short-story-jochona-fire-eseche

জোছনা ফিরে এসেছে বাবা ফিরে আসেনি
রাসয়াত রহমান জিকো


আমাদেরই কোনও এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল সেটা। বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে ছবি তো তোলা হবেই। তবে বিয়েবাড়িতে তখন আলাদা ফটোগ্রাফার ভাড়া করার ঘটনা ঘটত। কিন্তু মধ্যবিত্ত বা তার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর পক্ষে তো আর সম্ভব না। তখন যেটা হতো সব আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দু-একজন থাকত যাদের নিজের ক্যামেরা থাকত। সেই ক্যামেরা থাকত ছত্রিশটি ফিল্ম। সেগুলা দিয়েই ছবি তোলা হতো তাৎক্ষানিকভাবে যা দেখার সুযোগ নেই। স্টুডিয়োয় ফিল্ম দিলে নেগেটিভ থেকে তা ওয়াশ করে দিত। তখন দেখা যেত, মাঝে মাঝে ছত্রিশটার জায়গায় সাঁইত্রিশটা ছবি উঠেছে।
সেই বিয়েতে বাবার এক আত্মীয়ের কাছে প্রথম ক্যামেরা দেখি। শুনেছিলাম উনি থাকতেন দুবাই। বিয়ে খেতে দেশে এসেছিলেন আর সাথে নিয়ে এসেছিলেন তার শখের ক্যামেরা। বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি বউ-বরসহ সবার ছবি তুলছিলেন। হঠাৎ করে বললেন, ‘আচ্ছা আমার ছবি তো কেউ তুলল না।’ কাকে যে বললেন কেউ বুঝল না। তবে বলেই এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন। এত মানুষ থাকতে কীভাবে জানি আমাকে খুঁজে পেলেন। বললেন, ‘খুকী তুমি আমার ছবি তুলে দাও।’ আমি বললাম, ‘ছবি কীভাবে তুলে আমার তো জানা নাই।’ ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ি সম্ভবত। উনি আমাকে একটা ছিদ্রের মতো জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে তাকিয়ে যা দেখা যায়, ওপরে দেখ প্রেস করার জায়গা। প্রেস করলেই ছবি উঠে যাবে।’ জীবনে প্রথম ছবি তুললাম সেবার। দু’তিনটা তুলেছিলাম। তারপরেই মনে হয় ফিল্ম শেষ হয়ে যায়। নিজের তোলা ছবি অনেক পরে দেখেছিলাম। যার ক্যামেরা তার সাথে আর দেখা হয়নি। কিন্তু ছবিটা দেখেছিলাম যাদের বিয়ে হয়েছিল তাদের বাসায় গিয়ে তাদের নিজস্ব অ্যালবামে।

ছবি তোলার পদ্ধতি অবশ্য এরপর পরিবর্তন হয়ে যায়। সবার মোবাইলেই ছবি তোলা যায়- এই ব্যাপারটা শুরু হলো। এদিকে বাবার একটা ক্যামেরা মোবাইল ছিল পুরানো। নতুন মোবাইল কেনার পর বাবা সেটা ফেলেই রাখতেন। সেটা দিয়েই তখন টুকটাক ছবি তুলা শুরু করলাম। এমন বিশেষ কিছু না, গাছ, লতা, পাতা এসবই। সাহস করে বাবাকে একদিন বলেছিলাম ক্যামেরা কিনে দিতে, বাবা সে কথার জবাবে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি।

কেন জানি আমার প্রচুর জিদ ছিল ক্যামেরা নিয়ে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের টিনএজ মেয়ের জন্য দামি ক্যামেরা কেনা এত সহজ ব্যাপার ছিল না। হঠাৎ কীভাবে জানি একদিন আশার আলো দেখতে পেলাম। শুনতে পেলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে না কি দাদার জমি বিক্রি হবে। বুঝলাম বাবার কাছে বাড়তি টাকা আসবে। তখন বাবাকে রাজি করিয়েছিলাম ক্যামেরা কেনার জন্য। একটা সফট সিগনাল আদায় করেছিলাম। আসলে খুব শখ ছিল ছবি তোলার। প্রকৃতির এতসব অপূর্ব দৃশ্যকে ধারণ করার লোভ যে অনেক বড় লোভ। সবাই মনে করত সামাজিক যোগাযোগে নিজের ছবি দিয়ে বাহবা পাওয়ার জন্য আমার এই ছবি তোলার আগ্রহ। বিষয়টা তা না। মনে অভ্যন্তরে আগ্রহটা অন্যরকম ছিল।

তাই যেদিন বাবাকে প্রথম বললাম, ‘বাবা আমি ছবি তুলব ক্যামেরা কিনে দাও।’ বাবা আমার কথা শুনলেন। বাবা আমার কথা সবসময়েই মনোযোগ দিয়ে শোনেন। কিন্তু তিনি সেটা করবেন কি না তা আশেপাশের গুরুত্বহীন মানুষের মতামত নিতেন। বাচ্চু চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, সানিমা’র খুব ছবি তুলার শখ। বাচ্চু চাচা বললেন ‘এগুলা আবার কী আজেবাজে শখ। ছবি তুলে কী হবে? পড়ে ক্লাস এইটে, লেখাপড়া করুক। বিয়ার বয়স হইলে বিয়ে দিয়ে দিবো।’ ক্লাস এইটে পড়ি, তখন বয়স মনে হয় চোদ্দ। এই বয়সে আমার বিয়ের চিন্তা কেন করতে হবে বুঝলাম না! তখনও সেই ভাঙা মোবাইল দিয়ে ছবি তুলি। মোবাইলের অবস্থা এতই খারাপ ছিল, মোবাইলের যে ক্যামেরার লেন্স তা মোবাইল থেকে প্রায় বের হয়ে গিয়েছে। সেটা দিয়েই একদিন গ্রামের বাড়িতে পুকুরে ভেসে থাকা শাপলা ফুলের ছবি তুললাম। সাদা রঙের শাপলা ফুটেছিল পুকুরের ঠিক মাঝখানে। পাপড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। নিচে তার সবুজ পাতা আর চারপাশে নীল জল। শাপলার ছবি তুলতে যাওয়ার কারণে আমার গা জলে ডুবে যাচ্ছিল, পরনের প্যান্ট ভিজে গেল, ফতুয়ার নিচেও জল স্পর্শ করল। শরীরে তখন আমার রোগজীবাণুও ছিল। পুকুরে নামার সময় কাশছিলাম আর বুকে কফ আছে বুঝতে পারছিলাম! কিন্তু সেগুলাকে পরোয়া করার সময় আমার ছিল না, সেই শাপলার ছবি তোলা আমার কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ছবিটা তুলে গিয়ে মাকে দেখালাম। কিন্তু মা অনেক রাগ করল। বলল, পুকুরের এত ভিতরে কেন গেলি? আর জিজ্ঞেস না করে যাবি না। মায়ের বকা আপাতত হজম করে গেলাম কারণ আমি জানি খুব সুন্দর এক ছবি আমি তুলেছি। কেউ না কেউ তো দেখে নিশ্চিত বলবে এটা খুব সুন্দর একটা ছবি। অপেক্ষায় ছিলাম কারও প্রশংসার। ছবিটা বাবাকে দেখালাম। আমার মনে হলো, বাবা ছবিটা পছন্দ করেছে। মনে হলো আমাকে বলতেও চান সেটা। যখনই বলতে যাবেন তখনই সেই বিরক্তিকর বাচ্চু চাচা ফোন দিলো। বাবা বলতে গিয়েও কোনও কিছু না বলেই চলে গেল।

আমি পুকুরে ভাসমান শাপলা ফুলের ছবি থাকা অবস্থায় সেই ভাঙা মোবাইলে নিয়ে সারাদিন ঘুরলাম। আরও অনেক ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। ফুলের ওপর রাজা ফড়িং এর ছবি। গাছের ডালে টিয়া পাখির ছবি। কিন্তু কোনোটিই শাপলার ফুলটার মতো সুন্দর হয়নি।

দুই দিন আমি সেই সুন্দর ছবিটি নিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। ছবিটিকে জুম করার চেষ্টা করতাম। ডানে বামে ঘুরানোর চেষ্টা করতাম। খুব ভাল করে খেয়াল করতাম, ছবি কীভাবে আরও সুন্দর তোলা যায়। প্রকৃতির দৃশ্য এভাবে ধরে রাখা কী চমৎকার একটা ব্যাপার। শাপলা ফুলটা পুকুরের সেই স্থানে আর আছে কি না জানি না। কয়দিন পরেই হয়তো পচে গলে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তকে আমি ঠিকই ধারণ করেছি! সৌন্দর্যকে ধারণ করার এক অন্যরকম আনন্দে আমি আনন্দিত হলাম।

একদিন খেয়াল করলাম অবচেতন মনে ছবিও আমার সাথে কথা বলে। প্রকৃতি দেখার যেন অন্য এক চোখ আমার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনও দৃশ্য দেখলে যেন তা ধারণ করার জন্য মন আনচান করে। কিন্তু ভাঙা মোবাইলে আর কয়দিন! গ্রামের ছবি তোলার সময় স্কুলের ছুটিতে ছিলাম। ছুটি শেষে আবার ঢাকা শহরে ফিরে আসি। ঢাকা শহরে আর ছবি তোলার জায়গা কই? কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়েই ওপর থেকে যা পারতাম তুলতাম। পাশের বিল্ডিং এর ছাদে বসা চড়ুই পাখি। আশেপাশের ছাদের দৃশ্য। ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার যে দড়ি সেদিন একটা কবুতর এসে বসল। তুলে ফেললাম কবুতরের ছবি। কী যে সুন্দর সেই কবুতরটা!

এর মাঝে একদিন আমার সেই ভাঙা মোবাইল অর্ধ ভাঙা থেকে পুরোপুরি ভেঙে গেল। আমার আর ছবি তোলার কিছু থাকল না। তখন অপেক্ষায় থাকতাম বাবার মোবাইল কখন হাতে পাব। বাবা কাজ শেষে বাসায় ফিরলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। সেই সুযোগে বাবার মোবাইল হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে এদিক সেদিক ছবি তুলতাম। তবে ছবিগুলো ডিলিট করে দিতাম। বাবা বুঝতে না পারে, তাই।

সে বছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে আবার গ্রামের বাড়িতে গেলাম। শীতকাল ছিল তখন। গ্রামে দাদির ছাগল নিয়ে ঘুরতাম। ভাঙা মোবাইল তখন আর নেই। তাই ছবি তুলতে পারি না। বাবা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে তাই তার মোবাইলের নাগাল পাই না। তারপরেও বাবা বিশ্রামে থাকলে মোবাইল নিয়ে টুকটাক ছবি তুলি। একদিন ধানক্ষেতের একটা ছবি তুললাম। ততদিনে আলোর খেলা আমি ধরে ফেলেছি। ধানক্ষেতের সেই ছবিটা খুব সুন্দর ভাবে ফুটেছিল। সেই ছবি বাবাকে দেখালাম। বাবা কিছু বলেনি। তবে এবার মা খুব প্রশংসা করলেন। তাও একদিন আলাদা ভাবে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘খালি ছবিই না তুলে একটু লেখাপড়াও কর?’

‘লেখাপড়াও তো করি কিন্তু ছবি তুলতে সমস্যা কী? পড়ালেখা করা ছাড়া কি এই দুনিয়াতে আর কিছু নেই?’
‘থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। তবে কি না, লেখাপড়া না করলে সেগুলাও ভালোমতো করা যায় না। লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড়ো কিছু হবি। লেখাপড়ার মর্যাদাটা এখানেই।’
‘ছবি তুলে কি মানুষ বড়ো কিছু হয় না?’
‘এত খবর আমার জানা নাই। আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জীবনে চলার পথ খুব সহজ না এতটুকু বুঝি।’
‘আমাকে একটা ছবি তোলার কোর্সে ভর্তি করিয়ে দাও। আব্বাকে বলো, প্লিজ।’
‘তোর স্কুলের বেতন আর বাসার টিচার দিয়েই কুল পাই না, আবার ছবি!’
‘দাও না মা, প্লিজ।’
‘আচ্ছা তোর বাবাকে রাজি করাব। কিন্তু লেখাপড়া ঠিকমতো করবি তো?’
‘লেখাপড়া ঠিকমতো করব কিন্তু ২৪ ঘণ্টা কি কেউ লেখাপড়া করতে পারে?’
সেদিন বাবার সাথে মা কি কথা বলল জানি না। রাতের বেলা বাবার সাথে গ্রামের বাজারেই ঘুরতে গিয়েছিলাম। সুন্দর বাজার। বাজারের পিছনেই খুব সুন্দর বাগানের মতো জায়গা। সেখানে মনে হচ্ছে যেন জোছনার অপূর্ব খেলা চলছে। চাঁদের আলো অপূর্ব নকশা তুলেছে সেখানে। প্রকৃতির সৌন্দর্য সকল বাঁধ ভেঙে ফেলেছে সেখানে।


বাবা বললেন, ‘তোর কী লাগবে? মাকে কী বলেছিস?’
‘একটা ক্যামেরা কিনে দাও বাবা। আমি লেখাপড়া ঠিকমতো করবো।’
‘দাম তো অনেক! তুই যেটা কিনতে চাচ্ছিস সেটা তো কোনও নরমাল ক্যামেরা না।’
‘বাবা তুমি বাড়ি এবার কেন এসেছ আমি জানি। দাদাজানের জমি বিক্রি হবে। তুমি তো টাকা পাবেই। আর কিছু কখনও চাব না বাবা। না হয় পরের ঈদে ড্রেসও দিয়ো না।’
‘ঠিক আছে কিন্তু তুই যে এত মানুষের ছবি তুলিস, তারা জানে? না বলে কি কারো ছবি তুলতে হয়?’
‘জিজ্ঞেস না করে তো তুলি না বাবা।’
‘আচ্ছা ঢাকা গিয়ে ক্যামেরা কিনে দিব নে। ক্যামেরা পেয়ে সবার আগে কীসের ছবি তুলবি?’ ‘মায়ের আর তোমার ছবি।’
‘কই তুলবি?’
‘সুন্দর জায়গায়।’
বাবা বললেন, ‘এই জায়গাটা দেখ কী সুন্দর। ছোটোবেলা থেকেই এটা আমার খুব প্রিয় জায়গা। আমার যখনই মন খারাপ হতো এখানে এসে বসে থাকতাম। এই জোছনা আমার খুব প্রিয় জিনিস।’
‘আমি এখানে ছবি তুলব তোমার আর মায়ের। কি সুন্দর চাঁদের আলো। কি চমৎকার জোছনা। এখানেই তুলব। সেই ছবি দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে। বাবা বাসায় ফিরবে না?’
‘হ্যাঁ ফিরব। তুই এক কাজ কর। নিয়াজ ভ্যান নিয়ে এসেছে তুই যা। আমি পরে আসছি। আর হ্যাঁ, আমার মোবাইলও নিয়ে যা।’
‘আচ্ছা। কিন্তু বাবা তুমি কান্না করছ কেন? তোমার চোখে পানি কেন?’
বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘তুই যা মা। একটা কথা মনে রাখিস, কখনও সাহস হারাবি না। যখন যে পরিস্থিতিতেই থাকিস। সাহস হারাবি না।’

নিয়াজ গ্রামেরই ছেলে যে ভ্যান চালায়। আমাদের বিশ্বস্ত লোক। আমি তার ভ্যানে করে বাসায় ফিরে এলাম। তার ঠিক একঘন্টা পর নিয়াজই আমাকে জানাল এখন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি মাকে খুঁজতে উঠানের পাশে রান্নাঘরে গেলাম। দেখি মা হঠাৎ করে উঠে গোছগাছ শুরু করেছে।
মা এসে বলল, ‘শোন তোর বাবা আরও কয়েকদিন গ্রামে থাকবেন। আমি তোকে নিয়ে ঢাকা যাব।’ আমিও বললাম, ‘হ্যাঁ সেই ভালো।’
এখনও ভাবি বয়স আমার এত কম, অথচ সব কিছু বুঝে ফেলেছি। মাকে সামলাতে হবে এখন। মাও সব কিছু বুঝেই আমার সাথে আড়াল করে যাচ্ছেন।
নিয়াজ ভ্যানে করে আমাদের নিয়ে রওনা দিলো লঞ্চঘাট পর্যন্ত। আরেক রাস্তা দিয়ে। আমি সেই জোছনা ভরা জায়গাটার কথা চিন্তা করছিলাম। কি সুন্দর এক জায়গা। কত বয়স আমার ছিল তখন? চোদ্দ না পনেরো?
ঢাকার বাসায় এসে শুরু হলো আমার আর মায়ের অভিনয় অভিনয় খেলা। আমরা জানি বাবার কিছু একটা হয়েছে কিন্তু দুইজনই দুইজনের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছি যেন কিছুই হয়নি। বাবা বাজারে গেছেন, বা কাজে গেছেন যে কোনও সময় ফিরে আসবেন।
অথচ আমি মাকে বলি, ‘মা বাবা ফোন দিয়েছিল। বলছে ঢাকা আসতে দু’তিন দিন লাগবে।’

মা বলেন, ‘তোর বাবা তোর কাছে তাঁর মোবাইল দিয়ে ভাল করেছেন। উনি কাজে ব্যস্ত থাকেন, আর ক্যামেরা যেহেতু এখনও কেনা হয়নি, এই মোবাইল দিয়েই ছবি তুলতে থাক।’
একসপ্তাহ কেটে গেল বাবাকে ছাড়া। আমি বাসায় পেপারপত্র আসলেই লুকিয়ে রাখি। মাও ভান করেন যেন কিছু হয়নি। বাবা আসবেনই কয়দিন পর। দশদিন পর আমি আর মা একজন আরেকজনকে বললাম না, বাবা আর আসবেন না। কেন আসবেন না, কী হয়েছে তার কিছুই বিস্তারিত আলাপ করিনি। শুধু জানি বাবা আসবেন না।

বাবাবিহীন জীবন খুব সহজ ছিল না। বাচ্চু চাচা খুব ভান করত তিনি আমাদের দায়িত্ব নিয়েছেন আসলে কিছুই নেননি। আমার বাবার সকল সম্পত্তি নিয়ে আমাদের বের করে দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। মা তখন খুব ছোটো একটা কাজ পান। এক প্রাইভেট অফিসের কর্মচারী। একদিন তিনি এসে আমাকে বলেন, ‘মা, মানুষের শখ থাকেই, জানি না কোনটা পূরণ হয় আর কোনটা না। তোকে পড়ালেখাই করাতে পারব, ক্যামেরা কিনে দিতে পারব না। তবে তুই আশা হারাইস না।’

আমিও ক্যামেরার কথা ভুলে গিয়ে লেখাপড়া শুরু করলাম। মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন বিপদের উদ্ধারও পেয়ে যায়। তখনই মা একদিন এক বয়স্ক মহিলার বাসায় কেয়ারটেকারের কাজ পান। এই নিঃসঙ্গ মহিলার ছেলে মেয়ে সবাই থাকে বিদেশ। তিনি অনেক বড়ো এক বাড়িতে একা থাকেন। ওনার নাম মালাআন্টি। এই বাসাতেই আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। আমি এসএসসি পাস করি, এইচএসসি পাস করি এখানে থেকেই। ক্যামেরার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। হঠাৎ একদিন আন্টির ছেলে বিদেশ থেকে আন্টির জন্য ক্যামেরা পাঠায়। আন্টি আমাকে হাতে দিয়ে বলে ভালোমতো নাড়াচাড়া করে শিখে নাও। আমার ছবি তুলবে আর আমার ছেলেমেয়েদের পাঠাবে। আমি দেরীতে হলেও ক্যামেরা হাতে পেলাম। লেখাপড়া করি আর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলি। একদিন সাহস করে আন্টিকে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। আন্টি আমাকে ফটোগ্রাফি কোর্স করালেন। শিখলাম আমি অনেক খুঁটিনাটি।

আমি পাস করে বের হয়ে ফটো সাংবাদিক হলাম। আমার মা এখন বেশিরভাগ সময়েই অসুস্থ থাকে। মালা আন্টিরও বয়স হয়েছে। এই দুই মহিলাকেই আমি দেখে রাখি। একদিন সাহস করে দুই বৃদ্ধ মহিলাকে নিয়ে গেলাম কক্সবাজার ঘুরতে। মালাখালার তো আর টাকা পয়সার অভাব নাই। জীবনে প্রথম প্লেনে উঠালেন আমাকে। আকাশে উঠে নিচের দিকে তাকিয়ে আমি পাগলপ্রায় অবস্থা। এত সুন্দর কেন এই পৃথিবী? আমার ক্যামেরা তখন ক্লিক করা শিখে গেছে। তিনদিন কক্সবাজারে ছিলাম, প্রচুর ছবি তুললাম। সাহস করে বেশ কিছু অন্যরকম ছবিও তুললাম। জানতাম এই ছবি আলোড়ন তুলবেই। কিন্তু তখনও জানতাম না জীবনের সব থেকে বড় চমক লুকিয়ে আছে সেখানে।

আমি আসলে এখন আর আমার গল্প কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছি ফটো সাংবাদিক হিসেবে। একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে সহজ ছিল না আমার এই যাত্রা। কিন্তু আমার জীবনের রহস্য এখনও লুকিয়ে রেখেছি।

আজ আমি আবার আমাদের গ্রামের সেই বাজারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। বহু বছর পর সেই জোছনার দেখা আজও পাচ্ছি। আমার মা আর মালা আন্টিকে দেখাতে নিয়ে এসেছি এই চমৎকার দৃশ্য। একজন নামকরা ফটো সাংবাদিক আমি। পুলিৎজার বিজয়ী। কিন্তু একদিন এই ছবি তোলার কারণেই জীবন দিতে হয়েছিল আমার বাবাকে।

সামনের বাসার ছাদের ছবি তোলার সময় সেই বাসার প্রভাবশালী লোক তখন খুন করেছিলেন তার স্ত্রীকে। করতেন ড্রাগসের ব্যাবসা। বাবার মোবাইলে তখনকার সেই বিল্ডিং এর ছাদের ছবি তোলার সময় সেটাও চলে আসে। তাড়াহুড়ো করে সেই ছবি ডিলিট করার আগে ভুলে বাচ্চু চাচার কাছে চলে যায় কোনো এক মেসেঞ্জার অ্যাপে। বাবা কিছুই জানত না। বাচ্চু চাচাই সম্পত্তির লোভে বাবাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে সেই নেতাকে দিয়েই সেদিন খুন করান বাবাকে। আমাদেরও প্রাণনাশের আশংকা ছিল। বাবা নাকি বোঝান আমরা কিছুই জানি না। তারা নিজেদের অবৈধ ব্যাবসার গোপনীয়তার স্বার্থে খুন করে বাবাকে। বাবা জানতেন তিনি মারা যাবেন, অনেক অনুনয় করে আমার আর মায়ের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন।
সেই নেতাকে আজ ধরাশায়ী করেছি আমি আমার ক্যামেরা দিয়েই। আমার তোলা ছবি এনে দিয়েছে পুরষ্কারও। বাচ্চু চাচাও আর দুনিয়াতে নেই প্রকৃতির নিয়মেই।
মাঠ ভর্তি জোছনা আজ। সেদিনের সেই জোছনা এখনও আছে। জোছনা ফিরে এসেছে, বাবা ফিরে আসেনি।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *