দেবব্রত দাশ
আমহার্স্ট রো থেকে বেরিয়ে লোহাপট্টির ভিতর দিয়ে হেঁটে যখন সৌরভ আমহার্স্ট স্ট্রিটে পৌঁছোল, ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল এসপ্ল্যানেড-গামী বাস এবং তক্ষুনি হুড়মুড় করে এক দঙ্গল প্যাসেঞ্জার নেমে এল রাস্তায়। নেমেই তারা সবাই একজন মাঝবয়সি লোককে ঘিরে ধরে মারতে শুরু করে দিল। অঝোর ধারায় বর্ষিত হতে থাকে কিল, চড়, ঘুষি, লাথি, থাপ্পড়। সৌরভ অবাক হয়ে দেখল, লোকটা মুহূর্তে তার নিজের নাকমুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে উবু হয়ে বসে পড়ল রাস্তায় ।
কিছু পথচলতি মানুষজনও পরম উৎসাহে যোগ দিল মারকুটে প্যাসেঞ্জারদের দলে। কেন — কী কারণে এই মারধোর? — জানার প্রয়োজনই বোধ করল না তারা। বেশিক্ষণ নয়, তিন চার মিনিটের মধ্যেই রাস্তায় বসে পড়া লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল, ঠিক যেন হঠাৎ আছড়ে পড়া ঝড়ের সাথে একপশলা শিলাবৃষ্টি!
এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি সৌরভ। কল্লোলিনী কলকাতার কিছুসংখ্যক হিংস্র মানুষকে এইমাত্র দেখল সে। এবার সৌরভ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আহত হতভাগ্য মানুষটার সামনে। ততক্ষণে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে বেচারি।
এই ঘটনার কারণ জানতে না-চেয়ে সৌরভ মোলায়েম কণ্ঠে বলল, “আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”
“আমার সঙ্গে!” লোকটা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমতা আমতা করতে থাকে, “কী কথা…মানে…আমি তো…!”
“আপনাকে আমি এই মুহূর্তে হাজার পাঁচেক টাকা দিতে চাই। এজন্যেই চাই যে, আপনি এই টাকা দিয়ে কলকাতার ফুটপাথে আপনার সুবিধেমতো কিছু বিক্রিবাটার ব্যবস্থা করে উপার্জন শুরু করবেন এখন থেকে। পরে আমি আপনার আরও পুঁজির ব্যবস্থা করে দেব। আমার এই কার্ডটা রাখুন, এতে আমার নাম, ফোন নাম্বার আর ঠিকানা লেখা আছে।”
লোকটা এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে, কিছুসময় তার মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোল না।
সৌরভের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে সৌরভ জিজ্ঞেস করল, “করবেন তো ছোটোখাটো যা হোক কিছু…? আচ্ছা, থাকেন কোথায় আপনি?”
জোড়া প্রশ্ন হজম করে লোকটা জবাব দিল, “আমি থাকি পাইকপাড়ায় খেলাতবাবু লেনের কাছের এক বস্তিতে। কিন্তু স্যার, টাকা আমি নেব না ।”
“কেন? — অসুবিধে কোথায়?”
দুঃখের হাসি হেসে সে বলল, “যদি অনেক আগে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হত, তাহলে আমার জীবনটা অন্যরকম হলেও হতে পারত, কিন্তু আমি নিরুপায়…”
“ঠিক বুঝলাম না— কী বলতে চাইছেন আপনি!”
“আসলে, কী জানেন স্যার — এ লাইন থেকে এখন আমি চাইলেও আর বেরিয়ে আসতে পারব না । দল যদিবা বেরোতে দেয়, পুলিশ কিন্তু আমাকে তিষ্ঠাতে দেবে না। ওদের খাতায় যে আমার নাম লেখা হয়ে গেছে পাকাপাকিভাবে। আপনি এভাবে যেচে আমার উপকার করতে চাইছেন বলে আপনাকে আমি শতকোটি প্রণাম জানাচ্ছি। এমন মারধোর আমাদেরকে খেতে হয় মাঝেমধ্যে আর বাকি জীবনটাও চলবে এভাবেই। চলি স্যার…” বলতে বলতে বাঁহাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্ত মুছে নিয়ে মুহূর্তে জনারণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভালো লাগলো। বাস্তবের ছোঁয়ালাগা অণুগল্প।
ধন্যবাদ মহুয়া। তুমি আমার এই অণুগল্পের প্রথম পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানালে।
একেবারে বাস্তব ঘটনা চোখের সামনে ঘটে গেল। বুঝতেই পারিনি যে আমি একটা অণুগল্প পড়লাম। এতটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। লেখকের লেখনীর স্বাবলীলতার প্রশংসা করতেই হবে।
মন্তব্যের জন্যে তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ দীপঙ্কর ।
জীবন জীবিকার কষ্টকর দিকটা তুলে ধরেছে এই ছোটো গল্প, সেইসঙ্গে এটাও দেখিয়েছে পৃথিবীতে এখনও ‘মানুষ’ টিঁকে আছে, যেটা আশার কথা। বেশ ভাল লাগল অনুগল্পটি।