সুপ্রিয় চৌধুরী
‘শারদ প্রাতে আমার রাত পোহালো’। ভোর ছটা পনেরো। প্রিমিয়াম সিরিজ অ্যাপেল আইফোনটার অ্যালার্ম টোনে ঘুম ভাঙল অরিত্রর। ছেলেবেলা থেকেই সাগর সেনের গলায় এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা খুব প্রিয় ওর। তাই মাসকয়েক আগে যখন হাত আর পায়ের পাতায় কিরকম একটা ঝিমঝিম করতে শুরু করল, সঙ্গে সামান্য দুর্বলতা আর থেকে থেকে মাথাটা হাল্কা চক্কর দিতে লাগল, কলকাতার নামী ক্লিনিকের দেড় হাজারি ফিজওয়ালা মেডিসিনের ডাক্তার বেশ কয়েকটা টেস্ট করতে দিলেন, রক্তে উচ্চচাপ সহ চড়ামাত্রায় চিনি ধরা পড়লো এবং ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত বেশ কয়েকটা ওষুধ খাওয়া এবং সকালে হাঁটাহাঁটি শুরু করতে হল তখন অ্যালার্ম কল হিসেবে এই গানটাকে বেছে নিতে একমুহূর্তও লাগেনি অরিত্রর। বারোশো স্কোয়ার ফিটের নিউ গড়িয়ার এই ঝাঁ চকচকে ফারনিশড পূব-দক্ষিণ খোলা আটতলার ফ্ল্যাটটার জানলা দিয়ে এইমুহূর্তে ভোরের হাল্কা রোদ এসে পড়েছে মুখে। গায়ের থেকে পাতলা চাদরটা সরিয়ে বিছানায় উঠে বসলো অরিত্র। হাত দুদিকে ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল আয়েশ করে, তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়াল পূবের ব্যালকনিতে। অক্টোবরের প্রায় শেষ। পুজো গেছে মাত্র কদিন আগে। ভোরবেলার বাতাসে এখনই কেমন একটা শিরশিরেনি ভাব। সাতসকালের এই মিঠে রোদটা বেশ আরাম দেয় শরীরে।
ব্যালকনির রেলিঙে হাত রেখে উদাসচোখে সামনে তাকিয়ে ছিল অরিত্র। সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বড়সড়, প্রায় একরদশেক একটা ফাঁকা জমি। চার ফুটের বাউন্ডারি ঘেরা চারপাশে। এখনও ফ্ল্যাট ওঠেনি । ভাঙাচোরা বাতিল ইটের ঝামার টুকরো, ঝরে যাওয়া কাশ আর আগাছার ঝোপ জায়গাটা জুড়ে। জমি ছাড়িয়ে পিছনে বিশাল একটা ঝিল। ঝিলের পিছনে প্রথম সকালের তাজা, সদ্য ফোটা সূর্য। দুপুরের কড়া জ্বালানো পোড়ানো ভাবটা এখনো ফুটে ওঠেনি শরীরে। তার আপাতনরম শরীরটাকে তিন চারভাগে কেটে কেটে মাঝেমাঝেই উড়ে যাচ্ছে বকের সারি। শীতকালে দু’চার ঝাঁক পরিযায়ী হাঁস। বসন্তে বসন্তবৌরি, খঞ্জন, কোকিল। ঝিলের ধারে বড় বড় গাছগুলোয় সারাদিন তাদের ডাকাডাকি আর পাঁচপাঁচালি ব্যস্ততা। প্রোমোটারের নজর এড়িয়ে এখনও এত সবকিছু কিভাবে বেঁচে আছে ইশ্বরই জানেন। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে অরিত্র। ঝিলের ওপারে অনেক দূরে একগাদা একতলা-দোতলা বসতবাড়ির পিছনে একটা কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছে ভোরের আকাশ ঠেলে। দেখলেই ঠিক ওই চিমনির ধোঁয়াটার মতই বুকের মধ্যে পাক মেরে ওঠা কত কত স্মৃতি! গঙ্গার পাড় ঘেঁষা ওরকমই একটা চটকলে কাজ করত বাবা। তবে মিস্ত্রি নয়, টাইপিস্ট। প্রায়ই লক-আউট হত কারখানা। সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের নোটিশ ঝুলতো ফ্যাকটরির গেটে। সন্ধেবেলা বিষণ্ণমুখে বাবা বাড়ি ফিরলে সবাই বুঝে ফেলত আজ কোম্পানির গেটে তালা ঝুলেছে। অন্যদিকে মা। সর্বংসহা ধরিত্রীর একটা জীবন্ত প্রতিমূর্তি যেন। হাজার দুঃখকষ্ট আর শোকতাপেও ঠোঁটের কোণে মৃদু একটা হাসি। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে এমনভাবে রাতের বেলা উনুনে হাঁড়ি চড়াত মফস্বল শহরের বারো ঘরের বস্তির একমাত্র এজমালি উঠোনে, গুঁড়িকচুর পাতবাটা বা অল্প তেলের ফোড়নে ঘ্যাঁটকোল শাকের সব অমৃতপদ। মার মুখ দেখে মনে হত কিছুই যেন ঘটেনি। অন্তত এরকমটাই মনে হত অরিত্রর।
এরকমভাবে চলতে চলতে একদিন পাকাপাকিভাবে বন্ধই হয়ে গেল কারখানা। গেটের মুখে লাল শালু টাঙিয়ে অনেকদিন বসে রইল শ্রমিকরা। বড় বড় নেতারা এলেন। চোঙা টাঙিয়ে বক্তৃতা হল। কিন্তু কারখানা আর খুলল না। বসে থেকে থেকে হতাশ হয়ে এদিক ওদিক বিকল্প জীবিকার খোঁজে পা বাড়ালো চাকরি খোয়ানো মজদুররা। এলাকায় পার্টির নেতাদের ধরেকয়ে কোর্ট চত্বরের বটতলায় ভাঙা টাইপমেশিনটা নিয়ে বসে পড়লো বাবা। অরিত্র তখন স্কুল টপকে সবে ফার্স্ট ইয়ার।
একদিন বিকেলবেলা। কলেজ থেকে সবে বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে দাওয়ায় বসেছে। হাতে হাতে মার তুলে দেয়া মুড়ি বাতাসার বাটি। ঠিক এই সময় ছেলেবেলার বন্ধু দিলীপ, একই পাড়ার ছেলে, ছুটতে ছুটতে এল বাড়িতে। “জলদি চল! মেশোমশাই…” বললো বেদম হাঁফাতে হাঁফাতে। শোনামাত্র দিলীপের সঙ্গে পড়ি কি মরি দৌড় বটতলার উদ্দেশ্যে। বটতলা চত্বরে বড়সড় একটা জটলা। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখা গেল চেয়ারের বাঁদিকে এককাত হয়ে হেলে রয়েছে বাবা। আধখোলা দুটো চোখ। ঠোঁটের কষে গ্যাঁজলা গড়িয়ে নামছে। ‘ম্যাসিভ কারডিয়াক ফেইলইয়োর’ – ডেথ সার্টিফিকেটে এরকমই একটা কিছু লিখেছিল জেলা হাসপাতালের ডাক্তার।
হা-অন্ন, দে-অন্ন পরিবারে দিদির বিয়ে দেবার সামর্থ্য বাবার ছিলনা। সেই দিদি এক রাতে পালিয়ে গেল পাড়ার এক হিন্দুস্তানী ড্রাইভারের সঙ্গে। বাবার মৃত্যুর মাসখানেক কাটতে না কাটতে। স্রেফ ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে। আজও সব মনে আছে স্পষ্ট। ঠিক ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মত। ভাইফোঁটার দিন। সেদিন কারখানা ছুটি করেছে বাবা। মেঝেয় পাতা মার হাতে বোনা আসন। তার ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসা ছোট্ট অরিত্র। সামনে রাখা চন্দন বাটার পাত্র, ধূপদানি, মোমবাতি, ছোট পেতলের থালায় সস্তার দোকানের গোটাকয়েক সন্দেশ, সিঙ্গাড়া, দরবেশ, খাস্তা কচুরি। সামনে উবু হয়ে বসা দিদি। কড়ে আঙুলের ডগায় মাখানো চন্দনবাটা। ছোট ভাইয়ের কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে মন্ত্র পড়ছে একমনে, “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা / যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা / যমুনা দেয় যমেরে ফোঁটা / আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।” পিছন থেকে মার সহাস্য মৃদু ধমক, “পস্টো করে মন্তর পড় মুখপুড়ি, তবেই তো ভাইয়ের পরমায়ু বাড়বে।” খাটে পা তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসে মিটিমিটি হাসছে বাবা। সবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! উপহারের পালা। রঙিন ছবিওয়ালা মলাটে বাঁধানো চটি বইগুলো। ‘ব্ল্যাক অ্যারো’, ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, ‘রবিনসন ক্রুসো’ কিম্বা ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ সেইলার সিন্দাবাদ’। ছোট ভাইটার হাতে তুলে দিচ্ছে দু’বছরের বড় দিদি। বই বলতে একেবারে পাগল ভাইটা। “অ্যাই হতভাগা! দিদিকে পেন্নাম কর।” পেছন থেকে ফের ধমক লাগাচ্ছে মা। “না করবো না”, “ও আবার দিদি নাকি”, “মোটে তো দু’বছরের বড়” এ জাতীয় সব ওজরআপত্তি বাণের মুখে খড়কুটোর মত ভেসে যাচ্ছে মায়ের চোখ পাকানো আর ধমকের সামনে। ঘাড়মুখ গোঁজ করে কোনমতে সেরেই ফেলতে হচ্ছে পেন্নামটা। বিছানায় বসে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে বাবা।
বাবার মৃত্যু, দিদির এভাবে চলে যাওয়া, এত সব ঘটনার ধাক্কাটা বদ্ধ উন্মাদ করে দিয়েছিল মাকে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত সারাদিন। কঙ্কালসার চেহারা। গায়ে একপুরু ময়লা। জটপড়া চুল। দু’চোখ ভর্তি পিচুটি। শতছিন্ন নোংরা শাড়ী। নাওয়াখাওয়ার হুঁশতালটুকু পর্যন্ত নেই। ধরে বেঁধে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হত বাড়িতে। অতঃপর একদিন ভোরবেলা চটকলের পুকুরের জলে ভেসে উঠেছিল মার লাশটা। জল খেয়ে ফুলে ঢোল। পাড়ার লোকজন চাঁদা তুলে সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল। বস্তির ওই অন্ধকার খুপড়ি ঘরটায় হঠাৎ করেই একদম একা হয়ে গেছিল অরিত্র।
সেই কবেকার কথা! ভারি বিষণ্ণ হাসিটা এই এতদিন বাদেও লেগে রয়েছে এই মুহূর্তে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা অরিত্রর ঠোঁটের কোণে। তারপর তো সেই পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়ার নাছোড় লড়াই, ফি বছর এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড রিনিউ, ধোপার বাড়ির রেস্ত নেই, পুরোন জামাপ্যান্ট এক টাকার পাউচে কেচে বালিশের তলায় পাট করে ইন্টারভিউ দিতে দৌড়নো… সে এক প্রাণপাত লম্বা দৌড়।
কাঁচের সাইডডোরটা ঠেলে ঘরে ঢুকে এল অরিত্র। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে ব্রাশ করে মুখটুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। কাজের মাসি আসেনি এখনো। দরজা ঠেলে উঁকি মারলো ঘরে। বিছানায় ঘুমে অচেতন ঝুমা আর জিকো। আজ রোববার। ছুটি। নইলে আর আধঘন্টার মধ্যে জিকোর ইন্টারন্যাশনাল পাব্লিক স্কুলের বাসটা এসে পড়ে। জিকোকে তৈরি করার তাড়ায় ঝুমাও উঠে পড়ে। প্রিয় ফুটবলারের নামে ছেলের নাম রেখেছিল উন্মত্ত ব্রাজিল সমর্থক অরিত্র। আর এদিকে ঝুমা। ভালো নাম শতরূপা। কলেজে অরিত্রর সহপাঠী। বাবা অধ্যাপক, মা স্থানীয় স্কুলের শিক্ষিকা। সামাজিক অবস্থানে কয়েক আলোকবর্ষ ব্যবধান। অরিত্রর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল অনেক। এক কাপড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে অরিত্রর কাছে উঠছিল ঝুমা। নানা কারণে বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়নি আজও।
আলমারি খুলে নাইকির সিআর-সেভেন ট্র্যাকস্যুটের সেটটা বের করে গায়ে চড়িয়ে নিলো অরিত্র। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুত চিরুনি চালিয়ে নিলো চুলে। শ্যানেল নাইন। প্রিয় পারফিউম অরিত্রর। স্প্রে করতেই সোঁদা সোঁদা মিষ্টি গন্ধটা ছড়িয়ে পড়লো ঘর জুড়ে। আয়নায় নিজেকে আরেকবার ভাল করে জরিপ করে নিয়ে দরজা ভেজিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল অরিত্র। ড্রয়িংরুমে বিশাল বেলজিয়ান সোফাটার সোজাসুজি দেয়ালে টাঙানো ৫২ ইঞ্চির টিভি। ঝুমার সারাদিনের সিরিয়ালের খোরাক। ডানদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শোকেসের দ্বিতীয় থাকে অনেকগুলো বইয়ের পাশে পরপর সাজানো ‘গীতাঞ্জলী’, ‘গীতবিতান’ আর ‘সঞ্চিতা’। আজও মনে আছে ক্লাস নাইনে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় রবিঠাকুরের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটা পাঠ করে সারা স্কুলের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিল ও। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন কাজী সব্যসাচী। প্রথম পুরষ্কারের বইগুলো হাতে তুলে দেবার সময় বলেছিলেন “সঠিক তালিম পেলে ও অনুশীলন চালিয়ে গেলে ছেলেটি একদিন আবৃত্তি জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠবে।” এতদিনের পুরোনো কথা, মনে পড়তেই ভারী মিষ্টি আর ঝকঝকে একটা হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। চৌত্রিশ টপকে পঁয়ত্রিশে পা দিল গতমাসে। হাসলে অরিত্রকে এখনো ঠিক নিষ্পাপ দেবশিশুর মত দেখতে লাগে।
শোকেসের ওপরে রাখা বড় একটা ট্রফি। অরিত্র তখন ক্লাস টেন। সুব্রত কাপ নামে একটা অল ইন্ডিয়া স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো তখন। স্কুল টিমে অরিত্র খেলতো গোলকিপার পজিশনে। ওরকম একটা বিখ্যাত এবং সম্মানজনক টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল অরিত্রদের স্কুল। সেখানে হেরে গেলেও টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপার হয়েছিল অরিত্র। সে সময় ওই ট্রফির ফাইনালে প্রাইজ দিতে আসতেন দেশের রাষ্ট্রপতি স্বয়ং। সহ-খেলোয়ারদের প্রবল হাততালি আর সোল্লাস চীৎকারের মধ্যে দিয়ে স্টেজে উঠে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সেরা গোলকিপারের ট্রফিটা নিয়েছিল ও। এই খেলাধুলোর জন্যই সেই ছেলেবেলা থেকেই কি স্কুলকলেজ, কি পাড়া, সর্বত্র ওর সমবয়েসী ছেলেপুলে, বন্ধুবান্ধবদের কাছে প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিল অরিত্র।
এগিয়ে গিয়ে পরম আদরে একবার ট্রফিটার গায়ে হাত বোলালো অরিত্র। তারপর দরজার পাশে গদি আঁটা ছোট টুলটায় বসে র্যাকে রাখা আদিদাসের মোজা আর স্পোর্টস স্নিকারটায় পা গলিয়ে নিল দ্রুত। দরজার বাইরে পা রাখার মুখে থমকালো একটু – আরে, ওটা তো নেয়া হল না। ফের ভেতরে ঢুকতে গিয়েও মত পাল্টাল। বড় জোর ঘন্টাখানেকের তো ব্যাপার। কব্জিতে বাঁধা র্যাডো ঘড়িটায় চোখ রাখলো। সাতটা বাজতে দশ। অলরেডি দেরী হয়ে গেছে অনেকটা। অটো-শাট দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল অরিত্র।
লিফট থেকে নেমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে হাতের বাঁদিকে কার পারকিং লট। থামের ধার ঘেঁষে দাঁড় করানো ঝাঁ-চকচকে একটা মিৎসুবিশি প্যাজেরো এসইউভি। পুরোনো স্করপিওটার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ অফারে কেনা মাসছয়েক আগে। রিমোট টিপতেই কুঁক কুঁক করে উঠলো যন্ত্রদানব। চাবি লাগিয়ে দরজা খুলতেই ড্যাশবোর্ডে আটকানো মায়ের ছবি। অনেক পুরোনো, সেই কোনকালে সস্তার স্টুডিয়োয় তোলা। ছবিতে হাসছে মা। আদর করে ছেলেকে ডাকতো রাজা। পাড়াপড়শিদের কাছে গর্ব করে বলতো “আমার ছেলে একদিন সত্যিই রাজা হবে, দেখে নিও তোমরা।” বড় অভাব আর কষ্টের মধ্যে মারা গিয়েছিল মা! বিষণ্ণ চোখে মায়ের দিকে তাকাল অরিত্র। আজ বেঁচে থাকলে অরিত্রর এই বিপুল উত্থানটাকে কিভাবে নিতো মানুষটা কে জানে? ভাবতে ভাবতে গাড়ির কি-বোর্ডে চাবি ঢোকাল অরিত্র। মসৃণ ‘ঘোঁওও’ শব্দে ডেকে ঊঠলো যন্ত্রদানব। গেটের মুখে দাঁড়ানো সিকিওরিটি গার্ড, ভারি লোহার দরজাটা টেনে খুলে দিয়ে স্যালুট ঠুকে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ালো একপাশে। পারকিং লট ছেড়ে বেরিয়ে গেল প্যাজেরো।
আবাসন থেকে কিলোমিটার-খানেক দুরে একটা ফাঁকা মাঠমত জায়গায় এসে থামল গাড়িটা। নির্জন গাছপালায় ঘেরা এই জায়গাটা বেশ মর্নিং ওয়াকের জন্য খুব পছন্দের অরিত্রর। স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ী থেকে নেমে কয়েক পা এগোতেই সহসা বিদ্যুৎ খেলে যাওয়া নারকীয় যন্ত্রণা পিঠ, শিরদাঁড়া আর মাথায়। একটা উথালপাতাল নদীতে ডুবতে চলা মানুষের মত একফোঁটা বাতাসের জন্য আঁকপাঁক করছিল অরিত্র। দু’হাত শূন্যে ছূঁড়ে প্রাণপণে কুটোর মত আঁকড়ে ধরতে চাইছিল অদৃশ্য কিছুকে। পারছিল না কিছুতেই। পরমুহূর্তেই পৃথিবীর সব আলো দপ করে নিভে ওর গেল চোখের সামনে!
পরদিন সকালে খবরের কাগজে হেডলাইন ‘আবার শ্যুটআউট শহরে। অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতিদের গুলিতে খুন উঃ ২৪ পরগনার ত্রাস অরিত্র ব্যানার্জি ওরফে বাচ্চা রাজা। তদন্তসূত্রে প্রকাশ বছরখানেক আগে জেল থেকে খালাস পায় রাজা। একডজনেরও বেশি খুন সহ অপহরণ, তোলাবাজি, ও আরও বহু অপরাধের একাধিক মামলা ছিল তার নামে। তদন্তসূত্রে আরও জানা যায় যে একদা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র এবং কুশলী ফুটবলার অরিত্র কলেজে পড়ার সময় দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়ে। ইদানীং প্রোমোটারি ব্যবসাতেও হাত লাগিয়েছিল সে। সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে এলাকার আর এক কুখ্যাত দুষ্কৃতি তারক সাহা ওরফে কেলে তারকের সঙ্গে বিবাদ বেধেছিল রাজার। জেল থেকে খালাস পেয়ে এলাকা ছেড়ে সরে এসে নিউ গড়িয়ার একটি অভিজাত আবাসনে থাকতে শুরু করেছিল সে। এখান থেকেই দলের ছেলেদের মাধ্যমে রাজা তার অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনা করত বলে ধারণা তদন্তকারীদের। তাদের আরও অনুমান, ঘাতকদের আগ্নেয়াস্ত্রে সাইলেন্সার লাগানো থাকার ফলে গুলির শব্দ সেভাবে শোনা যায়নি। অরিত্রর মৃত্যুতে উঃ ২৪ পরগনার বারাসাত থেকে বনগাঁ, অন্ধকার জগতের একটি বিভীষিকাময় অধ্যায়ের ওপর যবনিকাপাত ঘটল বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
বিস্তারিত খবর ভিতরের পাতায়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন