short-story-bhutbhutam

ভূতভুতুম
তিলোত্তমা মজুমদার


লোকে বলে, এ ঘোরকলির যুগে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাভাব হ্রাস পাইতেছে। কেহ কাহাকেও বিনম্র সম্মান নিবেদনে প্রস্তুত নহে। প্রত্যেকে আত্মমোহে রাজা সাজিয়া অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে চায়। গুণীর স্বীকৃতি নাই, বিদ্বানের বরণমাল্য নাই, সততার কীর্তন নাই। কিন্তু এরূপ ধ্বংসাত্মক চিন্তন ক্ষতিকারক বলিয়া আমি মনে করি। কতিপয় লোকের স্বভাব হইল কূটচিন্তা ও নিন্দা করা। কোকিলের কুহুরব শুনিলেও তাহারা বলে, ও কুহু বলিয়া ডাকে কেন? সুহু বলিয়া ডাকিলে কী হইত? এরূপ মন্তব্য শুনিয়া আমি এক বসন্তদূত পাকড়িয়া জিজ্ঞাসিলাম, ‘ ওহে, তুমি কেবল কু ডাকো কেন বলো দেখি ?’
সেই পরভৃত কলঘোষে সবিস্ময়ে কহিল, ‘আমি কখন কু গাহিলাম?’
‘সর্বদাই কু কু করিতেছ। জানো না, কু বলিলে কু-ই হইবে, সু কিছু হইবে না।‘
‘এই কু সেই কু নহে দাদা। পক্ষীর কু আর মনুষ্যের কু ভিন্ন। আমি কুহু বলি সুরে। যে স্থলে সুরের অবস্থান, সে স্থলে দুর্লক্ষণের সম্ভাবনা নাই। তোমরা যে গৃহ বলিতে কুটির বলো, তাহা লইয়া বিতর্ক উত্থাপিত হইলে কী যুক্তি দিবে?’
কোকিলের অকাট্য কুকথা শুনিয়া ভারী ক্রোধ জন্মিল। কহিলাম, ‘তুমি কী বলিয়া ডাকিবে সে তোমার বিষয়। আমার উহাতে কোনও রূপ আগ্রহ নাই। লোকে বলাবলি করে তাই কহিলাম। তুমি কুটিরের প্রসঙ্গ টানো কোন সাহসে? আজ অবধি তো বাসা বাঁধিতে শিখিলে না। পিকতান গাহো আর পরভৃৎ উড়িয়া বেড়াও।‘
কোকিল, ’বেশ করি। পারিলে তুমিও করিতে।‘ এই বলিয়া কুহু কুহু গাহিয়া উড্ডীয়মান হইল।
অপ্রসন্ন চিত্তে চলিতেছি, দেখি সুবিশাল এক মঞ্চ। কত তাহার আলোকসজ্জা, কত না জাঁকজমক। লোক একেবারে উপচিয়া পড়িতেছে। দর্শকাসনেই কেবল নহে, মঞ্চেও। কৌতূহলে আমিও রাজারূপী জনগণে ভিড়িয়া গেলাম। সেক্ষণে নীচস্থ রাজাগণ উপরিস্থিত রাজাগণের প্রতি করতালি দ্বারা সম্মান প্রদর্শন করিতেছিল। আমি পার্শ্ববর্তী রাজাকে জিজ্ঞাসা করিলাম,’ মঞ্চে এত লোক কেন? কি হইতেছে?’
সে বলিল,’ উহারা সকলেই গুণী, জ্ঞানী, এবং আরও কত কী। উহাদিগকে সম্মাননা ও পুরস্কার প্রদান করা হইতেছে।‘ শুনিয়া আমি খুশি হইলাম। আমার এ বঙ্গদেশে এরূপ কাতার দিয়া গুণী ব্যক্তি বিরাজ করিতেছেন জানা ছিল না। আমার জানা না জানায় কী আসে যায়। চাক্ষুষ দেখিতেছি, শৈশবে স্বাধীনতা দিবসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইয়া, জনগণমন ইত্যাদি গাহিয়া আমরা হস্ত প্রসারিত করিয়া যেরূপ লজঞ্জুস লইতাম, তেমনই গুণীজনগণমন পুরস্কার লইতেছেন, উত্তরীয় পরিয়া বড় বিনয়ে গলিতেছেন। কে বলে, কলিকালে জনগণমন হইতে বিনয় দূরীভূত হইয়া হুহুংকারী বদলা অধিষ্ঠিত হইতেছে? আমি তো দেখিলাম রাজায় রাজায় একত্রিত ও বিনয়বিগলিত। বড় সন্তোষ জন্মিল মনে। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের পর এরূপ গুণীজনবরণ আর কেহ করে নাই। আহ্লাদে স্থির করিলাম, ঝামাপুকুর গলির সন্তোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার হইতে কচুরি আর রাবড়ি খাইব।
পরদিবস কোন কালে কোন স্থানে যাইব ভাবিয়া কিঞ্চিৎ অন্যমনা হইয়া পড়িয়াছিলাম, এক ব্যক্তিরাজা বিরক্তি সহকারে কহিল, ‘ভারী হইতেছে পুরস্কার প্রদান। কত সত্যকার জ্ঞানীগুণী পড়িয়া রহিল, সেই খোঁজ কেহ রাখিল না। দেখুন দেখি, মঞ্চে উঠিলেই রাজার রাজা, উহাদিগের অপেক্ষা রাজাতর আর কেহ কি নাই? এই দর্শকাসনেই ভূরি ভূরি গুণী মিলিবে।‘
আমি বোকা রাজা বলিয়া ফেলিলাম, ‘সকলেই কি আর সমান গুণী? ইতরবিশেষ কি নাই?’
‘ইতরবিশেষ থাকিবে কেন? আমরা কি গণতন্ত্রে বাস করি না? আপনি তো সাম্রাজ্যবাদীর পদলেহী বুদ্ধিজীবীর ন্যায় কথা কন।‘
আমি দ্রুত প্রতিবাদ করিলাম, ‘দেখুন, আপনি চটিয়া উঠিলে আমি দুঃখ পাইব। আমরা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে বাস করি, কিন্তু বলুন দেখি, প্রজা কে? ‘
‘প্রজা? কেন? প্রজা হইতে হইবে কেন? আমরা গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক, সাম্যবাদী। আমাদিগের উচ্চনীচভেদ সংবিধানবিরুদ্ধ। রাজা তো সব রাজা। গুণী তো সকলে গুণী। জ্ঞানী তো আপনিও জ্ঞানী, আমিও জ্ঞানী।‘
আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হইল। নিজ জ্ঞান ও গুণ বিষয়ে সম্যক অবগত হইলাম। অনুভব করিলাম, আত্মবিশ্বাসের বুদ্বুদ রঙিন হইয়া ফাঁপিয়া উঠিতেছে। শীঘ্র স্বীয় পুস্তকাননে আমি সমালোচনা লিখিব কেন আমার ন্যায় সুযোগ্য গুণী রাজা পুরস্কৃত হয় না। আমি বঞ্চনার কাব্য লিখিব। কেহ আমার প্রতিভা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করিলে আমি উন্মত্ত গালি দিব।
ভাবিতে ভাবিতে আমার স্নায়ু তপ্ত হইল। পূর্বেও দেখিয়াছি ধর্মতলা গেলেই, বেঘোর মস্তিষ্ক
স্বাভাবিক হইয়া যায়। অতএব দিন কয় পার করিয়া আমি ধর্মতলা আসিয়াছি। জগতে ইহার তুল্য ধার্মিক স্থান আর নাই। এ স্থলে সকল একাকার। চোর পুলিশের সহিত খৈনি খায়। শাসক ও প্রতিবাদী অনাদির মোগলাই খাইয়া উদ্গার তোলে ও ভাষণ দেয়। অনাদিকাল হইতেই এইরূপ চলিয়া আসিতেছে। ধর্মতলা আমাদিগের ঐতিহ্য, গর্ব, আরও কত কী।
একখানি কাঠিবরফ লেহন করিতেছি, দেখি আস্ফালন করিতে করিতে এক পদযাত্রা আসিতেছে। দূরাগত শব্দ যানবাহনের নাদে মিশিয়া খণ্ড হইতেছিল, পদযাত্রা নিকটতর হইলে সবিস্ময়ে দেখিলাম, সেই যাঁহারা পুরস্কৃত হইতেছিলেন, মানপত্র উত্তরীয় স্মারক ও টাকাকড়ি প্রাপ্ত হইয়া পুলকে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া উঠিতেছিলেন, তাঁহারা এই পদযাত্রার পুরোভাগে পথ অলংকৃত করিয়া পুরস্কারদাতার মহিমাকীর্তন করিয়া চলিতেছেন। অহো, আমি এহেন কীর্তনমুখরতা আস্ফালন ধারণা করিলাম? অজানিতে তাঁহাদিগের অনুসরণ করিতে করিতে আমার চিত্ত আপ্লুত হইল, কালগর্বে বক্ষ স্ফীত হইল। কে বলে ঘোরকলিতে মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ নিশ্চিহ্ন হইয়াছে? এই যে সম্মুখে কৃতজ্ঞতার দিব্য অলাতচক্র।
রবিবাবুর প্রতি আমার অনুরাগ গভীর। কিন্তু এইক্ষণে আমি নীরবে তাঁহাকে তিরস্কার করিতে লাগিলাম। যাঁহারা তাঁহাকে সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত করিয়াছিলেন, কই, তিনি তো তাঁহাদের মহিমাকীর্তন করিয়া কৃতজ্ঞতা বুঝান নাই, সে কি সঠিক কর্ম হইয়াছে? কলিকালে সুভাষচন্দ্র বলিলেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব। ঘোরকলির বঙ্গে শুনিতে পাই, দেখিতে পাই, তোমরা আমাকে ভজনা করো, আমি তোমাদের পুরস্কার দিব। আমি তোমাদের পুরস্কার দিয়াছি, তোমরা আমার কীর্তন করো।
আমার বিশ্বাস ঘোরকলি শেষে সত্যযুগ উদিত হইল। হরিনাম কীর্তন করিয়া পাপী উদ্ধার হয়, তদনুরূপ ঘটনাই কি প্রত্যক্ষ করি না?
রাজরদনী যেরূপ নিশ্চিন্তে পদশৃঙ্খল বিস্মৃত হইয়া কদলীকাণ্ড ভক্ষণ করে, আমিও তাহার অনুকরণে মর্তমান কলা খাইতে লাগিলাম। অর্ধপরিমাণ গলাধঃকরণ হইল কী হইল না, এক দোস্ত আমার নাম পুকারিতে লাগিল। বলিলাম, ‘এত ডাকো কেন? কলার ভাগ চাও? সাতখানি কিনিয়াছিলাম, পাঁচখানি খাইয়া ফেলিয়াছি। ‘
দোস্ত মহাবিরক্ত হইয়া বলিল,’ জানো না, আমি সাতেও নাই, পাঁচেও নাই। শুনিয়াছ কি, নবমীনিশি গত হইয়াছেন?’
‘সেকি? কবে? কী করিয়া?’ আকস্মিক আঘাতে আমার হস্তধৃত কদলীগুলি ভূপাতিত হইল। এক দুর্গন্ধ কুত্তা সেগুলির আঘ্রাণ লইল, লেহন করিল, অবশেষে, ‘অখাদ্য, মানুষে কী না খায়,’ বলিয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া আপনার ভিতর আপনি ঢুকিয়া গেল। দোস্ত সেইদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া বলিল, ‘যেরূপ নিশ্চিন্তে কলা খাইতেছিলে, বুঝিয়াছি সংবাদ জানো না। অত বিচলিত হও কেন? বয়স বিরানব্বই পুরিয়াছিল। কথা হইল, তাঁহার মরদেহের অধিকার লইয়া দুই দলে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়াছে। বোমা ফাটিয়াছে, গুলি ছুটিয়াছে, তবে হতাহতের খবর নাই।‘
ঘোরকলিতে এও এক চমৎকার। নামজাদা কেহ মরিল কি তাঁহার দেহের অধিকার লইয়া রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাঁধিয়া যায়। মরদেহ কাহারা কী উপায়ে শ্মশানঘাটে লইবে সেই পবিত্র কর্তব্য বিষয়ে কাজিয়া। কী সম্মান। কী প্রভূত সম্মান। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর কোনও কালে এরূপ ঘটে নাই।
নবমীনিশি ভুবনবিখ্যাত সঙ্গীতকার বাঁকাশশীর ধর্মপত্নী। তাঁহার কতিপয় অধর্মপত্নীও ছিলেন। বাঁকাশশীর জীবদ্দশায় সেইসকল পত্নীগণ তাঁহার সঙ্গগুণে সঙ্গীতকার হইয়া উঠিলে বাঁকাশশী মনুষ্যের নিমিত্ত গান বাঁধিবার প্রয়োজন ফুরাইয়াছে বোধ করিয়া ভূতের গান রচনা করিতে লাগিলেন। ঘটনাচক্রে সেগুলি প্রভূত কদর পাইল, আর পত্নীগণ রচিত গানগুলি ভূত হইল।
নবমীনিশি গান বাঁধেন নাই, দুই কলি গাহিতেও কেহ শোনে নাই, তিনি কৃষ্ণপক্ষের নবমীনিশিই ছিলেন। বাঁকাশশীর বৈধ স্ত্রী বলিয়া তাঁহার মরদেহ কদর পাইতেছে।
বন্ধু বলিল, ‘চলো, শ্মশানঘাটে যাই। মনে পড়ে, নবমীনিশি লইয়া কত মিথ্যা কল্পনা আমাদের কৈশোরে মুখে মুখে ফিরিত?’
‘মনে পড়ে। হাতকাটা ব্লাউস, চোখে রৌদ্রকাচ, কবরীতে করবীগুচ্ছ, শাড়ির কী রঙ ছিল মনে নাই। তুমি বলিয়াছিলে, এমন স্ত্রীধন ফেলিয়া যে নারীলোলুপ হইতে পারে সে বোকাশশী।‘
‘ আমার স্মরণে আছে। সাদার উপর কালো ডুরি। তাঁতের শাড়িখান। কাঁধে কালো শান্তিনিকেতনী ঝোলা। চলো, শ্মশানে যাই।‘
‘চলো।‘
শ্মশানে মহাআয়োজন। রাজায় রাজারণ্য। বাঁকাশশীর বৈধ স্ত্রী অবশেষে মরিয়াছেন। বন্ধু অপরাপর রাজাদিগকে ঠেলিয়া নবমীনিশির নিকটে যাইতে লাগিল। সারিবদ্ধ বন্দুকধারী পুলিশ দেখিয়া আমি পার্শ্ববর্তী রাজাজনকে জিজ্ঞাসিলাম, ‘মরদেহ লইয়া গোলমাল হইয়াছিল বলিয়া অত পুলিশ?’
সে চক্ষু পাকাইয়া বলিল, ‘জানেন না, নবমীনিশি কে?’
‘কে?’
‘এককালে গান লিখিত। মেয়েছেলে গান লিখিত। হেব্বি না? আমরা উহাকে দাহ করিবার পূর্বে গর্দভ অনড় দিতেছি।‘
‘উনি গান লিখেন নাই। ওঁর স্বামী ছিলেন নামজাদা সঙ্গীতকার।‘
‘হ্যাহ, স্বামী। আপনি বলিলেই তো আর আমি মানিয়া লইব না। আমাদের এমএলএ বলিল ভাষণে, মেয়েমানুষ হইয়াও উনি কত শত গীত রচনা করিয়াছেন। পুরুষশাসিত সমাজের পরোয়া করেন নাই। কী বলিতেছেন মশাই?’
বিউগল ফুকারিল, বন্দুক উন্মুখ হইল, বৃহৎ চোঙায় গান বাজিয়া উঠিল,

বাবা ভূত মামা ভূত
ওঁচা ভূত চোখা ভূত
গেছো ভূত মেছো ভূত
মাসি ভূত পিসি ভূত
মামদো ভুতের কাণ্ড দেখে
বেজায় হাসি পায়
ভূতের ডেরায় কারা যায়

ভুতপূর্ব বাঁকাশশীর জনপ্রিয় গান। বুঝিলাম, ঘোরকলির অনড় গর্দভেরাই জানে, কোন গীতের পক্ষে কখন উপযুক্ত সময়।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *