দীপান্বিতা রায়
“কাল পালং-পনিরটা খুব খারাপ খেতে হয়েছিল মালতী। এত বার করে তো বলে দিলাম পনিরের টুকরোগুলো ভাজবে না। ওতে পনিরটা না ভেজে দিতে হয়। সেই শক্ত ইঁট ইঁট করে ভেজে ফেলেছো। একটা কথা ঠিক করে মনে রাখতে পার না। তড়কার ডালটাও দাদা একবার মুখে দিয়েই সরিয়ে রাখল। আবার পেঁয়াজ ভেজে, সস্ দিয়ে জুত করতে হল। তুমি রেঁধে যাওয়ার পর আমাকে যদি আবার কিচেনে ঢুকতে হয়, তাহলে আর রান্নার লোক রাখা কেন বলো? আর এ তো শুধু একদিনের ব্যাপার নয়। রোজই হচ্ছে। এরকম চললে কিন্তু সামনের মাস থেকে আমি অন্য লোক দেখব বলে রাখলাম।”
আরও কিছুক্ষণ নিশ্চয়ই বকুনি চলত। কিন্তু বসার ঘরে মোবাইলটা বাজছে। তাই কথা অসমাপ্ত রেখেই ফোন ধরতে গেল মলি বউদি। ফ্রিজ থেকে সবজিগুলো বার করে একটা খবরের কাগজের ওপর ঢেলে রেখেছিল আগেই। সেগুলো এবার গুছিয়ে নিয়ে রান্নার যোগাড় শুরু করছিল মালতী। বউদির কথা শুনে বুকের ভিতরটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল তার। কাজের বাড়ির বকুনি শুনলে প্রথম প্রথম চোখে জল এসে যেত। কিন্তু এখন আর তেমন গায়ে লাগে না। অভ্যাস হয়ে গেছে অনেকটাই। কিন্তু কাজ চলে যাওয়ার ভয় আছে। রান্না করার জন্য মলি বউদি মাসে তাকে দু’হাজার টাকা দেয়। এমনি এমনি দেয় না। খাটনি যথেষ্ট। সকালে অন্তত চার-পাঁচ পদ রান্না করতে হয়। আবার বিকেলে এসে জলখাবার, পরের দিনের টিফিন, রাতের রুটি করে তবে ছুটি। সুবালা শুনে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, “দুবেলা রান্না করিয়ে মোটে দু’হাজার দিচ্ছে। বোকা আছিস তুই। আড়াই হাজার চাইবি তো। এইসব ফ্ল্যাটবাড়ির গিন্নিদের ফুটুনি খুব। শুধু কাজের লোককে পয়সা দিতে হলে পিঁপড়ের পিছন টিপতে হয়।”
মালতী কিছু বলেনি। আসলে রান্নার লোকের কীরকম মাইনে-কড়ি হতে পারে তার কোনও ধারণাই নেই। দু’হাজার টাকা তার কাছে অনেক। বাড়িতে তিন-তিনটে হাঁ-মুখ। কাজ চলে গেলে কী হবে ভাবতে গেলে পেটের ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে মালতীর। আসলে গরীব ঘরের মেয়ে হলেও না খেয়ে থাকা তো তার কোনওদিন অভ্যাস ছিল না। বাবার কয়েক বিঘে জমি ছিল। সেটুকুতে চাষ দিত। আবার অন্যের জমিতেও জন খাটত। বাড়ির পাশের এক টুকরো জমিতে সবজি বসাত মা। ভাতের সঙ্গে আর কিছু না হোক কুমড়ো ভাতে, কি পালং-মূলোর তরকারি জুটত অনায়াসেই। একমাত্র সন্তান। শত অভাবেও না খাইয়ে রাখার কথা মা ভাবতেও পারত না।
বিয়েও হয়েছিল প্রায় সমান ঘরেই। শাশুড়ি আসলে মায়ের সই, তার সই-মা। শ্বশুরেরও বাপের মত কয়েক বিঘে জমি। শাশুড়িও ঘরে বসে থাকত না। বিয়ে, চূড়ো, অশৌচ সবেতেই ডাক পড়ত গিনি নাপতেনির। বাড়িসুদ্ধ লোকের নখ কেটে, মেয়েদের আলতা পরিয়ে দিয়ে আসতো। পয়সা পেত ভালই। আলতার শিশি, নরুণ, ঝামা পাথর সব গোছানো থাকত একটা বাক্সে। সইয়ের মেয়ে বলে মালতী ছোটবেলা থেকেই সই-মার ভারি আদরের। তাই কোনও বাড়িতে নখ কাটার পর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আছে জানলে মালতীকে ট্যাঁকে করে নিয়ে যেত সই মা। মালতীর যদিও সবথেকে পছন্দ ছিল আটকৌড়েতে যাওয়া। বেশ দিব্যি বাড়ির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কুলো পিটিয়ে এক কোঁচড় আট কড়াই ভাজা নিয়ে ফেরা যেত। তার সঙ্গে যদি আবার দুটো-একটা টাকাও পাওয়া যেত তাহলে তো আর কথাই নেই। দুই সইয়ে কথাবার্তা হয়ে গেছিল অনেক আগেই। মালতীও একটু বড় হওয়ার পরই জানত দিলীপই তার বর হবে। অপছন্দও হয়নি। চেহারাখানা দিলীপের বরাবরই ভাল। বাপের ধাঁচের হাড় চওড়া ছেলে। গায়ের রঙ ময়লা হলেও খারাপ দেখায় না। মালতীরও ছিপছিপে চেহারার বাঁধুনি ছিল ভাল। নাকটা সামান্য চাপা। তা নিয়ে মায়ের দুঃখ থাকলেও সই মা হেসে হেসে বলত, “নাকটি চাপা, চোখটি ভাসা, সে মেয়ে দেখতে খাসা। ভাবিস না সই। ছেলের বউ আমার ভারি পছন্দ।”
মালতী যখন সবে উনিশ পেরিয়েছে বিয়ে হয়ে গেল দিলীপের সঙ্গে। নাইনে উঠে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে ছিল দিলীপ। পড়ালেখায় মন ছিল না কোনওদিনই। বিড়ি ফুঁকে বেড়াত। মেয়েদের হিড়িক দিত বলেও শুনেছে মালতী। তবে গায়ে মাখেনি তেমন। আসলে সই-মা আর শ্বশুরের ওপর অগাধ ভরসা ছিল চিরকালই। বিয়ের পর অবশ্য দিলীপের তেমন ছোঁকছোঁকানি চোখে পড়েনি কখনও। বড় মেয়েটা হওয়ার পর তো সংসারে মন বসেছিল ভালই। বাপের সঙ্গে মাঠে কাজ করত। সবজি-পাতি বেচে আসত বাজারে। সই-মাও কাজ-কর্মে বাইরে যেত। সংসার সামলাত মালতী। বাপ-ছেলের রোজগারে দিব্যি চলত তখন। একবেলা মাছ-ভাত তো হতই। তবে কাটা পোনা, বড় বড় গাদা-পেটির টুকরো নয়। পুঁটি, চাঁদা, লটে এসবই কিনে আনত শ্বশুর। মাসে দু-একবার মুরগিও আনা হত। কিছু না থাকলে ডিমের ডালনা তো ছিলই। মালতীর রান্না সবাই হাত চেটে খেত। শ্বশুর, শাশুড়ি, বর কেউ কখনও বলেনি মালতী রাঁধতে পারে না। আর এখন মালতীকে দু-বেলা শুনতে হয় সে নাকি ঠিক করে খুন্তি ধরতেই জানে না। কথাগুলো শুনতে শুনতে মালতীর মনে হয় আগের জীবনটা যেন স্বপ্নে দেখা। যেন সেটা কোনওদিন ছিলই না, সে শুধু মনে মনে ভেবে নিয়েছিল।
স্বপ্নভঙ্গটা অবশ্য শুরু হয়েছিল যবে থেকে এই এলাকার জমিগুলোর ওপর সরকারের চোখ পড়ল। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। এই অঞ্চলটায় নাকি নতুন টাউনশিপ তৈরি হবে। আজকাল যে ওই ঘরে ঘরে থাকে কম্প্যুটার না কি যেন বলে তার কারখানা তৈরির জন্য জমি দরকার সরকারের। শহরের ভিতরে তো আর অত জমি নেই। তাই এবার এইসব দিকে হাত পড়েছে। প্রথমটায় মালতীদের বিশ্বাস হয়নি। দিলীপের বাবা তো হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল। এইসব জলা-জঙ্গল, চাষের জমি। সেখানে কে আসবে কারখানা বানাতে। কিন্তু কথাটা ক্রমশ পাকতে লাগল। দালাল আর পার্টির নেতাদের আনাগোনা শুরু হল। কত রকম ভালো ভালো কথা। জমি নেবে। দাম তো দেবেই তার সঙ্গে চাকরিও দেবে অন্তত একজনের। কিন্তু তা সত্বেও জমি ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না অনেকেই। কিছুদিন বাদেই অবশ্য বোঝা গেল জমি না দিয়ে কোনও উপায় নেই আর চাকরি-বাকিররও কোনও গল্প নেই। যেটুকু টাকা হাতে পাওয়া গেল মালতীর মা-বাবা তাই দিয়ে ভেদিয়ার কাছে তার কাকাতো ভাইয়ের গ্রামে দু-কাঠা জমি কিনে চলে গেল। মালতীদের যাওয়ার উপায় নেই। দিলীপ তো এখানেই কাজ-কর্ম যা হোক কিছু করে। গ্রামে গেলে খাবে কী? তাছাড়া জমি গেলেও ওদের বসতবাড়িটুকু বেঁচে গেছিল। তাই বাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকল ওরা। কারখানা হয়নি তবে রাজারহাট এলাকায় তখন পরপর ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে। রাজমিস্ত্রির কাজ নিল দিলীপ। রোজগার খারাপ নয়। শ্বশুর মারা গেল হঠাৎ। আর সোয়ামি মারা যেতে সই-মাও কেমন যেন অসুস্থ, জবুথবু হয়ে গেল। মালতীর মেয়েদুটো ততদিনে ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে।
সব কিছু সামলে টালমাটাল সংসারটা আবার যখন একটু থিতু হওয়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছ, তখনই একদিন দিলীপ বাড়ি ফিরে জানিয়ে দিল, মালতীকে তার আর পছন্দ হচ্ছে না। ছেলেপুলে হয়ে মালতীর শরীর টসকে গেছে, বিছানায় শুয়ে তার কোনও সুখ হয় না, সে আর একটা বে করবে। দশ বছরের বেশি তাদের বিয়ে হয়ে গেছে, দু-দুটো বাচ্চার বাপ, তার মুখে এমন কথা শুনে মালতীর তো প্রথমটায় বিশ্বাসই হয়নি। ভেবেছিল দিলীপ বোধহয় ইয়ার্কি দিচ্ছে। কিন্তু দু-চারদিনের মধ্যেই বোঝা গেল ব্যাপারটা আদপেই তা নয়। রাতে বাড়ি ফেরা বন্ধ করল দিলীপ। দুপুর-বিকেলে কখনও-সখনও আসলেও মালতীর সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় বলেই না। মেয়েদের দিকেও কোনও গা নেই। একদিন মালতী জোর করে ধরে পড়াতে পষ্টই বলে দিল, বীরপাড়ার মলিনা বলে একটা মেয়ের সঙ্গে তার আশনাই হয়েছে। সে মেয়ে আয়ার কাজ করে। রোজগার ভাল। বুক-পাছা সব আঁটোসাঁটো। তাই এবার থেকে তার সঙ্গেই থাকবে ঠিক করেছে দিলীপ। সই-মা অনেক চেষ্টা করেছিল ছেলেকে বোঝানোর। কিন্তু লাভ হয়নি কোনও। দুটো মেয়ে আর বুড়ো মাকে মালতীর ঘাড়ে ফেলে দিয়ে কেটে পড়ল দিলীপ। প্রথম প্রথম তাও দু-চারটাকা দিত। মাসখানেক পরে সেটাও বন্ধ করে দিল।
গরীব হলেও এমন অভাবের কথা কখনও ভাবেনি মালতী। নিজেদের তো একবেলা উপোস আছেই। মেয়েদুটো খিদেয় কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ছে দেখে বুক ফেটে যেত। বাড়িতে দু-চার টুকরো সোনা-রুপো যা আছে তা বেচে দু-চারদিন চলার পর আর কোনও উপায় না দেখে মালতী ঠিক করেছিল সে নিজেই কাজে বেরোবে। শাশুড়ি জবুথবু হলেও ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে। মেয়েরা ইস্কুল থেকে ফিরলে দুটো ভাত বেড়েও দিতে পারবে।
কাজ পেতে অসুবিধা হয়নি। নতুন তৈরি হওয়া মস্ত মস্ত ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে ততদিনে অনেক লোকজন চলে এসেছে। তাদের ঠিকে কাজের লোক দরকার। আশপাশের গ্রামের বউ-ঝি-রা দুটো পয়সার জন্য সেখানে কাজে লাগছে। সুবালাকে বলাতে সেই কাজের সন্ধান দিয়েছিল। বাসন মাজা-ঘর মোছার কাজ। কাপড় কাচা হবে মেশিনে। সেগুলো মেলে দিতে হবে। মাইনে পাঁচশ টাকা। প্রথমটায় ভালই মনে হয়েছিল মালতীর। কিন্তু কাজ করতে ঢুকে বুঝল ব্যাপারটা অত সোজা নয়। আপনি-কোপনির সংসার হলেও বাসন পড়ে অনেক। চায়ের কাপটি পর্যন্ত বউদিমণি নামিয়ে রেখে দেয়। সাদা কাপের ভিতরে চা-এর এতটুকু লালচে দাগ থাকলে ঘষে তুলতে হয়। ওইটুকুনি ফ্ল্যাট। কিন্তু টেবিল-চেয়ার সব এপাশ-ওপাশ সরিয়ে ঝাঁট দিয়ে মুছতেও কম সময় লাগে না। চায়না, সুবালারা বলে, “করবি না অত। বলবি পারব না। অন্য লোক দেখে নাও। মুখ করবি। নাহলে পেয়ে বসবে।”
কিন্তু মালতী পারে না। একে তো তার স্বভাবটাই খানিকটা মুখচোরা ধরনের। তার ওপরে কাজ চলে গেলে নতুন কাজ একেবারে তুড়ি মেরে যোগাড় করে নেবে এমন জোরও নেই। এদিকে অন্তত চারটে বাড়ি কাজ না করলে সংসার চালানো মুশকিল। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে মালতী ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে দুটো ডাল-ভাত রেঁধে বাড়ি থেকে বেরোত। চারবাড়ি কাজ সেরে বাড়ি ঢুকতে প্রায় তিনটে। মাঝখানে শুধু একবাড়িতে চারটে রুটি বরাদ্দ। বাড়ি ফিরে কোনওরকমে দুটো মুখে গুঁজেই আবার ছুটতে হত। গোটা তিনেক স্কুল ফিরতি বাচ্চাকে বাস থেকে নামিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তার। মাস তিন-চার এভাবে চলার পর সে নিজেই বুঝতে পারছিল শরীরে দিচ্ছে না। ঠিক সেই সময় এই রান্নার কাজের খবরটা এনেছিল তাদের পাড়ার আরতি। কথাটা শুনে মালতী প্রথমটায় যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিল। যদিও এখন যা অবস্থা, তাতে কাজটা কতদিন টিকবে তাই-ই বুঝতে পারছে না।
মুড়িঘন্টটা কষে একটু বেশি করে জল দিয়ে ঢাকা দিল মালতী। গ্যাসটা সিম করে চা বানাল দু-কাপ। নিজের জন্য এক কাপ এই সময় রোজই বানায়। আজ মলি বউদির জন্যও বানাল। বউদি চা খেতে ভালোবাসে। শীতের দিনে গরম চা পেয়ে যদি মেজাজ একটু ভাল হয়। চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে মালতী দেখে এক গামলা জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে বউদি। রাগ নেই। তবে মুখে একটা বেশ ব্যাজার মত ভাব। চা-টা পেয়ে খুশি হল বোঝাই গেল। নিজের বরাদ্দের রুটি দুটো নিয়ে মেঝেতে বসে বউদির মেজাজ বুঝতে মালতী জিজ্ঞাসা করল, “এই ঠাণ্ডায় জলে পা ডুবিয়ে বসে আছ কেন গো বউদিদি?” “ঠান্ডা নয়, গরম জল। পা-টা কদিন ধরে এমন ময়লা হয়েছে…..ভাবলাম একটু পেডিকিওর করিয়ে নেব। ‘সাজো’তে ফোন করলাম। তো ফোন কেউ ধরছেই না। তারপর মীনাক্ষির কাছে শুনলাম ‘সাজো’ নাকি বন্ধ। মালিকের সঙ্গে কী গণ্ডগোল হয়েছে, কবে খুলবে কেউ জানে না। সিটি সেন্টারে যেতে হলে এখন তিরিশ তিরিশ ষাট টাকা অটো ভাড়া দিতে হবে।”
“কী করে নেবে ভাবছিলে বললে?”
“পেডিকিওর, মানে পা পরিষ্কার আর কী। শীতকালে পা-টা বড্ড ময়লা হয় তো। ফেটেও যায়। ভাবছি নিজেই করে নেব। কিন্তু কদিন ধরে কোমরটা এমন ব্যাথা হয়েছে যে নিচু হয়ে পা ঘষতে ইচ্ছে করছে না।”
মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা বুদ্ধির চমক খেলে যায় মালতীর। হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে বলে, “তোমাকে করতে হবে না বউদিদি। আমি পরিষ্কার করে দেব।”
“তুমি পরিষ্কার করবে! দূর…ও কী বললেই করা যায় নাকি! তাছাড়া তুমি রান্না করবে। তারমধ্যে এইসব নোংরা-ঝোংরা ব্যাপার!”
কিন্তু মালতী ততক্ষণে বউদিকে তুষ্ট করতে মরিয়া, “আমার কথাটা শোনো না গো। পা কি আর এখন পরিষ্কার করব নাকি! এখন গামলা তুমি তুলে রাখ। বিকেলে ইস্কুলগাড়ি থেকে বাচ্চাদের নামিয়ে আমি চলে আসব। আমার শাউড়ি তো নাপতেনি ছিল গো। পা ঘষা, নখ কাটা, আলতা পরানো এসব আমি শাউড়ির কাছে শিখেছি। দ্যাখোই না একবার। পছন্দ না হলে গাল দিয়ো আমায়।”
দোনোমোনো করে রাজি হয়ে যায় মলি। সেদিন বাড়ি ফিরে শাশুড়ির তুলে রাখা বাক্সটা পাড়ে মালতী। ঝামা পাথর, নরুণ, নখ খোঁচানি, আলতার তুলি সব গুছিয়ে রাখা। সই-মা যখন কারোর বাড়িতে কাজ করত, পিঁড়ি পেতে পাশে বসে দেখত মালতী। তাই হাতে-কলমে না করলেও সবটাই তার জানা। বাক্সটা মালতীকে বার করতে দেখে একটু অবাক হয়েছে সই-মাও। সব কথা শুনে বলল, “হ্যাঁ রে পা যে ঘষে দিবি, পয়সা-কড়ি দেবে তো?”
“পয়সা-কড়ি কে চাইছে গো। বউদি খুশি হলে রান্নার কাজটা যদি টিঁকে যায়, তাই ভাবছি শুধু।”
“শোন, একটা কাজ কর, ওই ওপরের তাকে একটা বোতলে তিলের তেল আছে। শিশিতে করে অল্প ঢেলে নিয়ে যা। পা ঘষা হয়ে গেলে লাগিয়ে দিবি। দেখবি পা নরম থাকবে, ফাটবে না।”
নাপতেনির বাক্স নিয়ে চারটের মধ্যেই মলি বউদির বাড়িতে পৌঁছে যায় মালতী। গরম জলে সাবান দিয়ে কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে রাখার পর প্রথমে হাতল বসানো ঝামা পাথর দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেলে পায়ের শুকনো চামড়া। নরুণ দিয়ে কেটে, খোঁচানি দিয়ে পরিষ্কার ঝকঝকে করে দেয় পায়ের নখ। ধুঁধুলের ছোবড়ায় সাবান লাগিয়ে প্রায় উরু পর্যন্ত বুলিয়ে নেয়। তারপর ভাল করে ধুয়ে, শুকনো তোয়ালেতে মুছে তিলের তেল লাগিয়ে দেয় পায়ের পাতায়।
“পা পরিষ্কার করে এই তেলটা মাঝেমাঝে লাগালে পা ফাটবে না গো বউদি, আমার শাউড়ি বলেছে।” মলিবউদির মুখ দেখেই বোঝা যায় কাজটা পছন্দ হয়েছে তার। চটিটা পায়ে গলিয়ে দু-কাপ চা বানাতে বলে মালতীকে। তারপর পঞ্চাশটা টাকা হাতে দিয়ে বলে, “খুব ভাল পরিষ্কার হয়েছে মালতী। এই শীতকালটায় মাঝে মাঝে করে দিও কেমন। তাহলে আর পার্লারে যাওয়ার হ্যাপা থাকে না।” পঞ্চাশ টাকা তো বাড়তি পাওনা। কিন্তু অন্তত শীতকাল পর্যন্ত তার রান্নার কাজটা বজায় থাকল ভেবেই সেদিন খুশিতে ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল মালতী। তার কয়েকদিন পর একদিন রান্না শেষ করে বাড়ি ফেরার মুখে মলি বউদি বলল, “কালকে মীণাক্ষি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। আমি গল্প করছিলাম তুমি কেমন সুন্দর করে আমায় পেডিকিওর করে দিয়েছো। তো বলল যে ও করাবে। তুমি যাওয়ার পথে মীণাক্ষির বাড়িতে একবার দেখা করে যেও। আর শোনো, আমি মীণাক্ষিকে বলেছি যে তোমাকে একশ টাকা দিয়েছি।”
ফেজ টু-এর মীণাক্ষির পর ফেজ ফাইভের সম্পূর্ণা, তারপর ফেজ ওয়ানের রিয়া –একমাস পরে মালতী হিসেব করে দেখল শুধু পা পরিষ্কার করেই সে প্রায় সাত-আটশ টাকা বাড়তি রোজগার করে ফেলেছে। “শীতকাল বলেই সব বাড়ির বউদের এত পা পরিষ্কার করার ধুম। ঠাণ্ডা কমে গেলে আর কেউ ডাকবে না গো সই-মা” তোলা উনুনে ভাতের ডেকচিটা বসিয়ে বলল মালতী।
“শীত ফুরোলে অন্য কাজ করবি। আমি আরও অনেক কাজ জানি। মেয়েদের শরীর অনেক কিছু চায়। সব সুখ পুরুষমানুষকে দিয়ে হয় না। আমি শিখিয়ে দেব তোকে।”
রবারের ম্যাট্রেসের ওপর শুয়ে থাকা রিয়া বউদির নগ্ন শরীরে অলিভ ওয়েল ম্যাসাজ করতে করতে ভাবছিল মালতী। কীভাবে সেদিন রাতে মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে, তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে শুইয়ে সই-মা শিখিয়ে দিয়েছিল কেমন করে তেল মাখিয়ে দিতে হয় মেয়েদের শরীরে। বুঝিয়ে দিয়েছিল নরম হাতের নিপুণ চাপে কীভাবে শরীরকে জাগিয়ে তুলে পৌঁছে দেওয়া যায় তুঙ্গ মুহূর্তে। “আমার মা-র কাছে শিখেছিলাম মালিশের এই কায়দা। তখনকার দিনে তো সব বারমুখো পুরুষ। বউগুলো ঘরে বসে শরীরের জ্বালায় ছটফট করতে করতে মা-কে ডেকে পাঠাত। শরীরও ঠাণ্ডা হল আবার বদনামের ভয়ও রইল না। তবে একটা কথা মনে রাখিস, খুব সাবধান ধীরে ধীরে এগোবি। বুঝে-শুনে। যার শরীর ডাক দিচ্ছে, সে নিজেই জানান দেবে। যে যতটুকু চায়, ঠিক ততটুকই আরাম দিবি। নিজে থেকে হাত বাড়াস না।”
সই-মার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে মালতী। শীত শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই বউদিদের পিঠ ঘষে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। ঘাড়, পিঠ, বগলের তলার পর সাবান হাত বুলিয়ে আনতো স্তনের পাশ দিয়ে। দু-একদিনের মধ্যেই বুঝতে পারল কারোর এতে আলাদা করে কোনও অনুভূতি হচ্ছে না আবার দু-একজন ইচ্ছে করে এমনভাবে শরীরটাকে এগিয়ে দিচ্ছে যাতে মালতীর হাত আরও একটু বেশি করে স্তন ছুঁয়ে যায়। এরকম বুঝে রিয়া বউদিকেই প্রথম মালিশের প্রস্তাবটা দিয়েছিল মালতী। দাদা ওষুধের কোম্পানিতে কাজ করে। মাইনে-কড়ি ভাল। কিন্তু মাসের মধ্যে পনেরো দিন বাইরে থাকতে হয়। এককথায় রাজি হয়ে গেছিল রিয়া। প্রথম প্রথম পিঠে-পায়ে মালিশ করলেও এখন একেবারে উদোম হয়ে শুয়ে পড়ে ম্যাট্রেসে। মালিশের সময় তার শীৎকারে মালতী বুঝতে পারে সই-মার সেদিনের বলা কথাগুলো কতখানি সত্যি।
ফুল বডি ম্যাসাজ তিনশ টাকা। হাফ বডি দেড়শো। চুল আর পিঠে হট ওয়েল ম্যাসাজও দেড়শো। পেডিকিওরের টাকা বাড়ায়নি মালতী। তবে এখন আর ডাকলেই দিনের দিন যেতে পারে না সমবসময়। মলি বউদির রান্নার কাজটা ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন। বউদিদের অভিলাষায় প্রায় শ-দেড়েক ফ্ল্যাট। পাশপাশি আরও গোটা চারকে একই রকম আবাসন আছে। সবগুলোতেই মালতী এখন রীতিমত পরিচিত নাম। মোবাইল কিনেছে একখানা। সই-মাকে ভাল ডাক্তার দেখিয়ে সচল করেছে অনেকটা। মেয়েদের দেখাশোনা এখন ঠাকমাই করে। মালতী সকাল সকাল রান্না-বান্না সেরে ব্যাগ গুছিয়ে বারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। কাজের সুবিধার জন্য আজকাল সালোয়ার-কামিজই পরে। আরতি বউদি একটা পুরোনো অ্যাপ্রন দিয়েছিল, সেটাও কেচে-কুচে ব্যাগে রাখে। হাতে ঘড়ি এঁটে, ছাতা মাথায় ব্যাগ হাতে গটগট করে রাজারহাটের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে নিজেকেই কেমন যেন অচেনা লাগে মালতীর।
রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে ভারা থেকে একদিন পা পিছলে পড়ে গেছিল দিলীপ। বাঁ হাতটায় চোট লেগেছিল। ডাক্তার যদিও বলেছিল ভাঙেনি। কিন্তু হাতটা কেমন যেন কমজোরি হয়ে গেছে। আজকাল ভারায় উঠতে ভয় ভয় লাগে দিলীপের। কাজেও তেমন জুত পায় না। হাতের স্পিড কমে গেছে বলে বিরক্ত হয় সাইট ম্যানেজার। তাছাড়া ইদানীং রিয়েল এস্টেট বাজারে নাকি মন্দা যাচ্ছে। তাই কাজও কমে গেছে অনেক। মাসের মধ্যে দশ-বারো দিন তো ঘরেই বসে থাকতে হয়। তার ঘাড়ে বসে খাচ্ছে বলে উঠতে-বসতে খোঁটা দেয় মলিনা। কথায় কথায় বলে, “দু-পয়সা ঘরে আনার ক্ষ্যামতা নেই, এদিকে পিরীতের শখ ষোলআনা।”
আগে তাও ঝগড়াঝাঁটি যাই হোক রাতে বিছানায় ব্যাপারটা মিটে যেত। মলিনার চাহিদা মেটাতে অসুবিধা হত না দিলীপের। কিন্তু এখন যেন সেদিকেও কেমন ভাঁটার টান। গায়ে হাত দিলে ঝামরে ওঠে। সন্দেহ হচ্ছিল দিলীপের। কানাঘুষোয় খবর শুনেছে হাসপাতালেরই কোন দারোয়ানের সঙ্গে নাকি এখন ভালোবাসা-বাসি চলছে মলিনার। দিলীপ কাজে বেরোলে সে লোক বাড়িতেও আসে। মলিনার এমন ছেনালিপনা দেখে কদিন ধরেই মালতীর কথা মনে পড়ছিল দিলীপের। আহা, মেয়েটাকে বড্ড অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে এসেছিল সে। না খেতে পেয়ে মরেনি নিশ্চয়ই, তাহলে খবর পেত। মলিনার সঙ্গে তার আশনাইয়ের কথা শুনে কেমন ভ্যাবলা গরুর মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিল মালতী। বিশ্বাসই করতে পারছিল না, তার এতদিনে বে করা বর তাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘর করতে চলে যাবে। সে বাড়ি ফিরলে মালতীর মুখখানা কেমন খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠবে ভেবেই ভারি আত্মপ্রসাদ হচ্ছিল। রাতে একলা পেলে গলা জড়িয়ে কাঁদবে নিশ্চয়ই। তবে সে কান্না থামানোর ওষুধও তার জানা আছে। তবু মলিনার কথা ভেবে একটু ইতস্তত হচ্ছিল। বছর তিনেকের সম্পর্ক। বাঁধন ছেঁড়া অত সহজ নয়। তবে সেদিন যখন ডিউটিতে যাওয়ার সময় মলিনা বলল যে রাতে বাড়ি ফিরবে না, অফিসের লোকজনের সঙ্গে দুদিনের জন্য দিঘা বেড়াতে যাবে, তখন আর দেরি করল না দিলীপ। থাকদাড়ি বাসস্টপে নেমে ভ্যান রিকশা ধরে এসে নামল মেহেদিপাড়ার কাছে। এখান থেকে একটু হাঁটলেই তাদের ঘর। এই অঞ্চলের কিছু গরীব-গুর্বোর বাড়ি এখনও বেঁচে আছে প্রোমোটারের থাবা এড়িয়ে। সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে ডান দিকে ঘুরেই একটু অবাক হল দিলীপ। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাড়িটা। বেতের কঞ্চির বেড়া শক্ত করে বাঁধা। বিকেলের আলোয় চকচক করছে নতুন টিনের চাল। নধর কুমড়ো লতা বেয়ে উঠেছে। পিছন দিয়ে একটা বাড়তি ঘরের আভাসও যেন চোখে পড়ে। একটু অবাক হয়েই বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় দিলীপ।
“আজ বিকেলে দিলীপ এসেছিল।”
কাজ থেকে ফিরে জামাকাপড় বদলে মুড়ির বাটিটা নিয়ে বসেছিল মালতী। সই-মার কথা শুনে চমকে তাকায়!
“ওই মাগীর সঙ্গে এখন নাকি আর বনছে না। পড়ে গিয়ে হাতে চোট পেয়েছে, তাই কাজকর্মও তেমন জুটছে না বলল।”
চুপ করে তাকিয়ে আছে মালতী।
“বলছিল এবার থেকে এখানে এসেই থাকবে। বে করা বউয়ের কাছে থাকলেই নাকি আসল সুখ। তাছাড়া তোর এখনও সোমত্ত বয়স… বর ছেড়ে গেছে জানলে শ্যাল-কুকুরে পিছনে লাগবে… মেয়েদুটোও বড় হচ্ছে…..সংসারে একজন বেটাছেলে না থাকলে কি চলে!”
গলাটা শুকিয়ে গেছে। মুড়ির বাটিটা নামিয়ে রেখে এক ঢোঁক জল খায় মালতী।
“আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। বলেছি, তোর মত বেটাছেলেকে ছাড়াও আমাদের চলবে। পরের মেয়ের সঙ্গে তিন বচ্ছর মুখ শোঁকাশুঁকি করে এসে বউয়ের ভাবনা ভাবতি হবে না।”
রাত অনেক। মেয়েদুটো গভীরভাবে ঘুমোচ্ছে। সই-মার হাতের ঠেলায় চটকা ভেঙে গেল মালতীর, “উঠে আয় বউ। উদোম হয়ে এই মাটিতে মাদুরে শো।”
সই-মার পাশে উষ্ণ তেলের বাটি। তেল মাখা হাতে নিপুণ সংবাহন চলছে মালতীর শরীরে। নরম আঙুল ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে স্তনের পাশ দিয়ে, মৃদু চাপ পড়ছে স্তন্য বৃন্তে। মালতী বুঝতে পারছে তার শরীর জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। সই-মার হাত ক্রমশ নামছে নিচের দিকে। উরু, জঙ্ঘা হয়ে একসময় যোনিকে ঘিরে রচনা হচ্ছে বৃত্ত। একটু একটু করে ছোট হয়ে আসছে তার পরিধি। একসময় প্রবল আশ্লেষে শরীর কেঁপে উঠতে মালতী টের পায় সে পৌঁছে গেছে তুঙ্গ মূহূর্তে। বহু বছরের খরার পর রাগমোচনের ক্ষরণ নিঃসাড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার শরীর।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
সুন্দর গল্প, খুবই অন্য রকমের, আধুনিক ও সময়োপযোগী
কি অদ্ভুত গল্পটা ! এমন শাশুড়িও হয় না কি!
Khub bhalo laglo, besh onnorokom.
খুব খুব ভাল লাগল।এমন আধুনিক সংবেদনশীল শাশুড়িকে প্রণাম।