স্মৃতিকথা
রকিবুল হাসান
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের বৈপ্লবিক ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্বের সর্বপ্রধান নায়ক ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)। তিনি বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে, তার নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংগঠিত সশস্ত্র বিপ্লবের নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। নিজের পারিবারিক জীবন, উচ্চশিক্ষা লাভ সব তুচ্ছ করে দেশের মুক্তিই তাঁর কাছে সর্ববৃহৎ স্বার্থে পরিণত হয়েছিল। জার্মানি থেকে অস্ত্র-অর্থ সাহার্য আনার সব ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন ব্রিটিশকে ভারতের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশবাহিনিীর সঙ্গে অপরিকল্পিত ও অসম যুদ্ধে বাঘা যতীন নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও, পালিয়ে যাবার সুযোগ ও অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও, মরণযুদ্ধকেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়চিত্তে বলেছিলেন, ‘আমরা মরবো, দেশ জাগবে’। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য রক্তসোপানে জীবনদান মন্ত্রই সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁরই সৃষ্ট-পথে বিপ্লবী কর্মকান্ড- ব্যাপকতর রূপ নিয়েছিল। সেই পথেই অর্জিত হয়েছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা।
ভারতবর্ষের জাতীয় জাগরণের একটি বিশেষ সময়কে চিত্রিত করবার মুহূর্তে শিবনাথ শাস্ত্রী সে-যুগের প্রতীকরূপে রামতনু লাহিড়িকে নির্বাচন করেছিলেন। সে সময় বাগ্মিতায়, রচনাশৈলীতে, মননের উৎকর্ষে শ্রেষ্ঠতর আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তারপরও রামতনু লাহিড়িকে কেন তিনি সে-যুগের প্রতীকরূপে অভিহিত করেছিলেন, তাঁর কারণ হলো, তাঁর চরিত্রে বাংলার তাজা প্রাণ ও পরিশীলিত বুদ্ধির যে সমন্বয় ঘটেছিল তা ছিল অভাবনীয়। অন্যদের থেকে এখানেই তিনি অনেক বেশি পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যা সে সময় সকলকে মুগ্ধ করতে পেরেছিল ।
কয়েক দশক পরে সেই জাগরণ রীতিমতো অভ্যূত্থানে পরিণত হয়েছিল। যাঁর প্রধান পুরুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, শ্রী অরবিন্দর মতো বিস্ময় প্রতিভা। কিন্তু সমগ্র আন্দোলনটির প্রতীকরূপে অনেকেই চিহ্নিত করেছেন বাঘা যতীনকে তাঁর মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় একটি যুগ বাংলার বিপ্লবী সংগঠনকে যিনি প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে, ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে প্রথম সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধ করে আত্মাহুতির মাধ্যমে নিজের জীবনদীপ নিবিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মৃত্যুর ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা লাভের প্রকৃত মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রেরণা অব্যাহত ছিল স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত। দেশের মুক্তির অনিবার্য হিসেবে বাঘা যতীনের দেখিয়ে দেয়া বিপ্লবী সশস্ত্র কর্মপন্থাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। বাঘা যতীন এ কারণেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলো, বর্তমান প্রজন্মের কাছে মহান বিপ্লবী বাঘা যতীন বিস্মৃত হয়ে গেছে। যেসব বিপ্লবীরা জীবন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য অদম্য অপ্রতিরোধ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের নেতা ছিলেন বাঘা যতীন। বিশেষ করে অগ্নিযুগের দ্বিতীয় পর্বে। তাঁর নেতৃত্বে ও নির্দেশিত বিপ্লবী পথে বিপ্লব করে যুগ যুগ ধরে গণমানুষের মনে চির ভাস্মর হয়ে থাকলেও, সে তুলনায় বাঘা যতীন অনেক কম পরিচিত ও অবহেলিত একটি নাম বর্তমানে। অবস্থা দৃষ্টে ব্যাপারটা এরকম হয়ে গেছে, সাইড নায়করাই প্রধান নায়ক হয়ে গেছেন, প্রধান নায়ক হয়ে গেছেন সাইড নায়কÑনির্মম বাস্তবতা। বাঘা যতীনকে নিয়ে একসময় বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হলেও, তাঁকে নিয়ে নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও, বর্তমানে সেগুলো দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। কাজী নজরুল ইসলামু তাঁকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন, উপন্যাস লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে বাঘা যতীনকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে তুলণামূলক অনেক কম, তাঁর বিপ্লবী কর্মকান্ড- সেভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপস্থাপিত হয়নি। তাঁকে নিয়ে গান-কবিতা উল্লেখযোগ্যভাবে সৃষ্টি হয়নি। তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা হয়েছে সামান্য। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর অবিশ্বাস্য দেশপ্রেম তুলে ধরার জন্য বিশেষ কোন উদ্যোগ বা বিশেষ কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান সময়কালে তাঁর বিপ্লবী কর্মকান্ড- নিয়ে নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। ভারতবর্ষে শাসন-শোষণকারীদের নাম বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের দোহায়ে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবী উপেক্ষিত রয়ে গেছেন দীর্ঘকাল। বর্তমান প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার জন্য বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবীদের জীবনাদর্শ ও কর্মকান্ড – বিভিন্নভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের দীর্ঘস্থায়ী কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। যে কারণে যাঁদের রক্তের ওপর, যাঁদের আত্মদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীনতা, তাঁদের নাম হারিয়ে যাচ্ছে, বর্তমান প্রজন্ম তাঁদের দীর্ঘকালের ইতিহাসের গভীর তেজস্বীতার তাপ কখনোই অনুভব করতে পারছে না। এভাবেই কালে কালে জন্ম নেয়া বহু সূর্যসন্তান হারিয়ে যাবে দেশের ইতিহাস থেকে, ইতিহাস সুষ্টি করেও ইতিহাসে থাকবে তাঁদেও নাম। যাঁদেও জন্য তাাঁদেও জীবন দান, তঁরাও জানবে না সেই সব মহাপুরুষদের নাম। বাঘা যতীনের ক্ষেত্রেও যেন সেই ট্রাজিক পরিণতিই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
ব্রিটিশবিরোধী স্বশস্ত্র আন্দোলনের মহানায়ক ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)। তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবী সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। ‘যতীন্দ্রনাথ ছিলেন বিপ্লববাদের ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ নায়ক।’১ তাঁর তৈরি সেই পধ ধরেই জাতীয় জাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল। তরুণ বিপ্লবীরা দেশের মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবকেই অনিবার্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
‘জাতীয় জাগরণের একটি মাহেন্দ্রক্ষণকে চিত্রিত করবার মুহূর্তে শিবনাথ শাস্ত্রী সে-যুগের প্রতীকরূপে নির্বাচন করেছিলেন রামতনু লাহিড়ীকে। বাগ্নিতায়, রচনাশৈলীতে, মননের উৎকর্ষে শ্রেষ্ঠতর একাধিক পুরুষের অবস্থিতি সত্ত্বেও লাহিড়ী মশাই কেন বিশেষভাবে গণ্য হলেন প্রতিভূর ভ’মিকায়, সে কৈফিয়ত কেউই চাই না; তাঁর চরিত্রে বাংলার তাজা প্রাণ ও পরিশীলিত বুদ্ধির পরিমাণ সমন্বয় ঘটেছিল তার পরিচয়ই মুগ্ধ করে আমাদের। কয়েক দশক পরে সেই জাগরণকে সুতীব্র অভিব্যক্তি দিল অভ্যুত্থান, আমরা তার বাস্তবিক হেতুর সন্ধানে সাক্ষাৎ পাই রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রী অরবিন্দের মতো প্রতিভার। কিন্তু সমগ্র আন্দোলনটির প্রতীকরূপে কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন বাঘা যতীনকে-১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় একটি যুগÑবাংলার বিপ্লবী সংগঠনকে যিনি প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে আপন জীবন-দীপ নিবিয়ে গেলেন, কয়েক প্রজন্মের স্মৃতিতে তাঁর প্রেরণা অব্যাহত রইলো অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো।’২
কী অবিশ্বাস্য দেশপ্রেম ছিল তাঁর, কী অমিততেজ শক্তি ছিল, দেশের মুক্তিই ছিল তাঁর একমাত্র স্বার্থ এবং সবচেয়ে বড় স্বার্থ। ‘যতীন্দ্রনাথ যেন একজন মানুষই ছিলেন তা নয়, তিনি একটি আন্দোলনের প্রতীক ছিলেন।.. যতীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিবিশেষ মনে করা ভুল হবে। রামমোহন হতে বিবেকানন্দ পর্যন্ত বাঙালী জীবনে যে ভাবধারা প্রবাহিত হয়েছিল, যতীন্দ্রনাথ ছিলেন তারই প্রতীক।’৩ বাঘা যতীন সুপরিকল্পিত ও নিজস্বধারায় বিপ্লব-কর্মপন্থা তৈরি করেছিলেন। যেখানে ব্রিটিশদেও সঙ্গে কোন আপসরফা নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবীদের সংঘবদ্ধ কওে সংগঠিতভাবে বিপ্লব ঘটাতে হবে। এজন্য তিনি অনুধাবন করেছিলেন বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতায় অস্ত্র ও অর্থ প্রয়োজন। সেই ভাবনা ও পরিকল্পনামাফিক তিনি তা বাস্তবায়নে কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিভিন্ন কর্মপন্থা নির্ধারণ করে তা কার্যকরী করার জন্য নিজে অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বদেশী যুগের বিখ্যাত বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায় (নরেন্দ্র ভট্টাচার্য) সান্ ইয়াৎ সেন, লেনিন, ট্রটস্কি প্রমুখ মহামানবের সংস্পর্শে এসেও ভুলতে পারেন নি তাঁর প্রথম জীবনের দীক্ষাগুরু যতীন্দ্রনাথকে: এঁরা সবাই মহামানব (great man); যতীনদা ছিলেন ভাল মানুষ (good man) এবং তাঁর চেয়ে ভালো মানুষ (better man) আমি এখনো খুঁজে পাইনি। মহামানবদের চাঁদেও হাঁটে ক্বচিৎ আমরা ভালো মানুষদের আসন দিই। এই রেওয়াজই চালু থাকবে যতদিন না সততা (goodness) স্বীকৃতি পাচ্ছে সত্যকার মহত্ত্বের পরিমাপ রূপে। .. কোনও একটা যুগের গ-ীতে বাঁধা যায় না যতীনদাকে; তাঁর অন্তরের মূল্যবোধ ছিল ষোল আনাই মানবীয় এবং ফল, দেশ-কালের সীমানার উর্দ্ধে। যেমন তিনি দয়ালু ও সত্যনিষ্ঠ তেমনি ছিলেন অসমসাহসিক সন্ধিবিমুখ (uncompromising)। তাঁর সাহসিকতা হৃদয়হীন ছিল না, আর তাঁর সন্ধির অনীহা ছিল না ক্ষমাবর্জিত। ..নিজেকে তিনি কর্মযোগী বলে জানতেন এবং সেই আদর্শই আমাদের সকলের পক্ষে শুভঙ্কর বলতেন। ..কর্মযোগী অর্থাৎ মানবতাবাদী; যিনি বিশ্বাস করেন যে মানুষের কর্মের মধ্য দিয়েই আত্মসিদ্ধি সম্ভব, তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করা স্বাভাবিক যে মানুষই তার নিয়মিত স্রষ্টা।.. যতীনদা ছিলেন মানবতাবাদী, সম্ভবত বর্তমান ভারতবর্ষের প্রথম মানবতাবাদী।’৪ তাঁর পারিবারিক বিপ্লববাদ চেতনা, বিপ্লবী কর্মপন্থা ও উড়িষ্যার বালেশ্বরে ব্রিটিশ-সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে অবিশ্বাস্য সম্মুখযুদ্ধ ও আত্মাহুতি বাঙালির জীবনে তা এক বিস্ময়কর ঘটনা।
জাতির জীবনে বাঘা যতীন সত্যিকার অর্থেই আশীর্বাদ ছিলেন। যখন ব্রিটিশরা এদেশকে দীর্ঘ শাসন-শোষনে রেখে এদেশের সম্পদ নিজেদের দেশে দোরসে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন বিপ্লব ঘটালেও মহাশক্তিধর ব্রিটিশকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য এসব উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না। এ জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একজন বিপ্লবী নেতা, যিনি বাংলায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে সংগঠিতভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ঠিক করে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতো পারেন। বাঘা যতীন ছিলেন পরাধীন ভারতের কাঙ্খিত সেই বিপ্লবী নেতা। যিনি আপাদমস্তক বাঙালি ছিলেন। সেই সময়ের পূর্ব বাংলায় বর্তমান কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল। প্রখ্যাত গবেষক পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে বলেছেন:
“রামমোহনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আবির্ভুত হলেন এদেশের ‘আভ্যন্তরীণ ইতিবৃত্ত গঠনের সর্বপ্রধান যুগপুরুষ’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-‘উগ্র উৎকট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তেজীয়ান পুরুষ’। এলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঋষী বঙ্কিমচন্দ্র, রাজনারায়ণ বসু, মাইকেল মধুসূদন, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন। এলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। এলেনবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী আর স্বামী বিবেকানন্দ। এই যে ক্ষণজন্মা পুরুষেরা একের পর এক এসে আমাদের দিয়ে গেলেন আলোর বার্তা, এঁদেও জন্মস্থানের কোথায় কটাই বা মর্মর-ফলক পাব আমরা, কোথায় পাব গাইড? জাতির চেতনায় নিভৃততম মহলে চির অক্ষয় এঁদের আসন। এই সাবেকী আমলের বাড়ীতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহান বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। সেদিন ছিল অগ্রহায়ণ মাসের একুশ; বাংলায় বারো-শ’ ছিয়াশি সাল। ইংরেজি মতে আঠারো-শ’ ঊনআশি সালের ৮ই ডিসেম্বর।৫
বিশাল মাপের এই বিপ্লবী মনে-প্রাণে ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিও। খেলাধুলার প্রতিও ছিল সমান আগ্রহ। বেশ অর্থ ব্যয় করে তিনি ‘কয়া থিয়েটার ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের ছেলেরা এখানে যেন নিয়মিত ভালো ভালো নাটক করতে পারে। ‘যে-সব নাটকে উদ্দীপ্ত হবে দেশপ্রেম, উদ্দীপ্ত হবে তরুণদের মনের অতলে সুপ্ত বহ্নিশিখা, যে-সব নাটক গড়ে তুলবে তাদের চরিত্র।’৬ তিনি নিজে এসব তরুণদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। থিয়েটারের পাশাপাশি তিনি ফুটবল ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিদ্যাভূষণের জাতীয়তাবাদী লেখা, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, স্বামী বিবেকানন্দের লেখা, বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস- এসব পাঠ করে তিনি তরুণদের শোনাতেন। যাতে, তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। লেখালেখি করতেন খুবই কম, কিন্তু লিখতেন। লেখার হাত ছিল। কবিতা লিখতে পারতেন। গল্পও লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা। তাঁর পত্রিকার নাম ‘গ্রহতারা’। প্রতি সপ্তাহে বুধবার করে বার হতো। বেশ কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। প্রথম সংখ্যার ভূমিকায় ছোটমাামা ললিতকুমার কাগজের উদ্দেশ্যে প্রভৃতি ক্যক্ত করেছিলেন; তিনি নিজে ভাল সাহিত্যিক ছিলেন। আর প্রথম সংখ্যার প্রথম রচনাই ছিল যতীন্দ্রনাথের ছোটগল্পটি।’৭
তিনি আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িত হওয়ার পর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়মিত খোঁজ-খবর করতে পারতেন না। কারণ তখন তাঁর খোঁজে ব্রিটিশ-বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যতীন তখন তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপন-অবস্থানে থেকে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। ব্রিটিশ সৈন্যরা যতীনের খোঁজে তাঁর কয়ার বাড়িতে অসংখ্যবার তল্লাশি করেছিল। তখন তাঁর সংসারের পুরো দায়িত্ব পালন করতেন মাতৃস্থানীয়া সহোদরা বিনোদবালা। ব্রিটিশ সৈন্যদের তিনি কখনো ছেড়ে কথা বলেননি। ভয় কাকে বলে তিনি জানতেন না। যোগ্য ভাইয়ের যোগ্য বোনই ছিলেন বিনোদবালা। যতীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে গর্ব ও গৌরবের সূর্যোজ্জ্বল একটি নাম। যখন ভারতবর্ষে সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়নি, তখন এ-বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের সন্তান স্বাধীনতার উদগ্র কামনায় নিজে বিপ্লবী মদলগুলোকে একত্রে সংগঠিত করে সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন।
‘১৯০৬ সালের এপ্রিল মাস। ২৮ শে চৈত্র।’৮ তিনি কয়া গ্রামে আসেন। এর আগের দিন তিনি অফিসের কাজ সেরে রাতেই ট্রেনে কুষ্টিয়া আসেন। চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে গড়াই নদী সাঁতরিয়ে কয়ায় আসেন। এ দিন যে তাঁর জন্য জীবন-মৃত্যুর এক সন্ধিক্ষণ অপেক্ষা করছিল তা নিজেও জানতেন না। বাঘা যতীন বাড়িতে এসেছে জেনে পাশের রাধারপাড়া গ্রামের দুজন চাষী এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে জানায় তাদের গ্রামে বাঘের অত্যাচার আর উৎপাতের কথা। বাঘা যতীন সব শুনে মুহূর্ত দেরি না করে ধুতিটা মালকোচা মেরে বের হয়ে যান ঘর থেকে একটা দার্জিলিংয়ের কুকরি (ছোট্ট ছোরা) নিয়ে। রাধারপাড়া গ্রামের মাঠ তখন আখের খেতে ভরা। বাঘ খুঁজতে খুঁজতে তিনি গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে চলে যান। তারপর লক্ষ্য করেন আখের খেতে একটা ঝোপের আড়ালে বিরাট এক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বাঘ দেখেই তিনি চাপাস্বরে বলতেই বাঘের কথা জানান দিতে তাঁর মামাতো ভাই অমূল্য পাখিমারা বন্দুকে ট্রিগার টিপে দেয়। বাঘ ক্রদ্ধ গর্জনে অমূল্যের ওপর লাফিয়ে পড়তেই বাঘা যতীন ত্বড়িৎবেগে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ফেলে নিজেই বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেষপর্যন্ত বাঘাটিকে তিনি হত্যা করতে সক্ষম হন।
বাঘা যতীন ১৯০৬ সালের ১১ এপ্রিলে (২৮ চৈত্র, ১৩৯২) সামান্য এক ভোজালি দিয়ে নিজের গ্রামের পার্শ্ববর্তী রাধারপাড়া গ্রামে একা লড়াই করে বাঘ মারার ঘটনা গোটা ভারতে রীতিমতো বিস্ময়কর খবরে পরিণত হন। সে-সঙ্গে বাঘ মারার এই ঘটনা স্বদেশী বিপ্লবীদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল। তাঁর এ-কীর্তি ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে নিজেও প্রচ- আহত হন। এজন্য তাঁকে কলকাতায় তাঁর মেজো মামা ডা. হেমন্তকুমার ও বিশিষ্ট ডাক্তার সুরেশচন্দ্র সর্বাধিকারীর চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তাঁর ডান পা-এর অবস্থা এতো খারাপ হয়ে পড়েছিল যে ডা. সুরেশচন্দ্র তাঁর পা-টি কেটে একদম বাদ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেজো মামা ডা. হেমন্তকুমার পা না-কেটে যথাসাধ্য চিকিৎসা করার কথা বলেন ডা. সুরেশকে। কারণ তিনি জানতেন অসম্ভব মনোবলের অধিকারী তাঁর এই ভাগ্নে। যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা তাঁর আছে। ডা. হেমন্তকুমারের কথামতোই চিকিৎসা করেছিলেন ডা. সুরেশচন্দ্র। ছয় মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, এরপরও কিছুদিন বাঘা যতীন ক্র্যাচে ভর করে হাঁটতেন। তারপর তিনি পুরোপুরি সুস্থ হন। এ প্রসঙ্গে বাঘা যতীনের ছোটমামা ললিতকুমার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য:
‘বিপদে পলায়ন করা যতীন্দ্রনাথের প্রকৃতিতে ছিল না-তাই তিনি সরিয়া না গিয়া বাঘের গলা তাঁহার বাম বগলের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বাঘের মাথায় ভোজালি দিয়া মারিতে লাগিলেন। বাঘ আহত হইয়া যতীন্দ্রনাথকে কামড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল, তাঁহার সহিত বাঘের রীতিমত লড়াই আরম্ভ হইল। অবশেষে তিনি মাটিতে পড়িয়া গেলেন। বাঘা সেই অবসরে তাঁহার দুই হাঁটুতে কামড়াইয়া ও সর্বাঙ্গে নখ বসাইয়া তাঁহাকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া দিল। তিনি নিজের দেহের আঘাত অগ্রাহ্য করিয়া বাঘকে মাটিতে চাপিয়া ধরিয়া ছোরার আঘাতে বাঘকে মারিয়া ফেলিলেন, কিন্তু নিজেও মৃতপ্রায় হইয়া গেলেন। তাঁহাকে তুলিয়া বাড়ী আনা হইল, ও কলিকাতায় তাঁহার মেজমামার নিকট পাঠান হইল। সেখানে বিখ্যাত সার্জন ডাক্তার সুরেশ সর্বাধিকারী তাঁহার চিকিৎসা করিয়া বাঘের কামড়ের ক্ষত ও বিষ হইতে তাঁহাকে বাঁচাইয়া দেন। তাঁহার দু’খানা পা-ই কাটিয়া ফেলিবার কথা হইয়াছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহা করিতে হয় নাই। তিনি ছ-মাস ধরিয়া শয্যাগত ছিলেন এবং ভাল হইয়াও বহুদিন ধরিয়া তাঁহাকে স্ক্রাচের সাহায্যে চলিতে হইয়াছিল। যতীন্দ্রনাথ পরে তাঁহার মারা ঐ বাঘের চামড়াখানি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তাঁহার জীবনদাতা ডাক্তার সর্বাধিকারীকে উপহার দিয়াছিলেন।’৯
ডাক্তার সুরেশচন্দ্র যতীন্দ্রনাথের এ-কীর্তিকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে ‘বাঘা যতীন’ উপাধি দেন। তিনি অবিশ্বাস্য এই কীর্তি নিয়ে ইংরেজীতে একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘The Bengali Nemrod’’। সেই প্রবন্ধে বাঘা যতীনের অপূর্ব শৌর্য, অসাধারণ সহ্যশক্তি ও দেবতুল্য চরিত্রের বর্ণনা দেন। সাধারণ মানুষের কাছে তখন এই প্রবন্ধ বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছিল। সাধারণ মানুষও তাঁর বাঘ মারার পর ভালোবেসে তাঁকে ‘বাঘা যতীন’ নামে ডাকতে শুরু করেন।
তিনি পরবর্তীতে একটি বাঘিনীও হত্যা করেছিলেন।
‘কন্ট্রাকটারী করিবার সময় যতীন্দ্রনাথ ঝিনাইদহে থাকিতেন এবং প্রত্যহ কার্য্য করিয়া অধিক রাত্রে বাড়ী ফিরিতেন। একদিন ঘোড়ায় চড়িয়া গভীর রাত্রে বনের মধ্য দিয়া বাড়ী আসিতেছেন এমন সময় হঠাৎ তাঁহার ঘোড়া পথিমধ্যে থামিয়া গেল। যতীন্দ্রনাথ বুঝিতে পারিলেন যে, কোন জন্তুর গন্ধ পাইয়াছে তাই যাইতে চাহিতেছে না। তিনি তথায় একটু দাঁড়াইতেই দেখিতে পাইলেন যে একটি বাঘ কয়েকটি বাচ্চা লইয়া অদূরে খেলা করিতেছে। তাঁহার সহিত বন্দুক ছিল; তিনি নিজের কোটটি খুলিয়া ঘোড়ার চোখে বাঁধিয়া দিলেন এবং ধীরে ধীরে ঘোড়া লইয়া আগাইয়া চলিলেন। বাঘটির নিকটবর্ত্তী হইয়া তিনি গুলি ছুঁড়িলেন, বাঘ ধরাশায়ী হইল। তারপর যতীন্দ্রনাথ নিকটে যাইয়া বাঘের বাচ্চাগুলিকে দেখিয়া তাহাদিগকে নিজ গৃহে লইয়া আসিলেন এবং বহুদিন যাবৎ তাহাদিগকে পুষিয়াছিলেন।’১০
বাঘা যতীনের বাঘ-মারার ভেতর দিয়েই সেই সময়ে বিপ্লবীদের মধ্যে নবজাগরণ তৈরী হয়েছিল-আমরা যদি বাঘ মারতে পারি, ব্রিটিশও মারতে পারবো। এই অগ্নিচেতনায় বিপ্লব তখন নতুন প্রাণে জেগে উঠেছিল।
যতীন সেন্ট্রাল কলেজে এফ-এ পড়ার সময়ই নিজে কিছু-একটা করার কথা ভাবেন। অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের উপার্জনে নিজে চলার চিন্তা তাঁর মাথায় ঢোকে। যদিও তাঁর মামারা তাঁকে অসম্ভবরকম স্নেহ করতেন তাঁর সমস্ত দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু মামাদের না-জানিয়ে নিজেই অর্থ উপার্জনের একটা পথ খুঁজতে থাকেন। যাতে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো যায়। এ চিন্তা থেকেই তিনি সর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং-এ ভর্তি হন। এবং অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তা দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ব করে নেন। এরপরই শুরু হয় তাঁর কর্মজীবনÑ কলকাতার আমহুটি অ্যান্ড কোম্পানী নামক ইউরোপীয় এক অফিসে পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকরি নেন তিনি। এখানে চাকরি করা অবস্থাতেই মজঃফরপুরে একটি ভালো চাকরি পান তিনি, বেতন ছিল আশি টাকা। কলকাতার চাকরি ছেড়ে মজঃফরপুরে চলে আসেন তিনি। এখানে তিনি ব্যারিস্টার প্রিংলে কেনেডির সচিব হিসেবে যোগদান করেন। কেনেডি সাহেব ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রায়চাঁদ-প্রেমচাঁদ স্কলার এবং ইংরেজি পত্রিকার ত্রিহুত কুরিয়ার-এর সম্পাদক। কংগ্রেস প্লাটফর্ম থেকে কেনেডি-সাহেব প্রথম প্রস্তাব আনেন- ভারতের নিজস্ব জাতীয় সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার সপক্ষে। বাঘা যতীন কেনেডি সাহেবের কাছেও বেশীদিন চাকরি করেন নি। কারণ ‘এখানে চাকরি করা অবস্থাতেই তিনি কলকাতায় বঙ্গীয় সরকারের অফিসে চাকরি পান। এই চাকরিটা তাঁর পছন্দ হয়, বেতনও ভালো, একশত কুড়ি টাকা। তিনি মি. কেনেডির চাকরি ছেড়ে কলকাতায় নতুন চাকরিতে যোগ দেন। এখানে তিনি বঙ্গীয় সরকারের অফিসের খুব প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মি. এ. এইচ. হুইলার নামক একজন আই.সি.এস.-এর অধীনে সর্টহ্যান্ড-টাইপিস্টের কাজ করতেন। একই সঙ্গে তাঁকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্বও পালন করতে হতো। তখন বঙ্গীয় সরকারের কর্মকা- মি. হুইলারের নির্দেশে চলতো বলেই প্রচার ছিল। যতীন নিজের ব্যক্তিত্ব আর কাজের দক্ষতাগুণে মি. হুইলার ও তাঁর অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সকলের বিশেষ পছন্দের পাত্রে পরিণত হন।’১১
তাঁরা যতীনকে খুব বিশ্বাস করতেন। মি. হুইলার রাজস্ব বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। সে-কারণে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজা, মহারাজা, জমিদারবর্গ প্রায়ই মি. হুইলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। সেকারণে যতীনের সঙ্গেও প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর এসব ব্যক্তিদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। মি. হুইলারের সঙ্গে দেখা করার আগে যতীনের রুমেই তাঁদের ঢুকতে হতো। যতীনের রুম ছিল মি. হুইলারের রুমের সম্মুখের রুম। যতীন তাঁর সুন্দর ব্যবহার ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাঁদের সহজেই মুগ্ধ করতে পারতেন। এখানে চাকরি করা অবস্থাতেই তিনি গোপনে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। মি. হুইলার ভুলেও ভাবতে পারেন নি যতীন বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত। এমনকি বঙ্গীয় সরকারের অফিসের উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তাও তাঁকে সন্দেহ করেন নি। কিন্তু বিপ্লবীদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে বাঘা যতীনের নাম তখন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। ১৯০৯ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকারি উকিল আশুতোষ বিশ্বাস আলীপুরের আদালত প্রাঙ্গণে খুলনা জেলার শোভনা গ্রামের চারুচন্দ্র বসুর গুলিতে নিহত হলে গোয়েন্দাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি পড়ে বাঘা যতীনের ওপর, একসময় যখন তাঁর যুক্ততাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, হাওড়া মামলায় যখন তাঁকে অভিযুক্ত করা হলো তখন বঙ্গীয় সরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অবাক হন, যাঁকে তারা এতো বিশ্বাস করতেন, ভালোবাসতেন, সে-ই নীরবে এসব বিপ্লবী কর্মকান্ড সংঘঠিত করছে! সে-ই বিপ্লবী কর্মকান্ডের মূল হোতা। চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। ১৯০৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে যতীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ায় আসেন। ‘দলের অনেক কাজ কুষ্টিয়ায়। ময়মনসিংহের বিপ্লবী নেতা হেমেন্দ্রকিশোর তখন কুষ্টিয়ায়। হেমেন্দ্রকিশোর আচার্য-চৌধুরী যতীন্দ্রনাথের বন্ধু। কুষ্টিয়ায় হেমেনবাবুর কুটুমবাড়ি। সেখানেই তাঁর সঙ্গে যতীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয়। কুষ্টিয়ার চক্রবর্তী-বাড়িতে। এঁরা মোহিনীমিলের প্রতিষ্ঠাতা,-শোনা যায় যতীন্দ্রনাথের প্রেরণা কম ছিল না এর পশ্চাতে।’১২
বঙ্গীয় সরকারের অফিসে চাকরিকালে যতীন্দ্রনাথ প্রতি বছর গরমের সময় কয়েক মাসের জন্য দার্জিলিংয়ে সময় কাটাতে যেতেন। একবার দার্জিলিংয়ে সময় কাটাতে যাবার সময় শিলিগুড়ি রেল স্টেশনে তিনি ট্রেনে বসে আছেন। ট্রেনটি ছাড়বে-ছাড়বে এরকম সময়ে তিনি লক্ষ্য করেন ট্রেনের কামরায় একটি ছোট শিশু পানির তৃষ্ণায় কাঁদছে। যদি ট্রেন ছেড়ে দেয় এ-আশঙ্কায় শিশুটির বাবা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না তিনি কি করবেন! পানি আনতে হলে তাকে নিচে যেতে হবে। বাঘা যতীন তা বুঝতে পেরে নিজেই একটি গ্লাস হাতে পানি আনতে দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে যান। কিন্তু পানি নিয়ে আসার আগেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। তিনি তাড়াতাড়ি দৌড়ে পানি নিয়ে ট্রেনে উঠতেই গেটে দাঁড়ানো চারজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের একজনের গায়ে ধাক্কা লেগে কিছুটা পানি তার গায়ে পড়ে। এতে ক্রোধান্বিত হয়ে চারজন সৈনিকই যতীনকে এমনভাবে ধাক্কা মারে যে তিনি নিচে পড়ে যান এবং তাঁর হাতে ধরা গ্লাসটিও ভেঙে যায়। যতীনের চোখের সামনে তখন তৃষ্ণার্ত শিশুটির অসহায় মুখ, আর বাঙালীর প্রতি তাদের বিরূপ আচরণ তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠলো। যতীন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন। তারা আবারও যতীনকে আক্রমণ করলো এবং বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে গালাগালি করতে থাকে। বাঘা যতীন প্রতিশোধে জ্বলে ওঠেন। আক্রমণ করেন চারজন সৈনিককেই। চারজনের সঙ্গে যতীন একা লড়েন, কারো নাক ভেঙে দেন, কারো মাথা ফাটিয়ে দেন। এ দেখে এক শ্বেতাঙ্গ সৈনিক যতীনকে পেছন থেকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এতেও তিনি ক্ষান্ত না হয়ে একা খালি-হাতে চার জন শ্বেতাঙ্গ সৈনিককে স্টেশনের প্লাটফরমে চরমভাবে প্রহার করে তারপর তিনি তাদের ছেড়ে দেন। ‘যতীন্দ্রনাথ সাধারণ ভারতবাসীর ন্যায় প্রহৃত হইয়া, গালাগালি শুনিয়া মুখ নীচু করিয়া চলিয়া যাইবেন সে পাত্র তিনি নন। তিনি স্বামীজীর কথা স্মরণ করিলেন- “তোমার গালে এক চড় যদি মারে, তাকে দশ চড় যদি ফিরিয়ে না দাও, তুমি পাপ করবে। ঝাঁটা লাথি খেয়ে চুপটি করে ঘৃণিত জীবন যাপন করলে, ইহকালের নরকভোগ, পরকালেও তাই। অন্যায় সহ্য করা গৃহস্থের পক্ষে পাপÑতৎক্ষণাৎ প্রতিবিধান করতে চেষ্টা করতে হবে”।’১৩ সেদিন সবাই শিলিগুড়ির প্লাটফরমে দেখেছিল এক বাঙালি যুবক কিভাবে শাসন করেছিল চার স্বেতাঙ্গ সৈনিককে। আঘাতপ্রাপ্ত এসব সৈনিকদের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাগ্রহণ করতে হয়েছিল। এ ঘটনায় যতীনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। আহত চার স্বেতাঙ্গ সৈনিকের মধ্যে একজন ছিলেন লেফটেন্যান্ট পদ-মর্যাদার।
‘দার্জিলিঙ শহরে এই মোকদ্দমার কথা হুইলার সাহেব শুনিয়া বিস্মিত হইয়া গেলেন। একজন নিরস্ত্র বাঙালী চারিজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিককে মারিয়া আহত করিয়া পনের দিনের জন্য তাহাদিগকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলেন, ইহাতে লাঞ্ছিত না হইয়া আবার তাহারা আদালতে নালিশ করিতেছে, ইহা হুইলার সাহের পছন্দ করিলেন না। এই ঘটনা আদালতে যাইলে মামলার বিবরণ সংবাদপত্রে পাঠ করিয়া জনসাধারণ শ্বেতাঙ্গর গায়ে হাত দিতে চেষ্টা করিবে বিবেচনা করিয়া তিনি লেফটেন্যান্টকে ডাকিয়া মামলা প্রত্যাহার করিয়া লইতে বলেন এবং তাহাদিগকে তিরস্কার করেন। হুইলার সাহেবের কথায় মামলা তাহারা প্রত্যাহার করিয়া লয়। হুইলার যতীন্দ্রনাথকে ডাকিয়া কি ঘটিয়াছিল তাহা জিজ্ঞাসা করেন এবং যতীন্দ্রনাথ সমস্ত সত্য কথা তাহাকে বিবৃত করেন। যতীনের কথা শুনিয়া সাহেব হাসিয়া আকুল হইলেন এবং তাহার সহিত করমর্দন করিয়া বলিলেন, তুমি কয়জনের সহিত লড়িতে পার?
যতীন্দ্রনাথ নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে জবাব দিলেন যে, তিনি ভাল লোক একজনের সহিতও লড়িতে পারেন না। এই ঘটনার পর যতীন্দ্রনাথের প্রতি তাহার স্নেহ আরও বৃদ্ধি পায়।’ ১৪
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঘা যতীন ও এম. এন. রায় ছিলেন দুই দিকপাল। দুজনই অনুভব করেন বৈপ্লবিক কাজকর্ম পরিচালণার জন্য অর্থের প্রয়োজন। কেননা দেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়িত করতে বিপ্লবীদের প্রয়োজন অস্ত্রের, বোমা-বন্দুক-পিস্তলের। তাছাড়া কর্মীদের খাওয়া-দাওয়া এসবের জন্যও তো অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু এই অর্থ কিভাবে আসবে-কোথায় থেকে আসবে-এসব ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমে ভেবেছিলেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে এ অর্থ সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রতি তখন সাধারণ মানুষের সমর্থনের অভাব ছিল। এই বিপ্লবীদের অধিকাংশই এসেছিলেন শহরের উঁচুতলার পরিবার থেকে। তারা রাজনৈতিক ডাকাতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইতিহাস থেকেও তারা এ ধরণের ডাকাতির পক্ষে সমর্থন খুঁজে পান। নিহিলিস্টরা অথবা অ্যানার্কিস্টরা সরকারি কোষাগার কিংবা ধনীর ধন লুঠ করে অর্থের প্রয়োজন মেটাতেন। গীতাতেও তো মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সন্ত্রাসের পথ বেছে নেবার সমর্থন রয়েছে। সুতরাং পুলিশ-প্রশাসন বাংলার যুবকদের এই প্রয়াসকে ডাকাতি অভিধা দিলেও বিপ্লবীরা মনে করতেন এ আসলে যুদ্ধকালীন ঋণ গ্রহণ। যুদ্ধশেষে এ-ঋণ মিটিয়ে দেয়া হবে। এরপর নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা প্রথম চিংড়িপোতা স্টেশনে ১৯০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এ স্টেশনটিতেই এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটান। এর মাধ্যমে বিপ্লব প্রচেষ্টার এক নব অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। শিয়ালদহ দক্ষিণ রেলপথে সোনারপুর পেরিয়েই যে স্টেশনটি, সেটিই ছিল চিংড়িপোতা রেল স্টেশন। বর্তমানে এটির নাম সুভাষগ্রাম। এর আগে এ ধরণের প্রচেষ্টা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু বৈপ্লবিক হত্যার প্রথম উদ্যোগগুলির মতো ডাকাতির প্রস্তুতিপর্ব ও তার কর্মপদ্ধতি ছিল যেন অনেকটা হালকা চালে নেওয়া। কিন্তু চিংড়িপোতা ঘটনা থেকে সেটা নব অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
‘১৯০৯ সালের ৩১ মে নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ডায়মন্ডহারবারের কাছে নেত্রায় আরেকটি ডাকাতি হয়েছিল। বাড়ির মালিক রামচন্দ্র মিত্র পরে পুলিশকে জানিয়েছিল, ‘ডাকাতের দল’ তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে যথাসর্বস্ব লুটে নিয়েছে ঠিকই, তবে যাবার বেলায় বলেছে -ইংরেজকে দেশ ছাড়া করতেই এ ঋণ গ্রহণ করা হল। সুদিন এলে এ ঋণ শোধ করা হবে।’১৫
নরেন্দ্রনাথ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রাজনৈতিক ডাকাতি গুলি সম্পন্ন করেছিলেন এবং নিজেকে ও দলের সবাইকে নিরাপদে রাখতেও সক্ষম হয়েছিলেন। মজঃফরপুরে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর দুঃসাহসিক অভিযানের দুদিনের মধ্যেই মানিকতলার মুরারীপুকুর গার্ডেন থেকে বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখ বিপ্লবীরা গ্রেপ্তার হন। ৮নং গ্রে স্ট্রীট থেকে পুলিশ অরবিন্দকে গ্রেপ্তার করে। এঁরা প্রত্যেকেই আলীপুর বোমা হামলায় অভিযুক্ত হন। এ ঘটনায় বাংলার বৈপ্লবিক প্রচেষ্টটা একটা বড় রকমের আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এ মামলায় চিত্তরঞ্জন দাসের তৎপরতায় অরবিন্দ মুক্তি পান। অন্যান্য বিপ্লবীদের অনেকের যাবজ্জীবন দীপান্তরবাসের সাজা হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার অভিঘাতে বিপ্লবীরা বুঝতে পারলেন ছোট ছোট দলের বিচ্ছিন্ন চেষ্টায় দেশকে স্বাধীন করা যাবে না। একটি বড় সুসংগঠিত দল তৈরি কাজ শুরু করা আশু কর্তব্য। ক্ষদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী কিংফোর্ডকে হত্যা করার জন্য ক্ষুদিরাম যে একাধিক পিস্তল বহন করেছিলেন, তার একটি নরেন্দ্রনাথের দেয় এবং তাঁদের অভিযাত্রার আগে নরেন্দ্রনাথ তাদের দুজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ক্ষুদিরামকে তিনি একটি পিস্তল দিয়েছিলেন। নেহরু এসব কর্মকান্ডকে অহিংসার মৌলিক দর্শনের পরিপন্থী বলে আপত্তি ছিল। ক্ষুদিরামের স্মৃতির প্রতি তিনি শ্রদ্ধাও জানাননি। এর ফলে বিপ্লবীদের বৃহৎ পরিসরে সুসংগঠিত হওয়া অনিবার্যতায় রূপ নেয়। প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যতীন মুখার্জি ও নরেন্দ্রনাথ ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যা অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। বাংলার প্রায় সব কয়টি বিপ্লবী দল একত্রিত হলেও ঢাকার অনুশীলন সমিতি এবং কলকাতার বিপিন গঙ্গোপাধ্যায়ের দল শুধু স্বতন্ত্রভাবে থাকলো। এই দুটি দল এবং উত্তর ভারতের বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলি রাসবিহারী বসুর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ‘দেরাদুন ও লাহোরের দলগুলিকেও সংগঠিত করেছিলেন রাসবিহারী বসু। হুগলী ও চন্দননগরের গোষ্ঠীগুলির সঙ্গেও রাসবিহারীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। রাসবিহারীর সঙ্গে নরেন ও যতীন মুখার্জির যোগাযোগ হয়। ১৯১৩ সালে দক্ষিণেশ্বরে যতীনের সঙ্গে রাসবিহারীর কথাবার্তা হয়। পরের বছরে নরেনের উপস্থিতিতে তাঁদের মধ্যে পুনর্বার যে আলোচনা হলো তাতে স্থির হয় যে, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য চরম প্রস্তুতি নিতে হবে। এই অভ্যুত্থানে উত্তর ভারতে ও বাংলায় নেতৃত্ব দেবেন যথাক্রমে রাসবিহারী ও যতীন মুখার্জি।’১৬ এই প্রক্রিয়া সফলভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু মানসিক দ্বন্দ্ব শুরু হয় রডা কোম্পানির ৪৬ হাজার টোটাসহ ৫০টি মাউসার পিস্তল লুটের পওে এর ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। এর পরেও দেশব্যাপী সশস্ত্র অভ্যুত্থানের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তাকে বাস্তবে রূপ দিতে নরেন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। এই প্রচেষ্টার ফলেই ১৯১৫ সালের মার্চ মাসে সারা বাংলার গুপ্ত সমিতিগুলোর নেতৃবৃন্দ এক গোপন সভায় মিলিত হন। দেশি-বিদেশি শক্তি সংহত করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রবল আঘাত হানার যে অবকাঠামো নরেন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন, তাতে প্রাণ সঞ্চার কওে জীবন্ত কওে তুলেছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। যতীন ও নরেন্দ্রনাথের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। নরেন্দ্রনাথ যতীনকে ‘দাদা’ সম্ভোধন করতেন এবং নিজের ‘নেতা’ মানতেন। হাওড়ায় ব্রিটিশ রাজ উচ্ছেদেও ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান অীভযুক্ত ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। কারাবাসের শেষ কয়েকটি মাস যতীন মুখার্জী ও নরেন্দ্রনাথ একই সেলে ছিলেন। সে-সময়ে দুজনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক তৈরী হয়। নরেন্দ্রনাথ এর পর যতীন মুখোপাধ্যায়কে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকারকে একটা বড় রকমের আঘাত করার প্রয়াসী ছিলেন।
বাঘা যতীন এবং তাঁর শিষ্য এম. এন. রায় ক্রমশ উপলব্ধি করলেন, পরিকল্পনা যতই নিখুঁত হোক, যতোই গুপ্ত সমিতিগুলো একত্রিত হোক না কেন, বহিঃশক্তির সাহার্য ছাড়া ও সমর্থন ছাড়া সশস্ত্র অভ্যুত্থান করা বেশ কঠিন কাজ। বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিচার করে তাঁরা সঠিকভাবেই অনুমান করেছিলেন যে একটা বড় রকমের যুদ্ধ বাঁধতে চলেছে। ১৯১৩ সালের শেষ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে যতীনন্দ্রনাথ এবং নরেন্দ্রনাথ কলকাতায় নিযুক্ত জার্মান কনসুলের সঙ্গে বহুবার মিলিত হন। তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা হয়। পরিকল্পনা অনুসারে ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়কে পাঠানো হয় শ্যাম দেশে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দায়িত্ব পড়েছিল নরেনের ওপর। গদর দলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য লোক পাঠানো হয় আমেরিকায়। ভারতবর্ষ ও তথা ভারতবর্ষের বাইরে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ভারতবাসীদের সঙ্গে গদও দলের যোগাযোগ ছিল। এবং এই দলটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ইউরোপে বার্লিন কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে রওনা দিয়েছিলেন বাংলার বিপ্লবী দলের প্রতিনিধিরা। কিন্তু জার্মানী সাহায্য না আসা পর্যন্ত অভ্যুত্থানের প্রাথমিক খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে যতীন্দ্রনাথ বড় ধরনের রাজনৈতিক ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দায়িত্ব দেন নরেনকে। ‘১৯১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নরেন গর্ডেনরিচে বার্ড কোম্পানির ১৮,০০০ টাকা লুট করলেন। ঘটনাটি ঘটল প্রকাশ্য দিবালোকে। বিপ্লবী নলিনীকান্ত বিবরণ থেকে জানা যায় ডাকাতির পর নরেন ঠিক সময়ে ফিরে না এলে যতীন খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।’১৭
যতীন ও নরেন চেয়েছিলেন জার্মানীর সাহায্যে জাহাজ বোঝাই করে অস্ত্র গোলা-বারুদ এনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে ভারতের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে। সে পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া তাঁরা বাস্তবায়নের দিকে প্রায় এগিয়েও নিয়েছিলেন। আর ব্রিটিশরা চেয়েছিল বিপ্লবীদের জাহাজ বোঝাই করে দ্বীপান্তরে পাঠাতে। কিন্তু হুট করেই তাদের ধারণা হয় প্রচলিত আইনেই এসব বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে ফাঁসিতে ঝুলানো সম্ভব। ব্রিটিশরা এ দিকটিই গ্রহণ করে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এম. এন. রায় ছিলেন অসম্ভব রকম এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সারা পৃথিবীতে তিনি এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তিনি ঘুরেছেন, এ আন্দোলনকে সংগঠিত করতে। অসম্ভব রকমের মেধাবী এ নেতা পৃথিবীর বহুভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ইউরোপ-আমেরিকায় তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম. এন. রায় নামে পরিচিত ছিলেন। মেক্সিকোয় প্রথম কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠাতা লেনিনের সান্নিধ্য-ধন্য বলে গোটা বিশ্বে তিনি পরিচিত। তিনি লেনিন, ট্রটস্কি, সুন-ইয়াৎ সেন, কারাঞ্জা প্রভৃতি বিপ্লবীদের সাথে চলেছেন, রাজনীতি করেছেন। এম. এন. রায়ের জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান ‘নব মানবতাবাদ’ দর্শন। এ দর্শনের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন মানবতার উৎকর্ষকে বিকশিত করতে; গুরু যতীন্দ্রনাথের যে উৎকর্ষ ও যে-বিকাশ পরিলক্ষিত হয়েছে, সেই দৃষ্টান্ত সামনে রেখেই তিনি অন্বেষণ করেছিলেন নতুন এক সমাজের।
এম. এন. রায়ের স্ত্রী এলিন্ও অভিভূত হতেন গুরু-শিষ্যের আদর্শ ও হৃদয়গ্রোথিত এই গভীর সম্পর্কে। বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর এম. এন. রায় যখনই বাঘা যতীন সম্পর্কে কোনো স্মৃতিচারণ করতেন, তখন তিনি চোখের পানি সংবরণ করতে পারতেন না। অথচ তাবৎ পৃথিবীর মানুষ এম. এন. রায়কে জানতেন দৃঢ়চেতা শক্ত মনের মানুষ হিসেবে।
বিখ্যাত বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০) ও বাঘা যতীন একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। অরবিন্দ যখন বিলাত থেকে ভারতে ফিরে এসে বরোদা রাজ কলেজে সহকারী অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন তখন থেকেই বাঘা যতীনের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং দেশ-মাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য বিপ্লবের দ্বারা কিভাবে অগ্রসর হতে হবে, সেসব তাঁদের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এর নিমিত্তেই তাঁরা বিপ্লবী কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় দু’জনে বিভিন্ন বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুবসমাজকে জেগে ওঠার আহ্বান জানান। এ সময়ে তাঁরা ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের সাহায্য লাভ করেন। তিনি বিলেতে ব্যারিস্টারী পড়তে গিয়ে বর্ণ কালো হওয়ার কারণে ইংরেজদের কাছে নানাভাবে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। সেই পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও বেদনা থেকেই যুবসমাজকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে বিলেত থেকে ফিরে কলকাতায় বেশ কয়েকটি ব্যায়াম সমিতি গড়ে তুলেছিলেন। যতীন প্রমথবাবুর সঙ্গে দেখা করে ১৯০৩ সালে ১০২ নং আপার সার্কুলার রোডে ‘আখড়া’ গড়ে তোলেন।
১৯০২ সালে অরবিন্দ কলেজের চাকরী ছেড়ে কলকাতায় এসে শ্যামপুকুর স্ট্রীটে পন্ডিত যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের বাড়িতে ওঠেন। যতীনও তখন এ বাড়িতে থাকতেন। এবং এখান থেকেই গোপনে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। বাঘা যতীন এবং প্রমথনাথ দুজনে মিলে কলকাতায় বহু ব্যায়ামাগার গড়ে তোলেন। এসময় গোপন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দের নেতৃত্বে ও নির্দেশ অনুযায়ী বাঘা যতীন মূল উদ্দেশ্য গোপন রেখে যুবকদের ব্যায়ামাগারে শরীর চর্চায় আগ্রহী করে তোলেন।
অরবিন্দ ও বাঘা যতীন দু’জন মিলে বিপ্লবের নতুন পথ বের করে গোপনে যখন দেশ মুক্তির জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছিলেন, তখুনি আসে বঙ্গ-বিভাগের প্রস্তাব। এর কারণ খুব স্পষ্ট ছিল। বাঙালী যুবকশ্রেণী বিপ্লব সংঘঠিত করার জন্য তখন অদম্য হয়ে উঠছিল, তাদের এই অদম্য মনোবল ভেঙে দেয়ার লক্ষেই এ-প্রস্তাব তৈরী হয়। এ প্রস্তাবের কারণে গোটা বাংলায় তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। বিপ্লবী নেতারা তখন এ সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদের কর্মকা- ব্যাপকভাবে পরিচালনা করেন।
মানিকতলায় (৩২ নং মুরারিপুকুর রোড) অরবিন্দ ঘোষের পিতা কৃষ্ণদয়াল ঘোষ-এর একটি বাগানবাড়ি ছিল। এটি গুপ্ত সমিতির নামে দলিল করে দেয়া হয়। বিপ্লব সংঘঠিত করার লক্ষ্যে এখানে নানারকম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। যাতে যুব-সম্প্রদায় এখানে এসে যুক্ত হয়। এদেরকে বিপ্লবী হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল মূল লক্ষ্য। যতীন নিজেও এখানে আসতেন। বিপ্লবীদেরকে এখানে দীক্ষা দেয়া হতো। বিপ্লবীদের কার্যপ্রণালী এবং কার ওপর কি দায়িত্ব অর্পিত হবে, তা এখান থেকেই নির্ধারণ করা হতো। এই বাগানবাড়িটিই ছিল বিপ্লবীদের মূল কর্মকেন্দ্র।
দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্য যখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাস চলছে, ব্যক্তি আত্মদানের মাধ্যমে বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে, তখন এ আন্দোলনকে সংগঠিত করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে গণ-সংগ্রামে পরিণত করতে দারুণ ভূমিকা পালন করেন বাঘা যতীন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিপ্লবী দলগুলো সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য একটি প্লাটফরম তৈরীর প্রয়োজন অনুভব করেন। এ থেকেই বাঘা যতীনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা গড়ে তোলেন বিকেন্দ্রিক ফেডারেশন ধরনের একটি দল। পরে এটি ‘যুগান্তর সমিতি’ নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটির নেতৃত্বে ছিলেন বাঘা যতীন। এ দলে যোগ দিয়েছিল বিপিন গাঙ্গুলীর আত্মোন্নতি সমিতি, হরিকুমার চক্রবর্তীর চব্বিশ পরগনার চিংড়িপোতা দল, যতীন রায়ের উত্তরবঙ্গ দল, প্রজ্ঞানন্দের বরিশাল দল, হেমেন্দ্রকিশোর আচার্যের মৈমনসিংহ দল ও পূর্ণদাসের অধীনন্থ ফরিদপুরের মাদারীপুর দল।
বিশিষ্ট গবেষক-লেখক ম.ইনামুল হক বাংলার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গ্রন্থে বাঘা যতীনকে যুগান্তর দলের নেতা অভিহিত করে বলেছেন, ‘যুগান্তর সমিতির নেতা বাঘা যতীন বালেশ্বরের কাছে বুড়িবালাম নদীর তীরে এক যুদ্ধে চার সঙ্গীসহ নিহত হন।’ এরকম উল্লেখ আমরা আরো অনেক গ্রন্থে পাই।
বাঘা যতীন অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখ আছে। অপূর্ব দাশগুপ্তের বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায় গ্রন্থে বলা হয়েছে তিনি অনুশীলন সমিতি করতেন। এ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বঙ্গীয় সরকারের সচিবালয়ে মি. হুইলারের স্টেনোগ্রাফারের দায়িত্ব পালনকালেই অনুশীলন সমিতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। ১৯০৭ সালে তিনি দার্জিলিং-এ অনুশীলন সমিতির একটি শাখাও খুলেছিলেন। অরবিন্দ-ভ্রাতা বারীন্দ্র ঘোষের সাংগঠনিক তৎপরতা থাকলেও তিনি প্রচ- অহংকারী ছিলেন। অপূর্ব দাশগুপ্ত তাঁর বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায় গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন,
‘সশস্ত্র বিপ্লব যে সমাসন্ন এই ভ্রান্তি ছড়াতে তিনি (বারীন্দ্র ঘোষ) ছল-চাতুরির আশ্রয় নিতেন। নিজ এবং অপর বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির নেতৃত্বের উপর তাঁর অসহিষ্ণুতা ছিল। যতীন্দ্রনাথ কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিলেন যে বারীনের সঙ্গে কাজ করা যাবে না। এদিকে ১৯০৬ সালে থেকে নরেনের সঙ্গেও বারীনের দূরত্ব বাড়ছিল। যতীন্দ্রনাথকে ঘিরে এ সময়ে কলকাতায় একটি বিপ্লবী গোষ্ঠী দানা বাঁধে। যতীন্দ্রনাথের অনুগামীরা বেশীরভাগই যুগান্তর পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। এ বিপ্লবী মানুষটির চরিত্রে তেজস্বিতা যেমন ছিল তেমনি সহযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম স্নেহ ও সহানুভূতি। বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর প্রধান মানুষটিকে সেকালে ‘দাদা’ ডাকবার চল ছিল। অনেক ‘দাদা’ই মোহিনীশক্তির অধিকারী বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন। সত্যিকারের মোহিনীশক্তি, নরেনের মতে, ছিল একমাত্র তাঁর যতীনদার মধ্যেই। নরেনের মতে, যতীনদা যুদ্ধবাজ মানুষ ছিলেন না। লোক দেখানো নায়কোচিত ভাবও তাঁর চরিত্রে দেখা যায় নি। তিনি ছিলেন দয়ালু ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ। যতীনদার মধ্যে বলিষ্ঠতা ছিল, আপোসহীনতাও ছিল; তা বলে তিনি পরমত-অসহিষ্ণু ছিলেন না-কারো প্রতিই তিনি অযথা বিদ্বেষ পোষণ করতেন না।’১৮
নরেন্দ্রনাথ (এম.এন.রায়) জেল থেকে মুক্ত হয়ে তীর্থ ভ্রমণ করেন, সন্ন্যাস জীবন বেছে নেয়ার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা প্রয়োজন। তিনি এও উপলব্ধি করলেন, দু’একটি গুপ্ত রাজনৈতিক হত্যা কিংবা বিচ্ছিন্ন কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হবে না। বহুধা-বিভক্ত এবং হতোদ্যম বিপ্লবী দল-উপদলগুলোকে সংগঠিত করে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলতে হবে। এজন্য একজন সর্বাধিনায়কের প্রয়োজন অনুভব করলেন তিনি। এ জন্য তিনি অরবিন্দের সঙ্গে দেখাও করেন। অরবিন্দ তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ না-করে তাঁকে ফিরিয়ে দেন। নরেন্দ্রনাথ তখুনি ঠিক করেন বাঘা যতীনকে সামনে রেখেই তাঁকে এই নতুন কাজে অগ্রসর হতে হবে। হাওড়ার ব্রিটিশরাজ উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের মামলায় অভিযুক্ত বাঘা যতীন কারাবাসের সময় শেষ কয়েকটি মাস নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে একই সেলে ছিলেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে নরেন্দ্রনাথ বাঘা যতীনকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বড় রকমের একটি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টা করেন।
কিন্তু ততোদিনে যাঁরা বিপ্লববাদের অগ্রজপ্রণেতা, তাঁদের অনেকেই এ পথ ত্যাগ করে অন্য পথে চলতে শুরু করেন। ১৯১০ সালে এপ্রিল মাসে শ্রী অরবিন্দ আধ্যাত্ম সাধনায় ব্রতী হয়ে পন্ডিচেরী চলে যান। সন্ধ্যা পত্রিকার প্রখ্যাত সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মহাশয়ও ১৯০৭ সালে বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। বক্তৃতা করছেন বড়লাট লর্ড কার্জন। হুট করেই তিনি ভারতবাসীকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলে ভর্ৎসনা করলেন। বঙ্গভঙ্গের অপচেষ্টা করে ইতোমধ্যেই তিনি গোটা ভারতবাসীর কাছে চোখের বিষে পরিণত হয়েছেন। এ অবস্থায় তিনি ভারতবাসীকে মিথ্যাবাদী বলে ফেললেন। দেশের সব নেতার মধ্যে এ বক্তৃতা দারুণ এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুহূর্তেই যেন এক অগ্নিরূপ পেয়ে বসে নেতাদের মধ্যে। এর জবাব দেয়ার জন্যে উপায় খুঁজতে থাকেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিরাও কলম-হাতে কার্জনের কথার জবাব দিতে থাকেন। কিন্তু যতীন্দ্রনাথের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে অন্যরকম। তিনি চরমভাবে এর প্রতিশোধ নিতে চান। ভারতমাতাকে একজন ইংরেজ মিথ্যাবাদী বলবে আর তা শুধু প্রতিবাদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখার ব্যক্তি তিনি নন। তিনি তাঁর দু’শিষ্য শ্রীশ দাস ও যতীশ মজুমদারকে রিভলভার দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন কার্জনকে হত্যা করার জন্য। কার্জন তখন দেশের মহাশত্রুতে পরিণত হয়েছেন। গোটা দেশের লোক তাঁর উপর অসন্তোষ।
শ্রীশ দাস ও যতীশ প্রথমে সিমলায় তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করা হয় চট্টগ্রামে। দ্বিতীয়বারও ব্যর্থ হয়। কার্জন বেঁচে যায়। কিন্তু কার্জনকে হত্যার এ চেষ্টা অন্যান্য বিপ্লবীদের মনে দুর্বার দুর্জয় এক সাহসের জন্ম দেয়। বিপ্লবীদের এগিয়ে যাবার পথে এটি এক নতুন প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।
১৯০৫ সালে অক্টোবর মাসে গোটা ভারতবর্ষে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন জাগরণের প্রবল ঢেউ তোলে। এ আন্দোলনের সময়ে অরবিন্দের অনুমতি নিয়ে যতীন, ইন্দ্রনাথ নন্দী, নিখিলেশ্বর রায় মৌল্লিক, কার্তিক দত্ত, প্রভাস দে, অন্নদা কবিরাজ, পবিত্র দত্ত বিপ্লবীরা ‘ছাত্রভা-ার’ নামে একটা দোকান চালু করেন। এ দোকানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুন্সেফ অবিনাশ চক্রবর্তী একাই কয়েক লাখ টাকা দেন। কয়েক কিস্তিতে এই দোকানে স্বদেশী কাপড়-বাসন, দেশাত্মবোধক বইপত্র ইত্যাদি বিক্রির ব্যবস্থা করা হয় এবং যারা বিদেশী পণ্য, বিদেশী শাসন ও বিদেশী শিক্ষা ব্যবস্থা বর্জন করে আন্দোলনে যুক্ত হন, তাঁদের ছাত্রভাণ্ডারের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হতো। ছাত্রভাণ্ডারের টাকাতে ‘ছাত্রভাণ্ডার মেস্’ নামে কয়েকটি মেস্ চালু করা হয়। এসব মেস্ ছিল বিপ্লবীদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। কোনো কোনো মেস্ ছিল বিপ্লবীদের আলাপ-আলোচনার গোপল জায়গা। বিশেষ করে অরবিন্দের মেসোমশাই কৃষ্ণকুমার মিত্রের কলেজ স্কোয়ারের বাড়ির নীচের তলায় মেস্ ছিল বিপ্লবীদের আলোচনার প্রধান জায়গা।
ছাত্রভাণ্ডারের টাকাতেই এক পর্যায়ে ছাপা হতো যুগান্তর পত্রিকা। নিখিলেশ্বর তাঁর সুমতি প্রেস থেকে পত্রিকাটি ছাপতেন। বারীণ ঘোষ পত্রিকাটির দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন বাঘা যতীনের অনুগত সহকারী কিরণচন্দ্র মুখার্জী ও অন্যান্য শিষ্যর উপর।
বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বয়ং যুগান্তর পত্রিকা বিলি করার দায়িত্ব চেয়ে পত্রিকার সম্পাদককে একটা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, যতীন্দ্রনাথ তাঁকে ভালোভাবে চেনেন। দরকার মনে হলে যতীনের কাছ থেকে যেন জেনে নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চিঠিটি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
যতীনের কর্মধারা এতো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে দেশের কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী এ কর্মধারার সাথে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তাঁরা অনুধাবন করেছিলেন বাঘা যতীন গৃহীত কর্মধারার মাধ্যমেই ভারতের মুক্তি সম্ভব।
‘ছাত্রভাণ্ডার’-এর প্রেরণায় তখন বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। বেঙ্গল স্টোর্স, ভারতভাণ্ডার, শিয়ালদার আর্যনিবাস হোটেল উল্লেখযোগ্য। কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল্সও একই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেটি বাঘা যতীনের পরামর্শে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।
মজঃফরপুর ঘটনার পর মুরারীপুকুর বাগানবাড়িসহ বিপ্লবীরা যেসব জায়গায় থাকতেন বিশেষ করে ১৩৪ নং হ্যারিসন রোড, ২৩ নং স্কটিস লেন, ১৫ গোপীমোহন দত্তের লেন, ৪৮ গ্রে স্ট্রীট, ৩৮/৪ রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রীট প্রভৃতি স্থানে পুলিশ তল্লাশি চালায়। সেসব জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণ বোমা, কার্তুজ, রিভলবার, বোমা প্রস্তুত করার সরঞ্জাম ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুলিশ হস্তগত করে। গ্রেফতার হন বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রভূষণ রায়, উল্লাসকর রায়, শিশিরকুমার ঘোষ, নলিনীকান্ত গুপ্ত, হেমচন্দ্র দাস, অবিনাশ ভট্টাচার্য্য, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, বিভূতি বসু প্রমুখ। বারীন্দ্র গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশের কাছে সমস্ত তথ্য ও বিপ্লবী কর্ম-পরিকল্পনা সম্পর্কে বলে দেন। বারীন্দ্রের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অরবিন্দ ঘোষকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই বিপ্লব সমিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বাঘা যতীন ভাগ্যক্রমে পুলিশী গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। কারণ সেদিন তিনি মুরারীপুকুর বাগানবাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না, মামাতো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে সে রাতে তিনি অন্যত্র অবস্থান করেছিলেন।
পরে আরো অনেক বিপ্লবী গ্রেফতার হন। বিশেষ করে শ্রীরামপুরের নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী রাজসাক্ষী হয়ে সব ঘটনা বলে দেয়ার কারণে এসব গ্রেফতার সম্ভব হয়। কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিশ্বাসঘাতক নরেন্দ্রনাথকে দেশদ্রোহী উপাধি দিয়ে জেল হাসপাতালে গুলি করে হত্যা করেন। কানাইলাল দত্তের বাড়ি চন্দননগরে আর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাড়ি মেদিনীপুরে। নরেন্দ্রনাথকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে এ দু’জনকে ফাঁসি দেয়া হয়।
সামসুল আলমের তৎপরতায় বিপ্লবীরা পদে পদে বিড়ম্বনার মুখে পড়ে। যতীন্দ্রনাথ তাকে পৃথিবী থেকে চিরতরের জন্য সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যে দায়িত্ব পড়ে বীরেন্দ্রনাথের ওপর। ১৯১০ সালে ৯ জানুয়ারী (২৪ জানুয়ারী?) সামসুল আলম কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হ্যারিংটনের আদালত থেকে বিকেল পাঁচটায় সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন, এসময় বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত তাকে রিভলবার দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। এ ঘটনায় বীরেন্দ্র গ্রেপ্তার হয়ে প্রথমে পুলিশকে বিপ্লবী কর্মকান্ড সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরের দিন পুলিশ বীরেন্দ্রনাথের ভাই ধীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ৬১ নং মির্জাপুর স্ট্রীটের বাড়িতে খানাতল্লাস করে এবং প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র পায়। পুলিশের অসহনীয় অত্যাচারে একপর্যায়ে তিনি পুলিশকে জানান, বাঘা যতীন তাঁকে সামসুল আলমকে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছেন। বাঘা যতীনের নির্দেশেই তিনি সামসুল আলমকে হত্যা করেছেন। এই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই ‘২৭ শে জানুয়ারি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে যতীন্দ্রনাথকে গ্রেফতার করিয়া পুলিশের গুপ্তচর বিভাগ তাঁহার নিকট হইতে একটি স্বীকারোক্তি আদায় করিবার বিশেষ চেষ্টা করে এবং তজ্জন্য শারীরিক যন্ত্রণা ও আদর-আপ্যায়ন কোন কিছুরই ত্রুটি হয় নাই। যতীন্দ্রনাথকে লালবাজারে চারিদিন না খাইতে দিয়া লক-আপে আটকাইয়া রাখা হয় এবং গুপ্তচরবিভাগের দারোগা কুমুদবন্ধু সেন স্বীকারোক্তি না করিলে তাহাকে চির নির্ব্বাসন করা হইবে বলিয়া ভয় দেখায়।’১৯ বাঘা যতীনকে গ্রেফতার করার সময় তাঁর মামাদের বাড়িও তল্লাশি করা হয়। একই মামলায় বাঘা যতীনের মামা অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় ও ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং মুহুরী নিবারণ মজুমদারকে গ্রেফতার করা হয়।। এই মামলায় সুরেশচন্দ্র মজুমদারকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিয়োগ আনা হয়, তাঁর রিভলবার দিয়েই সামসুল আলমকে হত্যা করা হয়েছে। বীরেন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এ অভিযোগ দাখিল করা হয়। সামসুল আলমকে হত্যার অপরাধে বীরেন্দ্রনাথের ফাঁসি হয় ১৯১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি।
বাঘা যতীনকে গ্রেফতারের পর তাঁর কাছ থেকে বিপ্লবী কর্মকা- সম্পর্কে তথ্য উৎঘাটনের চেষ্টা করে পুলিশবাহিনী। এজন্য তারা সব ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়। কখনো অসহনীয় শারীরিক অত্যাচার আবার কখনো আদর-আপ্যায়ন সবকিছুই করে তারা। কিন্তু বাঘা যতীনের মুখ থেকে একটি তথ্যও বের করতে পারে না। শেষে রয়েড স্ট্রীটে (পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কার্যালয় ছিল) একজন সার্জেন্ট এসে বাঘা যতীনকে লোভনীয় বিভিন্ন প্রস্তাব দেন। দু’জন একটি শ্বেতপাথরের টেবিলের দু’পাশে বসে কথা বলছিলেন। হঠাৎ সার্জেন্ট বাঘা যতীনকে বললো, ‘যদি তুমি সমস্ত কথা বলিয়া দাও তাহা হইলে ভালো ভালো স্ত্রীলোক পাইবে। এই কথা শুনিয়া যতীন্দ্রনাথ ‘চুপ করো রাস্কেল’ (Shut up you rascal) বলিয়া ভীষণ চিৎকার পূর্ব্বক সজোরে টেবিলটির উপর এরূপ একটা ঘুঁসি মারেন যে শ্বেতপাথরের মোটা টেবিলটি ভাঙিয়া চৌচির হইয়া যায়। যতীন্দ্রনাথের চীৎকার ও রাগতঃ চক্ষু দেখিয়া সার্জ্জেন্টটি ভয়ে পলাইয়া যায় এবং বাহির হইতে বহু ব্যক্তি তাঁহার চীৎকার শুনিয়া ব্যাপার কি দেখিতে অঅসে। তাঁহার অগ্নি-দীপ্ত চক্ষু দেখিয়া তখন কেহ তাহার সহিত কথা বলিতে সাহস করে নাই।’ ২০
লালবাজার লক-আপে চারদিন থাকার পর বাঘা যতীন, তাঁর মামা ললিতকুমার ও মুহুরি নিবারণকে পুলিশের গাড়িতে হাওড়া জেলে পাঠানো হয়।
১৯১০ সালে ‘হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা’ নামক একটি রাজনৈতিক মামলা শুরু হয়। এ মামলায় প্রায় পঞ্চাশজন বিপ্লবী অভিযুক্ত ছিলেন। এ মামলায় ললিত চক্রবর্তী ও যতীন্দ্রনাথ হাজরা রাজসাক্ষী হয়েছিল। তারা বাঘা যতীনের বিরুদ্ধে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের কথা বিচারপতিকে জানায়। কিন্তু আদালত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি। হাইকোর্টের সেসনে বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাঘা যতীন ও অন্যান্য বিপ্লবী প্রায় এক বছর জেলহাজতে ছিলেন। ১৯১১ সালে এপ্রিল মাসে হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা শেষ হয় এবং সব বিপ্লবী মুক্তিলাভ করেন।
১৯১১ সালে বাঘা যতীন মুক্তি পেয়ে বিপ্লবী কর্মকান্ড কৌশল পরিবর্তনের জন্য তিনি কন্ট্রাক্টরি করেন। কন্ট্রাক্টরির কাজ সামনে রেখে তিনি ভেতওে বিপ্লবীবিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। কন্ট্রাক্টরি কাজ পাওয়াটা তাঁর জন্য সহজসাধ্য ছিল না। ‘জেলাবোর্ডের কর্ত্তৃপক্ষগণ যতীন্দ্রনাথ সরকার বিদ্বেষী বলিয়া তাঁহাকে কোন কার্য্যর কন্ট্রাক্ট দিতে তাহারা প্রথমে আপত্তি করেন, কিন্তু তিনি দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন বলিয়া বহু কষ্টে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশংসা পত্র লইয়া মাত্র নদীয়, মুর্শিদাবাদ ও যশোহর এই তিনটি জেলাবোর্ডের কার্য্য করিবার অনুমতি পান।’২১
সংসারে ব্যয় নির্বাহের জন্য কন্ট্রাকটারী করলেও এ সময় তিনি বিভিন্ন এলাকার বিপ্লবীদের সঙ্গে আরো গভীর যোগাযোগ গড়ে তোলেন এবং এসব এলাকায় যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে তাদের ব্যাপকভাবে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে-সময় পুলিশের গুপ্তচর বাহিনীর কড়া নজর ছিল তাঁর ওপর। তাঁর গতিবিধি সবসময় লক্ষ্য রাখতো গুপ্তচর বাহিনী। যতীন সেই গুপ্তচর বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্নভাবে নাস্তানবুদ করে ছাড়তেন। পরে বাধ্য হয়ে গুপ্তচর বাহিনীর সদস্যরা যতীনের সাহায্য নিয়ে নিজেরা বিপদমুক্ত থাকতো। অখণ্ড ভারতে বাঘা যতীনের নাম উচ্চারণ করলেই যেখানে নিশ্চিত বিপদ, সেখানে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলা কী ভীষণ রকম কঠিন ছিল তা সহজেই অনুমেয়। কারণ বাঘা যতীন তখন তাদের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। বাঘা যতীন-আতঙ্কে তখন তারা প্রতিমুহূর্ত সন্ত্রস্ত, তটস্থ। ব্রিটিশদের সতর্ক-চোখ তখন চতুর্দিকে সজাগ। সে-কারণে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী যদি বুঝতে পারতো কেউ বাঘা যতীনের নাম উচ্চারণ করছে, কিংবা কারো সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে তাহলে এর জন্য তাকে কঠিন মূল্য দিতে হতো।
বাঘা যতীনের মুক্তি সরকারের জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সরকার ‘কিছুদিনের মধ্যে কয়েকজন জাঠ সৈন্যকে সামরিক রীতিতে ফাঁসি’ দেয়। পুরো ১০ নং জাঠ রেজিমেন্টের সব সৈন্যকে খিদিরপুর ডক থেকে করাচী নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই রেজিমেন্টের সব সৈন্য বাঘা যতীনের আদর্শকে গ্রহণ করেছে-এরকম খবর ছিল সরকারের কাছে। ফলে তারা আর ঝুঁকি নিতে চায় নি।
বাঘা যতীন জেল থেকে বের হয়ে আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করেন। তিনি সহকর্মী কুষ্টিয়ার যদুবয়রার সন্তান অতুলকৃষ্ণ ঘোষ (১৮৯০-১৯৬৬)-এর নিকট দায়িত্ব অর্পণ করে সোজা যশোরে চলে আসেন। শুরু করেন ঠিকাদারী ব্যবসা। এ-ব্যবসার আড়ালেই তিনি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তখন ব্রিটিশের শুত্রু জার্মানী। জার্মানদের সাহায্যে সারা দেশের বিপ্লবীরা তখন আন্দোলনে অগ্নিরূপ দিতে চেষ্টা করছিলেন। বাঘা যতীন এঁদের সাথে যুক্ত হন এবং ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯১৫ সালের মার্চ মাসে বার্লিন কমিটির পক্ষ থেকে জিতেন লাহিড়ী কলকাতায় এসে পৌঁছেন। তাঁর কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল যে জার্মানিরা ভারতীয় বিপ্লবীদের অস্ত্র ও অর্থ সাহার্য দিতে আগ্রহী। এই সাহায্য পেতে গেলে যোগাযোগ করতে হবে বাটাভিয়ায় (বর্তমানে জাকার্তা) জার্মানির কনসুলের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হলো যতীন কাপ্তিপোদায় গুপ্তস্থান থেকে দল পরিচালনা করবেন আর নরেন্দ্রনাথ বাটাভিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। বিদেশ থেকে নরেন কলকাতায় অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রমজীবী সমবায় সমিতি এবং হরিকুমার চক্রবর্তীর হ্যারি অ্যান্ড সন্সের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। বালেশ্বরেও হ্যারি অ্যান্ড সন্সের একটি শাখা খোলা হয়েছিল।
‘হ্যারি অ্যান্ড সন্সের প্রতিনিধি সেজে ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে নরেন্দ্রনাথ চার্লস এ. মার্টিন নাম নিয়ে বাটাভিয়ায় রওনা হয়ে গেলেন। বাটাভিয়ায় পৌঁছে জার্মান কনসালের সঙ্গে দেখা করে তিনি জানতে পারলেন যে ভারতীয় বিপ্লবীদের সাহায্যের্থে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে একটি জাহাজ করাচীর পথে রওনা হয়ে গেছে। নরেন সাংহাইতে গিয়ে সেখানকার জার্মান কনসালকে বোঝালেন যে করাচী নয়, অস্ত্র পৌঁছে দিতে হবে বাংলায়। নরেনের প্রস্তাব গৃহীত হলো। কিন্তু সাংহাই থেকে ফেরার পথে নরেন ব্রিটিশ পুলিশের নজরে পড়ে যান। গ্রেপ্তার এড়াতে মাঝ সমুদ্রে লাইফ বোটে চড়ে তাঁকে জাহাজ পাল্টাতে হলো। জার্মান কনসাল ও নরেনের আলোচনা থেকে এস. এস. মেভারিক নামে একটি জাহাজ সুন্দরবন অঞ্চলের রায়মঙ্গলে ৩০ হাজার রাইফেল, প্রতিটি রাইফেলের সঙ্গে চার শ’ রাউন্ড গোলা-বারুদ এবং দু’ লক্ষ টাকা পৌঁছে দেবে। সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে নরেন্দ্রনাথ কলকাতার হ্যারি অ্যান্ড সন্সকে টেলিগ্রাম করে জানালেন ‘Business was helpful.’ বাটাভিয়া থেকে নরেন্দ্রনাথ দুবারে মোট ১৫০০০ হাজার টাকা কলকাতাতে পাঠান। তিনি নিজে ১৪ই জুন কিছু টাকা এবং এক ব্যাগ স্বর্ণমোহর নিয়ে নিরাপদে দেশে ফেরেন।
কথা ছিল মেভারিক জাহাজ রায়মঙ্গলে রাত্রিতে এসে পৌঁছবে। জাহাজের একটি মাস্তুলে জ্বলবে সারি সারি আলো। এদিকে রায়মঙ্গলে উপস্থিত ড. যতীন্দ্র ঘোষাল, অশ্বিনীকুমার রায়, হরিকুমার চক্রবর্তী প্রমুখ সবুজ আলো দোলাবেন। এই আলোর সংকেত দেখে জাহাজ এসে তীরে ভিড়বে। অস্ত্র নিরাপদে পৌঁছলে পূর্ববঙ্গে অভ্যুত্থানের জন্য একভাগ যাবে নোয়াখালিতে। সেখানে দায়িত্বে থাকবেন মনোরঞ্জন গুপ্ত। কলকাতা ও প্রেসিডেন্সি ডিভিসনের জন্য আরেকভাগ অস্ত্র বরাদ্দ হবে। নরেন্দ্রনাথ ও বিপিন গাঙ্গুলি সেগুলির দায়িত্ব নেবেন। কলকাতায় দেশীয় সৈন্যদের নিয়ে প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ামের অস্ত্রাগার লুট করা হবে এবং কলকাতার দখল কায়েম করা হবে। অস্ত্রের তৃতীয় ভাগটি যাবে বালেশ্বরে, তার দায়িত্ব নেবেন স্বয়ং যতীন্দ্রনাথ। মেভারিক জাহাজে যে সমস্ত জার্মান অফিসারেরা আসবেন তাঁরা পূর্ববঙ্গে থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেবেন। অন্যদিকে বার্লিন কমিটি ও গদর দলের সহায়তায় হেনরি এস. নামে অন্য একটি জাহাজে আরো অস্ত্র-শস্ত্র আনবার ব্যবস্থা হলো। অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের জন্য খাকি পোশাক পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেলো। কিন্তু এত পরিকল্পনা, পরিশ্রম, আত্মত্যাগ-সবই ব্যর্থ হলো। মেভারিক জাহাজে অস্ত্র পৌঁছে দেবার কথা ছিল এনি লার্সেন নামে যে জাহাজটির, সেটি আমেরিকা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। ফলে মেভারিকের সঙ্গে এনি লার্সেনের যোগাযোগ হলো না। এদিকে মেভারিক জাহাজটিতে ডাচ পুলিশ খানাতল্লাশি চালায়। সেখানে অস্ত্র পাওয়া গেলো না ঠিকই, কিন্তু ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হয়ে গেলো।২২
এরকম সময়ে একটি ঘটনা ঘটে। ফরিদপুর ষড়যন্ত্র মামলায় বিপ্লবীরা সব মুক্তি পাওয়ায় পুলিশ প্রশাসন খুশি হতে পারেনি। পুলিশ প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্নভাবে বিপ্লবী ও তাঁর অভিভাবকদের অতিষ্ঠ করে তোলে। এ রকম অস্থির এক সময়ে বাঘা যতীন পূর্ণচন্দ্র দাসের কাছে অতি বিশ্বস্ত চারজন কর্মী চান, যাঁরা হবে তাঁর ভয়াবহ দুঃসময়ের সঙ্গী। পূর্ণচন্দ্র দাস পাঠালেন জ্যোতিষ, চিত্তপ্রিয়, নীরেন্দ্র এবং মনোরঞ্জন অকুতোভয় এই চার বিপ্লবীকে। এঁরা এসেই বাঘা যতীনের নিরাপত্তা ও নির্দেশ পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইংরেজ শাসনের শক্ত ঘাঁটি কলকাতা শহরে। বিপ্লব ঘটানোর আগে এটিকে দুর্বল করে দেয়া এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য কলকাতায় বাঘা যতীন কয়েকটি ঘটনা ঘটান। ঘটনাগুলো হলো: ১৯১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী গার্ডেনরীচ ডাকাতি, ২২ফেব্রুয়ারী বেলেঘাটা ডাকাতি, ২৪ ফেব্রুয়ারী পাথুরীঘাটায় যতীন্দ্রনাথের গুপ্তাবাসে গুপ্তচর নীরদ হালদারকে গুলি করে হত্যা, ২৮ ফেব্রুয়ারী হেদোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সুরেশ মুখার্জির হত্যাকা- সংঘটিত। কলকাতার মানুষ এসব ঘটনায় জয়োল্লাস করেছে। ইংরেজ ও তার অনুচর ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠে। এ রকম একটি পরিবেশই বাঘা যতীনেরা তৈরী করতে চেয়েছিলেন।
কলকাতায় ইংরেজদের ভয়াবহ আতঙ্কে ফেলে বাঘা যতীন চার সঙ্গী নিয়ে অধ্যাপক প্রতুল সেনের বাগনারের বাড়ি থেকে বালেশ্বরের দিকে রওয়ানা দেন। সময়টা তখন মার্চের শেষ দিকে। বাঘা যতীন চার সঙ্গী নিয়ে গোপাল ডিহার আস্তানায় ওঠেন। গোপালের আসল নাম শ্রী নলিনী কর। বাঘা যতীনের একান্ত ভক্ত মণি চক্রবর্তী গোপালের নামে নিজের কিছু জমি দান করেন। এ জমিতেই গড়ে তোলা হয় আস্তানা। এই আস্তানাতেই বাঘা যতীনের গোপন বাস ছিল। চিত্ত, নীরেন, মনোরঞ্জন ও জ্যোতিষ তালডিহায় আরো একটি গোপন আস্তানা গড়ে তোলেন। সেখানে থাকতেন নীরেন ও জ্যোতিষ। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর গভীর উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করেন অদম্য এই স্বাধীনতাকামী মানুষটি। তখন দুঃসহ কঠিন এক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছে তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত। কিন্তু তখনো তিনি জানেন না তাঁর সব পরিকল্পনার জাল ছিঁড়ে গেছে, ফাঁস হয়ে গেছে ম্যাভেরিকের খবর। ইংরেজবাহিনী তাঁর সব পরিকল্পনা জানার পর দ্রুত আক্রমণের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ৭ সেপ্টেম্বর মি. টেগার্ট, মি. রাদারফোর্ড ও মি. কিলভি বিশাল বাহিনী নিয়ে গোপালডিহায় আক্রমণ চালায়। কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর দুর্ভাগ্য, গোপনে বিশাল বাহিনী নিয়ে অভিযান চালিয়েও বাঘা যতীন ও তাঁর সঙ্গীদের তারা গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। গোয়েন্দারা ছায়ার মতো বাঘা যতীনের পিছু লেগে থাকে। কিন্তু তাঁকে কিছুতেই ধরতে পারে না। এক পর্যায়ে ডেনহ্যাম বড় লাটহার্ডিংস-এর কাছে বাঘা যতীন সম্পর্কে লেখেন, “Jatin Mukherjee, Perhaps the boldest and the most actively dangerous of all Bengal revolutionaries.” আর তাই বুঝি বালেশ্বর যুদ্ধের খবর পেয়ে বড়লাট হার্ডিঞ্জ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মন্তব্য করেন, “Nothing can be more Praiseworthy than the action of Kilby and Sergeant Rutheford.”২৩
বাঘা যতীন নিজেও জানতেন গোয়েন্দারা তাঁকে হন্যে হযে খুঁজছে। খোঁজ পেলেই ব্রিটিশ বাহিনী ঈগল পাখির মতো তাঁকে ছোঁ মেরে ধরবে। সেকারণে তিনিও ইংরেজ সাহেবদের গতিবিধি ৪ সেপ্টেম্বর থেকে লক্ষ্য করছিলেন। তাদের আচরণে অন্য গন্ধ পেয়ে তিনি ৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে গোপালডিহা ত্যাগ করে তালডিহি চলে যান। আবার ৭ সেপ্টেম্বরে ফিরে আসেন মহুলডিহায় জঙ্গলের মধ্যে মণি চক্রবর্তীর বাড়িতে। তখন তাঁর কাছে কোনো টাকা ছিল না। মণি চক্রবর্তীর কাছে তখন মোট টাকাই ছিল পঞ্চাশটি। তিনি পঞ্চাশ টাকাই বাঘা যতীনের হাতে তুলে দেন। এরপর মণি চক্রবর্তী তাঁকে আবার গভীর অরণ্যের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। বাঘা যতীন তখন তাঁকে নিজের সঙ্কল্পের কথা জানিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, জনারণ্যের মধ্য দিয়েই আমার পথ, এবার সে পথ দিয়েই যাব।’ ৮সেপ্টেম্বর তিনি কাটান নীলগিরির গোপন অঞ্চলে নিরালায়। ৯ সেপ্টেম্বর ভোর হওয়ার অনেক আগেই চার সঙ্গীকে নিয়ে রওয়ানা দেন বালেশ্বরের দিকে। ম্যাভিরিক জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার জন্য। কিন্তু পথে অবরোধের শিকার হলে রাজ মোহান্তিকে হত্যা করে অবরোধ মুক্ত করেন। সঙ্গীদেরসহ তিনি ময়ুর-ভঞ্জের বন এলাকার কাপ্তিপোদায় পৌঁছান। এ-খবর সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের কর্তাদের কাছে পৌঁছে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের ডিআইজি জি. ডি. ডেনহাম, কলকাতার ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ চার্লস টেগার্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ড অব পুলিশ এল. এন. বার্ড বালেশ্বরে যায়, ১৯১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এরপর কোনদিকে বা কোথায় পুলিশবাহিনী যাত্রা করবে, কোথায় বিপ্লবীদের অবস্থান, অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তারা। বালেশ্বরে ‘ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম’ নামে একটা দোকান ছিল। এই দোকানের সাথে বিপ্লবীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পুলিশ তা জানতে পেরে দোকানটি তল্লাশি চালায়। তল্লাশি করে পুলিশ একটুকরো কাগজ পায়, যাতে লেখা ছিল ‘কাপ্তিপোদা’। এটি একটি জায়গার নাম। পুলিশের কাছে ‘কাপ্তিপোদা’ নামটি এক বিরাট আবিষ্কার ছিল। এরপর কাপ্তিপোদার দিকে যাত্রা করে গোয়েন্দা কর্তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বালেশ্বর শহরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর.জি.কিলভি, চন্দ্রীপুরের পুলিশ বিভাগের সার্জেন্ট রাদাসবোর্ড এবং বিহার ও উড়িষ্যার ডিআইজি ইসি রাইল্যান্ড।
মি. টেগার্টের অনুরোধে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। তারা জানতো, বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়েও বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবীকে ধরা সহজ নয়। সে কারণে তারা বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। চতুর্দিকে তাদের লোকজন ছড়িয়ে দেয়। গ্রামে-গঞ্জে বাঘা যতীনদের নামে অপপ্রচার চালায় ‘একদল ডাকাত এই পথ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা যেন তাদের পাকড়াও করবার জন্য প্রস্তুত থাকে।’ সহজ-সরল সাধারণ গ্রামবাসীরা প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের তৈরী বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে বাঘা যতীন ও তাঁর সহকর্মীদের কাপ্তিপোদায় পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। জনতা তাঁদের ডাকাত মনে করে পেছনে পেছনে চেঁচাতে লাগলো। গ্রামের পর গ্রাম থেকে লোকজন ছুটে এসে জনতার সারিকে ভারী করে তুললো।
‘কামতানা গ্রামের কাছে এসে চিত্তপ্রিয় চেঁচিয়ে উঠলেন, বললেন, ‘আর যদি একটুও এগোও তোমরা, এই দেখ পিস্তল; আমরা গুলি করতে বাধ্য হবো। নিজেদের ভালো চাও তো ফিরে যাও এখুনি।’ কিন্তু বাবুরা যে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি ছুঁড়বেন, জনতা মোটেই তা আশা করেনি। তার ওপর ‘ডাকাত’ ধরার নেশা, বহু হাজার টাকার স্বপ্ন!-তাই উত্তরোত্তর ভিড় ঠেলে সাহসী গ্রামবাসীরা অগ্রসর হতে লাগলো। চিত্তপ্রিয়ের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। রঙ্গরাউতকে লক্ষ্য করে তিনি দুটো ফাঁকা আওয়াজ করলেন। তখন বহু টাকার স্বপ্নে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সানাই সাহু আর রঙ্গ রাউত। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে তারা যেই যতীন্দ্রনাথের পথ আগলে দাঁড়িয়েছে, আবার গর্জে উঠলো পিস্তল। তখনো বিপ্লবীরা তাদের গুলি না করে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। কারণ তাঁরা গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষ। ব্রিটিশরা তাদের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহার করছে। সাধারণ মানুষ প্রকৃত সত্যটা বুঝতে পারছে না। কতোটা গভীর দেশপ্রেম থাকলে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও দেশের মানুষকে-যারা এখন তাঁদের মৃত্যুও কারণ হয়ে উঠেছে, তাদেরকে এমন করে ভাবতে পারা যায়।..যে দেশবাসীর কল্যাণের সাধনায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছেন সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তাঁকেই আজ স্বদেশের এক অখ্যাত পল্লী-অঞ্চলের শিষ্যদের নিয়ে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে, সেই দেশবাসীরাই তাঁকে তাড়া করে নিয়ে চলেছে ‘ডাকাত’ আখ্যায় অভিহিত করে? অস্ত্র সঙ্গে আছে, অথচ অশিক্ষিত জনতার ওপর সে অস্ত্রের প্রয়োগেও আপত্তি যতীন্দ্রনাথের। আত্মরক্ষার জন্য একটা-দুটো ফাঁকা আওয়াজ করা হচ্ছে বড় জোর- আর প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে এদের অত্যাচারে। নীরেনের চোখ ফেটে জল পড়বার উপক্রম। ঈশ্বর, ওরা জানে না কী ওরা করছে! ওদের ক্ষমা কর।’২৪
এই উক্তির ভেতর দিয়ে বিপ্লবীদের দেশের মানুষের প্রতি অবিশ্বাস্য যে দরদ, তা ফুটে বিপ্লবী সাধনার অপ্রত্যাশিত এই অগ্নি-পরীক্ষার দুর্বিষহ সময়েও। অথচ এই সাধারণ মানুষেরাই ব্রিটিশ শাসকের অপকৌশলে ও ছলে তখন যতীন্দ্রনাথের মতো মহানায়কের এবং তাঁর চার শিষ্যর মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছিল।
বিপ্লবীরা বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু তাঁদের খুব নিকটে। সহকর্মীরা উদ্বেগে ব্যাকুল হয়ে বারবার বাঘা যতীনকে অনুরোধ করছিলেন তাঁকে নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যেতে। সহকর্মীরা জানতেন, বাঘা যতীনেকে হারানো দেশের পক্ষে এক অপুরণীয় ক্ষতি। কিন্তু তিনি সহকর্মীদের অনুরোধ শোনেন নি।
বরং তখন তিনি বলেছেন, ‘এ কি আমি কখনো করতে পারি? তোমরা কি আমাকে চেনো না।’ গ্রামবাসীর মারমুখি ধাওয়া খেয়ে, দীর্ঘ বুড়িবালাম নদী সাঁতরে পার হয়ে তারপর বিরাট ধানক্ষেত পেরিয়ে ক’দিনের প্রায় অনাহারী বাঘা যতীন তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে চাষাখন্ডের একটা বনের মধ্যে যখন পৌঁছান, তখন নীরেন অসুস্থ। বাঘা যতীন বনের ভেতর ঘুরে-ফিরে একটা টিলা বেছে নেন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য।
ব্রিটিশের বিরাট বাহিনী গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে কাপ্তিপোদার চাষাখন্ডের টিলার কাছাকাছি পৌঁছতেই বাঘা যতীন চার সঙ্গী নিয়ে গুলি ছুঁড়ে জবাব দিতে থাকেন। ব্রিটিশবাহিনী হতভম্ব হয়ে পড়ে। মৃত্যু আর আর্তনাদে দিশেহারা হয়ে পড়ে এই বিশালবাহিনী। কিন্তু যুদ্ধ তারা চালিয়েই যেতে থাকে।
বাঘা যতীন মাত্র চারজন সহকর্মী নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে তিন ঘণ্টা যুদ্ধ করেন। গুলি শেষ হয়ে যায়। মৃত্যুকে প্রায় ছুঁই ছুঁই অবস্থাতেও মহান সেনানায়কের মতো সহযোদ্ধাদের বললেন, ‘গুলি থামাস নে, থামালে চলবে না। নিভে যাবার আগে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা চাই। তোরাও চালা। মুহূর্তে বাহুমূলে ও পেটে গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীন ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, তোরা রইলি। ওরে, তোরা মরবার আগে দেশবাসীকে মুক্তকণ্ঠে বলে যাস-আমরা ডাকাত নই। দেশবাসীকে জানিয়ে যাস আমাদের মহান ব্রতের কথা। নতুন যুগের কর্মীরা এই দৃষ্টান্ত থেকেই খুঁজে পাবে তাদের পাথেয়; দেশ জাগবে এগিয়ে যাবে আমাদেরই পথে।’২৫
বাঘা যতীন যখন ধরা পড়লেন, তখন ব্রিটিশ অফিসাররা তাঁর রণকৌশলে বিস্মিত হন। বিস্ময় প্রকাশ করে ব্রিটিশবাহিনী প্রধান টেগার্ট বলেই ফেললেন, ‘আমরা এতক্ষণ মাত্র পাঁচ জনের সঙ্গে যুদ্ধ করলাম!’ চিত্তপ্রিয় যুদ্ধস্থলেই মারা যান।
গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীনকে বালেশ্বর গভর্নমেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসংখ্য পুলিশ, অশ্বারোহী আর মিলিটারীতে ঘিরে রাখা হয় হাসপাতাল। হাসপাতালে পুলিশের বড় কর্মকতার অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। জনসাধারণ্যের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পুলিশবেষ্টিত হয়ে হাসপাতালে ঢোকেন প্রবীণ বিজ্ঞ সার্জন ডা. খান বাহাদুর রহমান এবং তাঁর সহকারী সার্জন গাঙ্গুলী। সাথে একজন লেডি মহিলা ডাক্তার, দু’জন কম্পাউন্ডার, চারজন অভিজ্ঞ নার্স, তিনজন কুলি ও দু’জন মেথর। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন, বাম হাতের বুড়ো আঙুল ও দু’টি মেটাকার্পাল অস্থি গুঁড়ো হয়ে গেছে; তলপেটে ও নাভিতে বুলেটের ক্ষত। তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত বমি হচ্ছে ঘন ঘন। সহকারী সাজর্ন এ অবস্থা দেখে লিখেছেন, ‘যেন যবনিকা পতনে আর দেরী নেই।’
এ অবস্থায় যতীনকে অপারেশন রুমে নেয়া হয়। তখনো প্রচুর রক্ত তাঁর শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছে। রক্তবমি হচ্ছেই। ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি অস্থির হয়ে উঠলেন। এই মর্মান্তিক চেহারা তিনি নিজেও সহ্য করতে পার ছিলেন না। কিলবি জানতে চাইলেন, কেন এতো রক্তবমি হচ্ছে? খানিক সফট ড্রিংক দিলে কেমন হয়, ডাক্তার?’
কিলবি লেমনেড আনালেন। নিজে হাতে করে যতীনের গলায় অল্প অল্প করে ঢেলে দিলেন। কিন্তু তাতেও রক্তবমি বন্ধ হলো না। তখন কয়েকটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ডাক্তার তাঁকে ড্রিপ স্যালাইনের ব্যবস্থা করেন।
অপারেশনের আগে কিলবি ডাক্তারকে বললেন, যতীনবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখুন আমার কাছে তিনি আর-কিছু বলবেন?’
হ্যাঁ, বলবো, মি, কিলবি!’ বাঘা যতীন নিজেই জবাব দিলেন, ‘আবার বলবো: See that no injustice is done to those boys under the British Raj. Whatever has happened. I am responsible for all that-’২৬
বাঘা যতীনের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করে নিলেন ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি।
গুলির আঘাতে যতীনের ডান হাত তখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে অবশ। বাঘা যতীন মৃদু হাসলেন। তারপরই তিনি অপারেশনের অনুপতিপত্রে টিপসই করে দিলেন।
পরদিন ভোরে তাঁকে দেখতে এলেন চার্লস টেগার্ট। সঙ্গে এলেন ডেনহাম, ব্যর্ড, রাদার্সফোর্ড, মেজর ফ্লিথ। মি. আর.জি. কিলভি আরো আগেই এসে বাঘা যতীনের পাশে অবস্থান করছিলেন। সার্জনের অনুমতি নিয়ে টেগার্ট ও অন্যান্য সাহেবরা বাঘা যতীনের রুমে ঢোকেন। বাঘা যতীন তাঁদের দেখে রসিকতা করে বললেন, ‘Good morning Mr. Tegart..তোমাদের সঙ্গে দেখা হল, ভালই হলো। আমি তো চললাম।’…
এরপরই বাঘা যতীন গম্ভীর হয়ে যান। এর একটু পরই আবার তিনি টেগার্টকে বললেন, ‘আমি চললাম, যারা রইল তারা নিরপরাধ। আমার দোষেই তারা এভাবে ধরা পড়ল। দেখো, এদের ওপর যেন অন্যায় অত্যাচার না হয়।’
টেগার্ট বিচলিত বোধ করলেন। বিনীত স্বরে বললেন, Tell me Mukherjee, What can I do for you? বাঘা যতীন শান্তস্বরে উত্তর দিলেন, No thanks! All’s over, Good bye.২৭
চার্লস টেগার্ট এবং তার সঙ্গী সাহেবরা বের হয়ে যাবার পর পরই বাঘা যতীন নিজেই তাঁর ব্যান্ডেজ, অপারেশনের সেলাই ছিঁড়ে ফেললেন। ফিনকি দিয়ে তীব্রবেগে ছুটে বেরিয়ে এলো রক্তস্রোত। খবর পেয়ে দৌড়ে আসেন ডাক্তার ও নার্স। দ্রুত নতুন করে তাঁর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ দেয়ার চেষ্টা হলো। কিন্তু কোন কাজ হলো না। কিছুক্ষণ পরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। আর তখনি রচিত হলো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহাকাব্য।
খবর পেয়ে আবার ছুটে আসেন চার্লস টেগার্ট। বাঘা যতীনের নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে নিজের মাথার ক্যাপ খুলে মহান এ বিপ্লবীকে গভীর শ্রদ্ধা জানান তিনি।
বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর টেগার্ট কলকাতায় ফিরে গেলে তার কাছে ব্যারিস্টার জে. এন. রায় জিজ্ঞেস করেন, “ব্যাপারটা কি সত্যিই, নাকি সরকারের এ-ও একটা কৌশল?’
টেগার্ট তখন দু’চোখ নীচের দিকে করে অভিভূতকণ্ঠে বলেন, “Unfortunately he is dead.”
ব্যারিস্টার জে. এন. রায় টেগার্টের কথাটি যেন চেপে ধরলেন। বললেন, “Why do you say- Unfortunately?
টেগার্ট শ্রদ্ধাবনত কণ্ঠে বললেন, “I have high regard for him. I have met the bravest Indian, But- I had to perform my duty.”২৮
বাঘা যতীনের মৃত্যু সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটাবিশ্বে। বিপ্লবীরা শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা ভারতবর্ষ।
মহান এই বিপ্লবীর মাত্র ৩৬ বছরের জীবন যখন থেমে গেল মৃত্যুতে, যখন দেশের মানুষ জানলো তিনি দেশের জন্য ব্রিটিশবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ করে জীবন আহুতি দিয়েছেন- তখন দেশের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষ ব্যথিত হয়েছে, শোকাভিভূত হয়েছে এবং নীরবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছে। আর একই সাথে দৃঢ়প্রত্যয়ে গ্রহণ করেছে ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষের মহান কর্মধারাকে- ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার অপ্রতিরোধ্য অঙ্গীকার।
ব্রিটিশরা ভেবেছিল বাঘা যতীনের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ছিল সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বিপ্লব-ধারার তেজস্বিতা আরো বেশি তেজস্বী বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। ইতিহাস কোথাও এসে স্থির হয়ে থাকে না, ইতিহাস চলমান। সে সামনে এগুতেই থাকে-অগ্রসরতাই ইতিহাসের ধর্ম। একদিন যে পথকে একান্ত ও সুনিশ্চিত বলে মনে হয়, পরের দিন সে পথ পেছনে পড়ে থাকেÑনতুন পথের সৃষ্টি হয়। পেছনে পড়ে থাকা পদচিহ্ন- নতুন পথের আলো হয়ে থাকেÑএগিয়ে যেতে অদম্য শক্তি যোগায়-ইতিহাসের পাতায় তা মহামূল্যবান। আগামীর জন্য তা ধারণ করতে হয়। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যিনি বাঘা যতীন নামে বিখ্যাত- তিনি তেমনি ইতিহাসে শক্তিসঞ্চারি একটি পদচিহ্ন। তাঁর আগে ও পরে আরো অনেক পদচিহ্ন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত আছে। সকলের পদক্ষেপে পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য একটি পথ রচনা করেছিল। সেই পথ বহু আগেই পশ্চাতে পড়ে গেছে, কিন্তু তার আলোটা আমাদের অগ্রসরতার বড় শক্তি, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য অনিবার্যভাবে ধারণ করতে হবে বাঘা যতীন-চেতনা।
তথ্য নির্দেশ:
১.ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকাংশ), বেঙ্গল পাবলিশার্স, ১৪, বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রীট, কলকাতা, ভাদ্র, ১৩৫৪।
২.পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, মে ১৯৯০, পৃ. ৭।
৩.আনন্দদবাজার পত্রিকা, ২৪ ভাদ্র, ১৩৪৪, পৃ. ১০৫। বাঘা যতীনের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৪৭ সালে ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠানে ডা. যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত।
৪. ওহফবঢ়বহফবহঃ ওহফরধ,২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯: ‘যতীন মুখার্জী’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ।
৫.পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, পৃ. ২।
৬.পূর্বোক্ত, পৃ ৫৫।
৭.পূর্বোক্ত, পৃ. ৭১।
৮.পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৭।
৯.ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, ৩২।
১০.সুধীরকুমার মিত্র, বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী (দেবপ্রসাদ জানা সম্পাদিত), পৃ.২৭।
১১.পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪।
১২.পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, পৃ ৭৪।
১৩.সুধীরকুমার মিত্র, বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী (দেবপ্রসাদ জানা সম্পাদিত), পৃ. ১৪।
১৪.পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫।
১৫.পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭।
১৬.অপূর্ব দাশগুপ্ত, বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায়, রেনেসাঁস, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ২৬।
১৭.পূর্বোক্ত, পৃ.২৭।
১৮.পূর্বোক্ত, পৃ.২৫।
১৯.সুধীরকুমার মিত্র, বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী (দেবপ্রসাদ জানা সম্পাদিত), পৃ. ২৫।
২০.পূর্বোক্ত, পৃ.২৫।
২১.পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭।
২২.অপূর্ব দাশগুপ্ত, বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায়, রেনেসাঁস, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ২৮।
২৩.পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, পৃ ৩৩৮।
২৪.পূর্বোক্ত, পৃ. ৪০৫।
২৫.পূর্বোক্ত, পৃ.৪১৯।
২৬.পূর্বোক্ত, পৃ.৪২২।
২৭.পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২৫।
২৮.পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২৮।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন