short-story-dirghatama-ovishap

দীর্ঘতম অভিশাপ
ঋতা বসু


এই গল্প আমি অনেকবার শুনেছি।
একটা খুব আনন্দঘন রাতে স্ত্রী পুরুষের দেহ থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসা প্রাণরসের মিলনে আমি প্রথমে একটি বিন্দুমাত্র, কিন্তু তখন থেকেই মায়ের জঠরে আমি অসীম সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। তখন থেকেই আমার মধ্যে প্রথম সূর্যের মত চেতনার আলো উদ্ভাসিত। আমার বাবা মহাজ্ঞানী উতথ্য তা জানতেন।

বাবার জ্ঞান পান্ডিত্যের জন্যই যে মা পরমাসুন্দরী আর ধনীকন্যা হওয়া সত্ত্বেও বাবাকে বিয়ে করেছেন সেই গল্পটা বাবা নানাভাবে শুনতে ভালবাসেন। মাও চান সেবাযত্নের সঙ্গে বারবার সেই ভালবাসার অনুভবের পুনরাবৃত্তি করে বাবাকে দেহে মনে পরিতৃপ্ত করতে। ছাত্র পড়িয়ে, পুজোপাঠ সেরে ক্লান্ত শরীরে বাবা যখন ফেরেন মা প্রথমে তৃষ্ণার জল দেন। তারপর পায়ে ব্যাথা উপশমকারী তেল লাগান। এই সময়ে তাদের কথোপকথন থেকে আমি সব জানতে পারি।

বাবা বলেন, ‘মমতা তোমার দেবদুর্লভ রূপলাবণ্য দেখে বড় অপরাধী লাগে নিজেকে। গরীব ব্রাহ্মণ নয় রাজার ঘরেই তোমায় মানায়।’
মা তেল মালিশ করতে করতে মৃদু হেসে বলেন, ‘আমি এখানেই ঠিক আছি। অর্থবান ক্ষমতাবান পুরুষদের থেকে আমার কাছে তোমার আকর্ষণ সবসময়েই বেশী। এখন আসছে আমাদের সন্তান। আর আমার কিছু চাই না। এখানেই আমার স্বর্গ।’ ‘আমার ভাই বৃহষ্পতি, রাজগুরু রাজার উপদেষ্টা, আর্থিক সামাজিক বলে বলীয়ান। চেহারাও কন্দর্পের মত। সে তোমাকে চেয়েছিল। অন্য যে কোন মেয়ে হলে বর্তে যেত। তুমি হেলায় তুচ্ছ করলে তার প্রস্তাব।’
বাবা নিবিড় করে মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ‘কী পেলে তুমি আমার কাছে জানতে ইচ্ছে করে।’
‘আমি এখানে শান্তি পেয়েছি। হল?’
মায়ের মুখে কী সুন্দর কারুকাজ! আমি মাতৃগর্ভের জলাধারে ঘুরতে ঘুরতে কল্পনায় দেখতে পেলাম দুজনে দুজনের দিকে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
একটি গোপন তথ্য আমি জানি যেটা বাবা জানেন না। মা বৃহষ্পতিকেও অবজ্ঞা করতে পারেন না। যখনই উতথ্য থাকেন না ছল ছুতোয় সে এখানে আসে। সাপের মত ক্রূর তার স্বভাব, শকুনের মত দৃষ্টি। সে শেয়ালের মত লোভাতুর দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারি না। সম্পদশালী পুরুষ কতটা বশীভূত সেটা পরখ করার সন্তুষ্টি নাকি ক্ষমতাকে ভয়?

সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মা বৃহষ্পতির বদলে বাবাকে নির্বাচন করছেন এবং তার পরেও বৃহষ্পতির আনুগত্য বজায় রয়েছে এটা বোধহয় মাকে তৃপ্ত করে। কিন্তু মা চান বৃহস্পতি নামক ঝড়টি যেন আঙ্গিনাতেই থেমে থাকে। ঘর থাকুক নিরুপদ্রব। নারীর স্বভাবের এই দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তায় আমার অস্বস্তি বোধ হয়। দুপুরবেলা মায়ের সখী কাত্যায়নী আসে। বৃহষ্পতির কাঙালপনা নিয়ে দুজনের কত হাসাহাসি। কাত্যায়নী বলে ‘তোমাকে বুঝি না। বৃহষ্পতির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েও তাকে বেঁধে রাখতে চাও কেন?’
‘ভাল লাগে। অস্ত্রগুলোতে মরচে ধরেছে কিনা দেখি।’

‘সেটা দেখতে গিয়ে বিপদে না পড়ে যাও।’
‘কিসের বিপদ?’
তারপর পেটের ওপর হাত রেখে আমাকে স্পর্শ করে বললেন, ‘এখন আমার সঙ্গে সর্বদা একজন সঙ্গী আছে। স্বামী বলেছেন এই সন্তান সাধারণ নয়। উনি আমার গর্ভাবস্থার প্রথমদিন থেকে প্রতিদিন বেদ বেদাঙ্গ পাঠ করেন। তাইতে আমার গর্ভস্থ সন্তানের ইতিমধ্যেই ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়েছে। আমার বিশ্বাস যে কোন বিপদে মহাজ্ঞানী উতথ্যর বংশধরই আমাকে রক্ষা করবে।’

আমার ওপর এতটা নির্ভরতা অথচ নিজেকে রক্ষা করার কথা মা ভাবে না। স্ত্রীজাতির এই দৈবনির্ভরতা বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। এটা দুর্বলতারই নামান্তর। এই দুর্বলতাকে আমি মনে প্রাণে ঘৃণা করি। আমি এখনও পৃথিবীর আলো দেখিনি কিন্তু পিতার আশীর্বাদে নিজেকে আশ্চর্য শক্তির অধিকারী মনে হয়। সেইসঙ্গে খুব অসহায়ও লাগে। শরীর ও মনে দুর্বল আমার বাহক নারীটির কোন বিপদ ঘটলে আমার এই অসম্পূর্ণ শরীর নিয়ে কীভাবে লড়াই করব? কীভাবে অন্ধকার গর্ভমধ্যে এই জলাধারে বন্দী হয়ে বাইরের শত্রুকে বিপর্যস্ত করব?
একদিন সূর্য অস্ত গেলে পর বৃহষ্পতি অগ্রজ উতথ্যর সঙ্গে দেখা করতে এল। ভক্তিভরে দাদা ও বৌদিকে প্রণাম করে কুশল সংবাদ নিল। আমার কথা জিজ্ঞেস করল। তারপর আসল কথায় এল।
‘দেখ তোমার আর্থিক অবস্থার বিষয়ে আমি যে খুবই চিন্তা করি এটা তো তুমি জান। এতদিন তোমরা শুধু দুজন ছিলে যা হোক করে কেটে গেছে। এখন তোমাদের সংসারে নতুন অতিথি আসছে। সে আমাদের বংশধর। তার জন্য তো কিছু ভাবনাচিন্তা করতে হয়।’
বাবা বললেন, ‘ব্রাহ্মণের সম্পদ তার ধন নয়, বিদ্যা। আমার সন্তান সেই ধনে ধনী।’
‘বিদ্যা চিবিয়ে খাবার জিনিস নয়। শাস্ত্রে বলে দেহের পুষ্টি না হলে মনের পুষ্টি হয় না। তোমার মত উদাস জ্ঞানী মানুষ পুঁথির পাতার বাইরে আর কিছু দেখতে পায় না। তাই বলি তুমি মনটা দেখ আমাকে অন্য ব্যাপারটা দেখতে দাও। তোমার সন্তান আমারও সন্তান।’
এইরকম বিনয়বচনে কে না খুশী হবে!
বাবাও হলেন আর বললেন ‘ব্যস্ততা সত্ত্বেও তোমার সকল দিকে দৃষ্টি বিচক্ষণতার লক্ষণ।’
বৃহষ্পতি বলল ‘তোমার মত জ্ঞানী ত্রিভুবনে নেই। দক্ষিণদেশ থেকে অনেকদিন ধরেই তাগাদা আসছিল। দূরদেশ বলে দক্ষিণার বহর লোভনীয়। অধ্যাপনার কাজটিও অত্যন্ত সম্মানজনক। তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার পরিবারের যাবতীয় ভরণপোষণের দায় রাজার। আমার মনে হয় এই সুযোগ ছাড়া তোমার উচিত হবে না।’
বাবার কথায় বোঝা গেল তিনি অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। বললেন ‘আমার তো ইচ্ছে ছিলই। মমতারও বহুদিনের বাসনা জ্ঞানীগুনীদের মাঝে আমার কদর হোক। তোমার মঙ্গল হোক। তবে একটাই চিন্তা দক্ষিণদেশ বহুদূরের পথ। মমতার কিছু হলে তখনই আসা সম্ভব হবে কি না।’
পুরুষদের মাঝে কথা বলা অভব্যতা তাই মা হাতের বলয় কঙ্কনের ঝঙ্কারে বাবার কথার মৃদু প্রতিবাদ পাঠিয়ে দিলেন বাইরে। বৃহষ্পতি বললেন ‘শুনেছি এখনও প্রসবের কিছু দেরী আছে। সেরকম হলে আমরা সবাই তো আছি। তুমি গিয়ে দেখ। ভাল না লাগলে চলে এসো। সে স্বাধীনতা তো তোমার রইলই।’

তারপর তিনজন মিলে কত হাসি মশকরা। দক্ষিণদেশের মেয়েরা ছলাকলায় নিপুণ। তারা কামকলাতেও পারদর্শী। অগ্রজ যদি আর না ফেরেন বৃহষ্পতিকে যেন কেউ দায়ী না করে।’ বৃহষ্পতির এ কথার উত্তরে মা বললেন ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রমণীরও সাধ্য নেই উতথ্যর মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়।’
‘ঠিক বলেছ। যাঁর ঘরে এমন রমণীরত্ন তিনি অন্যদিকে মন দেবেন কেন? আমরা সবাই চাই উনি সুস্থ শরীরে কাজ সম্পন্ন করে ফিরে আসুন।’

দাদাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে বৃহষ্পতি হৃষ্টমনে ফিরে গেল। কাত্যায়নী রাতে এসে থাকবে ঠিক হল। মা বাবা সুখস্বপ্নে রাত কাটালেন। পরদিন থেকেই যাবার তোড়জোড়। বন জঙ্গল নগর পাহাড় জলপথ পেরিয়ে যাওয়া। অনেক কাজ। সবাই খুশী শুধু আমি জানি সামনে কতবড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে।
যাত্রা শুরুর আগে থেকেই দুর্লক্ষণ। গাধা শকুন শেয়াল কাকের অশুভ চিৎকারে চারপাশের বাতাস শিউরে উঠল। এত প্রবল বর্ষণ শুরু হল যে রাজরথের ব্যাবস্থা না থাকলে বাবার যাওয়া মুশকিল হত। যাত্রারম্ভে অশ্রুপাত অমঙ্গলজনক তবু মা চোখের জল ফেললেন। রান্না না করে দাওয়ায় বসে রইলেন উদাস হয়ে। আমি মায়ের গর্ভমধ্যে ঘুরে ঘুরে মাকে কতভাবে স্পর্শ করে সাবধান করার চেষ্টা করলাম।

ক্যাতায়নী এল খানিকটা বাদে। প্রসূতি ও নবজাতকের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তার হরেকরকম প্রণালী জানা আছে। বাবার বিরহে শোকাকুলা মাকে সে বলল ‘তোমরা ব্রাহ্মণরা এমনিতেই অনেক কিছু নিয়ে বাছবিচার কর। বিশেষত গর্ভাবস্থায় কুলপতিদের নির্দেশে নিষিদ্ধ বস্তুর তালিকা ক্রমশ যেভাবে লম্বা হচ্ছে তোমাদের ঘরে সবল সন্তান জন্মই দুরূহ হয়ে উঠবে। তার ওপর তুমি যদি এভাবে অনিয়ম কর তো তাহলে তুমি স্বামী শ্বশুরকুল ও গর্ভস্থ সন্তান সকলের কাছেই পাতকী হবে।’ সেই কথা শুনে আমি জলাধারে আলোড়ন তুলে আমার সম্মতি জানালাম।
কাত্যায়নী বলল, ‘আমাদের কথা ছাড়। গো ব্রাহ্মণের সেবা করলেই আমাদের মনুষ্যজন্ম সার্থক। কিন্তু জান তো সৎ ব্রাহ্মণের ঋণ চাররকম। দেবঋণ, ঋষিঋণ, পিতৃঋণ, মনুষ্যঋণ। সবাই জানে তোমার স্বামী যজনযাজন ও অধ্যয়ন দ্বারা প্রথমদুটি ঋণ শোধ করেছেন। এরপর পুত্রের মধ্যে দিয়ে পিতৃপুরুষের ঋনও শোধ করে দেবেন। সমাজের জন্য সুকৃতি দ্বারা মনুষ্যঋণ উনি শোধ করুন তুমি কি তা চাও না?’
মা উঠে কাত্যায়নীর গলা জড়িয়ে বললেন ‘তুই আমার গতজন্মের বোন।’
কাত্যায়নী মায়ের চুল বেঁধে দিল। তারপর ধোয়া একখানা কাপড় পরতেই চারপাশ মায়ের রূপে আলো হয়ে উঠল। আমি মানসচোখেই সেটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। কাত্যায়নী যাবার আগে বলে গেল ‘কাল থেকে সাতদিন আসব না। রাজবাড়ী থেকে খবর এসেছে শস্য ঝাড়াই বাছাই গোলাজাত করার কাজে আগামী কয়েকদিন আমাদের ব্যাস্ত থাকতে হবে। তোমাকে ক’টা দিন একা থাকতে হবে।’

সাবধানে থাকতে বলে কাত্যায়নী চলে গেল। আমার তারপর থেকেই অস্থির লাগছিল। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি এক গভীর ষড়যন্ত্রের কারণেই ঠিক সময়েই কাত্যায়নীকে দূরে চলে যেতে হচ্ছে। সবদিক থেকেই দুর্বল আমার গর্ভধারিণীর আত্মরক্ষার কোন ক্ষমতাই নেই। আমার অস্থিরতায় বিব্রত মা উদর স্পর্শ করে আমাকে মৃদু বকুনি দিলেন। কিন্তু আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলাম না। আমার মহাজ্ঞানী পিতাও কী বলে অমোঘ ভবিতব্যকে অবহেলা করলেন এটা চিন্তা করে আমি নিষ্ফল মাথা কুটতে লাগলাম গর্ভের দেওয়ালে।

তৃতীয় দিন মা প্রদীপগুলিতে তেল ভরছিলেন। সন্ধ্যা আসন্ন। এই সময় বৃহষ্পতি এল। মা ঘরের বাইরে বেতসপত্রের আসন বিছিয়ে দিলেন বসার জন্য। বিশ্বামিত্র বলল দূতমুখে বাবার নিরাপদে পৌঁছোনোর খবর এসেছে।
তাই শুনে মা করজোড়ে দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। দরদী অভিভাবকের মত বৃহষ্পতি জিজ্ঞেস করল ‘তোমার ঘরসংসারের রসদপত্র ঠিকমত এসেছে তো?’
মা তখনও পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। বললেন, ‘তুমি যেখানে অভিভাবক সেখানে না এসে পারে? তবে এত তাড়াতাড়ি প্রয়োজন ছিল না।’
বৃহষ্পতি মার হাত ধরে কুটিল হেসে বলল ‘আমার প্রয়োজন।’
এই পুরো সময়টা আমি মায়ের শরীরের অভ্যন্তরে আমার ক্রোধ ক্ষোভ নিয়ে উথালপাথাল করছিলাম। মা বুঝতেই পারছেন না কী ভীষণ বিপদের মধ্যে নিজেকে তার সঙ্গে আমাকেও ঠেলে দিচ্ছেন? মাকে সাবধান করার জন্য আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব গর্ভমধ্যে এক তীব্র ব্যাথার সৃষ্টি করলাম। আমার অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মা বললেন ‘শরীরটা ঠিক লাগছে না। আমি ঘরে যাই। আজ আপনি আসুন।’
মা ঘরে গিয়ে আগল দেবার সময় পেলেন না বৃহস্পতির বিশাল শরীর দরজার ওপর বাজপাখির মত ডানা মেলে দাঁড়ালো। তাঁর প্রতিটা রোমকূপ থেকে কাম বিচ্ছুরিত হচ্ছে। লোলুপ হেসে বলল, ‘আমি এত কিছু করলাম আমার ঋণ শোধের কী হবে?’
মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে মায়ের আঁচল ধরে টান দিল। বিপদ ঘাড়ের ওপর বুঝে মা কাতর স্বরে বললেন ‘আমি আপনার অগ্রজের স্ত্রী। আপনার মায়ের মত। আপনার ভরসায় স্বামী আমাকে এখানে রেখে গেছেন। তাঁর সন্তান আমার গর্ভে। মিনতি করছি এমন অবস্থায় আমাকে উৎপীড়ন করবেন না।’
বৃহষ্পতি মায়ের কথায় কর্ণপাত করল না। করবেই বা কেন? দুর্বল হরিণীকে কি উপবাসী বাঘ দয়া করে?
মায়ের শরীর আমার পীড়নে আগে থাকতেই দুর্বল ছিল। বৃহষ্পতিকে প্রতিরোধ করতে পারবে না জেনেও মা তাঁর অবশিষ্ট সামর্থ্য নিয়ে অসম লড়াই করছিলেন। কিন্তু স্ফীতোদর আর দুর্বল শরীরের জন্য পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে পারছিলেন না। বৃহষ্পতি মাকে বলল ‘তুমি মিছিমিছি প্রতিরোধ করছ। শক্তিশালী পুরুষের আশ্রয় নিশ্চিন্ততা দেয় এটা তুমি জানো। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে যৌন ক্ষুধা মেটানোর মধ্যেও কোন অন্যায় নেই।’
এই বলে বৃহস্পতি প্রবলভাবে মায়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। মা আর্তনাদ করে উঠলেন আর আমি প্রত্যক্ষ করলাম স্ত্রীজাতি কী দুর্বল! নিজেকে পুরুষের হাত থেকে রক্ষা করার কোন ক্ষমতাই তার নেই।

কিন্তু একই গর্ভে দুজন পুরুষের ঔরস কেমন করে সম্ভব? এখানে আমি এক এবং অদ্বিতীয়। মায়ের প্রতি তীব্র ক্রোধ সত্ত্বেও তাঁকে এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য দুই পা দিয়ে যোনিদ্বারের মুখে বাধা সৃষ্টি করে মায়ের গর্ভে বৃহষ্পতির বীর্যপতন রোধ করলাম। অন্দর আর বাহির মিলে এত রকম গোলযোগে বৃহষ্পতি পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভে বাধা পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে মাকে বলল ‘সমস্ত জীবজগৎ দেহগত এই আনন্দ লাভের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। তুমি ও তোমার সন্তান আমাকে সেই চরম উপভোগ থেকে বঞ্চিত করেছ বলে আমি অভিশাপ দিলাম সে অন্ধ হয়ে জন্মাবে আর তুমি বিকলাঙ্গ সন্তানের জননী হবে।’
সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের দীপ্তি নিভে গেল। আমি মনশ্চক্ষে আমার ভবিষ্যৎ জীবন দেখে শিউরে উঠলাম। আমার আশ্চর্য জ্ঞান সমস্ত অধীত বিদ্যা চক্ষুন্দ্রিয়ের অভাবে বৃথা বলে মনে হল। সর্ববিদ্যা বিশারদ হয়েও আমি নিজেকে পালন করতে অক্ষম এক পুরুষ বলে সমাজে গণ্য হব। অথচ এখনই প্রত্যক্ষ করেছি পুরুষের অসীম ক্ষমতা। সে চাইলে কোন কিছুই তার অপ্রাপ্য থাকে না।
আমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঋষি দীর্ঘতমা, শক্তিমান পুরুষপ্রজাতির প্রতিভূ। পুত্র জন্ম না হলে পিতৃপুরুষের ঋণ অপরিশোধ্য থাকে। যুগে যুগে মনুষ্যলোক তাই কন্যার থেকে পুত্রকেই কামনা করে। জন্মান্ধ হলেও আমার জন্ম সৌভাগ্যস্বরূপ। কিন্তু সে শুধু পিতামাতার কাছে। বাকী জীবন কী হবে? যৌবনে প্রেম থাকবে অলভ্য। বার্ধক্যে পরিবার পরিজন ভালবেসে স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গ করবে না। ভরণপোষণ করতেও অনিচ্ছুক হবে। কিন্তু যা গেছে তা আর ফিরবে না। মা বাবা চিরকাল থাকে না। নারীর জন্যই আমার এই দুর্দশা আবার তাকে আশ্রয় করেই আমাকে শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু এরা বড়ই দুর্বল। নিজেকে রক্ষা করতে একান্ত অক্ষম। অতএব পুরুষের নিজের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই নারীজাতিকে চিরকাল বশে রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জন্মগ্রহণের আগেই আমি যে অসীম ক্ষমতার অধিকারী সেই শক্তি দিয়ে এমন একটা কিছু করা দরকার যাতে স্বামী যেমনই হোক সংসারে তার স্থান যেন সর্বোচ্চ থাকে।

সেইহেতু আমি অদ্যাবধি পৃথিবীতে এই নিয়ম প্রতিষ্ঠা করিলাম যে স্ত্রীজাতিকে যাবজ্জীবন একমাত্র পতির অধীন হইয়া কালযাপন করিতে হইবে। পতি জীবিত থাকিতে অথবা পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলে, নারী যদি পুরুষান্তর ভজনা করেন তাহা হইলে তিনি অবশ্যই পতিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আর পতিবিহীনা নারীগণের সর্বপ্রকার সমৃদ্ধি থাকিলেও তাহা ভোগ করিতে পারিবে না। বিষয়ভোগ করিলে অকীর্তি ও পরিবাদের সীমা থাকিবে না।

মহাঋষি দীর্ঘতমার সেই অভিশাপ অদৃশ্য মেঘের মত মহাভারতের কাল থেকে আজ অবধি ছায়া ফেলে আছে ভারতবর্ষের মাটিতে।

ঋণ : কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “short-story-dirghatama-ovishap

  1. খুব ভালো লাগলো ঋতা বসুর গল্প টি। সেই মহাভারতের কাল থেকে নারীর সামাজিক অবস্থান কিছু মাত্র বদলায় নি। তার শারীরিক গঠন এর জন্য কিছুটা দায়ী, তবে বেশিটাই পুরুষ চেয়েছে বলেই নারী চিরটা কাল এমন ভাবেই অবদমিত ।
    তাই আজও আমরা সমাজে প্রত্যক্ষ করে চলেছি একের পর এক নারী শরীরের ওপর পুরুষের পাশবিক অত্যাচারের ঘটনা।

  2. চমৎকার লিখেছেন ঋতা। তাকে আমার শুভেচ্ছা জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *