ইন্টারভিউ
স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক
জাঁদরেল পুলিশ অফিসার থেকে পাড়ার দাপুটে কাকু, আদুরে নায়িকার বড়লোক বাবা থেকে দশটা পাঁচটা আপিসের সাধারণ কেরানি, আলাদিনের দৈত্য থেকে কুচক্রী ভিলেন, এই সমস্ত চরিত্রে তিনি শুধু যে মানিয়ে যান তা নয়, বরং ওই চরিত্রের বাইরে তিনি আলাদা একটা মানুষ এ কথা যেন মনেও পড়ে না। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে এই ২০২২ অবধি সিনেমা, থিয়েটার, সিরিয়াল এবং এখন ওয়েব সিরিজেও সমান দক্ষতার সঙ্গে অজস্র বাউন্ডারি এবং সুযোগ পেলে ওভার বাউন্ডারিও হাঁকাতে অভ্যস্ত অভিনেতা রজতাভ দত্ত। অভিজ্ঞ অভিনেতা বলতে যা বোঝায় তিনি হলেন তাই। এতদিনের অভিজ্ঞতায় বাংলার বিনোদন জগত নিয়ে নানা সুচিন্তিত মতামত উঠে এলো তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায়। শুটিং-এর ফাঁকে বললেন রজতাভ, ‘অপার বাংলা’র তরফে শুনলেন স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক।
প্রশ্ন: সম্প্রতি ‘ব্যাধ’ সিরিজে আপনভোলা অফিসার কানাইচরণের চরিত্রে অসাধারণ কাজ করলে। আবার ‘অন্তর্ধান’ ছবিতে এনকাউন্টার স্পেশ্যালিস্ট নিলাদ্রি সেনের ভূমিকাতেও তোমার নিজস্ব স্টাইল ছিল দেখার মতো। এতগুলো বছর তো হয়ে গেল ইন্ডাস্ট্রিতে। কী দেখে একটা চরিত্র পছন্দ করো? আদৌ সবসময় পছন্দের চরিত্র পাও কি?
রজতাভ: সবসময় বেছে নেবার জায়গা থাকে না। এতটুকু একটা ইন্ডাস্ট্রি, এত কাজও আসে না যে আমি দশটার মধ্যে একটা বেছে নিয়ে শুধু সেটা নিয়েই থাকতে পারবো। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক যে স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে চরিত্রটা বুঝতে পারা জরুরি। পরিচালক যদি চিত্রনাট্যকার হন তাহলে তাঁর চিন্তাভাবনা খুব স্পষ্টভাবে ধরা যায়। যদি স্ক্রিপ্ট শুনতে শুনতে মনে হয় আমি চরিত্রটাকে দেখতে পাচ্ছি, তার হাঁটাচলা কথাবার্তা এরকম হবে তাহলে কাজটা করতে রাজি হই। খুব কম ক্ষেত্রেই এমন হয় যে স্ক্রিপ্ট পড়ে মনে হল চরিত্রটাকে আমি বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবো না, কিংবা আমার চরিত্রটায় কোনও জোরের জায়গা নেই। সেক্ষেত্রে না বলি। আর পছন্দের চরিত্র খুব কমই আসে, কারণ ভালো গল্পের অভাব। মনে রাখার মতো চরিত্র তো রোজ রোজ পাওয়া যায় না। অপেক্ষা অবশ্যই থাকে, কিন্তু তার জন্য কাজ তো থেমে থাকবে না।
প্রশ্ন: শেষ কয়েক মাসে তোমার যে কটা কাজ এসেছে তার মধ্যে প্রায় সবই থ্রিলার গোত্রের। এত বেশি থ্রিলার ছবি বা সিরিজ আসার কারণ কি বর্তমান ট্রেন্ড নাকি অন্য কিছু? তোমার কী মনে হয়?
রজতাভ: আমার মনে হয় বাঙালি চিরকালই গোয়েন্দা গল্প, রহস্য উপন্যাস এসব পড়তে ভালবাসে। সে বেড়াতে গিয়ে হোক বা কাজের শেষে বাড়ি ফিরে হোক। আর থ্রিলারের মধ্যে লার্জার দ্যান লাইফ একটা ব্যাপার আছে। মানে যেটা তোমার আমার সঙ্গে রোজ ঘটে না। ওই সাসপেন্সটার জন্য আমরা অপেক্ষা করি। কোথাও নাটকীয়ভাবে গুলি চলছে বা ঝুড়ি ঝুড়ি খুন হয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে এমন তো নয়। কাজেই ওই রহস্যের মুহূর্ত পর্দায় দেখতে চাইছে দর্শক। কারণ লার্জার দ্যান লাইফ ছবি বাংলায় হয় না। আর কী নিয়ে তুমি ছবি করবে? কমেডি করতে চাইলে সেই গল্পের যে মূল তিন উপাদান সেই সেক্স, রাজনীতি আর ধর্ম, এর একটাও তুমি ব্যবহার করতে পারবে না। কোথাও না কোথাও থেকে বাধা আসবেই। যে কারণে কমেডি রিয়ালিটি শোগুলোও এখন আর জমছে না, তার কারণও তো এটাই। আমি নিজে দীর্ঘদিন কমেডি রিয়ালিটি শোয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম সকলেই জানে। কিন্তু সেখানে সেক্স, রাজনীতি, ধর্ম – এই সবকটা অস্ত্র যদি পারফর্মারদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে মজাটা তৈরি হবে কী দিয়ে? এছাড়া ধরো প্রেমের গল্প নিয়ে ছবি, একটা সময় খুব মিষ্টি প্রেমের ছবি তৈরি হতো। কিন্তু একটা সুন্দর প্রেমের মুহূর্ত তৈরি হতে যে সময়টা লাগে সেটা এখন সিনেমায় দেখালে এ যুগের ছেলেমেয়েরা বলবে ‘ন্যাকামি’। এরা প্রতিদিন বিদেশি সিনেমা সিরিজ দেখছে। বাংলায় সেই কন্টেন্টও নেই, আর বাঙালি রোমান্টিক ছবি বলতে যা বোঝায় তা এরা নিতে পারবে না। তো কী নিয়ে ছবি বানাবে? তবু রহস্য বা গোয়েন্দা গল্প সেই উত্তেজনাটা তো দিতে পারছে।
প্রশ্ন: এবার অন্য প্রশ্নে আসি। শেষ কয়েক বছরে বেশ কিছু কাজ করেছো তুমি ওটিটি বা ডিজিট্যাল মাধ্যমে। যেখানে সিনেমা নিয়ে এত পুরস্কার দেওয়া হয় সেখানে এবার অন্তত ডিজিট্যাল মাধ্যমে কাজের জন্য পুরষ্কার চালু করা উচিত, নয় কি?
রজতাভ: আমি নিজে জীবনে খুব কমই পুরস্কার পেয়েছি। তাই এই বিষয়ে বেশি কথা বলা মুশকিল। তবে এই ব্যাপারগুলো সবই একটা অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যারা সিনেমা বা সিরিজে টাকা ইনভেস্ট করছে তারা তো বাজারটা দেখবে। যত বেশি দর্শক বা যত বেশি রিটার্ন আসবে পুরো ব্যাপারটাই তখন সেদিকে ঘুরে যাবে। এখন ওটিটি যেখানে পুরস্কারের জায়গায় ব্রাত্য হয়তো সিনেমা একদিন সেই জায়গায় চলে যাবে। কারণ সবটাই টাকার খেলা। টিভি সিরিয়ালের সঙ্গে কিন্তু ওটিটির দ্বন্দ্ব নেই। আছে সিনেমার সঙ্গে। আসলে আমার আলতাপিসি বা রাঙাকাকু কিংবা কাজের দিদি, এরা তাদের সন্ধে কাটাবার রসদটা পায় টিভির থেকে। সেটা সিরিজ থেকে তারা পাবে না। এখন সারা পৃথিবী জুড়ে কন্টেন্টভিত্তিক কাজ হচ্ছে। তবে স্টারডম যতক্ষন থাকবে, বিগ স্ক্রিন ছবি যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ দর্শককে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতে হবে। যখন এমন কন্টেন্ট আসবে যেখানে আমি তুমি সকলেই রিলেট করতে পারবো তখন সেই কনটেন্টের ছবি আর ওটিটির মধ্যে কম্পিটিশন আসবে।
প্রশ্ন: বাংলা সিরিজে এখন নানারকম পরীক্ষামূলক কাজ হচ্ছে। কিছু ভালো গল্পের সিরিজও আমরা পাচ্ছি। তবু হিন্দি ওটিটির ধারেকাছেও আমরা যেতে পারছি না। এটার কারণ শুধুই কি বাজেট?
রজতাভ: দেখো এখন তো ভাষার ব্যবধান মিটে গেছে। লকডাউন এসে সারা পৃথিবীকে মিলিয়ে দিয়েছে। পুরো পৃথিবীর বিনোদন এখন আমাদের স্মার্ট ফোনে। এখন একটা ছবি তুমি ইংরেজিতে দেখলে পরের সিরিজটা দেখছো ফ্রেঞ্চে, তারপরেরটা হয়তো তামিলে। তাই যখন সেই জায়গায় আমাদের কন্টেন্টকে আমরা নিয়ে যেতে পারবো সেদিন বাংলা ভাষার বেড়াটাও চলে যাবে। মানে যেদিন বাংলার ওটিটি কনটেন্ট বাইরের লোকে দেখবে। আসলে একটা অদ্ভুত চক্রে পড়ে গেছে বাংলা ছবি বা বাংলা ডিজিটাল কাজ। লোকে দেখতে আসে না বলে কম পয়সায় নিচু মানের কাজ হচ্ছে। ওদিকে ছবির মান খারাপ হচ্ছে বলে লোকে হলে আসছে না, বা ওটিটি সাবস্ক্রাইব করছে না। এমন কিছু প্রোডিউসার দরকার যারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আগামি দশ বছর পরের কথাটা ভেবে সেই পরিমাণ টাকা ঢালতে পারবে। বাজেট বাড়ালে ভালো ছবি হবে, আর সেই ছবি চলবেও। আসলে সারা পৃথিবীতে ওটিটি কনটেন্টের একটা মান তৈরি হয়ে গেছে। সেখানে পৌঁছতে গেলে ‘ঠিক আছে একটা বাংলা দেখি’ এই মনোভাব থাকলে তো উন্নতি হবে না। যারা প্রতিদিন বিশ্ব মানের কাজ দেখছে তারা শুধু সহানুভূতি নিয়ে বাংলা ছবি দেখবে এই আশা রাখলে চলবে না। যেদিন সুদূর অ্যান্টার্কটিকার কোন মানুষ আগ্রহ নিয়ে একটা বাংলা কাজ সাবটাইটেল শুদ্ধু দেখবে সেদিন বাংলা ছবি সেই জায়গায় পৌঁছবে। শুধু সেক্স আর ভায়োলেন্স দিয়ে গভীরে গিয়ে কাজ করা যায় না।
প্রশ্ন: শুটের ফাঁকে আর বেশিক্ষণ আটকাবো না তোমাকে। শেষ প্রশ্ন করি, নতুন কী কী কাজ আসছে তোমার?
রজতাভ: নেটফ্লিক্সে দুটো বড় কাজ করছি এইটুকু বলতে পারি। কিন্তু সেগুলোর সম্পর্কে আর কিছু বলা যাবে না। এসভিএফের একটা সিক্যুয়েলে কাজ করতে চলেছি। এছাড়া কয়েকটা ছবিতে কাজ করেছি যেগুলো খুব শিগগিরিই মুক্তি পাবে। সত্যজিত রায়ের গল্পে সাগ্নিকের (চট্টোপাধ্যায়) ‘মাস্টার অংশুমান’ ছবিতে একটা চরিত্র করেছি। অরিন্দমের (শীল) ছবি ‘মায়াকুমারী’তে তিনটে বয়সের চরিত্র করেছি, যেটা ঋতুপর্ণার (সেনগুপ্ত) স্বামীর চরিত্র। তিনটে বয়সের গল্প থাকছে। শেষেরটা নব্বই বছরের বৃদ্ধ। এছাড়া ‘ভটভটি’ আসছে, তথাগতর (মুখোপাধ্যায়) পরিচালনায়।