prabandho-buddher-mahaparinirban-next

বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরবর্তী ঘটনাবলী
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী


১) পরিনির্বাণের পরবর্তী তাৎক্ষণিক ঘটনাবলী ও প্রথম ধর্মসংগীতিঃ

বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরবর্তী ঘটনাবলী - নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী - বুদ্ধের পরিনির্বাণ

আনুমানিক ৪৮৩ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে ভগবান বুদ্ধ পাবা নগরের কাছে কুশীনারায় মল্লরাজাদের একটি শালবনে বৈশাখী পূর্ণিমার দিন পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন। বুদ্ধ নিজেই দুটি যমজ শালগাছের মাঝখানে উত্তরদিকে মাথা করে তাঁর শেষ শয্যাটি আনন্দকে স্থাপন করতে বলেছিলেন। তাঁর পরিনির্বাণের খবর পেয়ে মল্লরাজারা এসে ভগবানের শরীরটি সৎকার করার দায়িত্ব নিলেন। এবং বুদ্ধের পুণ্যদেহটি সূক্ষ্ম নতুন কার্পাস বস্ত্রে জড়িয়ে সেটি আবার সুধূনিত কার্পাস তুলো দিয়ে ঢেকে দিলেন। এরপর কয়েকটি আস্তরণ করে তেলপূর্ণ সোনার পাত্রে বুদ্ধের দেহটি সংস্থাপন করে অপর একটি সোনার পাত্র দিয়ে ঢেকে দিলেন। এরপর উত্তর দক্ষিণে ১২০ হাত ও পূর্ব পশ্চিমে ১২০ হাত এইভাবে চন্দন কাঠ দিয়ে বুদ্ধের জন্য চিতা তৈরি করলেন। সোনার পাত্রসহ বুদ্ধের দেহটিকে চিতার উপর রেখে চারজন মল্লরাজা স্নান করে শুদ্ধবস্ত্র পরে বুদ্ধের চিতায় আগুন দিলেন, কিন্তু পরম আশ্চর্যের বিষয় হল বুদ্ধের চিতাটিতে শত চেষ্টাতেও কিছুতেই আগুন জ্বলল না। তখন স্থবির অনিরুদ্ধ চারজন মল্লরাজাদের বললেন, “দেবতাগণের ইচ্ছা স্থবির মহাকাশ্যপ তথাগতর চরণ বন্দনা করুন। তাই এই চিতা এখন জ্বলছে না, তিনি ভিক্ষুসংঘসহ এখন বনপথ দিয়ে কুশীনারার দিকেই আসছেন।”

বুদ্ধ তাঁর অবর্তমানে ভিক্ষুসংঘের ভার দিয়েছিলেন মহাকাশ্যপকে। কারণ তখন সারীপুত্র ও মৌদ্গলায়ন দেহরক্ষা করেছিলেন। কাশ্যপ ছিলেন সংঘের একজন অতি নিয়মনিষ্ঠ অরণ্যবাসী প্রবীণ অর্হত। ভিক্ষুদের মধ্যে কিছু ভিক্ষুরা সংঘবাসী এবং কেউ কেউ স্বেচ্ছায় কঠিন ব্রত যাপনের চেষ্টায় বনবাসী হতেন। মহাকাশ্যপের অধীনে পাঁচশো শিক্ষার্থী শ্রামণের ও ভিক্ষুরা বনের ভেতর থেকে তাঁর কাছ থেকে ধর্মের শিক্ষাপদ নিতেন।

বুদ্ধ কিছুদিন আগেই কাশ্যপের সঙ্গে তাঁর নিজের পরিধেয় বস্ত্রখানি বদল করেন এবং মহাকাশ্যপকে অন্ধকার আকাশের অনন্ত নক্ষত্ররাজির মধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় চাঁদকে দেখিয়ে ইঙ্গিতে তাঁকে তাঁর অবর্তমানে সংঘের ভার অর্পণ করে যান।

বুদ্ধের অসুস্থতার খবর পেয়ে মহাকাশ্যপ তখন শিষ্যদের নিয়ে পাবা থেকে কুশীনারার দিকে আসছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পাঁচশো শিক্ষার্থী ভিক্ষুদের একটি বিরাট দল। মহাপথ ছেড়ে কাশ্যপ একসময় বনের পথ ধরলেন। কাশ্যপ যখন একটি গাছের তলায় বসে বিশ্রাম করছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন একজন নগ্ন আজীবক সম্প্রদায়ের পরিব্রাজক কুশীনারার দিক থেকে ফিরছেন এবং তাঁর হাতে দিব্য মন্দারপুষ্পের একটি ডাল। আজীবকটি সেই ডালটিকে নিজের মাথায় ছাতার মত করে ধরে রেখেছিলেন। অসময়ে মন্দার পুষ্পের প্রস্ফুটিত ডাল দেখেই কাশ্যপ বুঝতে পারলেন ভগবান বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভ করেছেন এবং মহাপুরুষকে শ্রদ্ধা-জ্ঞাপনের জন্যই বনভূমির বৃক্ষেরা অসময়ে এমন পুষ্পিত হয়েছে। কাশ্যপ তক্ষুণি উঠে দাঁড়িয়ে কুশীনারার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে বললেন,

“বন্ধু! আপনি আমার শাস্তা (শিক্ষক) ভগবান বুদ্ধকে চেনেন কি?”

“হ্যাঁ, বন্ধু। আপনার জন্য একটি দুঃসংবাদ আছে। তিনি গত সপ্তাহে, বৈশাখি পূর্ণিমার রাতে পরিনির্বাপিত হয়েছেন। এই মন্দারপুষ্প সেই বনভূমি থেকেই আমি সংগ্রহ করে এনেছি।”

এ কথা শুনে উপস্থিত অবীতরাগ, স্রোতাপন্ন ও সকৃদাগামী ভিক্ষুরা অনেকেই মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কেউ কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁদের মধ্যে অনাগামী ফললাভ করা ভিক্ষু ও অর্হতেরাও ছিলেন। তাঁরা শোকার্ত ভিক্ষুদের বললেন, “জগতে সংস্কারসমূহ অর্থাৎ আয়ু ইত্যাদি অনিত্য। তাই শোক করলেও জগতে কখনও এই নিয়মের অন্যথা হবে না। সুতরাং বৃথা শোক করো না।”

কাশ্যপ গাছের তলায় একটু দূরে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। তাঁর সামনে এখন সুবিশাল দায়িত্ব। এই বিরাট ভিক্ষু সমাজকে তাঁকে এখন থেকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে হবে। এমন সময় ভিক্ষুদের দিক থেকে ক্রন্দনজনিত কোলাহলের মধ্যে হঠাৎ কয়েকটি কথা শুনতে পেলেন তিনি। এবং সেই কথাগুলি শুনে তিনি শোকে, বিস্ময়ে ও ক্রোধে একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কথাগুলি বলেছিলেন একজন বৃদ্ধ প্রব্রজিত ভিক্ষু। তাঁর নাম ছিল সুভদ্র। তিনি কয়েকজন শোকার্ত ভিক্ষুকে প্রবোধ দিয়ে বলে উঠেছিলেন,

“বন্ধুগণ! আর অশ্রু বিসর্জন দিও না! যা হয়েছে ভালই হয়েছে। তোমরা বৃথা শোক বা বিলাপ করো না। এখন আমরা সেই মহাশ্রমণের শাসন থেকে মুক্ত হয়েছি। এটা উপযুক্ত কাজ, এটা অনুপযুক্ত কাজ, এইসব বলে কেউ আর আমাদের উপর এখন থেকে উপদ্রব করবে না। এবার আমরা তাঁর শাসন থেকে মুক্ত হয়েছি। এখন থেকে আমরা যা ইচ্ছা তাই করব, এবং যা ইচ্ছা নয়, তা করব না।”

কাশ্যপ এই কথাগুলি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন, তিনি ভাবতে লাগলেন, এখনও বুদ্ধের দেহ ধরণীপৃষ্ঠে বর্তমান, এরই মধ্যে বুদ্ধশাসনে এমন পাপকন্টক উৎপন্ন হয়েছে! এই পাপ বর্ধিত হলে একসময় বুদ্ধের এত পরিশ্রমে গড়ে তোলা সম্পূর্ণ ধর্মের শাসন বিনষ্ট হবে। এখন সুভদ্রকে সংঘ থেকে বিতাড়িত করলে সকলে ভাববেন, এরই মধ্যে সংঘের ভেতর বিভাজন শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং এ বিষয়ে তিনি নীরব রইলেন। তাঁর মনে হল, বুদ্ধের অসংখ্য অনুশাসন ও তাঁর দেশিত ধর্ম ছেঁড়া মালার ফুলের মত ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে। অতএব এখন আশু-কর্তব্য হল ধর্ম ও বিনয়কে সংগ্রহ করা। নাহলে অচিরে সমস্ত ধর্ম বিনষ্ট হবে।

সুভদ্রের এমন কথা বলার অবশ্য একটি কারণ ছিল। তিনি ছিলেন জাতিতে নাপিত। প্রবীণ অবস্থায় প্রব্রজিত হওয়ায় বিনয় শিক্ষা করতে পারেননি তিনি। তাঁর দুই ছেলে ছিল, তাঁরাও প্রব্রজিত হয়েছিল। তাদের গানের গলা ছিল খুব সুন্দর। ভগবান সাড়ে বারোশো শিষ্যসহ আতুমাদেশে এসেছেন খবর পেয়ে তিনি তাঁর ছেলে দুটিকে ভিক্ষাপাত্র দিয়ে গৃহীদের ঘরে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে অশ্লীল অঙ্গ ভঙ্গী সহকারে নাচ দেখিয়ে ও গান করে তারা চাল, ডাল, তেল, নুন ইত্যাদি ভিক্ষার মাধ্যমে সংগ্রহ করল। তাদের নাচ গানে লোকজন হেসে আমোদে লুটিয়ে পড়লো। এর ফলে তারা অনেক ভিক্ষার জিনিস পেল।

সুভদ্র এরপর গিয়ে বুদ্ধ ও সংঘকে তাঁর বাড়িতে অন্ন গ্রহনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে এল। রান্না হবার পর বুদ্ধের কানে গেল যে সুভদ্রের অন্ন বিশুদ্ধ নয়, কারণ তাঁর পুত্রেরা অশ্লীল খেউর করে বুদ্ধ ও সংঘের জন্য এই অন্ন সমূহ সংগ্রহ করেছে। তখন তিনি সুভদ্রকে তিরস্কার করলেন ও ভিক্ষুদের আকপ্পিয়ং (অনুপযুক্ত) শিক্ষাপদ দিয়ে বললেন, “ভিক্ষুরা তোমরা সুভদ্রের গৃহে কেউ যাবে না। তোমরা হয়তো শুনেছো, সে সংঘের জন্য অনেক সুখাদ্যের আয়োজন করেছে। কিন্তু তাঁর অন্ন বিশুদ্ধ নয়। সেই অন্ন গ্রহন করলে তোমাদের এরজন্য কর্মের বিষময় ফল ভোগ করতে হবে। ভিক্ষুরা তোমরা এর আগে বহুবার জন্মে বহু দুর্ভোগ ভোগ করার পর বুদ্ধশাসনে এসে উপস্থিত হয়েছো। দুর্ভোগ অতিক্রম করতে আমি তোমাদের সবাইকে এই অন্নগ্রহন করতে নিষেধ করছি।”

এরপর বুদ্ধ সংঘসহ সেই অন্ন গ্রহন না করেই চলে এলেন। এতে সুভদ্র মনে অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন এবং ধারণা করেছিলেন, বুদ্ধ তাঁর বৈরী, তিনি তাঁর হিতকামী নন। তিনি সর্বজ্ঞ হয়েও কেন তাঁকে আগে থেকে প্রতিহত করেননি? সুভদ্রের রান্না করা খাবার সমস্তই নষ্ট হয়। তিনি ভাবেন, কেন বুদ্ধ তাঁর এতবড় ক্ষতি করলেন? এরপর থেকেই সুভদ্র বুদ্ধের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়েছিলেন।

কাশ্যপ কুশীনারায় পৌঁছে ভিক্ষুসংঘ সহ বুদ্ধের চরণ বন্দনা করলেন। অলৌকিকভাবে কাশ্যপ বুদ্ধের চিতা তিনবার প্রদক্ষিণ করে বুদ্ধের সামনে এসে দাঁড়াতেই, বুদ্ধের দুটি চরণ হঠাৎ বস্ত্রের আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। কাশ্যপ তখন বুদ্ধের চরণ ছুঁয়ে তাঁকে বন্দনা করলেন। সকলের বন্দনা শেষ হতেই বুদ্ধের চিতাটি নিজে থেকেই জ্বলে উঠল।

মহাকাশ্যপ ভিক্ষুদের বললেন, “হে মিত্রগণ এবার সকলে একত্রিত হয়ে আমরা প্রভুবুদ্ধের ধর্ম ও বিনয় একত্রিত করব। যাতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঠিক নিয়ম, নীতি ও আদর্শ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।”

মহাকাশ্যপ স্থবির ধর্ম ও বিনয় একত্রিত করার জন্য প্রথম যে মহাধর্মসন্মেলনের আয়োজন করেন, তাকে বলা হয় প্রথম ধর্মসংগীতি। এটি রাজগৃহে মগধরাজ অজাতশত্রুর আনুকূল্যে সংঘটিত হয়। মহারাজ অজাতশত্রু সংগীতির সফলতার জন্য যথাযোগ্য সাহায্য করেছিলেন। তিনি বৈভার পর্বতের পাশে সপ্তপর্ণী গুহার প্রবেশ পথের উপর একটি বিশাল ও রমণীয় সভামণ্ডপ নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন। বাইরে মনোরম লতা ও ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে ভেতরে বহুমূল্য কম্বলাসন বিছিয়ে দেন। সেখানে পাঁচশো ভিক্ষুর বসবার ব্যবস্থা ছিল। মাহামান্য সভাপতি মহাকাশ্যপের বসবার জন্য তিনি একটি মণিমুক্তাখচিত থেরাসন তৈরি করে দেন। এবং আরও একটি আসনে বক্তা ভিক্ষুর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বলা হয় সংগীতিটি শ্রাবণমাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রথম ধর্মসংগীতির জন্য মহাকাশ্যপ সংঘ থেকে বুদ্ধের শিক্ষাপদে বিশারদ ও অর্হত্বপ্রাপ্ত চারশো নিরানব্বই জন শ্রমণদের নির্বাচন করেছিলেন। যেহেতু ভিক্ষু আনন্দ তখনও অর্হত্বলাভ করতে পারেননি, তাই তাঁকে মহাকাশ্যপ সংগীতিতে নির্বাচিত ভিক্ষুদের মধ্যে রাখেননি। অন্যান্য ভিক্ষুরা এই সিদ্ধান্ত শুনে তাঁদের আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, “বুদ্ধ আনন্দকে সর্বদা শ্রেষ্ঠ সূত্রবিশারদ বলতেন। বুদ্ধের সুত্রগুলি সব থেকে ভাল করে আনন্দই জানেন, বুদ্ধের সেবায় অবিরত নিয়োজিত থাকায় তিনি এতদিন সাধনা করার অবকাশ পাননি, এবং তাই তিনি অর্হত্বলাভ করতেও পারেননি, তবে তাঁকে ছাড়া এই ধর্মসংগীতি সম্পূর্ণ অর্থহীন।”

বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরবর্তী ঘটনাবলী - নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী - দ্বিতীয় ধর্মসংগীতি

তখন মহাকাশ্যপ আনন্দকে সেই সভায় আহ্বান জানালেন। তবে একজন দুক্কট অপরাধী হিসেবে, তিনি আনন্দকে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং তিনি আনন্দের বিরুদ্ধে বহু ছোটো ও বড় অভিযোগ আনেন। যেমন –

ক) বুদ্ধ পরিনির্বাপিত হবার আগে আনন্দকে বলেন, ‘ভিক্ষুরা চাইলে ছোট ছোট শিক্ষাপদগুলি বাদ দিতে পারেন,’ কিন্তু এই শিক্ষাপদগুলি কী কী? তা আনন্দ বুদ্ধর কাছ থেকে তখন জেনে নেননি। এর ফলে সংঘের নিয়মশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে। উত্তরে আনন্দ জানান, বুদ্ধের বিদায়কালে তিনি শোকে বিপর্যস্ত ছিলেন, তাই ক্ষুদ্র শিক্ষাপদগুলি সঠিক কী কী? তা তাঁর তখন বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করার কথা মনে হয়নি বা তাঁর কাছ থেকে জেনে নেওয়া হয়নি। তিনি নিজের এই দোষ মেনে নিচ্ছেন।

খ) বুদ্ধের চীবর সেলাই করার সময় একবার আনন্দ জেনে শুনে তাতে পা দিয়েছিলেন কেন? এই অভিযোগের উত্তরে আনন্দ বলেন, তিনি যখন মাটিতে চীবর বিছিয়ে সেলাই করছিলেন, তখন তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য আর কোনো ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন না। তাই এই কাজটি তখন তিনি বাধ্য হয়ে করেছিলেন। এই দোষটিও তিনি স্বীকার করে নেন।

গ) বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে আনন্দ নারীদের সবার আগে বুদ্ধের দেহবন্দনা করতে দিয়েছিলেন। উত্তরে আনন্দ জানান, ক্রন্দনরত শোকাকুল নারীদের মানসিক যন্ত্রণার কথা ভেবে তিনি তাঁদের অপেক্ষা করাতে চাননি।

ঘ) আনন্দকে জিজ্ঞাসা করা হয়, যখন বুদ্ধ তাঁর আয়ু সংস্কার বিসর্জন দেবেন বলে তাঁকে জানিয়েছিলেন, তখন কেন তিনি বুদ্ধকে আরও এক কল্পকাল জীবিত থাকার জন্য অনুরোধ করেননি? উত্তরে আনন্দ আক্ষেপ করে উত্তর দেন, হয়তো বা বুদ্ধেরই ইচ্ছেতে তিনি সেই মুহূর্তে বিবশ হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁকে কোনো অনুরোধ করতে পারেননি। তাছাড়া তখন তাঁর মনে হয়েছিল, বুদ্ধ পরিনির্বাণের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েছেন, তাই তাঁকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বিব্রত করেননি। তবুও এটি তাঁর একটি চরম অপরাধ হিসেবেই তিনি মেনে নিচ্ছেন।

ঙ) সংঘে নারীদের প্রবেশাধিকার দেবার জন্য কেন আনন্দ বুদ্ধকে অনুরোধ করেছিলেন? যখন বুদ্ধ নিজে এ সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছিলেন? এবং আনন্দ তখন কেন নারীদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন? উত্তরে আনন্দ বলেন যে বুদ্ধের পালিতা মাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অনুরোধেই তিনি বুদ্ধকে সেই সময় নারীদের সংঘে প্রবেশের অধিকার দেবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

বুদ্ধের কৃপায় নির্দিষ্ট দিনটির আগের রাতে ভোর হবার আগের মুহূর্তে আনন্দ তীব্র মনোকষ্টে যখন ক্রমাগত বুদ্ধকে স্মরণ করছিলেন, এবং অনন্যস্মরণ হয়ে তাঁকে বলছিলেন, “ভগবান আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তবেই আমি ওই সভায় উপস্থিত হতে সক্ষম হব। আমি আজীবন যথাশক্তি আপনার সেবা করেছি, আপনার ইচ্ছাই যেন আমার উপর ফলবতী হয়।”

এভাবে সমস্ত রাত কেটে গেল। ভোর হবার আগে ক্লান্তিবশতঃ তিনি শয্যায় শোওয়ামাত্রই তীব্র আলোকরশ্মিতে তাঁর চেতনা যেন লুপ্ত হয়ে গেল। সেই মুহূর্তেই তিনি নির্বাণলাভ করলেন এবং অর্হত্বলাভ করে অর্হত হলেন। এর ফলে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই প্রথম ধর্মসংগীতিতে তিনি অংশ নিলেন। বলা হয়, আনন্দ যোগবলে আকাশমার্গ দিয়ে সহসা সেই সভামণ্ডপে সবার সামনে এসে উপস্থিত হন। তাঁর অলৌকিক শক্তি দেখে সভার কারো আর তাঁর অর্হত্বলাভ সম্পর্কে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকে না।

চুলবগ্গ অনুযায়ী, প্রথম ধর্ম সংগীতিতে ধর্ম ও বিনয় সংস্থাপিত হয়েছিল। সুমঙ্গলবিলাসিনীতে উক্ত আছে, অনিরুদ্ধ থের মহাকাশ্যপের নির্দেশে অভিধর্মও সংগৃহীত করেছিলেন। অর্থাৎ যমক, ধাতুকথা, পট্ঠান, বিভঙ্গ, পুগ্গলপঞ্ঞতি ইত্যাদি আবৃত্তিও করা হয়েছিল এবং পাঁচশো ভিক্ষু সকলে তা অনুধাবন করেন।


বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরবর্তী ঘটনাবলী - নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী - প্রথম ধর্মসংগীতি

দ্বিতীয় ধর্মসংগীতি অনুষ্ঠিত হয় বুদ্ধের মৃত্যুর একশো বছর পর, রাজা কাকবর্ণ বা কালাশোকের নেতৃত্বে। ইনি শিশুনাগ বংশের একজন রাজা ছিলেন। অজাতশত্রুর পর তাঁর পুত্র উদায়িভদ্র সিংহাসনে বসেন। শোনা যায় তিনিও নাকি অজাতশত্রুর মতোই পিতৃহন্তা ছিলেন। পাপ তার ফল প্রসব করবেই। পুণ্যবান পিতা বিম্বিসারকে অনাহারে হত্যা করার শাস্তি অবশেষে অজাতশত্রু পেলেন। অজাতশত্রুর পুত্রও পিতৃহন্তা হলেন।

মগধের সিংহাসনে তখন সুশাসকের বড় অভাব ছিল। পরবর্তীকালে হর্ষঙ্ক বংশের রাজাদের সরিয়ে তাঁদের আমাত্য শিশুনাগ মগধের সিংহাসনে বসেন। কাকবর্ণ বা কালাশোক হলেন শিশুনাগের পুত্র। বলা হয়, কালাশোক রাজা শিশুনাগ ও বৈশালীর একজন প্রভাবশালী বারবণিতার সন্তান ছিলেন। তাঁর গায়ের রং ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। তাই তাঁর অপর নাম ছিল কাকবর্ণ। তাঁর শাসনকালে বৈশালীতে দ্বিতীয় ধর্মসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়, এইসময় বৈশালী নগর ছিল মগধের রাজধানী। বৌদ্ধ দ্বিতীয় ধর্মসংগীতি, এই একটি ঘটনাই রাজা কালাশোককে ইতিহাসে অমর করে তুলেছে। এই ধর্মসংগীতি দীর্ঘ আটমাস ধরে অনুষ্ঠিত হয়, এবং সমস্ত ধর্ম ও বিনয়ের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য এই সংগীতিতে বিশেষ প্রচেষ্টা করা হয়।

এই সংগীতির সূত্রপাত হয় বৃজিদেশীয় কিছু শ্রমণদের জন্য। ঘটনাটি হল বৈশালীর বজ্জিপুত্তীয় ভিক্ষুরা দশটি বিষয় জনসাধারণের মধ্যে হঠাৎ প্রচার করতে শুরু করেন। তাঁরা বলেন, “এখন থেকে নতুন এই দশটি বিষয় ভিক্ষুরা মেনে চলবে।” যেমন-

১ কপ্পতি সিঙ্গিলোণকপ্পো- ভিক্ষুরা মৃত মোষ বা হরিণের শিংয়ের ভেতর নিজেদের সঙ্গে কিছুটা করে নুন রাখতে পারবে। (যাতে বাসি, পচা ও বিস্বাদ ভিক্ষাণ্ণে তা ব্যবহার করা যায় ও তা সামান্য হলেও স্বাদযুক্ত হয়।)

২ কপ্পতি দ্বংগুলকপ্প- দুপুরে রোদের ছায়া দু আঙুল (অর্থাৎ দু’ঘন্টা) সরে গেলেও তাঁরা দিবা-আহার করতে পারবে। (গ্রামের পথে ভিক্ষুদের ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা সংগ্রহ করতে অনেক সময় দেরী হয়ে যেত, তাছাড়া ভিক্ষাও যতদিন যাচ্ছিল ধীরে ধীরে বিশেষ দুর্লভ হয়ে উঠছিল।)

৩ কপ্পতি গামন্তরকপ্পো- খাওয়ার পরে ভিক্ষুরা যদি গ্রামে যায় এবং কেউ যদি অনুরোধ করে, তবে তাঁরা আবার অন্ন গ্রহন করতে পারবে। (অতি অল্প পরিমাণে ফেলার উপযোগী ও বাসি খাবার খেয়ে ভিক্ষুদের অনেক সময় পেট ভরত না, তাই পরে কখনও আবার খাবারের অনুরোধ এলে তাঁরা তা অনেক সময় রক্ষা করতে চাইতেন)

৪ কপ্পতি আবাসকপ্পো- একই সীমার ভেতর থেকেও ভিক্ষুরা আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে উপোসথ (উপবাস) পালন করতে পারবে। (অনেক সময় সংঘে কলহ বা বিবাদ উপস্থিত হত। ভিক্ষুরা তখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে স্বতন্ত্র থাকতেন)

৫ কপ্পতি অনুমতিকপ্পো- বিনয় আচরণ পালনের সময়, যা আইনত সিদ্ধ নয়, তা পরেও সঙ্ঘকে জানালে চলবে। (ছোট ছোট বিষয়ে অনুমতি নিতে অসুবিধা হত, এবং দৈনন্দিন জীবনচর্যা ব্যহত হত।)

৬ কপ্পতি আচিন্নকপ্পো- ভিক্ষুরা যে যার উপাধ্যায়ের (শিক্ষক শ্রমণ) রীতি মান্য করে চলতে পারবে। (সংঘের মধ্যে মতভেদ থাকত, ভিক্ষুরা যার যার আচার্যের নির্দেশক পালন করতেন)

৭ কপ্পতি অমথিতকপ্পো- দিবা-আহারের পরে ভিক্ষুরা চাইলে দুধ বা দধির মধ্যবর্তী আবস্থার পানীয় অর্থাৎ ঘোল পান করতে পারবে। (বাসি দুধ, যা ভিক্ষুদের দান করা হত, তা অনেক সময়ই নষ্ট হয়ে যেত। ভিক্ষা সুলভ ছিল না, বলা যায় খুবই দুর্লভ, সুতরাং এই অবস্থায় ভিক্ষুরা ইচ্ছা থাকলেও সেই নষ্ট দুধ খেতে পারতেন না।)

৮ কপ্পতি জলোগিকপ্প- তাল বা খেঁজুড়ের রস, যা গেঁজিয়ে ওঠেনি অথচ ঝাঁঝালো তা ভিক্ষুরা পান করতে পারবে। (গুড় বানানোর জন্য রস সংঘে পাঠানো হত। তা অনেক সময় নষ্ট হয়ে যেত, ভিক্ষুরা তা ফেলতে চাইতেন না।)

৯ কপ্পতি অদসকং নিসীদনং- ঝালরযুক্ত মাদুর, বা সুদৃশ্য আসন মাপের অতিরিক্ত বড় হলেও তাতে তাঁরা বসতে পারবে। (দান হিসেবে মাপ বহির্ভূত জিনিস পাওয়া গেলে ভিক্ষুরা তা নিতে চাইতেন, কারণ দান ও ভিক্ষা দুটিই তখন বিশেষ দুর্লভ হয়ে উঠেছিল।)

১০ কপ্পতি জাতরূপরজতং- মুদ্রা, সোনা বা রূপা এবং মণিমুক্তো দান হিসেবে ভিক্ষুরা গ্রহন করতে পারবে। (এটাও ভিক্ষুরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য নিতে শুরু করেছিলেন, কারণ অবস্থাভেদে তা খরচ করার সুবিধা।)

সেই সময় বৈশালীর মহাবন বিহারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হলেন ভিক্ষু যশ। যিনি ব্রাহ্মণ কাকন্দক পুত্র যশ এই নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি এসে দেখেন উপোসথ দিবসে বৈশালীর ভিক্ষুরা উপাসক গৃহী ভক্তদের কাছ থেকে অর্থ দান হিসেবে গ্রহণ করছেন। তাঁরা বিহারের সভাগৃহে একটা বিরাট তামার জলপূর্ণ পাত্র রেখে উপাসকদের সেখানে কাহাপন বা একপাদ বা একমাষা দান দিতে অনুরোধ করছেন। তাঁরা বলছেন যে এই সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ভিক্ষুদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে সুবিধা হবে। যশ উপাসকদের সামনেই এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেন।

রাতে ভিক্ষুরা সেই অর্থের একভাগ রেখে বাকিটা সবার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিলেন। যশকেও তাঁরা ভাগ দিলেন। যশ সেই অর্থ নিতে অস্বীকার করলেন, এবং বললেন এইভাবে অর্থ সংগ্রহ করা সম্পূর্ণ ধর্মবিরুদ্ধ। এর ফলে বৈশালীর ভিক্ষুরা ক্রুদ্ধ হয়ে ভিক্ষু যশকে ‘পতিসারণিয় কম্ম’ শাস্তি দিলেন। যশ এরপর বৈশালী নগরের চারদিকে ঘুরে উপাসকদের বোঝালেন যে এখানকার ভিক্ষুরা যা করছে তা ধর্মবিরুদ্ধ। কারণ তথাগত ভিক্ষুদের দান হিসেবে অর্থ বা সোনা রূপা নেওয়াকে ভিক্ষুর চারিত্রিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রচার করেছেন। তথাগত বলেছেন, “চন্দ্র-সূর্যেরও চারটি প্রতিবন্ধকতা আছে, যার দ্বারা তারা দীপ্তিহীন হয় এবং তাদের তেজ বা উজ্জ্বলতা হারায়। যেমন মেঘ ও কুয়াশা, ধুলো ও ধোঁয়া, ঝড় ও বৃষ্টি এবং গ্রহণ। ভিক্ষুদেরও এমন চারটি প্রতিবন্ধকতা হলঃ ১ মদ্যপান, ২ ইন্দ্রিয় আসক্তি, ৩ নীচবৃত্তি অবলম্বন, এবং ৪ সোনা, রূপা ও অর্থ দান হিসেবে গ্রহন করা।”

এই কথা বলে যশ মণিচুল্লকের উপাখ্যান সকলকে বললেন। যশের কথা শুনে উপাসক উপাসিকারা যশকে সদাচারী ভিক্ষু মনে করে তাঁকে মহাবন বিহারে থাকতে অনুরোধ করলেন।

এই খবর পেয়ে মহাবনের ভিক্ষুরা যশের প্রতি ‘উক্ষেপণীয় কম্ম’ করলেন এবং রাজা কালশোকের কাছে যশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। রাজার আদেশে যশকে ধরতে বিহারে রাজার লোক এল, কিন্তু যশ গোপনে সেই বিহার থেকে পালিয়ে গেলেন। তিনি যাবার আগে ভিক্ষুণী বিহারে গিয়ে রাজা কালাশোকের বোন ভিক্ষুণী নন্দাকে তাঁর নির্দোষীতার কথা বলে অনুরোধ জানিয়ে গেলেন। ভিক্ষুণী নন্দার কথায় কালাশোক নিজের ভুল বুঝতে পেরে যশের বিরুদ্ধে রাজদণ্ডাদেশ তুলে নিলেন।

এদিকে যশ বৈশালী থেকে দ্রুত কোশাম্বী রাজ্যে পালিয়ে গেলেন। যথাসময়ে তিনি পশ্চিমদেশ, দক্ষিণদেশ ও অবন্তিনগরে নিজের দূত পাঠিয়ে তাঁর দল আরও ভারী করতে লাগলেন। যশ ভিক্ষু প্রবীণ অর্হত সমভুত-সানবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি অহোগঙ্গ পর্বতে থাকতেন। তিনিও যশকেই সমর্থন জানালেন।

সেই সময় শীলবান ও প্রজ্ঞাবান ভিক্ষু রেবত বাস করতেন সোরেয্যতে। বৈশালীর বিক্ষুব্ধ ভিক্ষুরা চাইলেন তাঁকে তাঁদের দলে নিতে। তাঁরা প্রচুর দানদক্ষিণা নিয়ে রেবতের উদ্দেশ্যে বের হলেন। রেবত তখন সাংকষ্য নগরে চলে গেলেন। বৈশালীর ভিক্ষুরা রেবতের পরম শিষ্য ভিক্ষু উত্তরকে দান দিয়ে তাঁদের দলে টেনে নিলেন।

রেবত অহোগঙ্গ পর্বতে পৌঁছালেন এবং যশের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হল। রেবতও যশকে সমর্থন করলেন। এরপর আরও প্রবীণ ভিক্ষু সব্বকামের উপস্থিতিতে বৈশালীর বালুকারাম নামক স্থানে দ্বিতীয় ধর্মমহাসভার আয়োজন করা হল। ভিক্ষু রেবত মোট আটজন ভিক্ষুকে বিচারের ভার দিয়ে মনোনীত করলেন। পূর্বদেশ থেকে ভিক্ষু সব্বকাম, ভিক্ষু সাঢ়, ভিক্ষু খুজ্জ্সোভিত, এবং ভিক্ষু বাসভগামিক, এবং পশ্চিমদেশ থেকে মাহামান্য ভিক্ষু রেবত স্বয়ং, ভিক্ষু সমভুত-সানবাসী, ভিক্ষু যশ এবং ভিক্ষু সুমন। এই আটজন মিলে উদ্ভুত বিষয়টির মীমাংসা করলেন এবং ধর্ম ও বিনয় আবার আলোচনা করলেন। এই আলোচনায় মোট সাতশোজন অর্হত ভিক্ষু অংশগ্রহন করেছিলেন। এবং সব মিলিয়ে মোট বারো হাজার ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন। কালাশোকের রাজত্বের দশমবর্ষে এই ধর্মমহাসভার অনুষ্ঠানটি হয়েছিল।

সংগীতির শেষে বৈশালীর দশ হাজার ভিক্ষুকে সংঘ থেকে বিতাড়িত করা হয়। তাঁরা একত্রিত হয়ে বৈশালীর কুটাগারশালায় একত্রিত হলেন। তাঁদের ধর্ম মহাসভা মহাসংগীতি নামে পরিচিত হয়। যাঁরা এই মহাসংগীতিতে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা মহাসংঘিক নামে পরিচিত হন।

পরবর্তীকালে পূর্বদেশের ভিক্ষুরা পশ্চিমদেশীয় ভিক্ষুদের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং মহাসংঘিকদের সঙ্গে যোগদান করেন, এবং তখন পশ্চিমদেশীয় ভিক্ষুরা থেরবাদী নামে খ্যাত হয়েছিলেন।


৩) তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি ও অশোকের অবদানঃ



বুদ্ধের পরিনির্বাণের দুশো আঠেরো বছর পর মৌর্যসম্রাট পিয়দ্দসী অশোক সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি একবার সব ধর্মের মতবাদ শুনবেন বলে ব্রাহ্মণ, পরিব্রাজক, তীর্থিক, জৈন ও বৌদ্ধদের তাঁর রাজসভায় আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু কেউই অশোকের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। একমাত্র ধর্ম সম্পর্কে যথাযথ উত্তর দিয়ে অশোকের প্রশংসা লাভ করেন অল্পবয়স্ক বৌদ্ধশ্রমণ নিগ্রোধ। অশোক এরপর বৌদ্ধদের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং বৌদ্ধদের জন্য অশোকারাম নামক একটি বিহার নির্মাণ করে দেন। সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিশেষ সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করেছিলেন সম্রাট অশোক, এবং বাকি ধর্মমতের সকল সন্ন্যাসী, তীর্থিক ও আজীবকদের তাঁর রাজ্য থেকে তিনি দূর করে দেন।

বৌদ্ধদের মতো রাজার কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করার জন্য অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা ভিক্ষুদের বেশ ধারণ করে বৌদ্ধ বিহারগুলিতে প্রবেশ করে নিজের নিজের ধর্মমত প্রচার করতে লাগলেন। এর ফলে সংঘে ঘোর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে উপোসথ বা প্রবরণা পালন করতে একসময় অস্বীকার করলেন। ধর্মের এমন পতন দেখে বিরক্ত হয়ে মগ্গলিপুত্ত তিস্স পাটলিপুত্রের অশোকারাম বিহার ত্যাগ করে অহোগঙ্গা পর্বতে চলে যান। শোনা যায় তখন পাটলিপুত্রের অশোকারাম বিহারে প্রায় ষাট হাজার ভিক্ষু বসবাস করতেন।

অশোক জানতে পারলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিহারটিতে ভিক্ষুরা বিনয় পালন করছেন না। তিনি একজন আমাত্যকে সেখানে পাঠালেন। আমাত্যটি সেনাবাহিনী নিয়ে বিহারে প্রবেশ করলেন এবং যেসব ভিক্ষুরা রাজাদেশ পালন করছেন না, তাঁদের হত্যা করতে লাগলেন। এমন করে তরবারির আঘাতে বহু নিরীহ ভিক্ষুর প্রাণ গেল। এমন সময় সামনে এগিয়ে এলেন ভিক্ষু তিস্স। তিনি ছিলেন সম্রাট অশোকের ভাই। তিনি প্রব্রজ্যা নিয়ে ভিক্ষুত্ব লাভ করেছিলেন। আমাত্যটি তাঁকে দেখে চিনতে পারেন এবং তাড়াতাড়ি তরবারি নামিয়ে নিলেন। এরপর অশোকের কাছে গিয়ে সব ঘটনা জানালে, অশোক ভিক্ষুদের উপর অত্যাচারের ঘটনা জেনে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন।

তিনি মোগ্গলিপুত্ত তিস্সকে বিহারে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন এবং নিজের কর্মের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এরপর বিহার থেকে প্রকৃত ধর্মের অনুসারী ভিক্ষুদের বেছে নিতে একটি সভার আয়োজন করা হল। সভায় রাজা স্বয়ং এবং মোগ্গলিপুত্ত তিস্স দুজনেই বুদ্ধদেশিত ধর্ম সম্পর্কে ভিক্ষুদের নানা রকম প্রশ্ন করলেন। এরফলে ছদ্মবেশী তীর্থিকরা চিহ্নিত হলেন, এবং অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত ষাট হাজার পরিব্রাজককে শ্বেতবস্ত্র পরিয়ে বৌদ্ধসংঘ থেকে বিতাড়িত করা হল।

রাজার মধ্যস্থতায় আবার সেই বিহারে উপোসথসভার প্রচলন হল। এই সময় অশোকের উদ্যোগে পাটলিপুত্র নগরে তৃতীয় ধর্মসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। মোট নয়মাস ধরে এই সংগীতিটি চলেছিল। সভাপতি ছিলেন মোগ্গলিপুত্ত তিস্য। তিনি এই ধর্মমহাসভার জন্য বিশেষ ধর্ম ও বিনয় বিশারদ একহাজার অর্হতকে বেছে নিয়েছিলেন। এই সংগীতিতে মোগ্গলিপুত্ত তিস্স অধিবেশন চলাকালীন একটি অভিধর্মপিটকের গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটি হল “কথাবত্থুপ্পকরণ” বলা হয় অশোকের একাদশ শিলালিপি এই কথাবত্থুপ্পকরণ দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই সংগীতিটি অশোকের রাজত্বের সতেরোতম বছরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অবশেষে ধর্মমহাসভাটি বিরাট মহাপবারণা উৎসবের মাধ্যমে শেষ হয়। এই সভায় বিনয়পিটক, প্রবারণা, খন্ধক, অভিধম্মপিটক, পরিবারাদি ইত্যাদি গ্রন্থসমূহ গ্রন্থনা করা হয়েছিল।

তৃতীয় সংগীতির সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই সময় মোগ্গলিপুত্ত তিস্স নয়জন ধর্মদূতকে নটি দিকে পাঠিয়েছিলেন, যাতে দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে বৌদ্ধধর্ম সুরক্ষিত থাকে।

১ মজ্ঝান্তিক থেরকে – কাশ্মীর-গন্ধার রাজ্যে

২ মহাদেবকে – মহিষমণ্ডল বা মাহিস্মতিতে

৩ রক্খিত থেরকে – বনবাসীতে (দঃ ভারতের কর্ণাটক)

৪ যবন ও যোনক ধর্মরক্খিতকে – অপরান্তরাজ্যে (পশ্চিমের ভারুচ, সোপরা ইত্যাদি)

৫ মহাধম্মরক্খিত থেরকে – মহারট্ঠ বা মহারাষ্ট্রে

৬ মহারক্ষিত থেরকে – যবনলোক বা যবনদেশে (কাবুলের কাছে আলেকজান্ডার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আলেকজান্দ্রিয়া নগর)

৭ মজ্ঝিম থেরকে – হিমবন্ত প্রদেশ

৮ সোন ও উত্তর থেরদের – সুবণ্ণভূমি, বা সুবর্ণভূমিতে।

৯ মহিন্দ থেরকে – তম্বপণ্ণি বা তাম্রপর্ণীতে (শ্রীলঙ্কা)

মজ্ঝিম থেরের সঙ্গে এবং মহিন্দ থেরের সঙ্গে যাত্রাসঙ্গী হিসেবে অনুচর ভিক্ষুদের নাম পাওয়া যায়। যেমন হিমবন্ত প্রদেশে মজ্ঝিম থেরের সঙ্গী ছিলেন কস্সপগোত্ত থের, মূলকদেব, সহদেব এবং দূরভিসর থের। মহিন্দ থেরের সঙ্গী ছিলেন – ইট্ঠিয়, উত্তীয়, সম্বল ও ভদ্দসাল ভিক্ষু। তাদের সহকারী শ্রামণের (শিক্ষার্থী ভিক্ষু) ভিক্ষু ছিলেন সুমন। বলা হয়, শ্রামণের সুমন হলেন মহিন্দ থেরের ভাগ্নে অর্থাৎ তাঁর বোন সংঘমিত্রার পুত্র।

সম্রাট অশোকের সময় ভারতে বৌদ্ধধর্ম একটি বিশেষ স্থান লাভ করেছিল এবং দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর অনুগ্রহেই প্রান্তিক রাজ্যগুলিতে এবং বহির্বিশ্বে প্রথম বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল।


৪) চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি ও সম্রাট কণিষ্কঃ



চতুর্থ ধর্মসংগীতিটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সম্রাট কণিষ্কের রাজত্বকালে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের ৩৯৯ বছর পরে গান্ধাররাজ কণিষ্ক সিংহাসন লাভ করেন। তিনি বহুদেশ জয় করে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। রাজকার্যের অবসরে তিনি প্রতিদিন পার্শ্ব নামক স্থবিরের কাছ থেকে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন। বলা হয়, তিনি প্রতিদিন নানা বৌদ্ধভিক্ষুদের রাজসভায় নিমন্ত্রণ করে তাঁদের কাছ থেকেও ধর্মকথা শুনতেন। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা শুনে তিনি ধর্ম সম্পর্কে একসময় সন্দিহান হয়ে উঠলেন। তিনি এ সম্পর্কে একদিন স্থবির পার্শ্বকে জিজ্ঞাসা করলেন। পার্শ্ব তাঁকে জানালেন বিভিন্ন বৌদ্ধ আচার্যদের বিভিন্ন মতের জন্য ধর্মও এমন বহুধা বিভক্ত হয়ে গেছে। কণিষ্ক তখন স্থবিরকে বললেন, ত্রিপিটক শাস্ত্রগুলির ব্যাখ্যা ও সঙ্কলন করা প্রয়োজন। এ কথায় স্থবির পার্শ্বও সম্মতি জানালেন। তখন একটি সুবিশাল ধর্মমহাসভার আয়োজন করা হল। স্থবির বসুমিত্র এই সভার সভাপতি ছিলেন এবং পণ্ডিত অশ্বঘোষ ছিলেন এই সভার সহসভাপতি। সংগীতিটি কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সংগীতিতে পাঁচশোজন অর্হৎ অংশ নিয়েছিলেন। এই ধর্মসভায় বিনয়পিটক, সুত্তপিটক ও অভিধম্মপিটকের টীকাগ্রন্থ বা বিভাষাসমূহ সংকলিত হয়েছিল। বিভাষাসমূহ এত সুলিখিত ও সহজবোধ্য হয়েছিল যে সর্বত্র এর প্রচার ও সমাদর হয়েছিল।

অধিবেশনের ফলাফল সম্রাট কণিষ্ক একটি সুবিশাল তামার আধারে খোদাই করিয়ে ছিলেন এবং আগামী প্রজন্মের কাছে ধর্মের সুষ্ঠ ব্যাখ্যা প্রচারের জন্য সেই রক্তবর্ণ তাম্রপট্টটিকে একটি পাথরের আধারে রেখে তার উপরে একটি বিরাট স্তুপ নির্মাণ করে দেন। আজ পর্যন্ত সেই তাম্রপট্টটি আবিষ্কার হয়নি। যাতে অন্য মতাবলম্বীরা ধর্মের কোনো বিরোধীতা না করতে পারে, তাই বলা হয়, ধর্ম শিক্ষা করতে হলে সকলকে কাশ্মীরে আসতে হবে। এবং তিনি নগরের চারদিকে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চতুর্থ সংগীতিতে সমস্ত ত্রিপিটকের টীকা সংস্কৃতভাষায় রচিত হয়েছিল। এই সংগীতিটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই সময় থেকেই বৌদ্ধধর্ম মহাযান ও হীনযান এই দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়।


৫) বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন শাখাঃ


বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই সংঘের মধ্যে মতভেদের সূত্রপাত হয়েছিল। চুলবর্গে কোশাম্বীর ভিক্ষুদের বিবাদ (বিনয়ধর ও সূত্রধর ভিক্ষুর কলহ) ও দেবদত্তের সঙ্ঘভেদের চেষ্টা এর প্রমাণ। বুদ্ধের নির্দেশে তাঁর জীবদ্দশায় বিনয় না মেনে সংঘ থেকেও বহিষ্কৃত হয়েছেন ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা। আমরা বিনয় পিটকের বিভিন্ন অংশে সে সব কাহিনীর উল্লেখ দেখেছি। (ভিক্ষুণী নন্দা ও ভিক্ষু সুদিণ্ণের জীবনের গল্প ও বুদ্ধ দ্বারা তাদের সংঘ থেকে বহিষ্কার)

বুদ্ধের ধর্ম এত ব্যাপক ও দার্শিনিক তত্ত্বে ভরা যে সবার পক্ষে সব বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বলাভ অসম্ভব ছিল, তাছাড়া বুদ্ধ আধার অনুযায়ী শিক্ষা দিতেন। তাই আমরা বু্দ্ধের জীবিতকালেই দেখতে পাই স্থবির সারীপুত্ত প্রজ্ঞাবান, আনন্দ সূত্রবিশারদ, মোদ্গলায়ন ইদ্ধিমন্তানং অর্থাৎ অলৌকিক শক্তিশালী, মহাকাশ্যপ ধূতবাদী (শীলবান) ইত্যাদি বিভাজন অনুযায়ী শ্রমণেরা সংঘে প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধ চালিকাশক্তি, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও সর্বোপরি আধ্যাত্মিক শক্তি ও তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে ধর্মকে সুরক্ষিত করে রেখেছিলেন। বুদ্ধ সংঘের বিভাজনকে রোধ করতে পারলেও তাঁর অবর্তমানে সুবিশাল ধর্মের নিয়ম নীতির বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে শুরু করল এবং একশো বছরের মধ্যেই বৈশালীর বিক্ষুব্ধ ভিক্ষুরা মহাসংঘিক শাখায় বিভক্ত হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে সংঘ আঠেরোটিরও বেশি শাখায় ভেঙে যায়।

মহাসংঘিকরা পুনরায় আবার সাতটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়।

১। একব্যবহারিক, ২। চৈতিক বা চৈত্যক, ৩। কৌকুট্টিক, ৪। বহুশ্রুতীয়, ৫। প্রজ্ঞপ্তিবাদ, ৬। পূর্বশৈল, ৭। অপরশৈল

এর মধ্যে চৈত্যবাদ এবং শৈলসম্প্রদায় সবথেকে জনপ্রিয় ছিল।

স্থবিরবাদীরা এগারোটি শাখায় বিভক্ত হয়েছিল।

১। মহীশাসক, ২। বাৎসীপুত্রীয়, ৩। সম্মিতীয়, ৪। ছণ্ণগারিক, ৫। ভদ্রযানীয়, ৬। ধর্মোত্তরীয়, ৭। সর্বাস্তিবাদ, ৮। ধর্মগুপ্তিক, ৯। কাশ্যপীয়, ১০। হৈমবত এবং ১১। সংক্রান্তিক।

এর মধ্যে সর্বাস্তিবাদীদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী সব থেকে জনপ্রিয় হয়েছিল।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন শাখাগুলি অবলুপ্ত হয়ে যায়। প্রধান দুটি শাখা হীনযান বা থেরবাদ এবং মহাযান এই দুটি শাখায় বাকি শাখাগুলি এসে মিশে যায়। হীনযান ও মহাযান কথাদুটির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় মহাসংঘিকদের। তাঁরা দ্বিতীয় ধর্মসংগীতির সময় নিজস্ব কিছু উদারপন্থী মতবাদ সংঘে আনতে গিয়ে সংঘ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। মহাসংঘিকেরা প্রথম থেরবাদীদের ‘অধম্মবাদী’ ও ‘পাপভিক্ষু’ বলেন। এঁরাই থেরবাদীদের থেকে নিজেদের আলাদা করতে নিজেদের মহান প্রমাণ করতে নিজেদের ‘মহাযানপন্থী’ ও থেরবাদীদের ‘হীনযান’ বা হীনযানপন্থী নামে অভিহিত করেছিলেন। মহাযানীদের আদর্শ বুদ্ধত্বলাভ, এবং হীনযানীদের আদর্শ হল অর্হত্বলাভ। অপরদিকে মহাযানীরা স্বয়ং নির্বাণ লাভে উন্মুখ নন, তাঁরা চান জগতের মঙ্গলের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে। বস্তুতঃ প্রতিটি জীবের মোক্ষলাভ করানোই মহাযানীদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

হীনযান ধর্মমতের দুটি শাখা ১। সৌত্রান্তিক ও ২। বৈভাষিক।

এবং মহাযানের দুটি শাখা ১। মাধ্যমিক ও ২। যোগাচার।

মাধ্যমিক শূন্যবাদ –

শূন্যবাদ শব্দটি বিভ্রান্তিকর হলেও আচার্য্য নাগার্জুন খ্রীষ্টিয় ২য় শতাব্দীতে এই এই মতবাদের প্রবর্তন করেন। তিনি শূন্যবাদ বলতে প্রতীত্যসমুৎপাদকেই বলেছেন। এই শূন্যবাদের বিকাশ প্রতীত্যসমুৎপাদের উপরে নির্ভরশীল। যেমন অঙ্কুরই বীজ, কিন্তু বীজ নিত্য বা স্থির নয়, কারণ অঙ্কুর রূপে এর পরিবর্তন হয়। শূন্যবাদ বলে সংসার এক পরিবর্তনের প্রবাহ। পঞ্চস্কন্ধ প্রদীপশিকার মতই পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রবাহের অন্ত নেই।

জগত ও তার পদার্থ সমূহকে মরীচিকা বলতে গিয়ে নাগার্জুন বলেছেন, মরুভূমির মরীচিকাকে জল বলে কেউ ভুল করে কাছে গিয়ে যদি দেখে জল নয়, তবুও তিনি মূর্খ। কারণ সংসারে আছে এবং নেই দুই মোহ, যা যুক্তিযুক্ত নয়।

যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ –

এর উদ্ভব হয় খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে। অসঙ্গ ও মৈত্রেয়নাথ, শীলভদ্র প্রভৃতিরা এর প্রবক্তা। বিজ্ঞানবাদে আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছিল। কারণ জন্ম জন্মান্তর থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞান স্রোত প্রবাহিত হয়ে এই আলয় বিজ্৭আন সন্মিলিত হচ্ছে, এবং তা থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে পুণরায় জীবের ক্রিয়া, বৃদ্ধি ইত্যাদিকে প্রভাবিত করছে।আসলে বিজ্ঞানস্রোতকে বলা উচিত ক্ষণ পরম্পরা। বস্তু ও তার বিজ্ঞান দুই ক্ষণিক। পরিবর্তন স্বীকার করলে পূর্বমুহূর্তের বস্তুকে আর পরমুহূর্তের বস্তু বলা যাবে না। এই উভয় সংকট থেকে বাঁচতে বৌদ্ধ দার্শনিকেরা ক্ষণিকত্ববাদের আশ্রয় নিয়েছেন। বেদান্ত যদি মায়াবাদ হয়, তাহলে বৌদ্ধবিজ্ঞানবাদকে বলা যায়, ত্রিবর্গ মায়াবাদ। কারণ এতে গ্রাহ্য, গ্রাহক এবং সম্বন্ধ তিনই কল্পনা।

বৈভাষিক –

প্রাচীন সর্বাস্তিবাদ থেকেই বৈভাষিক সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়েছে। এর উদ্ভব হয়েছে খ্রীঃ ১ম থেকে ২য় শতকে। সর্বাস্তিবাদের সমর্থক সম্রাট কণিষ্ক একটি ধর্মমহাসভার আয়োজন করেন যা চতুর্থ বৌদ্ধ ধর্মসংগীতি নামে পরিচিত। বিনয়পিটক, অভিধর্মপিটক ও সুত্তপিটকের টীকা গ্রন্থ বা বিভাষা তৈরি করা হয়েছিল। তাকে বলা হত মহাবিভাষা শাস্ত্র। যাঁরা এর সমর্থক ছিলেন তাঁদের বৈভাষিক বলা হত। বসুবন্ধু এই সময় তাঁর প্রসিদ্ধ অভিধর্ম কোশ রচনা করেছিলেন।

অভিধর্ম কোশের টীকাকার যশোমিত্র বলেছেন, সর্বাস্তিবাদীরা আগম ও যুক্তি দ্বারা অতীত ও অনাগতের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ যাঁরা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই ত্রিকাল আছে বলতেন, তাঁদেরই সর্বাস্তিবাদী বলা হত। এঁরা সকলে অনাত্মবাদী ছিলেন।

সৌত্রান্তিক –

বৈভাষিকদের উৎপত্তির পরে খ্রীঃ ২য় শতকে সৌত্রান্তিকদের উৎপত্তি হয়। হরিবর্মণের ‘সত্যসিদ্ধিশাস্ত্র’ এই সম্প্রদায়ের প্রামাণ্য গ্রন্থ। সৌত্রান্তিকেরা বুদ্ধের সূত্রকেই প্রামাণ্য বলে মনে করতেন। তাঁরা মন এবং বাহ্যবস্তু উভয়কেই সত্য বলে স্বীকার করেন। তাঁদের মতে বাহ্যবস্তুকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহন না করলে বস্তুর পরিকল্পিত রূপকেও গ্রহন করা যাবে না। এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন কুমার লাভ, হরিবর্মণ, বসুবন্ধু, যশোমিত্র প্রভৃতি।


৬) বৌদ্ধ ধর্মের অবনতি ও অবলুপ্তিঃ


বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরবর্তী ঘটনাবলী - নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী - বজ্রযান

শাসকদের বিরোধিতা – মৌর্য সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরেই মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙন সূচিত হয়েছিল। শেষ মৌর্যসম্রাট ছিলেন বৃহদ্রথ। তিনি তাঁর ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্রের হাতে নিহত হন। পুষ্যমিত্র ছিলেন বৌদ্ধবিদ্বেষী। তিনি বহু স্তুপ, চৈত্য ইত্যাদি ধ্বংস করেন। অশোকের প্রতিষ্ঠিত কুক্কুটারাম বিহারটি তিনি ধ্বংস করেছিলেন। তিনি রাজ্যে ঘোষণা করেন প্রত্যেক শ্রমণের কাটা মাথার জন্য তিনি একশো স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেবেন। তিনি মধ্যদেশ থেকে জলন্ধর পর্যন্ত অসংখ্য বিহারে অগ্নিসংযোগ করেন।

পুষ্যমিত্রের পরবর্তী অত্যাচারী রাজা হলেন হুনরাজ মিহিরকুল। ইনি শৈব ছিলেন। রাজতরঙ্গিনীতে তাঁকে অত্যাচারের জন্য মৃত্যুর দেবতা যমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তিনি সমগ্রদেশের বহু বৌদ্ধসংঘ ধ্বংস করেন। কাশ্মীরে এক হাজার স্তুপ ও ছশো সংঘারাম ধ্বংস করেছিলেন। কথিত আছে মহিরকুল আমৃত্যু ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছেন এবং প্রায় তিন কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছিলেন। তিনি আগুনে গৃতাহুতি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। অপর এক হুন রাজা তোরমান কোশাম্বীর ঘোষিতারাম বিহারটি ধ্বংস করেন।

অপর নির্যাতনকারী রাজা হলেন শশাঙ্ক। তিনি কুশীনগরের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উৎখাত করেছিলেন। পাটলিপুত্র নগরে বুদ্ধের পদচিহ্ন সম্বলিত শিলাটি তিনি গঙ্গায় ফেলে দেন এবং বুদ্ধগয়ার পবিত্র বোধিবৃক্ষটিকে তিনি উপড়ে ফেলে দেন।

মুসলমান আক্রমণ –

একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কুতুবুদ্দিনের সেনাপতি বক্তিয়ার খিলজি ওদন্তপুরী বিহারটি ধ্বংস করে দেন। অগ্নিসংযোগ করেন এবং হত্যালীলা চালান অবশেষে বৌদ্ধ সাহিত্যের অমূল্য পাণ্ডুলিপিগুলি জ্বালিয়ে দেন। বিহারগুলিই ছিল বৌদ্ধধর্মের প্রাণকেন্দ্র, সেগুলি ধ্বংসের সাথে সাথে বৌদ্ধভিক্ষুদের জীবনযাত্রাও স্তব্ধ হয়ে যায়। এভাবেই ধ্বংস করা হয় নালন্দা বিহারটিকেও। মুসলমান আক্রমণের ফলে নালন্দার গ্রন্থাগারের আগুন প্রায় কয়েকমাস ধরে জ্বলেছিল। সেই সময় বহু ভিক্ষুরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছিলেন। কারণ সুলতানের হুকুম ছিল হয় ধর্মান্তরিতকরণ নচেত হত্যা।

সংঘের মতভেদ –

বুদ্ধের পরিনির্বাণের একশো বছরের মধ্যে সংঘে মহাসংঘিক নামে একটি শাখার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে সংঘে আঠেরোটি শাখার সৃষ্টি হয়। নির্ধারিত শিক্ষাপদগুলি সহজে কেউ গ্রহন করতে চাইছিলেন না। নানা রকম মতভেদ ও ভিন্ন মতবাদ দেখা দিল। পরবর্তী শতাব্দীতে সংঘ শাখা প্রশাখা বিস্তার করে মহীরুহে পরিণত হল। তখন মূল ধর্মটিই ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে গেল।

রাজানুকূল্যের অভাব –

বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল ছিল। রাজারা ছাড়াও সমাজের বহু ধনীব্যক্তিরা এই ধর্মের প্রচারে বহু সাহায্য করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে প্রধান ভূমিকা ছিল বিম্বিসার, প্রসেনজিত, উদয়ন, এবং অজাতশত্রুর। এছাড়া উচ্চবিত্ত শ্রেষ্ঠী, গহপতিরাও বুদ্ধের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে মৌর্য সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এরপরে বৃহৎ শক্তি ছিলেন কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক। এরপর হর্ষবর্ধনও বৌদ্ধ ধর্মীয় ছিলেন এবং ধর্মের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। শেষ বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাল রাজারা। তাঁরা বহু বিহারের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। এরপর থেকেই বৌদ্ধধর্মে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অবসান ঘটে, এবং বিহারগুলির অবস্থার অবনতি হতে থাকে।

হিন্দুধর্মের প্রভাব –

বৌদ্ধ ধর্মে নানা দেব দেবীর আবির্ভাব ঘটে, এবং ধারণী, মন্ত্র তন্ত্র ইত্য়াদির আগমন ঘটে। এরফলে একসময় হিন্দু ধর্ম আর বৌদ্ধধর্মের বিশেষ একটা পার্থক্য থাকে না। এছাড়া উল্লেখযোগ্য হিন্দু আচার্যদের প্রভাবে সমাজে হিন্দুধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি হয়। তাঁরা হলেন কুমারিল ভট্ট, শঙ্করাচার্য, উদয়নাচার্য, রামানুজাচার্য ইত্যাদি। তাঁরা তাঁদের দার্শনিক মতবাদ প্রচার করে হিন্দুধর্মকে একটা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বুদ্ধের অষ্টাঙ্গিক সাধনামূলক ধর্ম ভারতবর্ষ থেকে বিলুপ্ত হয়নি বরং হিন্দুধর্ম তা আত্তীকরণ করেছিল।ষষ্ঠ শতাব্দীর মৎস্যপুরাণে বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এভাবে বুদ্ধ ধীরে ধীরে একজন প্রসিদ্ধ হিন্দু দেবতারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একইভাবে বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রসাধনা একাঙ্গীভূত হয়ে একটি নতুন রূপ পেয়েছিল। শঙ্করাচার্য বৌদ্ধমঠের অনুকরণে কয়েকটি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করেন এবং এভাবেই বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের ভেতর প্রবেশ করেছিল। বৌদ্ধ ধর্ম ছিল মূলত বিহার কেন্দ্রিক তা হিন্দুধর্মের মত তা কখনো সামাজিক হতে পারেনি।

ধর্মের বিকৃতি –

বৌদ্ধ তন্ত্র সাধনা হল মহাযানী বৌদ্ধদের একটি বিশেষ ধ্য়ান পদ্ধতি যা মোটেই যৌগিক ধ্য়ান নয়। এতে নাকি সাধক সহজে সিদ্ধিলাভ করে। বুদ্ধের শীল, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, চিত্তশুদ্ধি ইত্যাদি এই ধ্যানে নেই। এটি বৌদ্ধ দর্শনেরও অঙ্গ নয়। একশ্রেণীর মহাযানী বৌদ্ধদের সৃষ্ট একটি ধ্যান পদ্ধতি।

অথর্ববেদে এই তুকতাক, বশীকরণ ইত্যাদি আমরা দেখতে পাই। নিজশক্তিতে বহিঃশক্তিকে বশ করাই হল তন্ত্রের উদ্দেশ্য। দক্ষিণ ভারতের কিছু মহাযানী ভিক্ষুরা এই সাধনার উদ্ভব করেছিলেন।

সাধারণ মানুষ শূন্যবাদের তত্ত্বকথা বুঝতেন না। তাদের কাছে ধ্যানের চেয়েও মন্ত্রই ছিল মূল প্রেরণা। তাদের কাছে যাদু-মণ্ডল, ধারণী, বীজ এইসব অনেক সহজ মনে হল। মহাযানীরা তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মকে বোঝাতে লাগলেন। এভাবে তন্ত্র সকলের কাছে বৌধগম্য হয়ে উঠল। এভাবে বাংলা হয়ে উঠল তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান। এখান থেকে তন্ত্রসাধনা আসামের কামাখ্যায়ও পাড়ি দিয়েছিল। তান্ত্রিক মহাযানের প্রথম পদক্ষেপ হল মন্ত্রযান। পুণরায় সৃষ্টি হল বজ্রযান, সহজযান ও কালচক্রযান।

তন্ত্রে ধীরে ধীরে নানা বিকৃতি দেখা যায়। তাতে যৌনাচারযুক্ত যোগ সাধনার প্রচলন হয়। অসঙ্গের একটি মহাযান গ্রন্থ সূত্রালঙ্কারে পরাবৃত্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করা যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরাবৃত্তি হল যৌনাচার। পরবর্তীকালে বজ্রযান বলতে তান্ত্রিক বৌদ্ধশাখাগুলিকে বোঝানো হত। বজ্রযানীদের বজ্র অর্থাৎ শূন্যতা। যা দৃঢ়, অবিভাজ্য, অভেদ্য এবং ধ্বংসের উর্ধে তাই হল বজ্র। এখানে শূন্যতা বলতে মহাসুখ বোঝানো হয়েছে। যা যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব বলে মনে করা হয়। বজ্রযানে ছয় প্রকারের নিম্নশ্রেণীর অকুশল আচারের উল্লেখ আছে। এর প্রয়োগের জন্য বিবিধ যৌনাচারেরও নির্দেশক এবং উল্লেখ আছে।

বজ্রযানের নির্দিষ্ট দেবদেবীর আছেন এবং এই ক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য সাধকের সাধনসঙ্গিনীর প্রয়োজন হয়। এভাবেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে ধর্মের নামে নানা বিকৃতির প্রচলন হয় এবং অবশেষে সমাজে তাঁরা ঘৃণিত ও নিন্দনীয় হয়ে ওঠেন, এবং ধর্মের অবনতি ও অবশেষে অবলুপ্তি ঘটে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *