মূল রচনাঃ নাগিব মাহফুজ
অনুবাদ – বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
(লেখক পরিচিতি: নোবেল বিজয়ী এই মিশরীয় সাহিত্যিকের জন্ম ১৯১১ সালে কায়রোতে। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি মিশরীয় বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন যা তাঁর জীবনকে আলোড়িত করেছিল এবং তাঁর সাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। ১৭ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু। ১৯৩৪ সালে মিশরীয় বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে কায়রো ইউনিভার্সিটি থেকে দর্শনে স্নাতক হন, পরে গবেষণার কাজে ব্যপৃত হলে তা ছেড়ে দিয়ে পূর্ণ সময়ের পেশাদার লেখক হয়ে ওঠেন। মিশরের বাস্তবমুখী সাহিত্য আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত থেকে ৩০টি উপন্যাস এবং ১০০টিরও বেশি ছোটগল্প রচনা করেন তিনি। ‘আল-খলিলি’, ‘মাইদাক গলি’, ‘মরীচিকা’, ‘শুরু এবং শেষ’ ও ‘কায়রো ট্রিলজি’ তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির অন্যতম। ১৯৫৫-১৯৫৭ এই সময়কালে লিখিত কায়েরা ট্রিলজি (‘প্যালেস ওয়াক’, ‘প্যালেস অব ডিজায়ার’ ও ‘সুগার স্ট্রিট) তাঁকে আরব সাহিত্যের দুনিয়ায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিনত করে। ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মিশরের ঐতিহ্যবাহী নাগরিক আলো অন্ধকারের জীবনধারাকে নিখুঁতভাবে তুলে আনেন এই ট্রিলজিতে। এর স্ব্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ২০০৬ সালে ৯৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু আরব সাহিত্যে শূন্যতার সৃষ্টি করে)
একটা মাঠ ছিল আমাদের বাড়ির পাশে। যেখানে আমার দুরন্তপনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল কয়েকটি গাছ। গাছগুলোর ডাল ধরে পুকুরে ঝাঁপ মারতে গিয়ে শুধু নিজের হাত পা নয়, ওদের ডালও ভেঙে দিয়েছি কতবার। যতবার এরকম করতাম ততবারই মা বাবাকে বলত- ওকে দাও না একটা স্কুলে ভর্তি করে, মাথাটা শান্ত হবে। বাবা তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়ে বলত- আরও কিছুদিন যেতে দাও। তারপর…
তারপর একদিন মা আমাকে সাজিয়ে দিল নতুন পোশাকে। জুতো পরিয়ে দিল সুন্দর করে। আমার মনপসন্দ খাবার ভরে দিল কৌটোয়। আমি বাবার আঙুল ধরে হাঁটছিলাম রাস্তায়। আমার মনে কোন আনন্দ ছিল না। বাবার লম্বা লম্বা পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল আমার বিষণ্ণ পা।
মা জানলায় চোখ রেখে দেখছিল আমাকে। আমি বারবার ফিরে দেখছিলাম মাকে। বাতাস বয়ে আনছিল মায়ের ভেজা চোখের আর্দ্রতা। এই দুঃসময়ে মা তার সিদ্ধান্ত বদলাবে আমি আশা করেছিলাম। মা স্থির হয়ে রইল ছবির মতো। আমি অনিচ্ছায় পেরিয়ে যাচ্ছিলাম ফুলের বাগান, সবুজ খেত, নাশপাতির গাছ, হেনাগাছের সারি অথবা খেজুরগাছের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা। পুকুরের ধারে গাছের ডাল থেকে জলে ঝাঁপ দিচ্ছিল আমার মতো অথবা কমবয়সী কয়েকটি শিশু। আমি তাদের অতিক্রম করে চলে যাচ্ছিলাম।
একটা বিশাল বাড়ির কাছে এসে আমরা থামলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম এর নাম স্কুল। বাবাকে অত্যন্ত করুণ স্বরে বললাম- আব্বা, আমি হলফ করে বলছি আর কখনও বদমায়েসী করব না, আর কোনদিন তোমাদের কষ্ট দেব না। আমার গোস্তাফি মাফ করে দাও।
বাবা বলল- স্কুল কোন জেলখানা নয়, এ পরম শান্তির জায়গা। কচি কচি শিশুদের মানুষ বানাবার কারখানা। এখানে কত কী শিখবি। শিখতে শিখতে একদিন বুঝতে পারবি কত বড় গেছিস।
আমার ভালো লাগছিল না কিছুই। বাবার হাতটা জোর করে আঁকড়ে ধরেছিলাম।
বাবা বলল- খবরদার, এরকম নয়, ছাড়, ছাড় বলছি।
জোর করে আমার আঙুলটা ছাড়িয়ে নিল বাবা। ইচ্ছে করছিল না তবু ভয়ে ভয়ে সেই বিশাল পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দির ভেতর আমাকে ঢুকতে হল।
যেখানে ঢুকলাম, সেখানে একজনকেও আমি চিনি না। আমি ভ্যা করে কেঁদে ফেললাম। বাবা বলল- ব্যাটা সাহসী হতে হবে, জীবন আজ থেকেই তো শুরু হল তোর। একা একাই অপরিচিত মানুষ নিয়ে চলতে তোকে, তাদের ভালোবাসতে হবে, আপন করতে হবে, এর নাম শিক্ষা। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব ছুটি অবধি। তারপর তোকে হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যাব।
আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। অনেক ছেলের মাঝে একজনকেই আমার খুব আপন মনে হল। ওর চোখে আমারই মতো মনখারাপ মাখানো রয়েছে। আমি ফিসফিস করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম – তুমি কার সাথে এলে? তোমার আব্বার সাথে?
ছেলেটি বলল- আমার আব্বা বেঁচে নেই। আমার মা আমার হাত ধরে এখানে রেখে গেছে।
আমি ছেলেটির কাঁধে হাত রাখলাম। সেও আমার হাতখানা ধরে রাখল আদরে। এই প্রথম আমি বন্ধুত্ব শিখলাম।
কেউ কেউ চেঁচিয়ে উঠছিল জোরে। কেউ কাঁদছিল। কেউ ফিসফিস করছিল। একসময় ঘণ্টা বাজল। কেমন নীরব হয়ে গেল চারপাশ। একটা ঘরে আমারই সমবয়সী সব বন্ধুরা এসে বসলাম। একজন ভদ্রমহিলা বললেন – এও হচ্ছে তোমাদের বাড়ি। এখানে মায়ের মতোই ভালোবাসবে সবাই। ঘরের চেয়ে আদর এখানে কম পাবে না বরং এক সুখী ও বৃহৎ পরিবারের অনুভূতি নিয়ে আরও আনন্দময় হয়ে উঠবে জীবন। ধর্ম ও জ্ঞানচর্চার ভেতর দিয়ে পৃথিবীকে দেখবে আলাদাভাবে, সম্পুর্ণ নতুন দুনিয়া।
দেখতে দেখতে আমার ভালো লাগল সবকিছু যে ভয় এবং আতঙ্ক নিয়ে এখানে এসেছিলাম তার আর বিন্দুমাত্র অবশেষ নেই। যে ছেলেদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হল তারা আমারই মতন। তাদের মনের ভেতরের সমস্ত সুখ অসুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। তারাও দেখতে পাচ্ছিল আমার আহ্লাদ বিষাদ। স্কুল এরকম হয়! এ আমার জানা ছিল না। জানতে পেরে আমার মনে হল সারা পৃথিবীতে মন ভালো করার যা উপাদান আছে স্কুল সেই সব জিনিসের উন্মুক্ত ভাণ্ডার। এখানে সবই আছে। বল খেলা, সবুজ মাঠ। প্রতিপক্ষকে ডিঙিয়ে গোলপোস্টের দিকে বল নিয়ে যাওয়ার আনন্দ। দৌড় দৌড় দৌড়। তারপর লক্ষ্যবস্তুর দিকে যাওয়ার সফল অথবা ব্যর্থ প্রয়াস।
এত কিছু আনন্দের পর একসময় ঘণ্টা বাজল। এক একটি ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল ছেলেমেয়েরা। গেটের কাছে এসে জড়ো হল সবাই। গেট খুলে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। অনেক নতুন মুখ দেখতে পেলাম, যাদের আমি চিনি না। তবু এদের সবাইকে আমার খুব আপন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমরা সবাই এক পরিবারে লোকজন। আমি গেট পেরিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। লম্বা গাছটার নীচে বাবার বসে থাকার কথা ছিল। সেখানে কাওকে দেখতে পেলাম না। আমি দূরের দিকে তাকালাম। হয়তো বাবা দোকানে পান পান কিনতে গেছে, এখনই ফিরবে। অনেক মানুষের ভিড় জমেছে রাস্তায়। সেই ভিড়ের মধ্যে কোথাও বাবার মুখ দেখতে পেলাম না। আমি বাবা, বাবা বলে কয়েকবার চীৎকার করলাম। কিন্তু কোন উত্তর শুনতে পেলাম না। বইএর ভারি ব্যাগ নিয়ে আমি এগিয়ে এলাম আরও কিছুদূর পথ। একজন বুড়ো মানুষ ভালো করে হাঁটতে পারছে না, তবু লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে এল আমার কাছে। আমি তাকে দেখেই চিনতে পারলাম। আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম – বাবা। তুমি আমাকে নিতে এসেছো?
বাবার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছিল। কোন কথা বলতে পারছিল না। তবু কাঁপা গলায় বলল- খোদা মেহেরবান, সাবধানে রাস্তা হাঁটবি বাবা, দিনকাল ভালো নয়। এরপর বাবাকে আর আমি দেখতে পেলাম না।
আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম। যে সবুজ মাঠের পথ দিয়ে আমি এসেছিলাম তার কোন চিহ্নই দেখতে পেলাম না। সেখানে অনেক লম্বা আর উঁচু বাড়ি। একটা পুকুরের পাশ দিয়ে এসেছিলাম যেখানে সাঁতার কাটছিল কত ছেলেমেয়ে। আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলাম পুকুরটাকে। কোথাও তার স্মৃতির আভাস অবধি নেই। আমি অনুমান করে নিলাম এই শপিং মলের জায়গায় সেই পুকুরটা ছিল। কাদামাটির রাস্তা ধরে খেজুর গাছের সারি পেরিয়ে যে দীর্ঘপথ তা আজ ঝকঝক করছে আলোয় আলোয়। রাস্তা জুড়ে শুধু ভেলকিওয়ালা মানুষের নানা কারবার। কেউ ঝুড়ি থেকে বের করে আনছে বিষাক্ত হিলহিলে সাপ। যারা ছোবল দিচ্ছে পথচারী শান্ত মানুষকে। কেউ বুঝতে পারছে না এই ধীর অথচ তীব্র বিষের জ্বালা। সুন্দর পোশাক আশাক পরে মুখে রঙ ও সুদৃশ্য পালিশ মেখে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে কত কত পুরুষ ও রমণী। এরা কোথায় যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। কেউ কেউ চীৎকার করছে বাতাস কাঁপিয়ে- এই পথে আসুন, এই পথে। সহজেই আপনি পেয়ে যাবেন আপনি যা চান।
আমি এদের সবার পাশ কাটিয়ে হেঁটে যেতে লাগলাম। আমার মাথা ঘুরছিল। আমি কেমন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম। সেই কোন সকালে বেরিয়ে হাঁটছি হাঁটছিই। আধখানা দিন পেরিয়ে এলাম। দূরে সুর্য ডুবে যাচ্ছে। আমাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে মা। খোলা জানালায় তার চোখ ভর্তি জল। আমি সাবধানে রাস্তা পার হতে চাইছিলাম । হাজার হাজার গাড়ির স্রোত। সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খেলাম।
কে একজন আমার সামনে এগিয়ে এল। বলল- হাতটা ধরো, দাদু। বাকি রাস্তাটুকু পার করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন