prabandho-anjana-nodi

আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
সুপ্রতিম কর্মকার


আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা

নদীটার নাম অঞ্জনা। এই নামটা শুনলেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা। সহজ পাঠের বইতে ফিরে যার মন। খুব ভাল ভাবেই মনে আছে অঞ্জনা নদীর তীরে ‘চন্দনী’ গাঁ। পোড়ো মন্দিরটা সেই গ্রামের এক কোনে। আচ্ছা চন্দনী গাঁ কি আদৌ আছে? আছে বৈকি। বাদকুল্লা স্টেশন থেকে একটু গেলেই পড়ে চন্দনদহ গ্রাম বা চন্দনী গাঁ। গ্রামটা একেবারে অঞ্জনা নদীর গা ঘেষে। সেখানে আজ থেকে ৩০ বছর আগেও পোড়ো মন্দিরটি ছিল। তবে আজ আর নেই। সবটাই স্মৃতি। সেই মন্দিরে আদৌ কি কুঞ্জবিহারী থাকতেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হতেই পারে তা কবির কল্পনা।

শুধু কবিতায় কেন, নদীর নামেও জুড়ে থাকে মানুষের কল্পনা। তাহলে অঞ্জনা নদীর নাম অঞ্জনা হল কি ভাবে? সেখানেও কি কোন কল্পনা জুড়ে আছে? না কী অন্য কিছু। নদীর নাম নিয়ে একটা লোক কথা পাওয়া যায়। বহুদিন আগে এই নদী নাম ছিল ক্ষীরাবতী নদী বা ক্ষীর নদী। এই নদীর ধারে এক গোয়ালা থাকতেন। যিনি কালী আর কৃষ্ণের এক সঙ্গে উপাসানা করতেন। গোয়ালার এক মা মরা ছোট্ট মেয়ে ছিল। নাম ছিল অঞ্জনা। একদিন অঞ্জনা তার বাবার কথা মতো ক্ষীর নদীতে পুজোর জল আনতে গিয়েছিল। সেখানে নদী ক্ষীরাবতী ফুটফুটে মেয়ে অঞ্জনাকে দেখে ‘মা’ হবার ইচ্ছে জাগে। নদী তার বুকে একটা জলের ঘূর্ণি পাক বানিয়ে অঞ্জনাকে তার গর্ভে নিয়ে নেয়। এই কথা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। গোয়ালা নদীর ঘাটে এসে এক মাত্র মেয়ে হারানোর শোকে বিহ্বল হয়ে নদীকে অভিশাপ দেয়। নদী যেন তার নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলে। এই কথা শুনে ক্ষীরাবতী নদী মানবী রূপ ধরে আবির্ভূত হন। গোয়ালার কাছে অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে বলে করুণ প্রার্থনা করতে থাকেন। গোয়ালা তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “আজ থেকে তার মেয়ে অঞ্জনার নামেই পরিচিতি লাভ করবে ক্ষীরাবতী নদী।”

এই অঞ্জনা নদী দখল হয়ে কৃষ্ণনগর শহরের বুকে আজ খাল। আর সেই খালে পরিণত হওয়া নদী বাঁচানোর লড়াইএ নেমেছেন নদী কর্মীরা। অঞ্জনা বাঁচানোর লড়াই-এর সঙ্গে জুড়ে গেছে চালতে তলার খাল বা চালতে তলার গেঁড়ে বাঁচানোর লড়াই। পথে নেমেছেন পরিবেশ কর্মীরা। সাইকেল মিছিল করেছেন তারা। জনজাগরণের জন্য। প্রায় একই সময়ে দত্তপুলিয়ার কলকলের খালকে জবর দখল থেকে মুক্ত করতে স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা ও কৃষকেরা এক সঙ্গে দল বেঁধে পথসভা করেছেন। ডেপুটেশন দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনকে। প্রথম দিকে প্রশাসন কিছুটা সক্রিয়তা দেখায়। তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। দিনে দুপুরে দখল হয়ে যায় আস্ত নদী কিংবা একটা খাল। কেন?

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-মধূসূদন দত্তের মতো মানুষের স্মৃতি ধন্য অঞ্জনা। এই কথা রেউই গ্রামের সকলেই প্রায় কম বেশি জানেন। কৃষ্ণনগর শহরের আগের নাম ছিল রেউই। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপিতামহ রাজা রুদ্র (রাজত্বকাল ১৬৮৩-৯৪) এই গ্রামেই তাঁর রাজধানীকে প্রতিষ্ঠা করেন। সে বহু বছর আগের কথা। অঞ্জনার প্রবাহ ধারা সরাসরি মিশছে তখন ভাগীরথীর সঙ্গে। এমন বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়ের লেখা ‘ক্ষিতীশ বংশাবলি চরিত’ -এ। রেনেল সাহেবের আঁকা মানচিত্রেও তখন চূর্ণী নদীর দেখা নেই। পরবর্তীতে একটা খাল কেটে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র (রাজত্বকাল ১৭২৮-৮২) নির্মাণ করলেন একটা নদী। নদীটার নাম চূর্নী। সাহেবদের কিছু অপ্রকাশিত রিপোর্ট ও কার্ত্তিকেয়চন্দ্রের লেখা থেকে আমরা এই কথার প্রমাণ পাই। চূর্ণী নদীর এই জন্ম পালটে দিয়েছিল নদী মানচিত্র। নদী বিজ্ঞানের ভাষায় চূর্ণীর জন্ম ছিল ‘রিভার মেটামরফোসিস’ বা ‘নদী রূপান্তর’-এর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা

অঞ্জনার শরীরে আরো একটি রূপান্তর হয়েছিল। সেটা তার উৎসমুখে। রাজা রুদ্র রায়ের রাজত্বকালে ঘটেছিল এক ঘটনা। এক ‘মন্দ যবন সেনাপতি’ খিড়কীর ঘাটে জোর করে ঢুকতে চাইলে রাজার সৈন্যরা তাকে বাধা দেন। শুরু হয় বিবাদ। আর বিবাদ থেকে ছোট খাট লড়াই। এই ঘটনার পর থেকেই রাজা রুদ্র রায় অঞ্জনার উৎসমুখ বন্ধ করে দেন। এই উৎসমুখটি অঞ্জনার পুরোনো উৎসমুখ। যে পথটি গোলাপট্টির মধ্যে দিয়ে ছিল। অঞ্জনার বন্ধ হয়ে যাওয়া পথটি পরিচিতি লাভ করে চালতে তলার গেঁড়ে হিসেবে। ‘গেঁড়ে’ শব্দটি নদীর ছেড়ে যাওয়া পথকে বোঝাতেই ব্যবহার করা হয়। এদিকে অঞ্জনা কচুরিপানাতে রুদ্ধ। ম্যালেরিয়ার আতুর ঘর। কাজেই ১৯৮৫ সালে মে মাসে বিধান সভায় অঞ্জনার পুনর্খননের প্রস্তাব আনা হয়। নতুন করে অঞ্জনার মুখ খাল নির্মাণ করে যুক্ত করা হয় রুদ্রনগর ও নগেন্দ্রনগরের ভেতর দিয়ে। আর জলঙ্গির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে খালের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হল একটা লক গেট।

উদ্দেশ্য ভালো ছিল। অল্প অল্প করে জল ঢোকানো হবে। তাতে অঞ্জনাটা অবশ্য বেঁচে থাকবে। প্রথম দিকে লক গেটটা কাজ করতো। তারপর অজ্ঞাত কারণে লক গেট বন্ধ থাকে। শেষে অকেজো হয়। জল আসা বন্ধ হল। নদী শুকোতে থাকে জলের অভাবে। কাজেই ধীরে ধীরে শুরু হল নদীর দখল।

অঞ্জনার কতটুকু অংশ এখন বেঁচে আছে? এক কথায় যত টুকু অংশতে মাছের কোপারেটিভের অধীনস্ত আছে। দোগাছিতে গিয়ে অঞ্জনার কালভার্টের ওপর দাঁড়ালে অঞ্জনাকে এখনো একটা নদীর মতো লাগে। কৃষ্ণনগর শহরের বুকে নদীটা ড্রেন। অঞ্জনার আরেকটি শাখা যেটা যাত্রাপুর হয়ে হাঁসখালি গেছে, সেটা এখন টুকরো টুকরো শরীর নিয়ে রায়তী পুকুর। নদীটাকে আগলে রাখতে পারতো এখানকার মানুষ। কিন্তু কেন পারল না? পারল না তার সব থেকে বড় কারণ দুর্নীতি। স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা দেখাচ্ছে রাতারাতি অর্থের বিনিময়ে জলা জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। জলা জমির চরিত্র পালটে সেটা বসবাসের জমি হয়ে যাচ্ছে। পুরো ভোট ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেললে কাজ শুরু হয়। তার পর নদীটা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থাকে। নির্বিকার পুরসভা। নিশ্চুপ প্রশাসন। শুধু অঞ্জনা নয়। শহরের বুকে পুকুর ভরাট হচ্ছে। পঞ্চাশের দশকে কৃষ্ণনগর পৌরসভার এলাকার ভেতর প্রায় ৭৫টা পুকুর ছিল। এখন পৌর এলাকার ভেতর মেরেকেটে ৩০টা পুকুর রয়েছে।

পুকুর ছোট হলেও নদী বাঁচাতে বড় অবদান পালন করে। বর্ষার সময় পুকুর গুল বৃষ্টির অতিরিক্ত জল ধরে রাখে। বৃষ্টি ফুরোলে পুকুরের জল মাটির তলার জলের ভান্ডারটিকে সমৃদ্ধ করে। আর মাটির তলার সেই জল চুঁইয়ে নদীকে জল পৌঁছে দেয়। এই পদ্ধতিকেই নদী বিজ্ঞানীরা বলে ‘ইফ্লুয়েন্ট সীপেজ’ বা ‘বেস ফ্লো’। এই পদ্ধতিটি নষ্ট হলেই নদীর মৃত্যু হয় অবধারিত।

শুধু নদী কেন! নদিয়া জেলার ছোট খাল বিল গুলোর অবস্থাও তথৈবচ। যেমন ধরুণ দত্তপুলিয়ার কলকলের খাল, সেটারও একই অবস্থা। কানিবামনি, কুলগাছি আর দত্তপুলিয়ার জল নামতো খালটি দিয়ে। গ্রামের প্রবীণ মানুষদের সেই স্মৃতি এখনো টাটকা। ঠিক জল নামার মুখটাতে সেই খাল দখল করে নিয়েছে স্থানীয় ক্ষমতাশালী মানুষ। জল নামতে পারছে না মাঠ থেকে। বৃষ্টির জল আটকে বিপন্ন হচ্ছে এলাকার চাষবাস। খালের জমি হাত বদল হয়েছে। রেকর্ড হয়েছে অন্যের নামে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর আজ দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। বলছেন ঐ এলাকার স্থানীয় আন্দোলনের মানুষেরা।

এবার একটা প্রশ্ন আসে মনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। ছোট এই মড়া নদী গুলোকে আবার নতুন করে কি বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব? উত্তরটা এক কথায় হ্যাঁ সূচক। ছোট মরে যাওয়া নদীকে বাঁচানোর পথ দেখিয়েছে আমাদের দেশই। যেমন ধরুণ কেরালার কুট্টামপেরুর নদী। পম্পা ও অ্যাচেনকোভিল নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতো এই নদী। এই নদীটা এক সময় স্থানীয়দের প্রাণের ধারা ছিল। নোঙরা ফেলে, বালি তুলে স্থানীয়রা এই নদীটাকে মেরে ফেলেছিল। নদীটা মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল নদীর আশেপাশের এলাকায় মাটির তলা থেকে আর জল উঠছে না। কাজেই দেখা গেল আশে পাশের এলাকাতে তীব্র জলের সংকট। কি করা যায়? পথ খুঁজে বের করলেন গ্রামের মানুষেরাই। একশো দিনের কাজকে তারা নদী বাঁচানোর উপায় হিসেবে দেখল। ৭০০ জন গ্রামের মানুষ ৭০ দিনের মাথায় নদীর নোংরা পরিস্কার করে নদীকে গভীর করে কাটিয়ে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনল। দেখতে দেখতে জলের সংকট দূর হয়ে গেল। স্থানীয় মানুষেরা নদী বাঁচানোর আনন্দে উৎসবে মাতল।

নদীয়া জেলার ক্ষেত্রেও তাহলে নদী খাল বিল বাঁচানোর পথ দেখাচ্ছে ‘নদী সংসদ’ মডেল। নদীয়া তথা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করে এলাকা ভিত্তিতে জলাভূমির জন্য ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করা। তাকে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো। জলাভূমির ম্যাপে সীমানা নির্দিষ্ট করে জনসমক্ষে সেটাকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। পঞ্চায়েত ও পৌরসভার স্তরে জলাভূমি রক্ষার ‘স্বেচ্ছাসেবী দল’ গঠন করা। অঞ্জনার বুকে মাছের আরো কোপারেটিভ তৈরি করা। এই ভাবেই কিছুটা হলেও নদী ও জলাভূমি বাঁচানো সম্ভব।

তবে শেষ কথা সাধারণ মানুষ বলে। জলাভূমি নিয়ে গড়ে ওঠা নাগরিক সচেতনা বলে। নদী জীবনের ধারা, এই কথা ভুলে গেলেই আমাদের সমূহ বিপদ।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *