মূল রচনা – অক্ট্যাভিও পাজ (রচনাকাল-১৯৪৯)
অনুবাদ- বৈশাখী ঠাকুর
(লেখক পরিচিতি: অক্টাভিও প্যাজ লোজানোর জন্ম ৩১শে মার্চ, ১৯১৪তে মেক্সিকো সিটিতে। তিনি ছিলেন মূলতঃ একজন কবি ও কূটনীতিক। তার কাজের জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে জেরুজালেম পুরস্কার, ১৯৮১ সালে মিগুয়েল ডি সারভন্টেস পুরস্কার, ১৯৮২ সালে সাহিত্যের জন্য নিউসট্যাড আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
পাজের সাহিত্যের সাথে পরিচয় হয় দাদুর লাইব্রেরীর প্রভাবে যেখানে ইউরোপিয়ান সাহিত্য এবং মেক্সিকান সাহিত্যের বইয়ে ভর্তি ছিল। পাজ একটি রোমান ক্যাথলিক ইস্কুলে পড়েছিলেন এবং মেক্সিকোর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে, ১৯৩৩ সালে ওনার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পায়। ১৯৫০ সালে ওনার লেখার ইংরেজী অনুবাদ, “দ্যা লাবিরিন্থ অফ সলিচুড” প্রকাশিত হয়েছিল যা ওনাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। কাব্য সংকলন, নো প্রসারান ওনার অন্যতম সৃষ্টি। বিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকার এই উল্লেখযোগ্য লেখক ১৯শে এপ্রিল, ১৯৯৮ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।)
ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে উঠে পরলাম। গরম বাষ্প উঠছে যেন সবে নতুন স্প্রে করা লাল রঙের ইটের থান বসানো উঠোন থেকে। একটি ধূসর পাখনাওয়ালা প্রজাপতি হলুদ আলোটার চারিপাশে ঘুরছে। আমি আমার খাটিয়া থেকে লাফিয়ে নামলাম, খালি পায়ে ঘরটা পার হয়ে গেলাম অতি সাবধানে যাতে কোন বিছের ওপর পা না দিয়ে ফেলি যে একটু সতেজ বাতাসের আশ্বাসে নিজের গোপন আস্তানা থেকে হয়তো বেরিয়ে এসেছে। আমি ছোট জানলাটার কাছে গেলাম আর বুক ভরে গ্রামাঞ্চলের বিশুদ্ধ বাতাস সেবন করলাম। কান পাতলে রাতের শ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাবেন, ঠিক এক নারীর মতন, বড় বড়। আমি ঘরের মধ্যিখানে ফিরে এলাম, ঘড়া থেকে জল খালি করে পিউটার বেসিনে ঢেলে আমার তোয়ালেটাকে ভাল করে ভেজালাম। আমার বুক এবং পা ভাল করে ঐ ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছলাম, খানিকক্ষণ নিজেকে শোকালাম, এবং নিশ্চিত করলাম যে জামাকাপড়ের কোন ভাঁজে যেন কোন ছাড়পোকা না লুকিয়ে থাকে, অতঃপর, নিজে সেই পোশাক পরলাম। এরপর আমি তরতর করে নেমে গেলাম সবুজ রঙের ঐ সিঁড়ি দিয়ে। বোর্ডিং-হাউজের দরজায় আমি মালিকের সাথে ধাক্কা খেলাম, সেই একচক্ষু, মিতভাষী ভদ্রলোক। চোখ দুটি আধ-বোজা, বেতের মোড়ায় বসে উনি ধূমপান করছিলেন। কর্কশ গলায় উনি জিজ্ঞেস করলেন,
—– কোথায় যাচ্ছ তুমি?
—– একটু হাঁটতে যাচ্ছি। বড্ড গরম ভেতরে।
—— হুম—সবকিছু বন্ধ এখন। আর এখানে আশেপাশে কোন রাস্তার আলোও নেই। তাঁর চেয়ে যেখানে আছ সেখানে থাকাই বেশী ভাল হবে।
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম, বিড়বিড় করে বললাম, “এক্ষুনি ফিরছি”, আর অন্ধকারের সাথে মিশে গেলাম। প্রথমে, চোখে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি খোয়াই-এর রাস্তা দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। হঠাৎ করে, কালো মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ উদ্ভাসিত হয়ে একটা সাদা দেয়ালকে আলোকিত করল, যা ভেঙে পরে প্রায় ধ্বংস্তূপের আকার নিয়েছে। আমি দাঁড়ালাম, এই শ্বেতশুভ্র আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আমি বাতাসে তেঁতুলের ঘ্রাণ নিলাম। রাত তখন গুনগুন করছিল পাতার মর্মরধ্বনি আর পোকাদের তানের সুরে। ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা ডেকে চলেছিল বড় বড় ঘাসের আড়ালে। আমি মাথা তুলে তাকালাম, ঐ সুদূর ওপরে তারাদের দলও শিবির ফেলেছে আকাশে। আমি ভেবেছিলাম এই মহাবিশ্ব, আদতে বিভিন্ন চিহ্ন পদ্ধতির প্রক্রিয়া, বিশাল বিশাল সত্ত্বার সাথে তাঁদের কথোপকথন। আমার ক্রিয়া, যেমনটা ঝিঁঝিঁরা দেখেছিল, তারা ঝিকিমিকি করেছিল, আসলে এগুলো কিছুই ছিল না –কেবলমাত্র বিরতি ও অক্ষর, বিক্ষিপ্ত পর্যায় কিছু সংলাপ। কোন কথা হতে পারে যেখানে আমি কেবলমাত্র একটি অক্ষর? কে উচ্চারণ করে সেই শব্দ? কাকে বলা হয় সেটা? আমি রাস্তার ধারে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ছোঁড়ার সময় সে একটি চকমকি বাঁক নিল, ইতস্ততঃ কিছু স্ফুলিঙ্গ দেখা দিল, ঠিক ছোট একটা ধূমকেতুর মতন।
ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ ধরে আমি হাঁটলাম। নিজেকে মুক্ত মনে হল, দুটি ঠোঁটের মধ্যে নিরাপদ, যারা এই মুহূর্তে এত আনন্দের সাথে আমার সঙ্গে কথা বলছে। রাতের আসলে অনেক চোখ, যেন চোখের বাগান। যখন আমি রাস্তা পার করছিলাম, তখন শুনতে পেলাম কেউ একটা দরজা ঠেলে বেরোচ্ছে। আমি ঘুরে তাকালাম, কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। খানিকক্ষণ বাদে, আমি শুনতে পেলাম গরম পাথরে স্যান্ডেলের গতানুগতিক এলোমেলো আওয়াজ। আমি পেছন ফিরে তাকাতে চাইছিলাম না কিন্তু প্রতি পদধ্বনিতে টের পাচ্ছিলাম, ছায়াটি আমার আরো নিকটে চলে আসছে। আমি দৌড়নোর প্রচেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। আচমকা আমি থমকে দাঁড়ালাম। নিজেকে রক্ষা করার আগেই টের পেলাম, একটি ছুরির ফলা আমার পেছনে ধরা হয়েছে এবং একটি মিষ্টি গলা।
—- নড়বেন না মশাই, নাহলে কিন্তু ভেতরে ঢুকিয়ে দেব।
মাথা না ঘুড়িয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
—— কি চাই আপনার?
—— আপনার চোখ মশাই। বেদনার্ত, নীচু স্বরে সে উত্তর দিল।
—— আমার চোখ! আমার চোখ দিয়ে আপনি কি করবেন? দেখুন, আমার কাছে কিছু টাকা আছে। খুব বেশী অংকের নয়, তবু কিছু আছে। আমি আপনাকে সবটা দিয়ে দেব যদি আপনি আমাকে ছেড়ে দেন। আমাকে মারবেন না।
—— ভয় পাবেন না মশাই। আমি আপনাকে মারব না। আমি শুধু আপনার চোখ দুটো নিয়ে নেব।
——- কিন্তু আমার চোখ দুটোই আপনার দরকার কেন? আমি আবার মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
——- আমার প্রেমিকার এটা খেয়াল বলতে পারেন। তাঁর নীল চোখের তোড়া চাই। আর এখানে নীল চোখ বেশ দুষ্প্রাপ্য, যা দেখা যাচ্ছে।
——- আমার চোখ দিয়ে আপনার কোন সাহায্য হবে না। আমার চোখের মণির রং বাদামী। নীল নয়।
—— আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না মশাই। আমি জানি আপনারটা নীল।
—— আপনার ভ্রাতৃ স্থানীয় মানুষের চোখ নিয়ে নেবেন না। বরঞ্চ, আমি আপনাকে অন্য কিছু দিচ্ছি।
——- একদম বেশী সাধু সাজার চেষ্টা করবেন না। অত্যন্ত রূঢ় গলায় তিনি বললেন, “নিন, এবার পেছন ঘুরুন।”
আমি ওনার দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। ছোটখাটো এক দুর্বল মানুষ উনি। মাথার টুপিটা মুখের অর্ধেকটা প্রায় ঢেকে রেখেছিল। ডান হাতে ধরা ছিল দেশীয় একটা শাণিত ছোড়া যা চাঁদের আলোয় চকচক করছিল।
—– দেখি, আমাকে আপনার মুখটা দেখতে দিন।
আমি একটা দেশলাই জ্বেলে আমার মুখের সামনে ধরলাম। অত কাছে আলোর ঝলকানি আমাকে ট্যাঁরা করে দিয়েছিল। উনি শক্ত হাতে আমার চোখের পাতা ভাল করে খুললেন। উনি ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন না। পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু করে দাঁড়িয়ে তিনি আমার দিকে তীব্রভাবে তাকিয়েছিলেন। দেশলাইয়ের কাঠিতে আমার তখন আঙুল পুড়ে যাবার উপক্রম। আমি কাঠিটা ফেলে দিলাম। নীরব একটি মুহূর্ত কাটল।
—– এবার আপনার বিশ্বাস হয়েছে তো? আমার চোখ নীল নয়।
—– খুব চালাক আপনি তাই না? সে বলল, “কই দেখি ভাল করে। আরেকটা দেশলাই জ্বালান।”
আমি আরেকটা দেশলাই কাঠি জ্বালালাম, এবং চোখের সামনে ধরলাম। আমার জামার হাতা টেনে ধরে, উনি আদেশ করলেন ,
—- হাঁটু গেড়ে বসুন।
আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। তিনি এক হাতে আমার চুলের মুঠি ধরে, মাথাটা পেছন দিকে ঠেলে দিলেন।
তিনি আমার ওপর ঝুঁকে পরলেন, কৌতূহলী এবং উত্তেজিত, এদিকে সেই শাণিত ছোঁড়া ধীরে ধীরে আমার চোখের পাতা ছুঁয়ে নীচে পরে গেল। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
—— চোখ খুলে রাখুন। উনি আদেশ করলেন। আগুনের শিখা আমার চোখের পাতা পুড়িয়ে দিল। হঠাৎ করেই তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন।
—– ঠিক আছে। যান। আপনার চোখের তারা নীল নয়।
তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমার দু হাতে মাথাটা ধরে আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি কোন মতে সামলে নিজেকে টেনে তুললাম। হোঁচট খেতে খেতে পরে যাচ্ছিলাম। তারপর চেষ্টা চরিত্র করে ফের উঠে দাঁড়ালাম। তারপর আমি ছুটতে শুরু করলাম। নির্জন শহরের রাস্তা দিয়ে আমি ঘণ্টা খানেক ছুটেছিলাম। যখন আমি প্লাজায় পৌঁছলাম, তখনও বোর্ডিং-হাউজের মালিক দরজার সামনে বসে ছিলেন। বিনা বাক্যব্যয়ে আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। তাঁর পরের দিন ঐ শহর আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন