেডিসরা যায় আর স্যাটাস্যাট ‘পেগনেন্ট’ হয়। সিয়োর সাকসেস গোদ ভরাই।’
‘নো লুজ টক।’ আবার দাবড়ানি দিয়েছে অজয়।
‘আমার মিসেস খুব হারামি!’ হাঁউমাউ করছে অবধেশ, ‘বাসে বসে আমার মর্দাঙ্গি নিয়ে উল্টাসিধা বলছিল। আমি লো ভল্যুমে প্রটেস্ট করছিলাম। হঠাৎ আমাকে কানচাপাটি দিল। ইন ফ্রন্ট অফ এভরিবডি। এই ইনসাল্ট মেনে নেব না। মিসেসের নামে ফিজিকাল অ্যাসল্ট অ্যান্ড মেন্টাল টর্চারের এফআইআর করব।’
অজয় কিছু বলার আগেই ছোটখাটো চেহারার এক মহিলা থানায় ঢুকে অবধেশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘তুমি এখানে! আজ তোমার একদিন কি আমার এক দিন!’
অবধেশও চেঁচাল, ‘স্যর! দিস ইজ মাই ওয়াইফ মিতা শর্মা! আবার মারতে এসেছে।’
গোপাল বলল, ‘অ্যাই, চুপ! থানায় চিৎকার করলে ফাইন দিতে হয়।’
টেবিলে রাখা ল্যান্ডলাইনে কটর কটর করে রিং হচ্ছে। অজয় ফোন ধরতে যাচ্ছিল। তার আগেই ক্রেড্ল থেকে রিসিভার তুলে মিতা বলল, ‘রং নাম্বার।’ তারপর ক্রেড্লে রিসিভার রেখে বলল, ‘স্যর, বর আমাকে খুন করতে চায়। আমি ওর নামে দফা তিনশো দুই লাগাব।’
‘ফোনে হাত দিলে কেন?’ মিতাকে হুমকি দেয় অজয়।
‘ফোন এলে ‘ডিস্টাব’ হবে স্যর,’ হাউহাউ করে কাঁদছে মিতা, ‘আপনি আগে ‘রিপোট’ লিখুন। এই লুচ্চা, লফঙ্গা লোকটা আমাকে মেরেছে…’
‘মিথ্যে কথা বলবি না চুড়েল!’ লাফিয়ে উঠেছে অবধেশ। ‘আমি তোকে মেরেছি না তুই আমাকে মেরেছিস?’
‘হায় রাম!’ কপাল চাপড়ায় মহিলা, ‘এত বড় ঝুঠ তুমি বলতে পারলে?’
মহিলার দিকে তাকিয়ে অজয় কড়া গলায় প্রশ্ন করে, ‘তোমরা বাসে করে কলকাতা যাচ্ছিলে? তুমি বরকে থাপ্পড় মেরেছ?’
‘আমি ওকে মারিনি। ও আমাকে মেরেছে। দফা তিনশো দুই লাগিয়ে দিন স্যর!’
আবার ফোনে কটর কটর আওয়াজ হচ্ছে। মিতা ফোন ধরে চেঁচাল, ‘না, আমাদের হোম লোন লাগবে না।’ তারপরে ক্রেড্লে রিসিভার রেখে ডাইভ মেরে টেবিলের তলায় ঢুকে অজয়ের পা ধরে বলল, ‘স্যর! প্লিজ কিছু করুন!’
গোপাল ক্রেড্ল থেকে রিসিভার তুলে দু’বার ‘হ্যালো’ বলে ফোন রাখল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘থানার ফোনে হাত দিলে কত ফাইন হয় এই নিয়ে কোনও আইডিয়া আছে?’
মিতা টেবিলের তলা থেকে না বেরিয়ে বলল, ‘ফাইন দেব। আগে রিপোট লিখুন!’
মোটা খাতা খুলে অজয় বলল, ‘তোমরা যে অচেনা একটা গ্রামে বাস থেকে নেমে পড়লে, এবার রাত কাটাবে কোথায়?’
অবধেশ বলল, ‘কোনও লোকের বাড়ি গিয়ে বলব রাতটুকু যেন থাকতে দেয়। আমি গরমিন্ট টিচার। সঙ্গে আইকার্ড আছে। কেউ আপত্তি করবে না।’
অবধেশের কথা শেষ হতেই টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে মিতা বলল, ‘তোমার গরমিন্টের চাকরি কী করে থাকে আমি দেখছি। দফা তিনশো দুইয়ের সঙ্গে দফা চারশো আটানব্বইও লাগান স্যর।’
আবার ফোন বাজছে। অজয় ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো?’
এই ফাঁকে অবধেশ মিতার দিকে তেড়ে এসেছে। খারাপ গালাগালি দিয়ে বলছে, ‘তোকে আমি আজ মেরেই ফেলব।’
মিতা ভয় পেয়ে এক লাফে টেবিলে উঠে উল্টো দিকে ঝাঁপ মারল। ঝাঁপের অভিঘাতে ল্যান্ডলাইনের তার ছিঁড়ল, টেবিলের পায়ায় ‘মট’ করে আওয়াজ হল।
অজয় আঁতকে উঠে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দুটোকেই গারদে ঢোকা!’
মিতা মেঝে থেকে উঠে আবার অজয়ের পা জড়িয়ে ধরেছে। কাঁদছে আর বলছে, ‘দেখুন স্যর! আপনার সামনে মার্ডার করতে চাইছে। এর পরেও দফা তিনশো দুই লাগাবেন না?’
অবধেশ জিভ কেটে বলল, ‘আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। ভুল হয়ে গেছে। চাকরি গেলে খাব কী? আপনি বরং আমাদের ডিভোর্সটা ফাইল করে দিন।’
‘ডিভোর্স চাওয়া হচ্ছে?’ বিকট জোরে চেল্লায় মিতা, ‘আমি বিদেয় হলেই অঙ্কের মাস্টারনিকে বিয়ে করবে, তাই না? চশমা পরা মেয়েছেলেটা ইংলিশ পেপার পড়ে বলে আমার থেকে বেশি স্যাক্সি?’
‘উফ!’ কপাল টিপে অজয় বলে, ‘গোপাল, দুটোকেই ঘাড় ধরে বার করে দাও। কোনও এফআইআর লেখা হবে না। নিজেরা মারামারি করে মরুক।’
অজয়ের কথা শুনে অবধেশ কাঁদতে আরম্ভ করেছে।
‘স্যর! এফআইআর নিয়ে নিন। আমার মিসেস অন্য থানা থেকে কাগজ বার করালে সিধে জেলে ঢুকে যাব।’
গোপাল পোঁ ধরে বলল, ‘খরচা লাগবে কিন্তু।’
গোপালের পা ধরে অবধেশ বলল, ‘খরচা দেব! আপনি লিখুন।’
‘এফ আই আর-এর রেট দশ হাজার। তবে তার জন্যে সরকারি হাসপাতালের কাগজ লাগে। সেটা না থাকলে রেট ডবল।’
‘ঠিক আছে স্যর। কড়া করে লিখে দিন।’ দাপটের সঙ্গে বলল অবধেশ।
মিতাও ছোড়নেওয়ালি নয়। সে অজয়কে বলল, ‘স্যর! আমারটা আপনি লিখে দিন!’
মিতার দিকে তাকিয়ে অজয় রুক্ষভাবে বলল, ‘থানায় ঢুকে গুন্ডামি করার জন্যে তোমার নামে আমিই এফআইআর করব।’
দেওয়ালে মাথা ঠুকে মিতা কাঁদছে আর বলছে, ‘মেয়ে হয়ে জন্মে কী অপরাধ করেছি ঠাকুর! আমাকে তুমি তুলে নাও।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা, লিখে দিচ্ছি। কুড়ি হাজার ছাড়ো।’ আর একটা খাতা খুলেছে অজয়।
‘আমি বাড়ির বউ। অত টাকা কোথা থেকে পাব? পাঁচ হাজার টাকা আছে।’ ব্লাউজের ভিতর হাত ঢুকিয়ে টাকা বার করছে মিতা। সে দিকে একপলক তাকিয়ে লেখায় মন দিল অজয়।
দশ মিনিটের মধ্যে লেখালিখি শেষ। অবধেশ আর মিতা ঝগড়া করতে করতে থানা থেকে বেরোল।
পুলিশ ভ্যানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে দেখল যে চারটে বাচ্চা এখনও রাস্তার ধারে খেলছে। বউদুটো এখনও রাস্তার পাশে বসে বিড়ি ফুঁকছে। ওদের দেখে ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকোল। দু’জন গ্রামবাসী থানার দিকে যাচ্ছে। তাদের দেখে মিতা বলল, ‘এরা কেন থানায় যাচ্ছে?’
‘জানি না’, অবধেশ বলে, ‘আচ্ছা সন্ধ্যা, তোমার কী মনে হয়? আমাদের অ্যাক্টিং-এ লাভ হল? পঁচিশ হাজার টাকা গচ্চা গেল না তো?’
সন্ধ্যা, এতক্ষণ যার নাম মিতা ছিল, বলল ‘জান লড়িয়ে কাজ করলাম, কার্তিক। প্রথম দু’বার বড়বাবুকে ফোন ধরতে দিইনি। শেষবার উপায় নেই দেখে কায়দা করে তার ছিঁড়ে দিয়েছি। এবার আমাদের কপাল!’
কার্তিক, এতক্ষণ যার নাম অবধেশ ছিল, ভুরু কুঁচকে বলল, ‘নির্ঘাত কোনও না কোনও পঞ্চায়েত সদস্য ফোন করেছিল। ভয়ের চোটে আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। যদি বড়বাবু রেগে গিয়ে লকাপে ঢুকিয়ে দিত?’
‘সেইরকম অভিজ্ঞতা আমাদের আগে হয়েছে তো!’ হাসছে সন্ধ্যা, ‘থানা এমন একটা জায়গা, যেখানে টাকা দিলে সাত খুন মাফ।’
কথা বলতে বলতে কার্তিক আর সন্ধ্যা থানা থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। জনমানবহীন, খানাখন্দে ভরা রাস্তায় এতক্ষণ কোনও গাড়ি এতক্ষণ ছিল না। এখন একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। একটু পরে চারচাকাটি নি:শব্দে ওদের পাশে দাঁড়াল। চালকের আসন থেকে বছর কুড়ির একটি ছেলে বলল, ‘বাবা! মা! উঠে পড়ো!’
চালকের পাশের আসনে বসে কার্তিক বলল, ‘কাজ ঠিকঠাক হয়েছে?’
পিছনের আসন থেকে এক কিশোরী বলল, ‘বাবা, আমি আর দাদাই এখন অ্যাডাল্ট। মিনিমাম এগারোটা অপারেশান করেছি। নো গণ্ডগোল!’
মেয়ের মাথায় চাঁটি মেরে সন্ধ্যা বলে, ‘বাবা যা জিজ্ঞাসা করল তার উত্তর দে।’
‘কাজ ঠিকঠাক হয়েছে’, ছেলে বলল, ‘সাতজন পঞ্চায়েত মেম্বারের বাড়ির লকারে যত ক্যাশ ছিল, সব নিয়েছি। মোট সাড়ে দশ লাখ টাকা। তবে একজন মেম্বারের বউ আমাকে দেখে ফেলে। বোন ওর মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে ঘরে তালা মেরে দিয়েছিল।’
‘থানায় তিনবার ফোন এসেছিল।’ বলল কার্তিক। ‘এখন দু’জন থানায় গেল। পুলিশের ফোন ধরা আটকাতে আমি আর তোদের মা কত নাটক যে করলাম! তবে একটু বাদেই থানা সব জেনে যাবে। জলদি গাড়ি চালা। মিনিমাম দু’মাস নিজের স্টেটে ফিরে চুপচাপ বসে থাকব। তারপর অন্য রাজ্যে কাজ।’
‘পরের বার কোথায়?’ জিজ্ঞাসা করল মেয়ে।
‘বেঙ্গল আর ঝাড়খন্ডের বর্ডারে একটা গ্রাম আছে। নাম চুহিয়া। ওখানে একটা শ্মশানকালীর মন্দির আছে। শুধু অমাবস্যায় পুজো হয়। সেই সময় তিনদিনের জন্যে খুব ভিড় হয়। থাকার জন্যে একটাই মাত্র হোটেল। পয়সাওয়ালা ভক্তরা এসে হোটেলে ওঠে। পুজো দিয়ে ফিরে যায়। গ্রামের দশ কিলোমিটারের মধ্যে থানা, কোর্ট, স্কুল, কলেজ, হেল্থ সেন্টার বা বিডিও অফিস নেই।’
কার্তিকের কথা শুনে সন্ধ্যা আর দুই ছেলেমেয়ে হাসছে। অন্ধকারের মধ্যে ট্রেকারের হেডলাইট মিলিয়ে যাচ্ছে।
চেয়ার থেকে উঠে অজয় বলল, ‘মজিদদা, এবার যে বেরোতে হবে।’
মজিদ, যার নাম এতক্ষণ গোপাল ছিল, খাতার বান্ডিল টেবিল থেকে তুলে বলল, ‘সাইনবোর্ড আর নোটিশবোর্ড দুটো কে খুলবে রে শ্যামল? আমার বাপ?’
শ্যামল, যার নাম এতক্ষণ অজয় ছিল, বলল, ‘শুধু বোর্ডগুলোই দেখলে মজিদদা? চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চি, খাকি পোশাক, অকেজো গাদা বন্দুক, লাঠি… এগুলো দেখলে না? কপালদোষে ওস্তাদের কাছে একটাই বিদ্যে শিখেছি। রিমোট গ্রামে গিয়ে জাল থানা খুলে বসা, স্থানীয় লোকের বিশ্বাস অর্জন করা। মাসখানেকের মধ্যে ওদের মাল্লু ঝেড়ে কেটে পড়া। পুলিশের চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্টের পরে ওস্তাদ এই কাজ করত। আমাদের স্যাঙাত বানিয়েয়েছিল। তবে আজকাল আর আগের মত মজা নেই। রিমোট জায়গা বলে ক’দিন পরে কিছু থাকবে না।’
শ্যামলের কথার মধ্যে লাফাতে লাফাতে চলে এসেছে চারটে বাচ্চা আর দুটো বউ, যারা রাস্তার ধারে বসেছিল। বাচ্চাগুলো নি:শব্দে যাবতীয় জিনিস বস্তায় ঢোকাতে শুরু করল। থিয়েটার কর্মীরা যে ভাবে দৃশ্যান্তরের সময় নিমেষের মধ্যে স্টেজ থেকে সমস্ত প্রপ সরিয়ে নেয়, এরাও ঠিক সেইভাবে ঘর ফাঁকা করে পুলিশ ভ্যানের দিকে দৌড়ল। একটু বড় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওদের মায়েরা— মজিদ আর শ্যামলের বউ। মজিদ সবুজ পেইন্ট দিয়ে গাড়ির গায়ে লেখা ‘পুলিশ ভ্যান’ শব্দদুটি মুছে দিচ্ছে। বদলে দিচ্ছে গাড়ির নম্বর প্লেট। হরেরাম শর্মার সঙ্গে দেখা করে শ্যামল এক মাসের বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে ফেরত আসছে।
শ্যামলের বউ জিজ্ঞাসা করল, ‘হরেরাম সন্দেহ করেনি তো?’
‘আমরা ভাড়া নেওয়ার সময় বলে রেখেছিলাম যে এটা টেম্পোরারি থানা। নতুন বিল্ডিং তৈরি হলেই চলে যাব। তবে লোকটা ভাল। নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে থানা পর্যন্ত ফোন লাইন টেনে দিয়েছিল।’
মজিদ বলল, ‘ফোন থাকলে সুবিধে। শহরের খবর পাওয়া যায়। আজ একটু আগে কাদের ফোন এসেছিল জানা হল না। অবশ্য জেনেই বা কী করতাম! আজ আমাদের চলে যাওয়া আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ঝগড়ুটে বরবউ দুটোর কাছ মাল্লু হাতানোর পরে নতুন দুটো মুরগি এল। সময় ছিল না বলে ওই দুটোকে জবাই করতে পারলাম না।’
সবাই গাড়িতে উঠেছে। গাড়ি স্টার্ট করে শ্যামল বলল, ‘এক মাসে কত আমদানি হল?’
মজিদ বলল, ‘মাত্র আড়াই লাখ। ধুস্ শালা! এই টাকায় পেট চলে?’
শ্যামল বলল, ‘কিস্সু করার নেই বস! পরের দু’মাস এই টাকাতেই চালাতে হবে। নিজের স্টেটে ফিরে যে যার বাড়িতে চুপ মেরে বসে থাকবে। সবকিছু থিতিয়ে গেলে অন্য রাজ্য, অন্য গ্রাম। আমি অলরেডি বেছে রেখেছি।’
‘কোথায়?’ মজিদের বউ জিজ্ঞাসা করল।
শ্যামল বলল, ‘বেঙ্গল আর ঝাড়খন্ডের বর্ডারে চুহিয়া গ্রাম। ওখানকার শ্মশানকালীর মন্দিরে শুধু অমাবস্যায় পুজো হয়। সেই সময় গ্রামটা ট্যুরিস্টে থিকথিক করে। একটাই থাকার হোটেল আছে। থানা বা অন্য সরকারি অফিস বহু দূর।’
‘হুররে!’ চিৎকার করে ওঠে শ্যামল আর মজিদের চার ছেলেমেয়ে। ওদের চারচাকার টেল লাইট অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন