মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
প্রজ্ঞাদ্যুতি আর আমি ক্লাস এইট অবধি পড়েছিলাম একসঙ্গে। ওর দাদান ছিলেন এই জেলার গভর্নমেন্ট প্লিডার। রাশভারী মানুষ। কালো শামলা গায়ে দিয়ে সাদা অ্যামবাসাডরে চেপে কোর্টে যেতেন। আমাকে দেখলেই গম্ভীর গলায় বলতেন, পড়াশোনা কেমন চলছে? আমি আরষ্ট হেসে বলতাম, ভাল।
প্রজ্ঞাদের সাবেকি আমলের দোতলা বাড়ি। চকমেলানো মেঝে। নিচতলায় ওর দাদানের চেম্বার। আইনের বইপত্র ঠাসা আলমারি। লোকজনের আসাযাওয়া লেগেই থাকত। নিচতলার একদিকে গ্যারাজ। অন্য ঘরগুলো কাজের লোকদের জন্য বরাদ্দ। দোতলায় থাকত প্রজ্ঞারা। ওর ঠাকুরদা বিপত্নীক। ওঁর ঘরটা ফাঁকাই থাকত দিনের বেলায়। দুপুরবেলা আমরা সেই ঘরের মেঝেতে বসে অংক কষতাম। প্রজ্ঞার আটপৌরে শাড়ি পরা মা চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় রেঁধে এনে বলতেন, দ্যাখ তো, কেমন হয়েছে খেতে। পুডিং বস্তুটা ওঁর হাতেই প্রথম খাই।
প্রজ্ঞার দাদানের ঘরটা ছিল নিরাভরণ। একটা প্রাচীন পালঙ্ক আর জলচৌকি ছাড়া সে ঘরে ছিল বইয়ের আলমারি। তাতে দেশি বিদেশি সাহিত্যের বই। অন্য কোনও আসবাব ছিল না। একদিকে শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরু হবার ফোটো। অন্য দেওয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা অয়েলপেন্টিং। ছবিটা এখনও হন্ট করে আমাকে।
কুয়াশার নীল আলোয়ান কাঁধে জড়িয়ে কালো পাহাড়। চড়াই উতরাই রাস্তা। নিচে গভীর উপত্যকা। তারও নিচে পীতাভ তৃণক্ষেত্র। মায়া মারীচেরা বুঝি সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটা লালরঙা বাড়ি। ধূসর স্কার্ফের মতো একটা প্যাঁচালো মেঘ জড়ানো চিমনিতে। এক দঙ্গল পাইনগাছ সান্ত্রীর মতো পাহারা দিচ্ছে বাড়িটাকে। কর্ডুরয়ের ট্রাউজার আর ফারের জ্যাকেট পরা এক তরুণী হাসিমুখে দাঁড়ানো বাড়িটার সামনে। আমি বলতাম, কী সুন্দর! কে এঁকেছে ছবিটা? উনি কি তোর ঠাকুমা? প্রজ্ঞা মাথা নেড়ে বলত, না রে ঠাকুমা নয়। মা-ও জানে না ঠিক করে। দাদানকে জিজ্ঞেস করেও স্পষ্ট উত্তর পাইনি।
প্রজ্ঞার বাবাকে কখনও দেখিনি। শুনেছি প্রজ্ঞা যখন খুব ছোট তখনই তিনি বৈরাগ্যের পথ বেছে নিয়েছিলেন। চিরকুট রেখে গিয়েছিলেন বালিশের নিচে – ‘আমাকে খুঁজো না’। এইটে ওঠার পর আমার বাবার বদলি হল। নিজেদের বাড়িতে ভাড়া বসিয়ে আমরা চলে গেলাম অন্য শহরে। আমি আর প্রজ্ঞাও ছিটকে গেলাম আলাদা বৃত্তে। পরে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরি পেয়েছি একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে বলে পৈত্রিক বাড়িতে থেকে কাজ করছি।
প্রজ্ঞা আইন নিয়ে পড়েছিল। এখন কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে। সম্প্রতি ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। ডিপি-তে ফুল-টুলের ছবি ছিল বলে অ্যাকসেপ্ট করিনি প্রথমে। ইনবক্সে এসে পরিচয় দেওয়ার পর বুঝলাম। আমার বিয়ে এই অঘ্রাণে। নেমন্তন্নের চিঠি রেডি। এদিকে প্রজ্ঞাও ওর মায়ের কাছে এসেছে ক’দিনের জন্য। আজ আগে থেকে জানিয়ে বিয়ের চিঠি হাতে এসেছি এ বাড়িতে।
খাঁ খাঁ করছে নিস্তব্ধতা। বাড়িটা রং করা হয় না বহুকাল। প্রজ্ঞার দাদান আর নেই। তিনি চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়ির জৌলুসও চলে গেছে। সদর দরজার বেল টিপলাম। প্রজ্ঞার মা দরজা খুললেন। চেহারা ভেঙে গেছে। আমি পরিচয় দিতেই উনি অবাক বিস্ময়ে বললেন, কত বড় হয়ে গেছিস!
প্রজ্ঞাকে পেলাম ওর দাদানের ঘরে। মেঝেতে উবু হয়ে বসে ইনডোর প্ল্যান্টের তদারকি করছিল। মুখ তুলে হেসে বলল, কেমন আছিস?
ইলেকট্রিক শক লাগল যেন আমার। চোখ নিজে থেকেই চলে গেল দেওয়ালের সেই হাতে আঁকা ছবিটার দিকে। এখনও টাঙানো আছে আগের মতোই। সময়ের ধুলো পড়ে ফিকে হলেও ছবিটা এখনও জীবন্ত। কিন্তু আশ্চর্য যেটা তা হল, ছবির সেই তরুণীর মুখ কেউ যেন কপি পেস্ট করে বসিয়ে দিয়েছে প্রজ্ঞার মুখে। এক গহন গভীর সত্য স্থানুর মতো দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে। চমক ভাঙল যখন প্রজ্ঞা বলল, এই ছবিটা দাদান এঁকেছিল, জানিস!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
এমন একটি অণুগল্প পাঠ করার তাৎক্ষণিক অথবা গভীর ঋদ্ধ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে বলে আপনার মনে হয়, মৃগাঙ্ক বাবু? এখন আর অবাক হইনা জানেন? কারণ ম্যাজিক দেখতে বসে প্রাচীন জাদুকরের কৌশল সম্মোহিত করে রাখে জীবনভর। একটি অণুগল্পের মধ্যেও বিস্তারিত বর্ণনার বিলাসিতা দেখাতে যে দাপট প্রয়োজন, ট্যুইস্টের অভাবনীয়তাকে বিদ্ধ করিয়ে দেওয়ার শব্দাশ্ব করে ছোটানোর যে অতুলনীয় দক্ষতা…এ তো আপনার কলমে সহজাত! আমার মত মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যে অন্ধ পাঠক বা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য জাত লেখকই নন বলে উন্নাসিক পাঠক – যে কেউ, যিনি বাংলা সাহিত্যের সাথে থাকতে ভালোবাসেন বা থাকেন, তাঁকে একবার অন্তত বাঁও হারিয়ে ফেলতেই হবে এই গল্পে। আর এখানেই অণুগল্পটির সার্থকতা। কষ্টসাধ্য ক্লাইম্যাক্স নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক অথচ গহনগামীতার স্মারক হয়ে উঠতে পারাই যেভাবে আপনার প্রত্যেকটি লেখার প্রাণ, এখানেও তা অক্ষুণ্ণ রইল। বহুদিন পর আপনার লেখা পাঠ করার সৌভাগ্য হল। মাঝখানে আপনার যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে, আমি সেই জঁরে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা, অক্ষমতা মার্জনা করবেন। কিন্তু এই লেখা বা এই ধরণের লেখা যা আপনি লিখেই চলেন এবং আশাতীতভাবে একটি প্লট আরেকটির সাথে মিলে যায়না, উপরন্তু প্রতিটি সৃষ্টি আমাদের জীবন, যাপন, মনোজগতের অন্তরাল থেকে অলৌকিক প্রতিফলন ঘটিয়ে যেতে থাকে…এমন লেখার কাছে চৈতন্য বন্ধক রেখে বানভাসি হওয়ার মৌতাত…আহা! ভালো থাকবেন। আসন্ন শারদীয়ার অফুরান শুভকামনা রইল। ‘অপার বাংলা’ ওয়েবজিনকে ধন্যবাদ এমন একটি আশ্চর্য সৃষ্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। বড় ভালোলাগল।
আমার আপ্লুতি জানবেন, রাজেশ। আপনার মতো শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠকের ভালবাসাই তো আমার প্রাপ্তি।
তুমি বাংলা কথাসাহিত্যের একজন নিপুণ শিল্পী। কথাসাহিত্যের যে কোনো ফরম্যাটে তোমার অনায়াস বিচরণ সত্যি বিস্ময়কর। মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের গল্প মানেই হামলে পড়ে চেটেপুটে স্বাদ গ্রহণ। গদ্য সাহিত্যে তুমি যে সিদ্ধিতে পৌঁছেছো তাতে বাঙালী পাঠক নতুন ভাবে উজ্জীবিত হচ্ছে। কোনো একঘেয়ে বস্তাপচা কাহিনী নয়, এক অদ্ভুত জীবনবোধের সংলগ্নতা গোটা গল্পে পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। কৃত্রিমতার মারপ্যাঁচহীন সহজ স্বচ্ছন্দ বিন্যাসের অনন্যতা উপভোগ করে আমরা মুগ্ধ। এই মুগ্ধতা চলতে থাকুক অবিরাম…
অজস্র ধন্যবাদ দিব্য। এমন পাঠক অর্জন করা একজন লেখকের পরম পাওয়া।
খুব ভাল লাগলো দাদা। অনুগল্পে একটি পরিবারের ইতিহাস…. ওই অয়েলপেন্টিংটার মতোই অবাক করা, সুন্দর।
অজস্র ধন্যবাদ স্থিতা।