নন্দিতা বাগচী
গত চল্লিশ বছর ধরে পৃথিবীটাকে প্রদক্ষিণ করে চলেছি আমি। নানা দেশ তথা মহাদেশের মাটি ছুঁয়েছি। সেসব অভিজ্ঞতার কথা গ্রন্থিত আছে দুটি বইয়ের গোটা পঞ্চাশেক ভ্রমণ কাহিনীতে। কিন্তু আজ আমি যে কাহিনী লিখতে বসেছি তাকে কী নাম দেব? একে কি ভ্রমণ কাহিনী বলা যায়?
ব্যাপারটা তবে খুলেই বলি। গত কুড়ি-বাইশ মাস হল আমরা সবাই গৃহবন্দী হয়ে আছি প্রবল পরাক্রমশালী এক ভাইরাসের দৌরাত্ম্যে। যেন পুরাণের বকরাক্ষস সে। রোজই চাই তার তাজা প্রাণ। কোথায় যাব বেড়াতে? আমাদের আগেই তো সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে সে। তার করাল গ্রাস থেকে পরিত্রাণ পেতে সব যানবাহনও বন্ধ গোটা পৃথিবীটা জুড়ে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণের তো কোনও প্রশ্নই নেই। কেননা আলফা, বিটা, গামা, ডেলটারা সব সেজেগুজে বসে আছে শূর্পনখার মতো। মানুষের সাধ্য কি তাদের সঙ্গে লড়াই করে।
তবুও অনেক গবেষণার পর ভীম-ভ্যাকসিন এলেন বকরাক্ষসকে শায়েস্তা করতে। পুরাণের ভীম একাই জব্দ করেছিলেন বক রাক্ষসকে, কিন্তু কলিযুগের ভীমেরা নানা মুনির নানা মনের কবলে পড়লেন। সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত। কোন টিকা নেন? কোন টিকা কোন দেশে প্রবেশের ছাড়পত্র দেবে? কারও বাবা-মা অসুস্থ এক দেশে। কারও পরিবারে নতুন অতিথি আসছে আরেক দেশে। কিন্তু ভাইরাস বাবাজীর ‘নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু।’
আমরাও আমাদের বাৎসরিক পরিযানে আমেরিকায় আসবার জন্য টিকিট কেটে বসে আছি। নিজেদের সঞ্চিত করেছি প্রয়োজনীয় টিকাগুলি নিয়ে। কিন্তু হায়! এদেশের দরজা যে বন্ধ আমাদের জন্য!
তবে সব আইনেরই যেমন ফাঁক-ফোকর থাকে, এই বিধানের ভেতরেও এক সুড়ঙ্গ খুঁজে পেলাম আমরা। অন্য কোনও দেশে যেখানে এই বকরাক্ষসের উপস্থিতি নেই সেখানে চোদ্দোদিন কাটিয়ে আমরা আমাদের গন্তব্যে যাত্রা করতে পারি। কিছুটা গঙ্গাস্নান করে পবিত্র হবার মতো আরকি। আর ঠিক সেই সময়েই দুবাই আমাদের জন্য দরজা খুলে দিল। কেননা তখন DUBAI EXPO শুরু হয়েছে। তবে দুবাইয়ের ভিসা পাবারও কিছু শর্ত ছিল। যেটা পূর্ণ করল আমাদের আমেরিকান ভিসা।
তবুও শত্রুনিধনে তৎপরতার কমতি নেই আমিরশাহিতে। লখীন্দরের বাসরের মতোই নিশ্ছিদ্র করতে চায় তারা নিজেদের দেশটাকে। তাই আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেকার RT-PCR টেস্ট ছাড়াও বিমানে ওঠার আগে কলকাতা বিমানবন্দরে এবং বিমান থেকে নেমে দুবাই বিমানবন্দরে Rapid Antigen Test এবং RT-PCR টেস্ট করে প্রমাণ দিতে হল যে আমরা বকরাক্ষসের কোনও রক্তবীজ বহন করছি না।
সব পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে দুবাই শহরে পা রাখা মাত্র বেশ মুক্ত বিহঙ্গ মনে হল নিজেদের। আমাদের কাছে পাসপোর্ট আছে, ভিসা আছে, আর আছে মহামূল্যবান RT-PCR টেস্টের নেগেটিভ সার্টিফিকেট। ‘নেগেটিভ’ শব্দটা যে এত ‘পজিটিভ’ আগে কখনও উপলব্ধি করিনি।
দুবাইয়ের পূর্বপ্রান্তে ডেয়রা অঞ্চলের ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট থেকে দুবাই ক্রিক পেরিয়ে, বার দুবাই হয়ে পশ্চিমপ্রান্তের জুমেইরা বিচের হোটেলে পৌঁছতে আধঘণ্টা মতো সময় লাগল আমাদের। ঝকমকে লিমুজিনের ড্রাইভারটিও চকচকে। তবে তার চোস্ত ইংরেজির মাঝেই বেরিয়ে এল উর্দু উচ্চারণ। কথায় কথায় জানতে পারলাম পাকিস্তানের মানুষ সে। হ্যাঁ, ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষেরাই মূলত চালাচ্ছেন এই দেশটাকে।
শেখ জায়েদ রোড ধরে এগিয়ে চলেছি জুমেইরা বিচের দিকে, হঠাৎ হাতের বাঁদিকে এলিভেটেড মেট্রোলাইনের গা ঘেঁষে দেখি এক আশ্চর্য ভাস্কর্য যেটা আগে কখনও দেখিনি। যেন রুপো দিয়ে তৈরি এক মস্ত ডোনাট, যার গায়ে কালো কালির অ্যারাবিক ক্যালিগ্রাফি। আমাদের ঔৎসুক্য দেখে ড্রাইভার জানাল যে সেটা নাকি মিউজিয়াম অফ দ্য ফিউচার। আমাদের কথোপকথনের মাঝখানেই ডাউনটাউন দুবাইয়ের আকাশে ভরদুপুরের সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিকিয়ে উঠল বুর্জ খলিফা তার আকাশ ভেদ করা অহংকার নিয়ে।
আর একটু এগোতেই হাতের ডাইনে একটা মস্ত জাহাজের পাল উঁকি দিয়ে গেল। খেজুর গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে লুকোচুরি খেলছে সে আমাদের সঙ্গে। হ্যাঁ, ওটাই বিশ্ববিখ্যাত বুর্জ আল আরব হোটেল। তার সঙ্গে আগেই মোলাকাত হয়েছে বার দুয়েক। তাই আমাদের দেখে সে যেন জিজ্ঞেস করল, “এতদিন কোথায় ছিলেন?”
জুমেইরা পাম আইল্যান্ডও পারস্য উপসাগরে শায়িত থেকেই একটা হাত নাড়ল পূর্ব পরিচিতের প্রতি। এমিরেটস্ গলফ ক্লাব এবং লেক ডিস্ট্রিক্টের আকাশ ছোঁয়া স্কাইস্ক্র্যাপারগুলোকে হাতের বাঁদিকে রেখে আর দুবাই মেরিনাকে ডানদিকে রেখে ডাইনে বাঁক নিই আমরা। এই জুমেইরা বিচ অঞ্চলে অনেকগুলো বিলাসবহুল হোটেল ছড়িয়ে আছে। আর আছে অসংখ্য রেস্তোরাঁ সারা পৃথিবীর খাদ্যসম্ভার নিয়ে।
হোটেলে পৌঁছে প্রথমেই মনটা খারাপ হল তাদের ওয়েলকাম ড্রিঙ্কটি না পেয়ে। আগেরবারে দেখেছিলাম রিসেপশনে রাখা ছিল একটা চমৎকার কফিপট যাকে এদেশে বলে Dallah আর তার ভেতরে ছিল Gahwa নামের সুস্বাদু কফি। সঙ্গে রাখা ছিল রুপোর ধামাভর্তি খেজুর। কফি ঢেলে নাও যত খুশি আর খেজুর তুলে নাও মুঠো মুঠো। এবার না কফি, না খেজুর। থরে থরে সাজানো রয়েছে শুধু স্যানিটাইজারের বোতল আর মাস্কের বাক্স। মন খারাপ হবে না?
আমাদের হোটেলে জুমেইরা বিচের শেষ প্রান্তে এবং দুবাই মেরিনা লাগোয়া। এর কিছু পরেই শুরু হয়ে যায় জেবেল আলি অঞ্চল। যেহেতু এই হোটেলটিতে আগেও একবার থেকে গেছি আমরা তাই ভেবেছিলাম এ অঞ্চলটার সব খুঁটিনাটিই আমাদের জানা। কিন্তু এ হচ্ছে আমিরশাহি। মাটির তলায় জলের মতো বয়ে যায় পেট্রোলিয়াম। আর দিওহামের দবদহা সারা দেশ জুড়ে। তাই নিত্যি নতুন সংযোজন এখানে। হোটেলের ঘরে ঢুকে জানালার পর্দা সরাতেই দেখি পারস্য উপসাগরের বুকে মস্ত এক সুদর্শন চক্র। চোখ রগড়ে দেখি সেটা আসলে London Eye-এর মতো একটা Ferris Wheel, গুগলমশাইয়ের শরণাপন্ন হয়ে জানতে পারি এটিই নাকি Air Dubai, যেটি পৃথিবীর উচ্চতম Ferris Wheel, যার উদ্বোধন হবে একুশে অক্টোবরে। আর আজ অক্টোবরের দশ তারিখ।
আসলে এ বছরটায় আমিরশাহির প্রতিষ্ঠা দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ১৯৭১ সালে সাতটি আমিরাত নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারই নানা উদযাপন চলছে। DUBAI EXPO তারই অংশ বিশেষ।
বাদশাহি লাঞ্চটি সারা হয়েছে এমিরেটস্-এর বিমানেই। তাই ঝটপট কাপড় জামা বদলে, পায়ে হাওয়াই চপ্পল গলিয়ে আমরা নিচে গিয়ে হাজির হই। দূরে হাতের ডাইনে দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রের ভেতরে জেগে ওঠা পাম জুমেইরা দ্বীপটিতে অবস্থিত আটলান্টিস হোটেল। আরও একটু দূরে সমুদ্রের মাঝে পাল তুলেছে বুর্জ আল আরব হোটেল। আর মুহুর্মুহু আমাদের হোটেলের পাশ থেকেই উড়ে যাচ্ছে ছোট ছোট প্লেন স্কাই ডাইভারদের নিয়ে। আর Air Dubai চক্রটার দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা মোটেও সমুদ্রে ভাসছে না। সেটা একটা দ্বীপের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। যে দ্বীপটা আগেরবারে দেখিনি। দুবাইয়ের আশেপাশে বেশ কয়েকটি মানুষের তৈরি দ্বীপ রয়েছে (reclamation ground), এই দ্বীপটি তারই নবতম সংযোজন। নাম Blue Waters Island. এই ছোট্ট দ্বীপটতে Air Dubai ছাড়াও আছে দুটো পাঁচতারা হোটেল, গোটা দশেক রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং আর অসংখ্য দোকানপাট, রেস্তোরাঁ। পর্যটকদের জন্য তো বটেই, উপরন্তু দুবাইবাসীদের জন্যও একটি বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই Blue Waters Island. আর আমাদের তো ঘরের মানুষ সে। আমাদের হোটেলের ঠিক পেছনের বিচের ওপর দিয়ে চলে গেছে নতুন, ঝকমকে একটা লম্বা বোর্ডওয়াক। যার একপ্রান্ত জুমেইরা বিচ রেসিডেন্সিয়াল (স্থানীয় নাম JBR) এরিয়াতে আর অন্য প্রান্ত Blue Waters Island-এ যাবার ব্রিজে। হ্যাঁ, একটা চমৎকার আলোকিত কাঠের ব্রিজ এই ছোট্ট দ্বীপটিকে সংযুক্ত করেছে জুমেইরা বিচের সঙ্গে।
আমাদের হোটেলটার ঠিক পাশেই তৈরি হয়েছে আরেক অভিনব স্থাপত্য যার নাম Jumeirah Gate, যেটি দুটি আকাশছোঁয়া বাড়ির সমন্বয়। যার গোড়ার কয়েকটি তল এবং চূড়ার কয়েকটি তল সংযুক্ত। মাঝখানে এক মস্ত শূন্যতা। যার ফলে একটি তোরণের আকার পেয়েছে বাড়িটি। এই স্কাই স্ক্র্যাপারটিতেও আছে বেশ কয়েকটি পাঁচতারা হোটেল যার একটিতে আছে পৃথিবীর সব চাইতে উঁচু ইনফিনিটি পুল। এই অভিনব বাড়িটি এখন দুবাইয়ের একটি দ্রষ্টব্য। পর্যটকরা এখানে এসে ছবি তুলছেন দিবারাত্রি।
এবার যেহেতু পর্যটনের তেমন সুবিধে নেই। আর আমরাও আতঙ্কিত হয়ে আছি বকরাক্ষসের তাড়নায়, তাই দুবাইয়ের দর্শনীয় স্থানগুলোতে পা রাখিনি। আগেরবার মারঘাস বালিয়াড়িতে গিয়েছিলাম ‘ডিউন ড্যাশিং’ করতে। সাফারি ক্যাম্পে গিয়ে শিশা (গড়গড়া) টেনেছিলাম। দেখেছিলাম তানুরা (Tanoura) নৃত্য। তানুরা আসলে মিশরীয় সুফি নৃত্য।
সেবার হপ অন, হপ অফ বিগবাসে চড়ে দুবাই শহরটিকে চষে ফেলেছিলাম আমরা। চড়েছিলাম বুর্জ খলিফার একশো চব্বিশ তলার অবজারভেশন ডেকে। দেখেছিলাম ‘মল অফ দ্য এমিরেটস্’, ‘দুবাই মল’, ’ইবন বতুতা মল’, ‘আল ফাহিদি ফোর্ট’, শিংদাসা অঞ্চলের ‘শেখ সইদ আল মাখতুমের বাড়ির মিউজিয়াম’, ‘স্পাইস সুক’, ‘গোল্ড সুক’। সুক (Souk) অর্থাৎ বাজার। হ্যাঁ, বাজারই বটে। কলকাতার বড়বাজারের স্টিলের বাসনের দোকানের মতো সোনার গয়না সাজানো থাকে সেখানে।
দুবাই মেরিনা থেকে ধাও ক্রুজটিও বড় ভালো লেগেছিল সেবার। ধাও অর্থাৎ কাঠের তৈরি মস্ত নৌকো। কিছুটা আমাদের পুরাকালের বজরার মতো বলা যেতে পারে। কিন্তু হলে হবে কী? নাকে-মুখে মুখোশ এঁটে আর সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে আর যা হোক বিনোদন হয়না। তাই বিরত থাকি ধাও-ধাবন থেকেও।
তবে আমাদের পা-গাড়ি আছে কী করতে? আর আমরা যেখানে আছি সেটাই তো এখন দুবাইয়ের সব চাইতে অভিজাত অঞ্চল। জুমেইরা বিচ। আগে ছিল শুধু TBR Walk, এখন বিচটাকে চওড়া করে হয়েছে Beach Walk. অসংখ্য নামীদামী দোকানপাট, রেস্তোরাঁ সেখানে। আছে শিশা লাউঞ্জ। আছে ড্রিঙ্ক-ডান্স-ডিজে। কে বলবে পৃথিবীটা রোগগ্রস্ত হয়ে ধুঁকছে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করে সে অঞ্চল। লাল টুকটুকে লম্বারগিনি আর ফেরারি গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকে সওয়ারির অপেক্ষায়।
আমরা সাবধানী মানুষ। এই অজ্ঞাতবাসের দিনগুলোতে বিচের সানবেডে শুয়ে রৌদ্রস্নান করি সারাটা দিন। বিকেল হতেই ঘরে গিয়ে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ি। বোর্ড ওয়াক ধরে হেঁটে কোনওদিন চলে যাই ব্লু ওয়াটারস্ আইল্যান্ডের কোনও রেস্তোরাঁতে। কোনওদিন বা JBR Walk ধরে হেঁটে গিয়ে বসে পড়ি কোনও আরবি রেস্তোরাঁতে। পিটারুটি, হামাস, শিশ কাবুব, দোলমা (আঙুর পাতায় জড়ানো ভাত-মাংসের পুর), বাখলাওয়া (স্বর্গীয় মিষ্টি) খাই।
এরই মাঝে Air Dubai-এর উদ্বোধন হল একুশে অক্টোবরে। হোটেলের বিচ লাগোয়া লনের খেজুর গাছের তলায় বলে আতশবাজির রংমশাল দেখলাম আমরা। তারপর দিন তিনেক কাছের এক সন্ধ্যায় গিয়ে চড়ে বসলাম সেই সুদর্শন চক্রের একটা কাচের কামরায়। সে এক অপরূপ অবলোকন। সম্পূর্ণ শহরটা আমাদের পায়ের তলায়! দেখতে পাচ্ছি পাম আইল্যান্ড, বুর্জ আল আরব, বুর্জ খলিফা, দুবাই মেরিনা, জুমেইরা বিচ আর আলো চনমনে জেবেল আলি অঞ্চল। সেই মুহূর্তে সব ক্ষোভ মিটে গেল আমাদের। কেন কোথাও বেড়াতে যেতে পারলাম না, কেন দুবাই এক্সপোয় ঢুকতে পারলাম না, কেন এতগুলো টাকা খরচ করে চোদ্দো দিন হোটেলে থাকতে হল আমাদের ইত্যাদি।
কোনও কোনও ভ্রমণ যে এখনও আজব হতে পারে জানা ছিল না আগে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন