নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
গাছের ছায়া এখানে বেশ ঘন। ঘন অন্ধকার এখন। অবশ্য অন্ধকারে পথ চলতে ওর খুব একটা অসুবিধা হয় না। বনের এদিকে একটা খাল আছে। সেখানে আসতেই নাকে গন্ধটা ধক করে লাগল ওর। এই বনে মানুষের জিপ বেশি আসে না। এইখানটাকে বলে বনের কোর এরিয়া। তাই জিপের পোড়া ডিজেলের গন্ধ এখানে বাতাসে ভাসে না। বরং তার পরিবর্তে গাছপালার পাতা আর ফুল ফলের গন্ধই এখানে বেশি পাওয়া যায়। তবে এ গন্ধ হল টাটকা কাঁচা রক্তের গন্ধ। সেই বন্য রক্তের গন্ধ কোনো সাধারণ প্রাণীর রক্ত নয়, বাঘিনীর গায়ের ঘ্রাণ মিশে আছে এই গন্ধে। কোনো বাঘিনী সদ্য ঋতুমতী হয়েছে। এই গন্ধ চিনতে পেরে ওর শরীর শক্ত হয়ে গেল। কে? কে এসেছে এখানে? টি ২৪৩ এই নামে ও নথিভুক্ত বাঘ এই জঙ্গলের। বাঘিনীদের নামের পরে এক দুই তিন এমন করে সংখ্যা পড়ে। আর পুরুষ বাঘের নাম শুরু হয় দুশোর পর থেকে। এই বিস্তীর্ণ বনে ও এখন একা। কোনো বাঘিনী এখানে নেই। এমনিতেই এই বনে বাঘিনীর সংখ্যা খুব কম। পুরুষেরা পরস্পর লড়াই করে একটা স্ত্রী বাঘিনীর অধিকার পেতে। ওর সঙ্গেও গায়ে পড়েই শত্রুতা করছিল ওরা। মানে টি ২৫০ আর টি ২২৪ ও এতদিন জানতো না কেন ওরা এমন করছে? বুঝতেই পারেনি। ওরা ওকে শুকনো খাদের ভেতর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল, দুজনে মিলে কাঁধ কামড়ে ধরেছিল। কিন্তু ও তো ওদের কোনো ক্ষতিই করেনি? তীব্র হুঙ্কার দিয়ে ও সেটাই একবার বলতে চেয়েছিল। তখনই ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে খাদের সামনেটাতে দাঁড়িয়েছিল ও, আর ওকে প্রথমবার দেখতে পেয়েছিল টি ২৪৩, দেখেই ভীষণ ভালো লেগেছিল। নির্মেদ শরীরে অদ্ভুত সুন্দর কোমলতা ওর। মুখের সামনের কাঁটাগুলো তীব্র ছুঁচালো, চোখ দুটো ঘনকালো আর হিংস্র। ওর উপর অধিকার বজায় রাখা অত সহজ হবে না। এ কথাই ওকে দেখে মনে এসেছিল ওর। এবার টি ২৪৩ বুঝতে পারলো, এই সুন্দর বাঘিনীর জন্যই ওরা দল বেঁধে এসে ওকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে, কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করছে, যাতে ও এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়। টি ২৪৩ একবার মেয়েটার চোখের দিকে তাকালো। কী চায় মেয়েটা? মানুষেরা ওর কী নাম রেখেছে? মেয়েটার দৃষ্টি নির্লিপ্ত। যেন তিনটে পুরুষের এই লড়াইয়ে ওর কোনো যায় আসে না।
চলেই এসেছিল টি ২৪৩, ঝামেলা করে লাভ নেই। অনেকদূর পথ পেরিয়ে একটা নতুন জঙ্গলে চলে এসেছে ও। জায়গাটার নাম পান্না। ও বান্ধবগড়ের জঙ্গল চিরদিনের মতোই ছেড়ে এসেছে। আসার আগে একবার যে মেয়ে বাঘটার কথা ওর মনে হয়নি তা না। কিন্তু মেয়েদের মন ও ঠিক বুঝতে পারে না। তবে একটা কাজ ও করেছে। যদি মেয়েটা সত্যিই ওকে চায় তাহলে এখানে এতটা পথ পেরিয়ে আসতে পারবে। হ্যাঁ এই কৌশল ওরা ভাবতেও পারবে না। ওরা সব মাথামোটার দল। মেয়েটা বুদ্ধিমতী হলে আসতে পারবে। অবশ্য ওরও আগ্রহ থাকলে তবেই ও আসবে। নাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে এতটা পথ কেন পাড়ি দেবে? আসার পথটা গাছের গায়ে ঘাসের উপর একটু একটু মূত্রত্যাগ করে করে পথ এগিয়েছে ও। নতুন বনের কোণে কোণেও রেখেছে ওর ইঙ্গিত। এটাই ওর মেয়ে বাঘটাকে কাছে টানার ইঙ্গিত! যদি বুঝতে পারে, ও ঠিক আসবে।
খালের পাশে হরিণদের প্রিয় আতার বন। পাকা আতার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। প্রচুর টিয়া এসে আতা খাচ্ছে। ওকে দেখে একঝাঁক বাদর সরসর করে একটা বড় গাছের ডালে উঠে গেল। একটু দূর থেকে চাপা একটা হুঙ্কার শোনা গেল হঠাৎ। “খবরদার!” যেন কোমল গলায় বলল কেউ। টি ২৪৩ পেছন ফিরে তাকালো, আর সঙ্গে সঙ্গেই ওকে দেখতে পেল। বুকটা আনন্দে নেচে উঠল ওর। ও এখানে আসবে এটা ওর মন আগে থেকেই বলছিল। ও থেমে দাঁড়াতেই মেয়েটা এগিয়ে এল। দাঁত খিঁচিয়ে ফ্যাসফ্যাস করল কিছুক্ষণ। টি ২৪৩ চুপ করেই থাকল। মেয়েটা এখন ক্লান্ত, এখন কোনো ঝামেলা করবে না সে। “হাদা কোথাকার! দুটো শয়তানকে তাড়িয়ে এতটা পথ কষ্ট করে হেঁটে এলাম, এখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছো কোথায়!”
“একা আমি যাচ্ছি না, তুমিও চলো।”
“কোথায়?”
“জায়গাটা তোমারও পছন্দ হয় কিনা একবার দেখবে না?”
“কোন জায়গা?”
“যেখানে আমরা দুজন এখন থাকব। আমাদের নতুন সংসার!”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Vison valo laglo pore