শফিক হাসান
ক’দিন আগেও যাদের চোখ ছিল করুণায় আর্দ্র, একই মানুষের দৃষ্টি এখন কিলবিলে! যেন কী এক অপরাধ করে ফেলেছে আরিফা, সবার শান্তির ঘুম হারাম। আড়ালে-আবডালে ছ্যা ছ্যা করতেও ছাড়ছে না কেউই। বেকারত্বের এই দেশে পরিপার্শ্বের লোকজন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকার মওকা পেয়েছে!
আরিফার অপরাধটা কী? তার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বয়সের একজনকে বিয়ে করেছে। এছাড়া কীইবা করতে পারত! বাবা মারা গেছেন করোনা ভাইরাসের প্রথম বছরে। করোনা না এলেও মরতেন। সংসারের নিত্য হাহাকার ও যাতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরিফার পড়াশোনার খরচ। মা চাননি, তার মতো পোড়াকপালি হোক আরিফাও। চেয়েছিলেন মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক।
জীবনের ঘানি থেকে মুক্তি পাক। কৃষক কাম দিনমজুর বাবার কোনো আপত্তিই ধোপে টেকেনি মায়ের প্রবল ইচ্ছার তোপে। চাল-ডাল-ওষুধের সঙ্গে মেয়ের পড়াশোনার খরচ বাড়তি চাপ ফেলেছে দেহ-মনে। কুঁজো হতে হতে একদিন শুয়েই পড়লেন বাবা। জীবিত মাকে বাঁচিয়ে দিতে আরিফা ঝুলে পড়ল মাঝারি গোছের একজন শিল্পপতির গলায়।
কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন আহকাম উদ্দৌলা। ফেরার পথে কী মনে করে প্রশ্ন করলেন আরিফাকে— ‘এ্যাই মেয়ে, তুমি কি এখানকার ছাত্রী?’
আরিফা ‘জি, স্যার’ বলার মাঝখানেই ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিলেন— ‘কখনো প্রয়োজন মনে করলে অফিসে এসো।’
কার্ড নিতে নিতে আরিফা জবাব দিল, ‘আগামীকালই আসব, স্যার।’
‘আগামীকাল! আচ্ছা, এসো।’
এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত গ্রাম-আগত আরিফা খাতুন। অফিসে থেকে অল্প ক’দিনের মধ্যেই যে আহকাম উদ্দৌলার ঘরে স্থায়ী আসন পাবে, ভাবতে পারেনি। স্বামী বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও ‘স্যার’ ডাকার বিধান নেই। আবার নাম ধরেও ডাকা অনুচিত। ‘তিনি’ এবং ‘উনি’ নিয়েই কাজ চালাচ্ছিল আরিফা। ইতোমধ্যে গুছিয়েছে অনেককিছু, পরিচিত হয়েছে আগের সংসারের সন্তানদের সঙ্গে। খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এরাও মোটামুটি সমবয়সী। ছোট মেয়ে সূচনা ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে, বড় ছেলে তুষার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। বয়সে আরিফার বড়ই হবে। ইয়ার গ্যাপ না থাকলে আরিফাও এদ্দিনে ওই শ্রেণিতেই থাকত।
একদিন বাসায় বন্ধুরা এলে অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়ে আরিফা। বন্ধুদের কাছে আরিফাকে ‘ছোট মা’ বলে পরিচয় দেয় তুষার। বিপরীতে বিব্রত আরিফা ‘আমার কোনো ছেলে-মেয়ে নেই’ বলে ঢুকে গিয়েছিল ঘরের ভেতরে। রাগে-দুঃখে শরীর জ্বলে গেলেও সামলে নিয়েছে। অথর্ব অথচ চৌকস স্বামীর কাছে এসবের সমাধান মিলবে না। পেটে খেলে তো পিঠেই সইতে হবে!
সূচনার সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বড় বউও তাকে মেনে নিয়েছেন আশ্চর্য রকমভাবে। কন্যাস্নেহে কাছে ডাকেন; আদর করেন। শুধু গন্তব্য মিলে গেলে তুষার ও আরিফা দুজনই বিব্রত হয়। কেউই কারও সামনে পড়তে চায় না। আরিফারও কী দরকার, যেচে-পড়ে ‘মা’ হওয়ার! মাস দুয়েক পরের এক পাতাঝরা বিকালে তুষারের সঙ্গে দেখা। তুষার উঠছে, আরিফা নামছে। আরিফা যেই না অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছে, কানে ভাসল তুষারের কণ্ঠস্বর— ‘আমি দুঃখিত।’
‘দুঃখের কিছু নেই। মায়েদের অনেক কিছু সয়ে নিতে হয়।’ সকৌতুকে জবাব দিল।
‘আপনাকে তো আমি নাম ধরে ডাকতে পারছি না, আপা-আন্টি কিছু বলার সুযোগ নেই। আবার ন্যায়সঙ্গতভাবে মা-ও বলা যাবে না। তবুও রাগ করে থাকবেন?’
‘রাগ করব কেন!’
‘তাহলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসুন।’
আরিফা হাসল, স্বতঃস্ফূর্ত সেই হাসি। যেন অনেকদিন পরে হাসল প্রাণ খুলে। তুষারও স্মিত হেসে বিদায় নেয়। আরিফার আর নামা হল না সিঁড়ি বেয়ে। তাকিয়ে-তারিয়ে দেখল যৌবনদীপ্ত তরুণের চলে যাওয়া। সিঁড়ি দিয়ে না নামলেও সে যে আরও নিচে নেমে গেছে কিংবা উঠে গেছে, বুঝতে পারল অল্পদিনের মধ্যেই। তুষারকে দেখলেই কেন যেন কথা বলতে আঁকুপাঁকু করে মন।
আহকাম উদ্দৌলা ব্যস্ত নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্লাব-পার্টি নিয়ে। নববধূকে পাওয়ার উত্তেজনাও মিইয়ে গেছে ইতিপূর্বে। অন্যদিকে আরিফার যুগপৎ ব্যাকুল-বিধ্বস্ত যাপন। পড়াশোনায়ও মন বসে না। মাঝে-মধ্যে দায়সারাভাবে মায়ের খোঁজ নেয়।
মন কেমন করা এক অপরাহ্ণে কলেজ থেকে ফিরছিল হেঁটে। চলন্ত রিকশায় বসা তুষার ডাকল— ‘এ্যাই, আরিফা!’
অনিচ্ছাসত্ত্বে সড়জড় হয়ে বসল। কিছুদূরে এগোতেই পাশ থেকে কে যেন মন্তব্য করল, ‘কী রে দোস্ত, ভালোই চালাচ্ছিস মনে হচ্ছে!’
বিব্রত দুজন তাকাল দু’দিকে। রাহুল কতটা বিব্রত না বুঝলেও আরিফা ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে আকাশে-বাতাসে। জোছনার বান-ডাকা সেই রাতেই বিদঘুটে স্বপ্নটা দেখল আরিফা। তুষার এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এ্যাই আরু, চল আমরা পালিয়ে যাই!’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন