micro-story-bivas-babur-nojor

বিভাস বাবুর নজর
হিমি মিত্র রায়


ঘরে মোট সাতটা বেঞ্চ। ঠিক শেষের বেঞ্চের দেয়ালের দিকে বসে থাকে সূর্যস্নাতা। বিভাস বাবুর পড়ানোর ব্যাচের নতুন স্টুডেন্ট। আগে কখনো বিভাস বাবুর এমন হয়নি। অনেকদিন ধরেই উনি অনার্সের প্রচুর ছাত্রীদের পড়িয়েছেন। কিন্তু সূর্যস্নাতার দিকে চোখ পড়ছে শুরু থেকেই। এই মেয়েটি কিছুদিন হলো আসছে ওঁর কাছে। প্রথম প্রথম কিছু মনে হয়নি, কিন্তু হঠাৎ করে বারবার শুধু ওই মেয়েটির দিকে চোখ যাচ্ছে। মেয়েটির মধ্যে এমন একটা কিছু রয়েছে যে যে কেউ তাকাতে বাধ্য। বিভাস বাবু কোনো ভুল করছেন না তো!

পেছনের বেঞ্চে কোনার দিকের জায়গাটা তিন চারদিন হলো ফাঁকা। সূর্যস্নাতা আসছে না। পড়াতে পড়াতে বারবার ওদিকে চোখ যায়। মনে হলো একবার ফোন করে খোঁজ নিতে, তারপর আবার মনে এল ফোন নাম্বারই তো রাখেননি। আরত্রিকাদের কাছে চেয়েছিলেন কিন্তু ওরাও দিতে পারেনি ফোন নাম্বার, নতুন বন্ধু তো, এখনও ফোন নাম্বার চালাচালি হয়নি। দূর থেকে জানালা দিয়ে দেখা যায় কে আসছে কে যাচ্ছে। বিভাস বাবু ফলো করেন ওকে, চেহারার মধ্যে একটা কী যেন আছে যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। দু একদিন একটি ছেলেকে ওর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে জানলা দিয়ে।

ধুর, একদম ভাল লাগছে না। কি যে হল! ছেলেটির সঙ্গে আবার পালিয়ে গেল না তো! কত কিছু কল্পনা করছিলেন বিভাস বাবু, হাত নিসপিস করছে। কতদিন একা পেয়েছেন সূর্যস্নাতাকে! কোনো কোনো দিন আগে এসে বসে থাকত! তখনই যদি…

বিকেল থেকে আজকে বিভাসবাবুর সারা বাড়ি চুপচাপ। অর্চনার ক্যাচকেচি শোনা যাচ্ছে না ও ঘর থেকে। সে বন্ধুর বাড়ি গেছে। সেখানে চলবে নিজেদের স্বামীদের নিয়ে কাটাছেড়া পর্ব। কার স্বামী কতটা খারাপ সে নিয়ে কম্পিটিশন চলবে দুই বন্ধুতে। অবশ্যই অর্চনা জিতবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। থাক গে ভালোই হয়েছে, এমনটাই তো চাইছিলেন উনি।

বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সূর্যস্নাতা ছাতা মাথায় দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে এদিকে।

হাতের চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন বিভাস বাবু। সোজা হয়ে বসলেন। আজকেই সময়, এই বৃষ্টির দিনে সকলেরই আসতে একটু দেরি হবে। অর্চনাও নেই বাড়িতে, আজকেই যা করার করতে হবে, নয়তো হাতের বাইরে চলে যাবে। এরকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। বিভাস বাবু মনে মনে তৈরী হয়ে নিলেন। প্রার্থনা করতে থাকলেন যেন অন্য কেউ না আসে, অর্চনা তো একদমই না। তাহলেই প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

দরজা খোলাই ছিল। সূর্যস্নাতা ছাতাটা দরজার পাশে রাখল নিচু হয়ে, তারপর ওড়না ঠিক করতে করতে বলল, স্যার আসবো?

-এস এস ভেতরে এসো।

চুপচাপ গিয়ে পেছনের দিকের বেঞ্চটায় গিয়ে বসল ও।

-আহা আহা, পিছনে কেন, সামনে এসে বসো না! কেউ তো আসেনি এখনো।

একটু ইতস্তত করে ও বলল, না স্যার, মানে আমি এখানে ঠিক আছি।

বিভাস বাবু বুঝতে পারলে যে ও লজ্জা পাচ্ছে। ও আবার কিছু আন্দাজ করে ফেললো না তো! একটা হলুদ রঙের চুরিদার পরেছে ও, সঙ্গে গোলাপি রঙের একটা ফুলছাপ ওড়না। বারবার সেটাকে হাত দিয়ে ঠিক করছে। হয়তো কিছুটা ভিজে গেছে। ফ্যানের স্পিডটাও বেশ জোরেই ।

বিভাস বাবু ওপর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠান্ডা লাগছে?

-ন..না না স্যার ঠিক আছে।

বিভাস বাবু হাসলেন হালকা করে। তারপর উঠে গিয়ে নিজেই ফ্যানের রেগুলেটরটা ঘুরিয়ে তিন থেকে একে নামিয়ে আনলেন। একটা বিরাট বাজ পড়ল সামনেই কোথাও, চমকে গেল সূর্যস্নাতা। ঝপ করে লাইট নিভে গেল ঘরের, শুধু জানলা দিয়ে হালকা আলো আসছে।

ইনভার্টারের ব্যাটারিটা বেশ কিছুদিন হলো খারাপ হয়ে পড়ে আছে, ঠিক করা হচ্ছে না। অর্চনা বলে বলে ফেডআপ হয়ে গেছে বিভাস বাবুকে।

নিজের টেবিলের কাছে হাতরে হাতরে এলেন উনি। দেখতে পেলেন সূর্যস্নাতা মোবাইলের টর্চ জ্বালালো। উঠে এদিকেই এগুতে থাকলো মোবাইল নিয়ে। ড্রয়ার খুলে দেশলাই আর মোম বের করলেন উনি, তারপর মোম জ্বালিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন।

-অত দূরে বসে থাকলে কি করে কথা বলি বল তো? অন্ধকারে তো তোমাকে ভালো করে দেখাই যাচ্ছে না।

বিভাস বাবুই এগিয়ে গিয়ে সূর্যস্নাতার সামনে গিয়ে বসলেন, অন্য একটি বেঞ্চে মুখোমুখি। হাল্কা আলোয় ওকে দেখতে পাচ্ছেন, কি সুন্দর মুখটা! অন্য যতগুলো মেয়ে ওঁর কাছে পড়তে আসে তাদের থেকে একদমই আলাদা এই মেয়েটি। বারে বারে নিজের ওড়নাটা ঠিক করছে সূর্যস্নাতা। মুখ নিচু করে বসে রয়েছে। খুব ভয় পাচ্ছে কোনো এক কারনে, ও কী কিছু সন্দেহ করছে? কিছু বুঝে ফেলল না তো!

বিভাস বাবু ছটফট করছে ভেতরে ভেতরে, কখনও এই কাজ আগে করেননি। কিন্তু এই সুযোগ আর ছাড়া যাবে না, কিছুতেই না!

ওড়নার খুঁট ধরে ধরে গিঁট পাকাচ্ছে সূর্যস্নাতা।

-তোমার সঙ্গে মাঝে মাঝে একটি ছেলেকে দেখি, সে কে? তোমার চেনা কেউ?

সূর্যস্নাতা মুখ তুলে বলল, ও তনয়, আমার ছোট ভাই, মাঝে মাঝে আমাকে পৌঁছে দিয়ে যায়।

বিভাস বাবু হাসলেন।

তোমার কাকীমাকে আগে থেকে কিছুই জানাতে চাইনি। ওঁরা বলে আমি নাকি কোন কাজ করি না বাড়ির, সংসারে সময় দেই না, ছেলের বিয়ের চিন্তা করি না। তাই আগে থেকে না শুনে স্ত্রীকে বলিনি, তোমাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করব বলে। তোমার জীবনে অন্য কোন পুরুষ নেই তো মা? থাকলে বল, তাহলে আর এগোবো না। তোমাকে আমার পুত্রবধূ হিসেবে পেলে খুব খুশি হব। তুমি না করে দিলে তোমার কাকীমা আমাকে অনেক কথা শোনাবে। বলবে একটাও কাজ ঠিকমতো করতে পারো না। তাই আর কি। তোমার আপত্তি থাকলে আমাকে অবশ্যই জানিও। তাহলে আর তোমার বাবা মার সঙ্গে কথা বলব না, আপত্তি আছে?

কথাগুলো বলে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন বিভাস বাবু।

সূর্যস্নাতার ওড়না ধরে টানাটানি দেখে উনি বুঝে গেলেন, মেয়েটি খুব লজ্জা পাচ্ছে। চুপ করে মাথা দুদিকে ঝাঁকালো ও।

বিভাস বাবু খুব খুশী হলেন। মনে মনে নিজের কলার টাকে উঁচু করে নিলেন বেশ খানিকটা। অর্চনা আসামাত্রই এই কথাটা বলে ক্রেডিট নিতে হবে। আর ‘পাত্রী চাই’ এর বিজ্ঞাপন দিতে হবে না কাগজে। তারপর নিজেই নিজেকে তিনবার বললেন, ” ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস! আই হ্যাভ ডান ইট!!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *