bibidho-noni-bhoumick

শতবর্ষে ননী ভৌমিক
অনুবাদের প্রসারিত দিগন্তে বিস্মৃত এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক

স্মৃতিচারণা
বিতস্তা ঘোষাল

গল্প শুনতে ভালোবাসে না এমন বাচ্চা প্রায় কোথাওই দেখা যায় না। গল্পের মধ্যে দিয়েই শিশু নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে এক কল্পনার জগত গড়ে তোলে। যেমন বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’র অপু গড়েছিল মহাভারত শুনে। আসলে বাঙালি গড়পড়তা বাচ্চার গল্পের বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে রামায়ণ, মহাভারত, ঠাকুরদার ঝুলি, ঠাকুমার ঝুলি, রাক্ষস-খোক্ষস-এই সব দিয়ে।

এর পাশাপাশি রূপকথার গল্প, বিদেশি রূপকথার গল্পের অনুবাদ বা ভাবানুবাদ- তা হতে পারে সিন্ড্রেরেলা, স্নো হোয়াইট, আবার কখনো গ্রিম ভাইদের রূপকথা বা দাদুর দস্তানার রোমাঞ্চকর কাহিনি। অনুবাদ হলেও এগুলো এতটাই প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা হত যে তা অনুবাদ না হয়ে সমান্তরাল এক বাংলা গল্পেই পরিণত হয়েছে। লীলা মজুমদার, মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় –এদের হাত ধরেই সেই অচেনা জগতে ঢুকে পড়ে শৈশব।

পাশ্চাত্যের ভাষা থেকে যে সব মানুষ নিরন্তর অনুবাদ করে ছিলেন বিংশ শতকের বিভিন্ন সময় তাতে রাশিয়ান ভাষার প্রাচুর্য ছিল সবচেয়ে বেশি। অবিভক্ত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহিত্যের একটা অংশ ছোটোদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের জন্য বিশেষ আগ্রহী ছিল। আর তাই একাধিক রাশিয়ান গল্প বাংলাতেও নিয়মিত অনুবাদ হয়েছে, প্রতি পাতায় রঙিন ছবি দেওয়া সেইসব গল্প একসময় অধিকাংশ বাঙালি বাচ্চার হাতে পৌঁছেছে নাম মাত্র মূল্যে। এই দূরূঢ় কাজটি যারা করতেন, তাদের মধ্যে অরুণ সোম, সমর সেন – এই নামগুলো উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি আরেকটি নাম সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে, যিনি শুধু শিশু সাহিত্য নয়- কিশোর পাঠ্য ও চিরায়ত সাহিত্যও নিরন্তর ভাবে অনুবাদ করেছেন মাতৃভাষার মতোই এবং তা কেবল অনুবাদ না হয়ে ঢুকে পড়েছে পাঠকের মনে- সেই নামটি কারোর অজানা নয়।

হ্যাঁ। তিনি ননী ভৌমিক। ননী ভৌমিকের আদি বাড়ি বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর। রংপুর শহরে স্কুলে পড়তেন। রংপুর কলেজে থেকে আই.এসসি ও পাবনা সরকারি কলেজ থেকে বি.এসসি পাস করেন। অর্থাভাবে এম.এসসি পড়তে পারেননি। পরে বীরভূম জেলার সিউড়িতে চলে আসেন। বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী বিপ্লবী নিত্যনারায়ণ ভৌমিক তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

ননী ভৌমিক তরুণ বয়েসেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজ করতে শুরু করেন। ৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার ভেতরেও নির্ভীকভাবে সংবাদ সংগ্রহ করে গেছেন তিনি। পরে তেভাগা আন্দোলনের খবর জোগাড় করেছেন গ্রামে গ্রামে গিয়ে যা স্বাধীনতা পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তাঁর এই অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ছোটগল্প সংকলন ‘ধানকানা’ বের হয়। এছাড়া ‘অরণি’ পত্রিকায় নিজের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। ‘চৈত্রদিন’ তাঁর অপর গ্রন্থ। তিনি ফ্যাসিবিরোধী প্রগতি লেখক সংঘ ও ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সদস্য ছিলেন। ‘পরিচয়’

পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কিছুকাল। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ধুলোমাটি’ ধারাবাহিকভাবে ‘পরিচয়’-এ বের হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তিনি গ্রেপ্তার হন ও প্রেসিডেন্সি, বক্সা জেলে আটক থাকেন।

১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি তিনি মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অনুবাদকের কাজ নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া যান। রুশ মহিলা স্বেতলানা’কে বিয়ে করে সে দেশেই থেকে যান। বহু রুশ সাহিত্যের অসামান্য বাংলা অনুবাদ তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে। রাজনৈতিক সাহিত্য ছাড়াও অজস্র শিশু কিশোরদের গল্প, উপন্যাস অনুবাদ করেছেন। ফিওদোর দস্তোয়েভ্‌স্কির বঞ্চিত লাঞ্ছিত, জন রীডের “দুনিয়া কাঁপানো দশদিন”, ল্যেভ তল্‌স্তোয়ের “আনা কারেনিনা” ইত্যাদি ছাড়াও বাংলা- রুশ- বাংলা অভিধান, ইউক্রেনের গল্প, সোনার চাবি, উভচর মানব ইত্যাদি। অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে নিজের মৌলিক লেখার কাজ ব্যহত হয়। সোভিয়েত মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমন করে রিপোর্টাজ ধর্মী ‘মরু ও মঞ্জরী’ গ্রন্থটি লেখেন সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে।

তবে তাঁর অনুবাদগুলোর তুলনা হয় না। পরিচিত আবহ, চেনা নাম না থাকলেও অচেনা পৃথিবী খুব সহজেই ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে ঢুকে পড়েছিল আপামর বাঙালি শিশুর মনে। যেমন – ‘দাদুর দস্তানা’ গ্রন্থটি।

“বন দিয়ে চলেছে দাদু। পিছনে তার কুকুরটা। যায়, যায়, যায়- দস্তানাটি ওদিকে পড়ে গেল। ছুটে এল নেংটি-ইঁদুর,দস্তানার ভেতর ঢুকে বললে- এইখানে থাকব আমি।

এইসময় তিড়িক তিড়িক- এল ব্যাঙ। জিজ্ঞেস করলে-

কে গো, কে থাকে দস্তানায়?

কুটুর কুটুর নেংটি ইঁদুর। কিন্তু তুমি কে?

তিড়িক- ঠ্যাঙ ব্যাঙ। আমাকে ঢুকতে দাও।

এসো।…

আর এমনি করে দৌড়- খোশ খরগোশ, সেয়ানা-দিদি শেয়ালি, দাঁত- ফোঁড় বনশুয়োর… এমন সময় দাদু ফিরলো দস্তানা খুঁজতে। কুকুর ছুটলো আগে আগে- দেখলো দস্তানা পড়ে আছে, নড়ছে। ঘেউ ঘেউ শুনে ভয় পেয়ে দস্তানার সাতজন যে যেদিকে পারলে দৌড় দিলে। দাদু এসে কুড়িয়ে নিলে নিজের জিনিসটা।…”

এই গল্পে অনুবাদক যে অনুপ্রাসকে মনে রেখেছেন সহজে পড়ে ফেলার জন্য তা বোঝা যায় বিশেষ্য –বিশেষণের দিকে তাকালেই। যেমন – দৌড়খোশ/ খরগোশ/ তিরিকঠ্যাঙ/ ব্যাঙ… ইত্যাদি।

অনুপ্রাস আসলে চট করে মনের গভীরে ঢুকে পড়ে, এর ফলে ছন্দের যে দোলা তা সহজে মাথায় প্রবেশ করে। অন্য দিকে বিশেষণগুলো এমন কিছু- দৌড় বাজ খরগোশ, লম্ফ মহারাজ ব্যাঙ, চোখা নাক নেকড়ে ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রত্যেকের আগে কিছু শব্দ যা দিয়ে চরিত্রকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে সহজেই।

এখানেই আবার কিছু বিশেষ্যও আছে। যেমন – যে সেরা দৌড়ায়, যে সেরা লাফাতে পারে, যার শুয়োর নাক… । অর্থাৎ সেরা শব্দটি দিয়ে চরিত্রর গুণকে বোঝানোর চেষ্টা।

আরেকটি বিষয়ও ফুটে উঠেছে এই গল্পের মধ্যে দিয়ে। চরিত্রগুলো সবাই খুব সাধারণ। সেইজন্য তারা সবাই একই দস্তানার মধ্যে আশ্রয় নেয়। গায়ে লেপ্টে থাকে। কিন্তু কাউকে ফেরায় না। এদের প্রত্যেকের মধ্যে খাদ্য খাদকের সম্পর্ক হলেও এক্ষেত্রে তারা প্রতিবেশী।


আরেকটি গল্প তেলেসিক। এই গল্প একেবারেই মুখে মুখে বানিয়ে যে ভাবে মায়েরা ঠাকুমারা গল্প বলে সেভাবে অনুবাদ করা। তেলেসিক জন্মেছিল একটা কাঠের পায়া থেকে। নিঃসন্তান বুড়োবুড়ির স্বপ্নের সন্তান সে।

সেই সন্তান – “ যখন হল নওল কিশোর,ছেলে বললে- বাবা আমায় সোনার নাও, রুপোর বৈঠা বানিয়ে দাও-না; নদীতে মাছ ধরব, তোমাদের খাওয়াব।”

তেলেসিকের মায়ের ছড়া নকল করে নাগিনী তাকে বন্দী করলে সে সাহায্য চায় হাঁসের কাছে। – “ হাঁস, ওগো হাঁস, হাঁসের পো/ আমায় নিয়ে চলো গো,/সবাই আছে পথ চেয়ে/দরদী তুমি সবার চেয়ে/নইলে নাগে ফেলবে খেয়ে!”

এই ছড়া সে তার বুড়িমার থেকেই আয়ত্ব করেছিল, যা শুনে দয়ালু হাঁসের দল তাকে নিয়ে উড়ে গেল। পৌঁছে দিল তার বাড়ি। পেট ভরে গম খেল। তারপর আবার উড়ে গেল আকাশে। শেষে লেখা- ‘আমার কথাটি ফুরলো। একসার পিঠে পুড়লো’। এ যেন ঠাকুমার ঝুলির শেষ লাইন। নটে গাছটি মুড়ালো, আমার কথা ফুরালো’। কিন্তু এখানে একটা মজা যে এ গল্প সময় সীমা নির্দিষ্ট। ঠিক যতক্ষণ একটা পিঠে পুড়ছে ততক্ষণ গল্পটা চলল।

আবার বুড়োর মেয়ে বুড়ির মেয়ের গল্প পড়তে গিয়ে সুখু দুখুর গল্প পড়ছি বলে মনে হয়। ভালো আচার ব্যবহারের জন্য বুড়োর মেয়েকে মালিক, আপেল গাছ, উনুন, ঝর্ণা, কুকুর ভালো জিনিস উপহার দেয় ভালোবেসে। যেমন – সোনারুপোর আপেল, মিষ্টি রুটি, সোনার থালা, হাতা ইত্যাদি। কিন্তু বুড়ির মেয়ের খারাপ আচরণের জন্য সে পেল মৃত পশুর হার। সে কখনো কারোর ভালো করেনি। এ গল্প আমাদের দেশের নীতি গল্পের মতোই।

এতো গেল শিশু কাহিনি। যা বাংলা ভাষার পরিচিত আবহে মিশে যায় বিদেশি অচেনা ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে। এখানেই ননী ভৌমিকের অনুবাদক হিসেবে স্বার্থকতা। পাঠক তাঁর অনুবাদে কমফোর্ট অনুভব করে।

গল্প ছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন ছড়াও এবং তা একেবারেই শিশুদের উপযুক্ত করে। কর্নেই চুকোভস্কির লেখা গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন তিনি। ধোলাই রাম নামে সে ছড়ার শুরু-
“লেপ খানা
মেলে ডানা
বালিশটা পালালো,
কম্বলও
উড়ে গেলো
বড়ো দেখি জ্বালালো।
মোমদানিটা, লে লুল্লি,
ছুটলো কোথায় জ্ব্লে চুল্লি!
বই কইরে,
বইও পালায়
ডিঙ্গি মেরে
খাটের তলায়।”
এখান থেকে বোঝা যায় তাঁর ছন্দ নিয়ে দক্ষতাও অপরিসীম।

তাঁর অনূদিত কিশোর পাঠ্য উপন্যাস উভচর মানুষ- ও বঙ্গীয়করণের ফলে একাত্ম এখানকার কিশোরদের সঙ্গে। এখানে মূল চরিত্র ইকথিয়ান্ডর। সে মানুষ।তবে বিশেষ কারণে সে স্থলে চলে সমানভাবে বিচরণ করতে পারে। সে ভালোবাসে সুন্দরী গুত্তিয়েরেকে। তার সঙ্গে বেশি করে সময় কাটাবার জন্য ডাঙায় থাকে অনেকক্ষণ। এতে তার কষ্ট হয়। আর এই সুযওগে তাকে বন্দী করে কিছু অসৎ মানুষ। তার একমাত্র শুভার্থী অলসেন তা বুঝতে পারে।এবং তার চেষ্টায় সে মুক্ত হয়ে সমুদ্রে ফিরতে পারে। কারন সমুদ্রই তার আশ্রয়, মুক্তির স্থান। কিন্তু সেখানে ফিরে গিয়ে সে আর আগের মত শান্তি পায় না। মাটির পৃথিবী,নিজের জন্য সঙ্গী খোঁজা – এসব আসলে জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়ার মত- এ বোধ তাকে ঘিরে ধরে।

এ কাহিনির প্রতিটি ছত্রে তার দুঃখের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে নিখুঁত অনুবাদে।
“নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?
হ্যাঁ বাবা- বললে ইকথিয়ান্ডর।
তোমারই দোষ- বললেন সালভাতর। ডাঙায় অত বেশি সময় থাকা তোমার উচিত হয়নি।

মাথা নিচু করে কি ভাবতে লাগল ইকথিয়ান্ডর। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে সোজাসুজি সালভাতরের দিকে চেয়ে শুধালো- কি উচিত হয়নি বাবা? সবাই থাকে আর আমার চলবে না কেন?

মামলায় জবাব দেবার চেয়েও তিরস্কার ভরা এই দৃষ্টি সহ্য করা সালভাতরের পক্ষে কঠিন হয়েছিল। তাহলেও দমলেন না তিনি।

তার কারন তুমি এমন একটা জিনিস পারো যা আর কেউ পারে না। জলে ডুবে থাকতে পারো তুমি- কোনটা তুমি চাইবে ইকথিয়ান্ডর, সবাই যেমন থাকে ডাঙায় থাকা, নাকি কেবল তলে থাকা?

জানি না।–একটু ভেবে বললে ইকথিয়ান্ডর।জলতলের জগৎ আর ডাঙা, গুত্তিয়েরে- দুই-ই তার কাছে সমান প্রিয়। কিন্তু গুত্তিয়েরেকে তো এখন আর সে পাবে না…

এখন আমি সমুদ্রই চাইব- বললে ইকথিয়ান্ডর।

এই অনুবাদ পড়ে পাঠকের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সে নিজের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে। আর এখানেই অনুবাদকের জয়। ননী ভৌমিকেরও সাফল্য এখানেই।

দস্তোয়েভস্কির বিখ্যাত উপন্যাস উনিঝোন্নিয়ে ই অস্কোর্লিয়েন্নিয়ে( ৪ খন্ড)র অনুবাদ করেছিলেন ননী ভৌমিক, নাম দিয়েছিলেন ‘বঞ্চিত লাঞ্চিত’। দস্তোয়েভস্কির লেখায় মানুষের সবরকম অনুভূতি প্রকাশিত। সেই অনুভূতিগুলো নিবিড়ভাবে রূপ পায় তাঁর অনুবাদেও। সমাজের বৈষম্য, শ্রেণী বিন্যাস, বহু স্তরে বিন্যস্ত অনুভব প্রধান এই উপন্যাসে ভাষার গঠন একটা প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। অনুবাদক সেটা মাথায় রেখেই বঙ্গীয়করণ করেছেন। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নেল্লী অল্প সময়ে অপ্রত্যাশিত সহানুভূতি পেয়ে যথাক্রমে সন্ত্রস্ত,ভীত ও প্রত্যাঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে আর তারপর খুশি হয়েও তা গোপনের প্রাণপণ চেষ্টা করে তার বিস্তৃত ও বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা অনুবাদে আছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে অনুবাদক অনুবাদের স্বাধীনতা নিয়েছেন, এবং ভাব বাচ্যে তা বুঝিয়েছেন। কিন্তু তাতে মূল গল্পের স্বাদ নষ্ট হয়নি এতটুকুও। যেমন –

“আমি যে কতবার গেছি তোকে দেখতে- কেউ তা জানত না- গিয়ে দাঁড়াতাম তোর জানলার নিচে- অন্তত জানলায় তোর ছায়া তো দেখতে- শীতের সময় – গভীর রাত- অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান পেতে থেকেছি তোর দরজায়- তোর গলা কি শুনতে পাব না?’

এখানে লেখক যে আর্তি, সাধারণ মানুষের বঞ্চনার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, অনুবাদক তার সঙ্গে মিল রেখেই এক হাহাকারের চিত্র বর্ণনা করেছেন, যা সরাসরি ধাক্কা দিয়েছে পাঠকের অন্তরে।

“ওকে আমি ক্ষমা করিনি- মা শেষ কথা বলে গেছে- ওকে আমি অভিশাপ দিই। তাই আমিও অভিশাপ দিচ্চি ওকে। ওকে ব’লো মা কী ক’রে মারা গেছে, কীভাবে আমি একলা ছিলাম বুবুনভার কাছেই থাকতে চেয়েছি-“ চামড়ার বালিশ থেকে শুরু করে অনেক শব্দই এক রেখেছেন তিনি। আবার গল্প রাসিয়ান হলেও বঙ্গীয় প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে দক্ষতার সঙ্গে। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যায়-
“ কাল অবিশ্যি অবিশ্যি আসবে আমার কাছে-” এই অবিশ্যি অবিশ্যি শব্দের ব্যবহার আমরা পাই পথের পাঁচালীতেও, যেখানে সর্বজয়া যাত্রাদলের নায়কের প্রতি করেছিল।
বাঙালিয়ানায় ভরা আরও কিছু বাক্য –
ত কী বলব বাপু, বিপদ যেন কাটে না, দেখছি গেরোর আর শেষ নেই।
ত পট করে লোকটা আবার মরে গেল-
ত কার কান ভাঙাচ্ছিস তুই?
ইত্যাদি নানা বাক্য পড়লে একে আর অনুবাদ মনে হয় না। বরং নিজেদের ভাষায় লেখা একখানি উপন্যাস বলেই মনে হয়।

আরেকটি উপন্যাস – আন্না কারেনিনা। লেখক এ উপন্যাসে শৈল্পিক অভিব্যক্তি সহকারে প্রায় সর্বপ্রকার মানবিক অনুভূতির চর্চা করেছেন। এজন্য এক বিশেষ কথনভঙ্গী বেছে নিয়েছিলেন লেখক। এই ভঙ্গী আর ভাষা- দুইয়েরই সার্থক অনুবাদ করেছিলেন ননী ভৌমিক। যার ফলে শত জটিলতার মধ্যেও কাহিনির অন্যতম চরিত্র আন্না কারেনিনা, কাটিয়া, লেভিন, ভ্রন্সকি, দারিয়ার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল পাঠকের কাছে।

তাছাড়া এ গ্রন্থের সুচনাতেই ননী ভৌমিক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণকাজ করেছিলেন। তা হল রাশিয়ান নাম সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা। যা বাঙালিদের পক্ষে খুবই মূল্যবান সংযোজন। রাশিয়ানরা একই মানুষের নাম ডাকবার সুবিধার জন্য নিজেদের মত সংক্ষিপ্ত করে নিত। যেমন- দারিয়া দারেঙ্কা সংক্ষেপে ডল্লি। আন্না আকার্দিয়েভনা কারেনিনা- এর অর্থ শ্রী যুক্ত কারেনিন –য়ের স্ত্রী আন্না, যিনি আবার শ্রীযুক্ত আর্কাদির কন্যা। মূল উপন্যাসে লেখক একই ব্যক্তিকে নানা নামে ডাকলেও অনুবাদকের এই ভূমিকায় পাঠক বিভ্রান্ত হন না।

অনুবাদ ভাবানুবাদ না আক্ষরিক হবে যুগ যুগ ধরে এই বিতর্ক অব্যহত। এবং তা মেটার কোনও অবকাশও নেই।

অনুবাদ প্রসঙ্গে হোরেস বলেছিলেন ,‘As the wood change their foliage with the decline of each year and the earliest leaves fall ,so words die out with old age and the newly born ones thrive and proper just like human beings in the vigor of youth’। অর্থাৎ বিষয় পুরোনো হলেও তা নতুন এবং স্রষ্টার আপন সম্পদ হয়ে উঠতে পারে যদি অনুবাদক সেই বিষয়টার মাত্রাজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন থাকেন। রোমান ক্লাসিসিজমের অন্যতম ব্যক্তি লনজাইনাস ও আক্ষরিক অনুবাদের অন্ধ অনুকরণ না করার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন।

রেনেসাঁর প্রভাব শুধু সাহিত্যে কবিতায় বা গদ্যে পড়েনি ,তার প্রভাব অনুবাদেও। তারই ফলশ্রুতি জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটে। তাঁর ফাউস্ট নাটকের নায়ক ফাউস্ট সেন্টজনের এর গসপেল অনুবাদ করতে গিয়ে যে সমস্যায় পড়েছিলেন তার মধ্যে দিয়ে গ্যেটের অনুবাদ নিয়ে মনোভাবের পরিচয় মেলে। তিনি একই সময়ে ও একই ভাষার থেকে অনূদিত প্রতিটি সাহিত্যকেই ঠিকঠাক পেশ করার জন্য অনুবাদককে তিনটি স্তর অতিক্রম করতে হয়, এই কথাও বলে মুলত অনুবাদকের ভাবানুবাদকে কিছুটা মূল্য দিলেন, এবং তারই ফলশ্রুতি গাউস্টের অনুবাদ।

‘অনুবাদ-চর্চা’ নিয়ে লিখিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূমিকায় লিখেছেন –“ দুই সম্পূর্ণ বিভিন্ন ভাষার মধ্যে কথায় কথায় অনুবাদ চলতেই পারে না। ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষায় প্রকাশের প্রথা স্বতন্ত্র এবং পরস্পরের মধ্যে শব্দ ও প্রতিশব্দের অবিকল মিল পাওয়া অসম্ভব, এই কথাটি তর্জ্জমা করতে গিয়ে যতই আমাদের কাছে ধরা পড়ে ততই উভয় ভাষার প্রকৃতি স্পষ্ট করে বুঝতে পারি। এই জন্যে অনুবাদের যোগে বিদেশী ভাষাশিক্ষার প্রণালীকে আমি প্রশস্ত বলে মনে করি।”

অনুবাদ নিয়ে ইংরেজিতে একটি জনপ্রিয় উক্তি আছে। “Translations are like women. They are either beautiful or faithful” যিনি দুটি ভাষাই উৎকৃষ্টভাবে জানেন, তিনিই পারবেন সঠিক মূল্যায়ন করতে।অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বিউটিফুল’ অনুবাদের গ্রহনযোগ্যতা বেশি। কারন তা পাঠককে মূল ভাষা না জেনেও আকৃষ্ট করে অন্য লেখাগুলোও পড়ার জন্য।

উপরের এই অংশটি থেকে এটুকু অনুমান করা যায় ননী ভৌমিক এদের সকলের কথাই মাথায় রেখেছিলেন অনুবাদ করার সময়। এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তার সঠিক ব্যবহার করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর অনুবাদ হয়ে উঠেছিল বিউটিফুল ও ফেথফুল। তাই তাঁর অনুবাদ পড়তে গিয়ে পাঠক হোঁচট খায় না, বরং মূল কাহিনির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন। আর এখানেই একজন অনুবাদকের সাফল্য।

অবশ্য অনুবাদ করতে গিয়ে লেখক ননী ভৌমিক হারিয়ে গেছেন ক্রমশ। ১৯৪৬ এর প্রেক্ষাপটে দশটি গল্প নিয়ে প্রকাশির ধানকানা মৌ্লিক লেখক হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ধুলোমাটি উপন্যাসের জন্য পেলেন ১৯৮৯ সালে বঙ্কিম পুরস্কার।

কিন্তু ধুলোমাটির তার আর কোনও লেখা চোখে পড়ে না। ততদিনে তিনি রাশিয়ান সাহিত্যের অসাধারণ ভান্ডার খুলে দিচ্ছেন বাঙালি পাঠকের কাছে অনুবাদের মধ্যে দিয়ে। এই কাজে তিনি এতটাই সফল যে তাঁর পূর্ববর্তী সব লেখা ম্লান হয়ে গেল।

বিদেশেই তীব্র অর্থকষ্ট ও সন্তানের অকাল মৃত্যু তাঁকে সরিয়ে দিল সাহিত্যের আঙিনা থেকে। নিঃসঙ্গ এক নাবিকের মতো ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে তিনি রাশিয়াতেই পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন তিনি। তারপর বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেন প্রবাদপ্রতীম অনুবাদক ননী ভৌমিক।

সোভিয়েট দেশও নেই। আর তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থেরও আর খোঁজ পাওয়া যায় না। তবু যেটুকু পেলাম এখানে নাম উল্লেখ করলাম।
১। উভচর মানুষ (আলেক্সাঔর বেলায়েভ) রাদুগা, ১৯৭৩
২। পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার( ইউরি দ্রুকভ) প্রগতি, ১৯৭৪
৩। বাচো আর গোচো( ওতিয়া ইউসোলিয়ান) প্রগতি, ১৯৭৫
৪। বঞ্চিত লাঞ্চিত ( ফিওদর দস্তোয়েভস্কি) প্রগতি, ১৯৭৮
৫। আন্না কারেনিনা ( লিও তলস্তয়) রাদুগা, ১৯৮৩
৬। সোনার পেয়ালা( কায়ুম তাংগ্রিকুলিয়েভ) রাদুগা, ১৯৮৯
৭। সোনার চাবি কিংবা বুরাতিনোর কান্ড কারখানা ( আলেক্সেই তলস্তয়) রাদুগা, ১৯৮৮
৮। ইউক্রেনের লোককথা ( রাদুগা, ১৯৮৮)


এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “bibidho-noni-bhoumick

  1. আমার খুব ভালো লাগলো! ছোটবেলার দিনগুলো যেন আবার মনে পড়ে গেল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *