স্বপ্নময় চক্রবর্তী
বারো তলার ছাদে
লোলা আর রুবির মধ্যে কথা হচ্ছিল। ওরা অনেক দিনের বন্ধু। প্রায় তিন বছরের। দেখা হলে পরস্পরকে ‘হাই’ করে, গুড মর্নিং গুড নাইট করে। সুখ দুঃখের কথা, মনের কথা, এমনকি গোপন কথাও বলে। লোলা বলল বড্ড বোর হচ্ছিরে রুবি। কতদিন হয়ে গেল হ্যাংআউট হয়নি। এই এক জায়গায় ঘুরতে কি ভালো লাগে?
রুবি বলল যা বলেছিস লোলা। চোখ পচে গেল। তার উপর ওই ছেলেটা, মিলো না কি যেন নাম, ও খুব ঝাড়ি করে আমায়। দেখেছি তোকেও করে। একদম পাত্তা দিবি না। নিজেকে খুব শো অফ করে। বডি স্কিল দেখায়, লাফায়, বল নিয়ে যতসব কায়দা করে। জাস্ট বোরিং। আমাদের ইনফ্লুয়েন্স করতে চায়।
লোলা বলে, আমরা যে ওকে পাত্তা দিচ্ছি না – সেটা এখনও বোঝে না ও। বলে বেড়ায় ও হল অ্যালসেসিয়ান। আসলে দো আঁশলা। প্রায় নেড়ি। আমরা হলাম রিট্রিভার। তুই কি আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার যোগ্য! বন্ধুত্ব করতে হলে রাস্তার নেড়িদের সঙ্গে দোস্তি পাতা গে শালা। সরি।
-না, না, না। সরির কি আছে।
-রাস্তার কুকুরদের মত বাজে কথা বলি না তো, বেরিয়ে গেল।
-ও ঠিক আছে। মাঝে মাঝে একটু খিস্তি না দিলে চলে? রাস্তার ওরা সব সময় খিস্তি দিচ্ছে, কিন্তু মস্তিতে আছে।
-ঠিক বলেছিস রে।
আমরা ভুল করেছি। আমাদের পেট চয়েসটা ঠিক হয়নি। আমরা যাদের পুষছি, ওরা ঠিকঠাক নয়। তোর তো আবার তিনটে পোষ্য। আমার বাবা একটা। আমি একটাকে নিয়ে হিমশিম, তুই তিনটে কি করে রাখিস রে? আমার পোষ্যটা এমনিতে ভালোই। বেশ কথা শোনে। যদি বলি যাও, দুটো করে বিস্কুট নিয়ে এসো, বেশ গুটিগুটি পায়ে ও ঘরে গিয়ে কৌটো খুলে বিস্কুট নিয়ে আসে। যদি বলি চিকেন স্যুপ খাবো, ঠিক ম্যানেজ করে দেয়। একজন ম্যাম আসে তো, ও আমার পোষ্যর জন্যও কুক করে আমার জন্যও করে। এখন কদিন ধরে অবশ্য আসছেনা। আমার পোষ্যটা জানিস তো, ওয়াইফ নেই। এই চারটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। হাসবেন্ড ওয়াইফ রিলেশন থাকে। অনেকের অনেক দিন ধরেই থাকে। আমাদের বাপু এসব ঝামেলা নেই, বল?
-একদম ঠিক বলেছিস। আমি আবার তিনটেকে রেখেছি। হ্যাসবেন্ড, ওয়াইফ আর ওদের একটা মেয়ে। ওরা তিনজনই বেশ কেয়ারিং রে। একজন অবিশ্যি একটু বেয়াড়া টাইপের, কথা শোনে না। আমাকে একটা বাজে জিনিস খাওয়াবার চেষ্টা করে।
বাচ্চা কিনা, বাচ্চাদের আবার বায়নাক্কা বেশী। ওকে খুশি করার জন্য দু চারবার খেয়েছি। বাজে খেতে। ক্যাডবেরি।
-এ্যাঃ তুই খেয়েছিস? কী বাজে গন্ধ। কী করে খেলি রে?
-কী করবো বল, পোষ্যের আব্দার। ওরা খুশি হলে মুখ দিয়ে কিরম যেন একটা আওয়াজ করে। ওরা লেজ নাড়াতে পারে না। ওদের লেজই নেই তো নাড়াবে কি করে।
-আমার বুড়োটা অনেকদিন বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল না। আমার তো একটু শরীর খারাপ করেছিল, তখন আমাকে পাহারা দেবার জন্য বাইরে বেরুচ্ছিল না। এখন আমার শরীর ঠিক আছে, কতদিন বলেছি, এ্যাই বুড়ো, কাম ডাউন, গো টু পার্ক, শোনেই না।
-হ্যারে ঠিক বলেছিস। আমার যে তিনটে পোষ্য আছে, বড্ড অলস হয়ে গেছে রে। পেট রাখা হয় আনন্দের জন্য। আনন্দই যদি না রইল তবে ওদের রাখা কেন, বল?
একদম ঠিক বলেছিস রে… খুব ফেঁসে গেছি।
-ওদের হাবভাব কেমন যেন হয়ে গেছে রে। আমার তিনটে পোষ্য রেখেছি, ওদের হাবভাব দেখে মজা পেতাম খুব। এখন ওরা সব কেমন যেন হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বের হয় না। একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে দেয় বাইরে, সব্জিওলা, মাছওলারা ব্যাগে পুরে দেয়, ব্যাটাছেলেটা দড়ি দিয়ে টেনে নেয়, মেয়েছেলেটা সাবান জল দিয়ে তরকারি পরিষ্কার করে। বাপের জন্মে এসব দেখিনি। কিছুদিন এসব দেখে মজা পেতাম। এখন আর পাইনা। আর কী বলবো লোলা, হ্যাজব্যান্ড ওয়াইফের যে কাজকর্ম হয়, ওরা সেসবও করে না রে। একদম কাছাকাছি যায় না। টাচউড, তিন মাস ওদের কোনও ইয়ে নেই। কিছু দেখতে পাইনা।
-আর আমার তো একটা বুড়ো। ওর তো বউ নেই। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি সবাই আছে বিদেশে। ফোনে ওদের সঙ্গে কথা বলে। সব বানানো কথা। শুধু আমার সঙ্গেই বুড়োটা মনের কথা বলে। ও কখন আনন্দ পাচ্ছে, কখন দুঃখ পাচ্ছে, কখন রাগ হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারি আমি। ওর নাতনিটার ছবি চলে আসে একটা চ্যাপ্টা বাক্সের ডালাটায়। তখন বুড়ো চুমু খায় ওই ডলাটায়। তখন আনন্দ হয়। আর বৌমাটা যখন নানা রকম উপদেশ দেয় এটা কোরোনা বাপি, বাইরে যেওনা বাপি, তখন খুব রাগ করে, কিন্তু মুখটা হাসি হাসি নাহক। ডালাটা বন্ধ করে রাগ দেখায়। আমি দেখি। কাল থেকে দেখছি বুড়োটা কেমন চুপচাপ। মুখের ভিতরে একটা কাচের কাঠি ঢোকাচ্ছে আর দেখছে। দিনের মধ্যে অনেকবার এরকম করছে।
-আজব একটা প্রাণীকে পুষ্যি নিয়েছিলাম আমরা। যা বরাত। চল, যাই, সন্ধ্যে হয়ে এলো। তোর হিসি করা হয়ে গেছে? -করেছি। এখানে জলের ট্যাঙ্কের থামের গোড়ায় একদম ভাল্লাগেনা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের গায়েই মজাটা, বল?
দোতলার ব্যালকনিতে
লোলা গ্রীলের ফাঁকে মুখ ঢুকিয়ে রাস্তা দেখছে। রাস্তায় মানুষজন খুব কম। কোথায় গেল সব পিঁ পিঁ পিঁ চিৎকার করতে করতে ধাওয়া অটোগাড়ি? প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে যাওয়া রিকশা? কেমন নিঝুম নিঝুম ভাব। রাস্তায় ভোলা, কেলো, ধনা, কালি, জগা, ঘেয়ো, আরও সব ছোটলোক কুকুরগুলো, ওদের সবার নাম জানিনা। আমার বুড়োটাকে নিয়ে যখন বেড়াতে যেতাম, ওরা আমার সঙ্গে সেধে সেধে ভাব করতে চাইতো। আমি ওদের পাত্তা দিতাম না। ওরা বড্ড নোংরা। আর বড্ড অসভ্য অসভ্য কথা বলে। সিলি কারণে ঝগড়া করে। ওদের কাজকর্ম কিছু নেই, আবার অবসরও নেই। সব সময় ছুটে বেড়াচ্ছে, এখানে যাচ্ছে, ওখানে যাচ্ছে, এটা খাচ্ছে, ওটা খাচ্ছে। ওদের নির্দিষ্ট কোনও পোষ্য নেই। ওরা সবাই মিলে একটা পাড়ার মানুষগুলোকে পোষে। ফেলে দেয়া হাড়গোড়গুলি খায়, জানালা দিয়ে রুটিরমাথা টাথা গুলো ছুঁড়ে দিতে বলে, মানুষগুলো কথা শোনে। ছুঁড়ে দেয়। দুই একজন মানুষ আছে, বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে আসে, সবাইকে একটা করে দেয়। ওরা এ্যাক্সেপ্ট করে। আমরা খেলে নাকি মানুষের পুণ্যি হয়। আমি উঁচু জাতের কুকুর, কিন্তু কুকুরতো বটে। ওদের ভাষা আমাদের ভাষা থেকে একটু আলাদা হলেও ওদের সব কথাবার্তা বুঝতে পারি। ওই ভেদ্দা, ভুলো, কালি, ল্যাংড়াদের দল কত গল্প করে। ওদের কথাবার্তা গ্রীলে মুখ বাড়িয়ে শুনছে লোলা।
-এই মানুষশালারা মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছে। হুট করে কী হল বলতো?
-আগে ভেবেছিলাম এস্টাইক। কিন্তু ওটা কি এতদিন ধরে হয় নাকি। তা ছাড়া স্ট্রাইকের আগে হল্লাগোল্লা হয়। বন্ধ সফল করুন সফল করুন করা হয়, তারপর সেই দিনটায় কিচাইন হুজ্জোত হয়। এখন কিন্তু ওসব কিচ্ছু হচ্চে না।
-আবে হচ্চে, হচ্চে, আমি দুদিন দেখেছি পুলিশ ডান্ডা মেরেছে…
-আরে ধুর, এস্টাইকে রাস্তার বেরুলে তো যারা এস্টাইক ডাকে, সেই পাট্টির লোকরা ঝিন্দাভাত ঝিন্দাভাত বলতে বলতে মারে। এখানে তো উল্টো কেস। পুলিশ বলছে ঘরে যা!
-হ্যা মাইরি, কি যুগ পড়ল! মালের দোকানগুলো পর্য্যন্ত বন্ধ। মাতাল হরিদাস সন্ধ্যেবেলায় টিউকল টিপে জল খাচ্ছে। লুচ্চা সিং, গব্বর, দুলাল, ওরাও ঠেক এ বসছে না। দেশি মালের দোকানে সন্ধ্যেবেলায় চাটের দোকানে বসে, ওখানে থার্মোক্লের বাটিতে ঘুগনির ঝোল, নাড়িভুড়ির ঝাল, চিকেন হাড্ডি এসব আমাদের জন্য একটু রেখে দেয়। সেটাও নেই। বেস্পতিবার ছাড়া এপাড়ায় মালের দোকান বন্ধ হতে দেখিনি কুনদিন।
আরও বন্ধ হয়। যেদিন সকাল বেলায় ঝান্ডা ওড়ে, জিলিপি বিলি করে। সেদিনও মালের দোকান বন্ধ থাকে।
-বেপাড়ার লোকদের ঠিক চিনতেও পাচ্ছিনা। মুখ তো ঢেকে রাখে। আগে চোর ছ্যাঁচোররা মুখ ঢেকে চুরি করতে আসতো শুনেছি। এখন তো সব ভদ্রলোকগুলোও মুখ ঢাকছে।
-আমার কি মনে হয় জানিস, মানুষগুলোর কোনও কারণে লজ্জা হয়েছে। তাই ওরা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেনা।
একটা রোয়াকের উপর বসে ঝিমুচ্ছিল একজন। গেঁজজ্যাঠা বলে ডাকে। গায়ের অনেক লোম উঠে গেছে ওর। বয়েস হয়েছে কিনা… গলা খাঁকারি দিল। তারপর বলল – আমার বেশী কথা বলতে আজকাল ইচ্ছে করে না। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। কত কিছুই তো দেখলাম। এই যে দু ঠেঙে প্রাণীটা, মানুষ, একটা বোকা টাইপের জানোয়ার। আমার বাবা একটা গল্প বলেছিল, তাদের কোন পূর্বপুরুষ নাকি দেখেছিল দুটো সাপ। একটার মুখ অন্যটার লেজে। একটা অন্যটাকে খাচ্ছিল। দুটোই দুটোকে খেয়ে হজম করে দিল। মানুষ হল ওই সাপদুটোর মতন। আমরা কুকুরজাতি মহান জাতি। আমরা যুগে যুগে কথার খেলাপ করি না। আমরা যুগে যুগে এই মানুষ ব্যাটাদের পুষছি। বহুকাল আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা একটু আরাম করবে বলে মানুষদের রেখেছিল। এরা আমাদের খাবারদাবারের ছাল ছাড়িয়ে দিত, টুকরো করে কেটেও দিত। সেদ্ধ করে কখনও বা চিবিয়ে বেশ নরম করে দিত। পূর্বপুরুষের কোনও কোনও শাখা ক্রমশ আরামকেই ভালোবাসতে শিখল। মানুষ জাতির মধ্যে হাতে লাঠি, খালি গায়ের একজন জন্মেছিল, বলেছিল ‘আরাম হারাম হ্যায়।’ কিন্তু তারও অনেক আগে আমাদের এক পূর্বপুরুষ একই কথা বলেছিল এই লোকটার অনেক আগে। ওরা মানুষের মত নরম বিছানা ভালোবাসে। ওরা শীতকাতুরে, গরম সয় না। ওরা কুকুর জাতির কলঙ্ক। মানুষের সঙ্গে বেশী মেলামিশি করে ওদের বারোটা বেজে গেছে। আমরা যারা রাস্তার কুকুর, তারাই হচ্ছে আসল কুকুর। আমরাই উঁচু জাত। তোরা ছেলেছোকরারা এসব বুঝিস না।
যাক, যা বলছিলাম, শোন। এই মানুষ বহুত কেদ্দানি দেখাচ্ছে। নিজেদের ঘর ঠান্ডা করে বাইরে গরম হাওয়া পাঠাচ্ছে তো দেখতেই পাচ্ছিস। প্লাস্টিক ফাস্টিক ছাতামাথা কি সব নিয়ে মেতে আছে। আমরা ওরা যা ফেলে দেয়, খেয়ে নি। কিন্তু প্লাস্টিকটা খেতে পারি না। ওরা নানারকম ঝামেলা করে চলেছে। ভগবান এসব করছে না। ওদের ভগবান আর কুকুরদের ভগবান বোধহয় একজনই। ভগবান ওদের অনেকবার সাবধান করেছে। এখন একটা ভেল্কি দেখিয়ে বলছে দ্যাখ কেমন লাগে। এই হচ্ছে কেস। ওই বুদ্ধুগুলো এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না। আমাদের উচিত ওদের বোঝানো। বলব লজ্জার কিছু নেই, মুখ ঢাকতে হবে না। যা করেছিস করেছিস। এবার আমাদের খেতে দে শালা। খেতে দে, নইলে মানচিত্র খাবো।
ভোদা, কালি, ভুলু, বান্টিরা সব হো হো হেসে উঠল।
ওদের কি মজা। ওরা কত জায়গা ঘুরে বেড়ায়, কী সুন্দর রোয়াক থেকে রোয়াকে লাফায়। কত মজার মজার গল্প করে।
চারপাঁচটা কুকুর চল রগড় হয়েছে একটা দেখে আসি চল… বলতে বলতে লেজ নাড়তে নাড়তে চলে গেল। একজন কেন গেল না কে জানে। ও আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশে তখন মেঘের ফাঁক দিয়ে আলো লিক করছিল।
লোলা বলল – ও ভাই, ও বন্ধু। আমার সঙ্গে একটু কথা বলো না প্লীজ। তোমার নাম কী?
রাস্তার কুকুরটা বলল – আমার নাম ভোলা।
লোলা বলল, ভোলা! কী সুইট! আমার নাম লোলা। কী মিল বলো দেখি…
ভোলা বলল – মিল না ছাই। তোমাদের সঙ্গে আমাদের অনেক তফাৎ। তোমরা সেজেগুজে, গলায় চেনটেন পরে বেড়াতে বের হও, ওসব বিলাসিতা আমাদের নেই। তোমরা ডগ আমরা নেড়ে। তোমরা ইন্ডিয়া, আমরা ভারত। সব চেয়ে বড় তফাৎ, তোমরা পটি কর, আমরা হাগি।
লোলা বলল – আমারও তো হাগতেই ইচ্ছা করে গো! লাফিয়ে লাফিয়ে বেপাড়ার ছেলেগুলোকে বলতে পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব। আমারও খুব ইচ্ছে করে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে প্রেম করি। কিন্তু ইচ্ছেগুলোর গলা টিপে ধরি। তোমাদের কি মজা, তাই না? আচ্ছা ঐ যে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জায়গাটা, মাঝখানে কয়েকটা ইঁট ফাঁকা, তোমরা ওই ফাঁকের ভিতর দিয়ে গলে কেমন ভিতরে চলে যাও, ওখানে কি আছে গো?
ভোলা বলল – ওটা একটা খুব ভালো জায়গা। মানুষেরা বলে পাগলা গারদ। ওখানে অনেক ভালো ভালো মানুষ থাকে। কিছু মানুষ আছে, যারা ওসব ন্যাকা ন্যাকা ফালতু জামাকাপড় খুলে ফেলতে চায় আমাদের মত। কেউ আবার আপন মনে গান করে, একজন বলে একটা গর্ত করে আমাকে পুঁতে দাও গাছ হব। আর একজন আছে, সে প্রাণপনে ভৌ ভৌ করে। যেন ভৌ ভৌ করলে কুকুর হতে পারবে। কুকুর হওয়া কি সহজ? বহু জন্মের সাধনায় কুকুর জন্ম হয়।
লোলা বলে ঠিকই বলেছ গো, ভোলাদা, কুকুর জন্মের মজাটা তোমরা পেলে। ওইযে দূর থেকে একটা কী সুন্দর শব্দ ভেসে আসে ঢং – ঢং – ঢং… ওখানে গিয়েছো তুমি?
ভোলা বলে – কেন যাবোনা? ওটা তো চার্চ। ওখানে একটা মানুষের বুক থেকে রক্ত ঝরছে। কেউ পরিষ্কার করে দিচ্ছে না। আমার খুব ইচ্ছে হয় চেটে পরিষ্কার করে দিই। পারি না। মানুষ এক আজব জাতি। রক্ত ঝরা দেখে আনন্দ পায়। আবার ওই ওদিকে একটা মন্দির আছে। ওখানেও ঘণ্টা বাজে। ওখানে একজন মাথায় মুকুট পরা লেডি জিভ বের করে আছে। গলায় মানুষের মুন্ডু। মুন্ডু থেকে রক্ত পড়ছে। তাই দেখে মানুষগুলোর কী আনন্দ। ঘণ্টা বাজায়। মানুষ এক আজব জাতি। কেন যে আমরা ওদের পোষ্য নিয়েছিলাম কে জানে। আসলে অভ্যেস। বাপ দাদারা করে গেছে, আমরাও করি।
লোলা বলল – তুমি কত ভালো গো ভোলা। তোমার বন্ধুগুলো আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না।
ভোলা বলল – বরং পাকাবাড়িতে থাকো বলে তোমরাই অহংকারে আমাদের পাত্তা দাও না।
লোলা বলল – তাই কি? আমার বাবা ওসব নেই। তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড হবে?
ভোলা সাতবার লেজ নাড়িয়ে বলল ওক্কে।
রাস্তায়
লোলা রাস্তায় নেমে এসেছে। না নেমে উপায় ছিলনা কোনও। দরজার উপরে ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। অনেক চিৎকার করেছে। তোমরা এসো, দরজাটা খোলো। না খুলতে পারলে ভেঙে ফেলো। দরজা ভাঙা তো আগেও দেখেছে। পচাগন্ধ বেরুচ্ছিল যখন, ভাঙলো। একটা বুড়ি ছিল একা। কুকুররা গন্ধটা আগে পায়। এই এপার্টমেন্টের কুকুররা সবাই চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছিল। মানুষ বোঝেনি। মানুষরা অনেক পরে গন্ধ পায়। পচাগন্ধ পেয়ে পুলিশ ডাকলো। পুলিশ দরজা ভাঙলো। লোলাও চিল্লিয়ে চিৎকার করে বলেছিল দরজা ভাঙ্গো। ভাঙ্গো ভাঙ্গো দ্বার। কেউ শোনে নি।
গত দুদিন ধরে বেশী কথা বলছিলনা বুড়োটা। বেশ কাশছিল থেকে থেকে। ছাদেও যাচ্ছিল না বিকেলবেলায়। বার বার মুখে কাচের কাঠি ঢোকাচ্ছিল। কাজের মাসিটাও কয়েকদিন আসছিল না। বুড়োটা গরম জল করে কি সব গুঁড়ো মিশিয়ে খেয়ে নিচ্ছিল, আর লোলাকেও টিন থেকে ডগফুড বার করে খাইয়ে দিচ্ছিল। কাল রাতে ওই চ্যাপ্টা বাক্সের ডালায় ওর ছেলে- ছেলে বউদের মুখ ভেসে উঠেছিল। অনেকক্ষণ কথা বলেছিল। তারপর ওদের ছবি মুছে গেলে সেই বাক্সটার গায়ে অনেকক্ষণ হাত বুলিয়েছিল আস্তে, আদরে। তারপর লোলার গায়ে। লোলাকে এত আদর কক্ষনো করেনি আগে। টিন খুলে চারপাঁচটা ক্রিম ক্র্যাকার খাইয়ে দিল। তারপর ট্যাবলেটের পাতা ছিঁড়ে অনেকগুলো ট্যাবলেট জমা করল একটা প্লেটে। তারপর চারটে ছটা করে এক এক করে গিলে নিল। ওরা দুজন দুজনের ভাষা বোঝে। লোলা বুঝতে পেরেছিল বুড়ো বলছে – কি হবে অন্যদের বিরক্ত করে। লোলা বলেছিল কেন এমন কথা বলছো বুড়ো। বুড়ো বলেছিল কালই বুঝে যাবি।
ভোর থেকেই গন্ধটা পাচ্ছিল। লোলা মরা মানুষের গন্ধ বোঝে। লোলা এবার চিৎকার করে। দরজা খোলার চেষ্টা করে অনেকক্ষণ। দরজা আঁচড়ালো, হ্যান্ডেল কামড়ালো। বলতে লাগলো হে ফ্ল্যাটবাসীগণ, তোমরা দুর্গাপুজোর বিজয়া সম্মেলনে বল সবার জন্য সবাই আমরা। তোমরা কোথায়? তোমার পাশের ঘরের লোকটাকে দেখ, কিছু কর। লুচি ভাজার গন্ধ পাচ্ছিলাম। কোথায় লুচি ভাজছো সুখী বউ, পাশের ঘরে এসো, ওমলেট ভাজছো কেউ, পাশের ঘরে এসো। আদা গোলমরিচের চা খাচ্ছো যে, পাশের ঘরে এসো।
কেউ আসেনা। লোলা তখন দোতলার গ্রিলের ফাঁকে মুখ বাড়ায়। রাস্তায় ভোলা ছিল। ওকে বলল সব। ভোলা বলল নেমে এসো তুমি, এই রেলিং থেকে ছোট্ট লাফ দাও ওই কার্নিশে, ওখান থেকে জানালার সানশেডে, তারপরই রাস্তায়। আগে নেমে এসো, তারপর দেখছি। লোলা লাব্রাডর হতে পারে, বলে তো বীরের জাত, কিন্তু ভয় করছিল। কিন্তু পারলো। ওর লাব্রাডর গরিমা ঝেড়ে ফেলে নেড়ির সাহায্য নিল। ভোলা ততক্ষণে ভোদা, লালু, গব্বরদের ডেকে নিয়েছে। ল্যাংড়াও খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে এলো। সবাই সমস্বরে গাইল কুকুর কুকুরের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি কুকুর পেতে পারেনা।
মানুষেরা ওই গান বুঝতে পারলো না। ওরা শুধু ঘেউ ঘেউ শুনল। ব্যালকনি থেকে একজন বলল এই কুত্তারা, থাম, সক্কালবেলা চিল্লামিল্লি করছে।
লোলা চেঁচালো তোমরা তোমাদের পাশের ঘরে যাও। বন্ধদরজা খোলো প্লীজ। একজন বলল সেনবাবুর কুকুরটা ওদের ওখানে ভিড়ে গেল কি করে?
ওরা সবাই মিলে অনেক চেঁচালো। অনেকবার বলল মানুষ বড় কাঁদছে, কুকুরেরাও মানুষের জন্যই কাঁদছে। কিন্তু চোখের জল মোছাতে কোনও মানুষ আসছে না। হে মানুষগুলো, তোমরা এখনও জ্যান্ত আছো তো।
বন্ধ লোহার গেটে দারোয়ান। কাউকে ঢুকতে দেয়না। ল্যাংড়া বলল বাড়ির এই লৌহ কপাট ভেঙে সব কররে লোপাট…
ল্যাংড়াটা লাফিয়ে গেটের উপর উঠছিল। দারোয়ান লাঠি উঁচিয়ে বলল ভাগ শালা কুত্তাকা বাচ্চা। ওরা ভাবছে খুব বুঝি খিস্তি দিল। আসলে এটা তো ঠিকঠাক কথা। ল্যাংড়াতো কুত্তারই বাচ্চা। যদি বলতো আদমি কা বাচ্চা, সেটা গালাগালি হত।
এমনি করে করে অনেক বেলা হল। লোলা দেখলো ওর বুড়োর খোঁজ কেউ নিচ্ছে না।
লোলা দেখল ব্যানার্জীসাহেব হাতে গ্লাভস মুখে মাস্ক পরে বেরিয়েছে। লোলা ওর কাছে গেল। ব্যানার্জী সাহেবের গন্ধটা পেলো না। লোলা সবার গন্ধ আলাদা করতে পারে। ব্যানার্জী সাহেবের গন্ধটা যেন ঠিক ওর বুড়োর মতন। মিত্রবাবু দুটো দুধের প্যাকেট, পলিথিনে ঝুলিয়ে ঢুকলো। ওর কাছেও বলতে গেল – স্যার আমার বুড়োটা… কিন্তু মিত্রবাবুর গায়েও সেই বুড়োর গন্ধ। সুচরিতা গোস্বামী ঢুকলেন। কবি। লোলার বুড়োকে কবিতা শোনাতে এসেছিলেন। লোলা বলতে গেল ম্যাডাম, আমার বুড়োটা… কিন্তু সেই একই রকম গন্ধ। জ্যান্ত মানুষের আলাদা আলাদা গন্ধ হয়। কিন্তু সব মরা মানুষের একই রকমের ঘ্রাণ। তবে?
জ্যান্ত লোকের গায়ে লাশের ঘ্রাণ কেন?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভীষন ভালো লাগল।
স্বনময়বাবুর গল্প আমার ফেভারিট- বহুদিন ধরে। উপন্যাসও অসাধারণ । লেখার ভঙ্গিটি বড় পছন্দের । শুভেচ্ছা জানবেন ।