onubad-pratishodh

প্রতিশোধ
মূল রচনা – ইসাবেল আইয়েন্দে গল্পের নাম UNA VENGANZA
অনুবাদ – শুক্তি রায়

Picture courtesy : Wikipedia

লেখক পরিচিতি
দক্ষিণ আমেরিকার সুদূর দক্ষিণে অবস্থিত চিলি-র লেখিকা ইসাবেল আইয়েন্দে ইয়োনা। চিলি-র জনপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান সালভাদোর আইয়েন্দের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইসাবেল। ১৯৭৩ সালে যখন জেনারেল আউগুস্তো পিনোচেত-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান হয় এবং সালভাদোর আইয়েন্দে অপসারিত হন, তখন থেকে তেরো বছর ভেনেজুয়েলাতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান ইসাবেল এবং সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সাহিত্যযাত্রা। বলা হয় স্প্যানিশ সাহিত্য জগতে সবচেয়ে বেশি পঠিত হয় ওঁর লেখা। লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু বাস্তবতা র সাহিত্য আন্দোলনের একজন উজ্জ্বল নাম ইসাবেল আইয়েন্দে। এছাড়াও ওঁর লেখায় নানা ভাবে উঠে এসেছে লাতিন আমেরিকার শাসন ব্যবস্থার অসারতার ছবি আর তার বিপ্রতীপে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা আর মানবিকতা। এই গল্পটিও সেই রকমেরই একটি গল্প।

দিনটা ছিল রোদ ঝলমল এক সোমবার। দুলসে রোসা ওরেয়্যানোর মাথায় যখন কার্নিভাল কুইনের জন্য নির্ধারিত জুঁইফুলের মুকুটটা পরানো হল, তখন অন্যান্য প্রতিযোগীদের মায়েরা ফিসফাস করছিলে যে ব্যাপারটা মোটেই ন্যায়সঙ্গত হল না। ও যে জিতবে সে তো জানা কথাই ছিল। সারা রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি সেনেটর আনসেলমো ওরেয়্যানোর একমাত্র মেয়ে বলে কথা ! লোকজন বলছিল যে এটা অনস্বীকার্য যে মেয়েটা অসাধারণ পিয়ানো বাজিয়েছে, নেচেছেও আর সকলের থেকে অনেক ভালো। কিন্তু সৌন্দর্যের নিরিখে কিন্তু ওকে একটু পিছিয়েই রাখতে হবে। সবাই দুলসে রোসাকে অপূর্ব সুন্দর অরগ্যান্ডির পোশাক পরে আর মাথায় ফুলের মুকুট সাজিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার দিকে হাসিমুখে হাত নাড়াতে দেখল এবং সেই জনতার বেশির ভাগই দাঁত কিড়মিড় করে ওকে শাপশাপান্তই করল অকারণে। তারা এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল তাদের নেতার উপর যে কয়েক মাস পর যখন সেনেটর ওরেয়্যানোর উপর নেমে এল ভয়ংকর দুর্ভাগ্যের আঘাত, তখনো তাদের অনেকেই উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। সে দিন সেনেটরের বাড়িতে যে মৃত্যুর বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিরিশ বছরের দীর্ঘ সময় লেগে গিয়েছিল তার ফসল তুলতে।

সেদিন দুলসে রোসা প্রতিযোগিতার রানী হিসেবে পুরস্কার লাভ করল, সেদিন ওই শহরের সান্তা তেরেসা টাউন হল-এ জমে উঠল এক বল ডান্সের অনুষ্ঠান। অনের দূর দূরান্তের গ্রাম এবং আধা শহর থেকে যুবকেরা এল একবার দুলসে রোসাকে চোখে দেখার অভিলাষ নিয়ে। মেয়েটা কাউকে ফেরাল না। সবার সঙ্গে সুন্দরভাবে নাচল সে একটু সময়ের জন্য হলেও। তখন আর কারোর মনে হল না যে দুলসে রোসা ওই প্রতিযোগিতার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল না। ছেলেগুলো যখন যে যার জায়গায় ফিরে গেল, তখন ওদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল দুলসে রোসার রূপের খ্যাতি। ওরা সবাই এক বাক্যে বলল যে ওই রকম সুন্দর মুখ ওরা আগে কোনো দিন দেখেনি। যারা বলে আসছিল যে রোসা ততটাও সুন্দরী নয়, তাদের কথা কানে নেওয়ার মতো আর কাউকে পাওয়া গেল না। সবার বর্ণনায় তখন ওর কলঙ্কহীন চামড়ার কথা আর ওর মাদকতাময় চোখের কথা। অপরকে দুলসে রোসার সম্পর্কে বলার সময় সবাই কিছুটা করে মিশিয়ে দিত নিজেদের কল্পনাও। কাজেই অনেক দূরের মানুষদের কাছে দুলসে রোসা হয়ে গেল এক কল্পনায় গড়া মানুষী।

একটা সময় সেনেটর ওরেয়্যানোর বাড়িতে বেড়ে উঠতে থাকা অপরূপ সুন্দরী কন্যার রূপের কথা গিয়ে পৌঁছল তাদেও সেসপেদেস-এর কানেও। তাদেও কল্পনাও করেনি যে ওর মনে কোনো আগ্রহ জন্মাবে ওই সুন্দরীর প্রতি, কারণ ওর পঁচিশ বছরের জীবনে ওর কখনো সুযোগই হয়নি এক পাতা কবিতা পড়ার বা কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবার। ওর একমাত্র ভাবনার বিষয় ছিল গৃহযুদ্ধ। যখন থেকে ও দাড়ি কামাতে শিখেছিল, তখন থেকেই ওর হাতে থাকত কোনো না কোনো অস্ত্র আর ওর নিঃশ্বাসে মিশে থাকত বারুদের গন্ধ। ওর মন থেকে মুছে গিয়েছিল মায়ের চুমু কিংবা গির্জার প্রার্থনাসঙ্গীতের স্মৃতি। লড়াই করার কোনো কারণের দরকার হত না ওর। অনেক দিন লড়াই করা হয়নি, এই যুক্তিতেই ও ওর লড়াকু সঙ্গীদের উত্তেজিত করে তুলতে সক্ষম ছিল। এমনকি যখন চারদিকের পরিবেশে শান্তি বিরাজ করত, তখনো ও আত্মগোপনকারী দস্যুর জীবনই যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। হিংস্রতাই হয়ে গিয়েছিল ওর স্বভাব। এমনটাই চলত আরো অনেক দিন যদি না অপ্রত্যাশিত ভাবেই ওর দল নির্বাচনে জয়লাভ করে শাসন ক্ষমতায় চলে আসত। এর ফলে যে মানুষটা এত দিন আইনের তোয়াক্কা করত না, তার উপরই এসে পড়ল আইন রক্ষার দায়িত্ব।

তাদেও সেসপেদেস স্থির করল যে তার শেষ অভিযান হবে সান্তা তেরেসাতে, তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং চির শত্রু সেনেটর ওরেয়্যানোকে শায়েস্তা করতে। একশো কুড়ি জন সঙ্গী নিয়ে রাতের অন্ধকারে সে ঢুকে পড়ল ওই ছোট্ট শহরটায়। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তার শত্রুকে সমূলে বিনাশ করা। ওরা সব কটা সরকারী অফিসের জানালাগুলো চুরমার করল গুলি ছুঁড়ে এবং ওদের আক্রমণের হাত থেকে গির্জাও রক্ষা পেল না। ঘোড়া ছুটিয়ে ওরা ঢুকে পড়ল একেবারে গির্জার ভেতরে, প্রার্থনা বেদীর সামনে গিয়ে থামল। ফাদার ক্লেমেন্তে ওদের ঠেকাতে গিয়ে মারা পড়লেন নির্মমভাবে। লেডিজ ক্লাবের সামনের গাছগুলো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আর আকাশ ছুঁয়ে ফেলল সেই আগুনের হলকা। চারদিকের ভয়ার্ত চিৎকারকে পিছনে ফেলে ওরা জোর কদমে ছুটে চলল পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত সেনেটর ওরেয়্যানোর বিশাল প্রাসাদের দিকে।

সেনেটর উপর থেকে দেখছিলেন সব কিছুই। আগে উনি ওঁর কিশোরী মেয়েকে তালা বন্ধ করে রাখলেন একদম কোনার একটা ঘরে। তারপর ওঁর প্রাসাদ রক্ষার জন্য রাখা এক পাল হিংস্র কুকুরকে বাইরে ছেড়ে দিয়ে অল্প কিছু বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন তাদেও আর তার দলবলের। অন্যান্য বারের মতো এবারও ওঁর আফসোস হল কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকার। অন্তত কেউ তো থাকত ওঁর পাশে বা পরবর্তী সময়ে ওঁর হয়ে প্রতিশোধ তো নিতে পারত। আজ ওঁর অসহায় মেয়ের সম্মানটুকু রাখার কী হবে সেই ভাবনায় উনি অস্থির হয়ে উঠলেন। নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত এবং জরাগ্রস্ত মনে হতে থাকল ওঁর। বাইরে তাকিয়ে উনি দেখতে পেলেন যে পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে জ্বলন্ত মশালের সারি। রাতের অন্ধকার যেন কেঁপে উঠছে ওদের পাশবিক গর্জনে। সেনেটর তার আত্মরক্ষার শেষ অস্ত্রগুলো ওঁর অনুচরদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। ওরা সবাই বুঝে গিয়েছিল যে রাত ভোর হওয়া পর্যন্তও ওরা বাঁচবে না। তাই ওরা ওদের মালিকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শপথ নিল যে যতক্ষণ ওদের শরীরে প্রাণ থাকবে, ওরা বীরের মতো লড়াই করবে।

গুলির শব্দ আরো কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। সেনেটর তখন আদেশ দিলেন, “এই রইল আমার মেয়ের ঘরের চাবি। আমাদের মধ্যে শেষ জীবিত ব্যক্তি এই চাবি দিয়ে দরজা খুলে আমার মেয়েকে মুক্তি দেবে অসম্মানের হাত থেকে।“

সেনেটরের ওই অনুগামীরা জন্ম থেকে দেখেছে দুলসে রোসাকে। মেয়েটা যখন টলোমলো পায়ে হাঁটত ওরা তখন ওকে হাত ধরে হাঁটিয়েছে, বড় করেছে কোলে পিঠে করে, শীতের বিকেলগুলোতে ওকে শুনিয়েছে ভুতের গল্প, ওরা ওর পিয়ানোর সুরে মুগ্ধ হয়েছে এবং রোসা যেদিন কার্নিভালের রানীর পুরস্কার পেল, ওরা চোখের জলে ভেসে বিরামহীন হাততালি দিয়ে গেছে। ওরা মাথা নেড়ে সেনেটরের আদেশ পালন করার প্রতিশ্রুতি দিল যাতে মানুষটা শান্তির সঙ্গে তার অবধারিত মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারে। ওদের একজনও জীবিত থাকতে তাদেও সেসপেদেস দুলসে রোসাকে জীবন্ত অবস্থায় ছুঁতে পারবে না। একটা কথা সেই সময় মাথায় আসেনি সেনেটরের আর সেটা হল ওই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের শেষে উনিই আহত অবস্থায় বেঁচে থাকবে এবং ওঁর উপরেই বর্তাবে ওঁর মেয়েকে রক্ষা করা বা মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব। ওঁর চোখের সামনে ওঁর অনুগত ভৃত্যরা এবং সঙ্গীরা একে একে প্রাণ হারাল। অবশেষে সেনেটর ওরেয়্যানো বুঝলেন যে আর লড়াই করা সম্ভব নয় ওঁর পক্ষে। ওঁর পেটে গুলি লেগেছে, ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের দৃষ্টি। তারই মধ্যে উনি অনুভব করলেন যে ওঁর বাড়ির দখল নিচ্ছে শত্রুরা। সেই অবস্থাতেই ওঁর এইটুকু খেয়াল ছিল যে ওঁর কিশোরী মেয়েটা একেবারে কোনার ঘরটায় বন্দী। কোনো মতে টলতে টলতে তিনি চললেন মেয়ের ঘরের দিকে। ওঁর পোষা হিংস্র কুকুরগুলো রক্ত, ঘাম আর বেদনার গন্ধের মধ্যেও ওঁকে চিনতে ভুল করল না। ওরা ওঁকে পথ ছেড়ে দিল। যথা জায়গা থেকে চাবি নিয়ে মেয়ের ঘরের তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন সেনেটর আনসেলমো ওরেয়্যানো। ওঁর চোখে তখন অন্ধকার নেমে আসছে তবুও উনি বুঝতে পারলেন যে ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে দুলসে রোসা। মেয়েটার পরনে ওই উৎসবের দিনের অরগ্যান্ডির পোশাক আর তার মাথায় ফুলের মুকুট।

‘এবার তো যেতে হবে, মা’, সস্নেহে বলেন সেনেটর। ওঁর পায়ের নীচে রক্তের পুকুর আর ওঁর হাতে কাঁপছে ওঁর প্রিয় রিভলভারটা।

‘আমাকে মেরো না, বাবা’, দৃঢ় গলায় দুলসে রোসা বলে, ‘আমাকে বেঁচে থাকতে দাও, যাতে আমি প্রতিশোধ নিতে পারি।’

সেনেটর ওরেইয়্যানো তাঁর পঞ্চদশী কন্যার মুখের দিকে তাকালেন অতি কষ্টে। তাদেও সেসপেদেস ওই ফুলের মতো মেয়েটার সঙ্গে কী করতে পারে, ভেবে সারা শরীর শিউরে উঠল ওঁর। কিন্তু মেয়ের স্বচ্ছ স্থির দৃষ্টি ওঁকে বলে দিল যে রোসা মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। ওর মধ্যে সেই জেদ এবং শক্তি উনি প্রত্যক্ষ করলেন যার সাহায্যে একদিন না একদিন ও তাঁর হত্যাকারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেই। উনি রিভলভারটা নামিয়ে দিলেন। দুলসে রোসা দরজার হুড়কো বন্ধ করে তার মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে কোলে নিয়ে দরজার দিকে রিভলভারটা তাক করে বসে রইল।

একটু পরেই চারদিক থেকে ধেয়ে এল ভারি বুটের শব্দ। কুকুরগুলোর মরণ আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দড়াম করে খুলে গেল দরজাটা, হুড়কোটা ছিটকে পড়ল ঘরের কোনে। সেনেটর আধো অচেতন অবস্থায় ছ রাউন্ড গুলি চালিয়ে দিলেন মেয়ের হাত থেকে রিভলভারটা নিয়ে কিন্তু সে গুলি কাউকে স্পর্শ করতে পারল না। তাদেও সেসপেদেসই প্রথম পা রাখল ওই ঘরে আর ও অবাক হয়ে দেখতে পেল যে দুধ সাদা অরগ্যান্ডির পোশাক পরা, মাথায় জুঁইফুলের মুকুট সাজানো এক স্বর্গের দূতী ঘরের মাঝখানে বসে আছে একটা রক্তে মাখামাখি মরণোন্মুখ মানুষকে কোলে নিয়ে। তার মাথা উঁচু, চোখের দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। তাদেও অবাক হওয়ার আগেই নিজের লাগামটা টেনে ধরল। মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল সে। দয়া বা করুণা এখন নির্বুদ্ধিতা। ওর রক্তের মধ্যে নেচে বেড়াচ্ছে হিংস্রতার প্রেত। ওর সাথিরা মেয়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই ও চিৎকার করে বলল, “কেউ ছোঁবে না এই মেয়েকে। ও শুধু আমার!”

সীসার মতো ভারী একটা শুক্রবারের ভোর। গোটা আকাশ যেন আগুনরঙে মাখামাখি। গোটা পাহাড় নিস্তব্ধ। আগের দিন গোটা সময়টা ঘরের মধ্যে পড়ে থেকে যন্ত্রণায় কাতরেছে দুলসে রোসা। এবার ও কোনো মতে নিজেকে টানতে টানতে নিয়ে গেল ওর বাগানের ফোয়ারাটার কাছে। দুদিন আগে জায়গাটা ভরে ছিল ম্যাগনোলিয়ার পুষ্পসম্ভারে আর আজ সর্বত্র আগুনে পোড়া কাঠ আর ভাঙা বাড়ির জঞ্জালের স্তূপ। দুলসে রোসা প্রথমে নিজের শরীরে লেগে থাকা ওর প্রিয় অরগ্যান্ডির পোশাকটার টুকরোগুলোকে সরাল আর তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আশ্রয় নিল ওর বন্ধ হয়ে থাকা ফোয়ারাটার নীচের ঠাণ্ডা জলের মধ্যে। ধীরে ধীরে সূর্য অনেকটা উপরে উঠে গেল আর মেয়েটা বসে রইল ওই লাল হয়ে ওঠা স্বচ্ছ জলের মধ্যে। ওই জলে মিশে গেল ওর নিজের দু পায়ের ফাঁক থেকে বেরোনো তাজা রক্ত আর ওর চুলে শুকিয়ে থাকা ওর মৃত বাবার রক্ত। নিজেকে পরিষ্কার এবং শান্ত করে দুলসে রোসা সোজা মাথায়, অশ্রুহীন চোখে বাড়ির মধ্যে হেঁটে গেল নিজেকে ঢাকবার মতো কিছু একটা খুঁজে নিতে। চারদিকে সব কিছু জ্বলে খাক হয়ে গেছে; তারই মধ্য থেকে ও খুঁজে বের করল একটা বিছানার চাদর। সেটা গায়ে জড়িয়ে এবার ও চলল ওর বাবার দেহাবশেষ খুঁজতে। ওরা সেনেটরের মৃতপ্রায় শরীরটাকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গেছে পাহাড় বেয়ে। কাজেই ওই শরীরের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ভালোবাসা থাকলে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে। আঁতিপাঁতি করে চারদিক খুঁজে দুলসে রোসা অভ্রান্তভাবেই আবিষ্কার করল ওর বাবার শরীরের করুণ অবশেষটুকু। রোসা ওর গায়ে জড়ানো চাদরটা খুলে ঢেকে দিল ওর বাবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীরটা। তারপর চুপ করে বসে রইল তার পাশে। সকালের সূর্য ধীরে ধীরে উঠে গেল মাথার উপর। তারপর দু এক জন করে আসতে লাগল সান্তা তেরেসা শহরের লোকজন। তখনো গোটা শহরে আতংকের ছায়া। যখন কিছু মানুষ ভয় কাটিয়ে ওরেয়্যানো ভিলাতে ঢুকল অবশেষে, তারা দুলসে রোসাকে একই ভাবে বসে থাকতে দেখল সেনেটরের মৃতদেহকে আগলে। ওরাই রোসাকে সাহায্য করল ওর বাবাকে সমাধিস্থ করতে আর বাড়িটার এখানে ওখানে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুন নেভাতে। সবাই রোসাকে বলল অন্য একটা শহরে ওর ধর্মমায়ের কাছে চলে যেতে, যেখানে কেউ জানবে না ওর কলঙ্কের কাহিনী। রোসা রাজি হল না। ওর জেদ যে ওইখানেই থাকবে। তখন শহরের লোকেরা মিলে ভিলাটাকে মেরামত করে দিল এবং ছটা কুকুরের ব্যবস্থা করে দিল রোসাকে রক্ষা করার জন্য।

যে মুহূর্তে তাদেও সেসপেদেস-এর বাহিনী সেনেটরকে টানতে টানতে নিয়ে গেল এবং তাদেও নিজের বেল্টটা খুলে ফেলল, সেই মুহূর্ত থেকে রোসার কাছে বেঁচে থাকার একটাই উদ্দেশ্য হয়ে উঠল প্রতিশোধ নেওয়া। ধীরে ধীরে কেটে গেল তিরিশটা বছর। রোসার কাছে স্মৃতির ঢেউ নিয়ে আসত ওর নিদ্রাহীন রাতগুলো আর অকারণ বয়ে যাওয়া দিনগুলো। তা সত্বেও রোসা যে সব সময় বিষণ্ণ বা গোমড়া হয়ে থাকত, তা কিন্তু নয়। ওর হাসি, ওর রূপ এবং ওর ব্যক্তিত্বের খ্যাতি ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল দূর থেকে দূরে। অন্যদের কল্পনার সঙ্গে ওর বাস্তব সৌন্দর্য মিলে মিশে ওকে করে তুলল এক জীবন্ত রূপকথা। ভোর চারটেয় উঠে ও নিজের বাড়ি সংলগ্ন খামার বাড়ি আর চাষবাস দেখত, গৃহস্থালির কাজকর্ম সারত নিজের মনে, ঘোড়ার চড়ে তদারক করত নিজের সম্পত্তির, দরদাম করে কেনাবেচা করত সামনে দাঁড়িয়ে, গৃহপালিত জন্তুগুলোর খোঁজ খবর রাখত ঠিক ভাবে আর অতি যত্নে বাগানে ফোটাত ম্যাগনোলিয়া আর জুঁই ফুল। বিকেল বেলায় ও জামা জুতো খুলে রেখে রাজধানী থেকে সুরভিত ট্রাংকে করে নিয়ে আসা সুন্দর পোশাক পরত আর পায়চারি করত বাগানে। সন্ধ্যার পর কেউ দেখা করতে এলে দেখতে পেত যে ও তন্ময় হয়ে সুর তুলছে পিয়ানোতে। ওর কাজের লোকেরা অতি সুস্বাদু মিষ্টি আর চমৎকার সুরা পরিবেশন করত অভ্যাগতদের। সবাই ভাবত কোন ধাতুতে গড়া এই মেয়ে ? এটা কেমন করে সম্ভব হল যে এত কিছুর পর মেয়েটা মানসিক সন্তুলন হারিয়ে পাগলা গারদে চলে গেল না, বা নিজেকে নিবেদন করে দিল না কোনো সন্ন্যাসিনীদের মঠে ? ওরেয়্যানো ভিলাতে মাঝে মাঝেই পান ভোজনের পার্টি হত নানা উপলক্ষ্যে আর উপস্থিত লোকজন মুগ্ধ হয়ে যেত দুলসে রোসার রূপে গুণে। ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে মুছে গেল সেনেটরের ওই ভয়ংকর মৃত্যু এবং দুলসে রোসার ধর্ষিত হওয়ার করুণ ইতিহাস। বেশ কিছু উচ্চবংশীয় ধনী মানুষ রোসা ধর্ষিতা হয়েছিল জেনেও তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল। রোসা কখনোই কারোর প্রস্তাবে সম্মত হওয়া দূরে থাক, তা নিয়ে ভাবনা চিন্তাও করেনি কারণ পৃথিবীতে ওর বেঁচে থাকার একটাই হেতু ছিল এবং তা ছিল প্রতিশোধ।

তাদেও সেসপেদেসও নিজের মন থেকে কখনো সরাতে পারেনি ওই রাতটার স্মৃতি। সান্তা তেরেসা থেকে রাজধানীর পথে যাওয়ার সময়ই ওর মন থেকে মুছে গিয়েছিল ওই হত্যালীলার উত্তেজনা আর অমন সুন্দরী একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার তূরীয় পুলক। শত্রুকে শায়েস্তা করার, নির্মূল করার কোনো আনন্দই সে আর খুঁজে পাচ্ছিল না। ওর মনে শুধু ভেসে উঠছিল সুন্দর সাদা পোশাকে আর জুঁই ফুলের মুকুটে সজ্জিত একটা নিষ্পাপ কিশোরীর চোখ দুটো। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করেনি, ওকে নষ্ট না করার জন্য মিনতি করেনি তাদেওকে। ওই বারুদের গন্ধে দম আটকানো ঘরে ও নীরবে সহ্য করে গেছে তাদেও অত্যাচার। তাদেওর বার বার মনে পড়তে থাকে ওই শেষ দৃশ্যটা যেখানে মেয়েটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, কোনো মতে একটা কম্বল টেনে নিয়ে নিজেকে ঢাকার ক্ষীণ চেষ্টা করতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছে চেতনা হারানোর সকরুণ আলিঙ্গনের মধ্যে। সেভাবেই যেন সে প্রতি রাতে ফিরে আসত তাদেওর স্মৃতিতে। পরিস্থিতি এখন শান্ত, তাদেও নিজেকে সুশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে, রাজনীতিক হিসেবে তার সততা এবং পরিশ্রম তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে সময়ের সঙ্গে। মানুষের মন থেকে মুছে গেছে গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি। লোকের মুখে মুখে তাদেও সেসপেদেস হয়ে গেছে দোন তাদেও। একটা পাহাড়ের ঢালে বিশাল চাষের জমি আর চারণ ভূমি কিনেছে তাদেও। ধীরে ধীরে পদোন্নতি হতে হতে আজ সে মেয়রের কুর্সিতে আসীন। যদি ওর জীবন জুড়ে দুলসে রোসার ছায়া না থাকত, তবে হয়তো নিজের জীবন নিয়ে দিব্যি সুখী হতে পারত সে। কিন্তু তাদেও ধারে কাছে যে নারীই আসে, তার মধ্যেই সে দেখতে পায় সেই কার্নিভাল কুইন দুলসে রোসাকে। পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে ওঠে যখন আধুনিক কবি এবং গীতিকারদের লেখাতে উচ্চারিত হয় ওর নাম (দুলসে রোসা র শাব্দিক অর্থ মিষ্টি গোলাপ) আর তাদেওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ওই একটা রাতের স্মৃতি। ওই কিশোরীর চেহারাটা যেন ওকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে দিন থেকে রাতে, বছর থেকে বছরে, শহর থেকে শহরে। অবশেষ একদিন সব কিছু তাদেওর সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল। একটা পার্টিতে ওর পঞ্চান্নতম জন্মদিন উদযাপিত হচ্ছিল সেদিন। তাদেও দেখতে পেল যে লম্বা টেবিলটার উপর পেতে রাখা দুধ সাদা টেবিল ক্লথের উপর নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে আর তার চারদিকে ছড়িয়ে আছে জুঁই ফুলের কুঁড়ি। তাদেও বুঝতে পারল যে ওই দুঃস্বপ্ন ওকে আমৃত্যু তাড়া করে বেড়াবে, কখনো শান্তি পেতে দেবে না ওকে। প্রচণ্ড জোরে টেবিলের উপর ঘুষি মারে তাদেও। ঝনঝন করে ওঠে খাবারের প্লেটগুলো। নিজের ছড়ি আর টুপিটা নিয়ে তাদেও রওনা দেয়।

‘কোথায় যাচ্ছেন দোন তাদেও ?’ গৃহকর্তা ব্যস্ত হয়ে জানতে চান।

‘পুরোনো একটা জখম মেরামত করতে’, তাদেও বলে এবং কারো কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই সে ওই অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যায়।

দুলসে রোসাকে খোঁজার কোনো দরকার ছিল না কারণ আর সকলের মতো তাদেও নিজেও জানত যে রোসা ওই অভিশপ্ত বাড়িটাতেই থাকে গত তিরিশ বছর ধরে। সেই দিকেই নিজের গাড়ি ছোটাল তাদেও। ততদিনে সরকার ভালো রাস্তা তৈরি করেছে এবং রাজধানীর সঙ্গে দূরত্ব অনেক কমে গেছে সান্তা তেরেসার। প্রকৃতির দৃশ্যও পালটে গেছে অনেকখানি কিন্তু পাহাড়ে ওঠার পর শেষ বাঁকটা নিয়ে তাদেও দেখল সেই ভিলাটা আর ওর মনে পড়ল সেই সময়ের কথা যখন ওর দলবল ওটার উপর আক্রমণ করেছিল। নদীর বুক থেকে তোলা পাথর দিয়ে তৈরি দেওয়াল ওরা ভেঙে ফেলেছিল ডায়নামাইট ফাটিয়ে, বিশাল বিশাল কাঠের ফটক ধ্বংস করেছিল আগুন লাগিয়ে, বড় বড় গাছগুলোর সঙ্গে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছিল সেনেটরের অনুগামীদের, ফটক পেরিয়ে উঠোনে ঢুকে মেরে ফেলেছিল কুকুরগুলোকে। দরজা থেকে একশো মিটার দূরে তাদেও পার্ক করল তার গাড়িটাকে। তারপর যেন তা পা দুটো চলতে চাইছিল না আর ওর মনে হচ্ছিল যে ওর হৃদপিণ্ডটা যেন দুম করে ফেটে যাবে। ও ফিরে যাবে বলেই পা বাড়িয়েছিল কিন্তু ওর চোখের সামনে উঠোনে নেমে এল এক অতুলনীয়া নারী। তার চামড়া থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল। তাদেও ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল এবং একান্তভাবে কামনা করতে লাগল যে রোসা ওকে চিনতে না পারে। সন্ধ্যার নরম আলোয় তাদেওর মনে হচ্ছিল যে বাগানটার পথ ধরে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ওর দিকে এগিয়ে আসছে দুলসে রোসা ওরেয়্যানো। ওর চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল রোসার চুল, ওর সরল মুখশ্রী, ওর কোমল অভিব্যক্তি, ওর পোশাকের কাঁপন আর তাদেওর মনে হচ্ছিল যেন তিরিশ বছর ধরে ওর মনের মধ্যে আধো ঘুমন্ত একটা স্বপ্ন হঠাৎ জেগে উঠেছে আর সে নিজে মিশে যাচ্ছে ওই স্বপ্নটার মধ্যে।

‘তাহলে… তুমি আবার এলে তাদেও সেসপেদেস !’ রোসা বলে। রোসা জানে যে লোকটার পরনের মেয়রের পোশাক বা তার মাথা ভর্তি সাদা চুল দেখে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। ওর হাতদুটো এখনো ওই দস্যুরই হাত।

‘তুমি আমায় বাধ্য করলে আসতে। এতটা বয়স হয়ে গেল আমার কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারলাম না আমি’, তাদেওর গলা যেন লজ্জায় ডুবে যেতে থাকে।

একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে দুলসে রোসা। অবশেষ ওর সুযোগ এসেছে। কিন্তু যখন রোসা তাদেওর চোখের দিকে তাকাল তখন ওই চোখে কোনো নিষ্ঠুর খুনিকে ও দেখতে পেল না। লোকটার চোখ দুটো ভেসে যাচ্ছে অঝোর অশ্রুতে। নিজের মন খুঁড়ে ও বের করে আনতে চাইল তিরিশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা ঘৃণা কিন্তু সেই ঘৃণা হঠাৎ অন্তর্হিত ! ও মনে করার চেষ্টা করল সেই মুহূর্তটাকে, যখন ও ওর বাবার কাছে নিজের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল প্রতিশোধ নেবে বলে। এতদিন তো ও বেঁচে আছে শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। ও মনে করার চেষ্টা করল ওর বাবার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মৃতদেহ যেটাকে ও নিজের শরীর ঢাকা চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল সেই রক্তাক্ত সকালটায়। ও মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে লোকটার নোংরা স্পর্শ যে স্মৃতি বার বার উসকে দিয়েছে ওর ঘৃণার আগুনকে, প্রতিশোধস্পৃহাকে। এবার ওর সামনে এসে উপস্থিত প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ কিন্তু সেই সুযোগ পেয়ে এক বিন্দুও আনন্দ হল না দুলসে রোসার, বরং ওর মন ভরে উঠল এক গভীর বেদনায়। তাদেও সেসপেদেস ধীরে ধীরে স্পর্শ করল রোসার হাতখানা এবং সেটা ভিজে গেল তার অনুতাপের চোখের জলে। সেই মুহূর্তে থরথর করে কেঁপে উঠল রোসার বুকের ভিতরটা কারণ ও নির্ভুলভাবে বুঝতে পারল যে এতদিন যে প্রতিশোধের পরিকল্পনা ও করছিল, তা আজ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে। ওর মন এখন একেবারে বিপরীত স্রোতে ভেসে গেছে। নিজের অজান্তেই ও ভালোবেসে ফেলেছে ওর শত্রুকে।

পরের কয়েকটা দিন ধরে ওরা দুজনেই চাপা পড়া অতীতের সমস্ত আগল খুলে কথা বলে চলে। ওরা দুজনেই বুঝতে পারে যে ওরা এক নিষ্ঠুর দুর্ভাগ্যের শিকার। ওরা হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াত বাগানে। অকপটে নিজেদের সব কিছু উজাড় করে দিত একে অপরের কাছে এমনকি সেই যন্ত্রণাময় রাতের কথাও আসত ওদের কথোপকথনে যে রাতটা তছনছ করে দিয়েছিল ওদের দুজনেরই জীবন। সন্ধ্যা নামলে রোসা পিয়ানো বাজাত আর তার পাশে বসে সিগারেট খেত তাদেও। এইভাবে ওদের দুজনের মন থেকেই দ্রুত মুছে যেতে থাকল অতীতের সব ক্ষত চিহ্ন এবং শীতের রাতের একটা উষ্ণ কম্বলের মতো সুখের অনুভব জড়িয়ে ধরতে লাগল ওদের অস্তিত্বকে। তাদেও সান্তা তেরেসায় ঘুরে ফিরে বেড়াল কয়েকদিন এবং আবিষ্কার করল যে তিরিশ বছর আগের ওই ভয়ংকর ঘটনা এখন আর মনে নেই কারোর। ওখানকার সবচেয়ে ভালো হোটেলে তাদেও তার আর দুলসে রোসার বিয়ের আয়োজন করল। ও আবিষ্কার করল যে বয়সে ওর সমবয়সীরা ভালোবাসার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সেই বয়সে এসে প্রেমের অনুভব ওর মনকে তারুণ্যের সতেজতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। তাদেওর ইচ্ছে করত দুলসে রোসাকে উপহারে আর ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতে। অর্থ দিয়ে যা কিছু কেনা যায়, তার সবটাই উজাড় করে দিতে ওকে। যেভাবেই হোক, ও চাইত যে নিজের কম বয়সের হিংস্রতায় উন্মাদ হয়ে ও যা দুষ্কর্ম করে ফেলেছে, বাকি জীবনটা দিয়ে তার ক্ষতি পূরণ করতে। এক এক সময় যেন আতংকে অস্থির হয়ে যেত তাদেও। ওর চোখ রোসার মুখে খুঁজে বেড়াত কণামাত্র অসন্তুষ্টির রেখা কিন্তু সে রেখা কখনোই ওর চোখে পড়তে না। দুলসে রোসার সুন্দর মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে থাকত পরিপূর্ণ ভালোবাসার আলোতে। তাদেও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেত তাই দেখে। এইভাবে কেটে গেল আনন্দময় একটা মাস।

বিয়ের আর মাত্র দুটো দিন বাকি। ওরেয়্যানো ভিলার বাগানে অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন চলছে পুরো দমে। পাখি আর শুয়োর মেরে মাংস প্রস্তুত হচ্ছে। ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে গোটা ভিলা। এমন সময় দর্জিবাড়ি থেকে এল দুলসে রোসার বিয়ের পোশাক। রোসা পোশাকটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়াল ঠিক সেই ভাবে যে ভাবে ও কার্নিভালে যাওয়ার পোশাকটা পরে দাঁড়িয়েছিল বহু বছর আগে। নিজেকে আয়নায় দেখে যে ভিতরটা ভেঙেচুরে যেতে লাগল রোসার। ওর পক্ষে তো আর সম্ভব নয় প্রতিশোধ নেওয়া। ও নিজের মন প্রাণ সমর্পণ করে ফেলেছে ওর ধর্ষক এবং ওর বাবার হত্যাকারীকে। এবার কী হবে ? কোন মুখে রোসা দাঁড়াবে ওর বাবার অতৃপ্ত আত্মার সামনে? দর্জি বৌকে বাড়ি পাঠিয়ে বিয়ের পোশাকটা পরে হাতে একখানা ধারালো কাঁচি নিয়ে রোসা ঢুকে গেল সেই কোনার ঘরটায় যেখানে ওর জীবন নাটকের এই পর্যায়টা শুরু হয়েছিল তিরিশ বছর আগে।

তাদেও সেসপেসেস গোটা বাড়িময় খুঁজে বেড়াচ্ছে দুলসে রোসাকে। পাগলের মতো ডাকছে রোসার নাম ধরে। কুকুরগুলো তাদেওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ভিতর থেকে হুড়কো দেওয়া সেই অতি পরিচিত ঘরটার সামনে। বার বার রোসাকে ডাকার পরও যখন কোনো সাড়া মিলল না, তখন মালিদের ডাকাডাকি করে ভাঙা হল সেই ঘরটার দরজা যেখানে তিরিশ বছর আগে তাদেওর সামনে বসে ছিল জুঁই ফুলের মুকুট পরা এক স্বর্গের পরী। এখন সেই দুলসে রোসাকে আবার দেখল তাদেও ঠিক যেভাবে সে প্রতিদিন হানা দিত তার স্বপ্নের মধ্যে। চাপ চাপ রক্তের মধ্যে নিথর হয়ে পড়ে আছে রোসা। পরনে তার বাহারি অরগ্যান্ডির সাদা পোশাক যার এখানে ওখানে লেগে আছে রক্তের ছোপ। তাদেও বুঝতে পারল যে তার পাপের মাশুল দিতে এখন ওকে বেঁচে থাকতে হবে নব্বই বছর পর্যন্ত। ওর স্মৃতি জুড়ে থাকবে সেই একমাত্র নারী যাকে সে ভালোবাসতে পেরেছিল।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “onubad-pratishodh

  1. ইসাবেল আইয়েন্দার লেখা গল্প “প্রতিশোধ” -এর অনুবাদ করেছেন শুক্তি রায় । মূল গল্পটি যেমন অসাধারণ, তেমনই সুন্দর সাবলীল অনুবাদ । অনূদিত গল্পটিও যে আমাকে এভাবে মোহিত করে দিতে পারে, আমি পড়া শুরুর আগে বুঝতেই পারিনি ! অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই “অপার বাংলা”-কে এবং শুক্তি রায়কে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *