micro-story-sei-rikshawala

সেই রিকশাওয়ালা
দেবব্রত দাশ


পঞ্চাশ নয়… ষাট নয়… প্রায় সত্তর বছর পার হয়ে গিয়েছে, তবু ভুলতে পারিনি সেই মুখটা। এক প্রৌঢ়ের বিষণ্ণ মুখ। বিধ্বস্ত…ঘেমে নেয়ে একেবারে বিপর্যস্ত যাকে বলে! শরীরে জড়িয়ে রাখা তেলচিটে গামছা দিয়ে সে শিয়ালদা থেকে মানিকতলা পর্যন্ত মুখ আর গলায় জমতে থাকা ঘাম মুছছিল সমানে। দেখে ওই শিশুবেলার আমিও যে ভেতরে ভেতরে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলাম, সে-কথাটা আজও মনে আছে স্পষ্ট। আমার বারবার মনে হচ্ছিল, বাবা কেন ওরকম দরদাম করছে ‘দিন আনা দিন খাওয়া’- গরিব মানুষটার সঙ্গে!
আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে ট্রেনে চেপে শিয়ালদা স্টেশনে এসেছিলাম মানিকতলায় জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি যাব বলে। বাবা, মা আর আমাদের সংসারে থাকা বিধবা পিসিমাকে নিয়ে চারজন আমরা। মানিকতলায় বছরে তিন-চার বার আসতামই… মানে, আসতে বাধ্য হতাম আর কি…কারণ, বাবার রোজগারপাতি এতটাই কম ছিল যে, সচ্ছল জ্যাঠামশাইয়ের আনুকূল্য ছাড়া আমাদের জীবনধারণ সম্ভব ছিল না।
তা — শিয়ালদা-স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে সে-সময় চোখে পড়ত একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সারিসারি হাতেটানা রিকশা। বাবা তাদের হাঁকডাকে সাড়া না-দিয়ে হনহন করে হেঁটে এগিয়ে যেত দূরে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো রিকশাওয়ালাদের দিকে। কারণ, বারো আনার জায়গায় তারা ভাড়া চাইত ছ’আনা। কিন্তু সেই পয়সা দেওয়াও বাবার পক্ষে চাপের হয়ে যেত আর তাই প্রতিবার দরদাম করত বাবা, যতক্ষণ না পাঁচ আনায় রফা হত। এবার বাবা পাঁচ আনা দিতেও রাজি হল না, বলল, “চার আনা দেব…এইটুকু তো পথ…চার আনায় যদি না যাও, যেতে হবে না তোমায়…” বলতে বলতে হাঁটা দিয়েছিল বাবা। বাধ্য হয়ে সেই প্রৌঢ় রোগা লম্বাটে-মুখের রিকশাওয়ালা বলল, “চার নেহি, সাড়ে চার মাঙ্গতা হূঁ ম্যায় বাবুজী…আপ ফিকর মত করো।”
বাবা আর দরদাম না-করে রাজি হয়ে গেল এবং বাবা, মা আর পিসিমা চাপাচাপি করে কোনোক্রমে রিকশার সিট-এ বসল, আমি আধবসা হয়ে মা’র কোলে।
জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ির দরজায় ঠন করে রিকশার হাতল মাটিতে নামিয়ে রাখার মুহূর্তেই ঘটনাটা ঘটল আচমকা। প্রৌঢ় সেই রিকশাওয়ালা মুখথুবড়ে পড়ে গেল রাস্তায়।
আশপাশের পথচারীরা ছুটে এল হাঁ হাঁ করে৷ হইচই শুনে আমার জ্যাঠামশাই দরজা খুললেন এবং সবাই মিলে ধরাধরি করে রিকশাওয়ালাকে চাতালে নিয়ে গিয়ে চিত করে শুইয়ে দিল। চোখেমুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতেই চোখ খুলল মানুষটা। ভেতর থেকে জ্যাঠাইমা দ্রুত বেরিয়ে এলেন গরম দুধের গেলাস হাতে নিয়ে।
সাড়ে চার আনা নয়, সেদিন যে জ্যাঠাইমা তাঁর জমানো পুঁজির বটুয়া খুলে পুরো ষোল আনা ভাড়া দিয়ে দিয়েছিলেন রোগা লম্বাটে-মুখের সেই হতদরিদ্র মানুষটিকে, এ দৃশ্যটা আমি এত বছর পরে আজও স্পষ্ট দেখতে পাই চোখের সামনে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

5 thoughts on “micro-story-sei-rikshawala

  1. এই গল্পে লেখকের জেঠিমা নিজেই তো সবচেয়ে বড়ো টুইস্ট দিয়েছেন। এ গল্পে দারিদ্র্যকে যেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তেমনই তাকে সন্মানিতও করা হয়েছে।
    ছেলেবেলার চোখ দিয়ে লেখা হয়েছে বলে গল্পটি অন্য মাত্রা পেয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।

  2. মনকাহন মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ অনুভা। তবে, সপ্তর্ষি আর উস্রি-ম্যাডাম যা বলেছেন, সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তোমার কথাতেও যুক্তি আছে।

  3. Golpota pore monn ta chotobelar hatte tana rickshaw r chobi bhrse uthli r monee porlo borora erokom korai rickshawwalar sathe dor korten ,koto kosto kore tader dinn japoner ruto jogar korte hoto ekhono hoi kintu kojon r seta feel korte pare .golpota sotto ghotona r reflection monne hochhe,Monta bedanarto hoyeo kichuta swosti Bodh holo jethimar moto manush tokhono chilo ekhono achhe sonkhai simito holeo
    Golpoti tai Bindute sindhu

    1. শুভলক্ষ্মী, এটা 54 Amherst, Row -র কাহিনি। আমার মনে দাগ কেটে রয়ে গেছে এত বছর পরেও…রিকশাওয়ালা মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল, কিন্তু তা না ঘটলেও আমার শিশুমনকেও ভারাক্রান্ত করেছিল। বড়ো হয়ে বুঝেছি— বাবার আর্থিক অবস্থা সেসময় খুবই খারাপ ছিল। তোর মন্তব্যে আমি অভিভূত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *