Short Story – Ek Shatangsho Putro

এক শতাংশ পুত্র
(পূরবী বসু)

প্রথম প্রথম  ব্যাপারটা অতো খারাপ লাগতো না।

কেননা, এমন একটা সময় ছিল, যখন বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনাই ছিল না আমার।

তারপরেও যে বেঁচে আছি আজো, সে তো তার দয়াতেই। সন্দেহ কি?  তাহলে?

তাহলে তার প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতাবোধ থাকাই তো স্বাভাবিক। তাই নয় কি?  আর এই কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হলো, তাকে তার পুত্রের জীবিত অংশটুকু, কোন প্রতিবাদ না করে – কোন বাধা না দিয়ে, যতক্ষণ খুশি অনুভব করার সুযোগ করে দেওয়া।

বিষ-পোকার মতো এক বিরল ভাইরাসের সংক্রমণে হৃদপিন্ডের দুটো ভাল্ব-ই যখন প্রায় রাতারাতি পুরো অকেজো হয়ে যায়, সেই সঙ্গে শ্লথ হয়ে পড়ে হৃদপিন্ডের মাংসপেশী,  সম্পূর্ণ অঙ্গ পাল্টানো ছাড়া বাঁচার, সুস্থ হয়ে ওঠার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না আমার।  সার্জারী করে কৃত্রিম ভাল্ব দিয়ে অকেজো ভাল্বগুলো পাল্টে নিলেও হৃদপিন্ডের মাংসপেশীকে পুনর্জীবন দেয়া সম্ভব ছিল না। এটা ডাক্তার এতো ভালো করে বুঝিয়ে বলেছিলন যে মৃত্যু ভয়েই আমি অর্ধেকের চাইতে বেশি মৃত হয়ে পড়েছিলাম।

তখনই এক ভয়ঙ্কর গাড়ি দুর্ঘটনায় সদ্য প্রাণ-হারানো বিশ বছরের এক সাদা আমেরিকান তরুণের শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন তার শোকে স্তম্ভিত, শোকাতুরা মা। শত শত প্রতিক্ষারত রোগী ডিঙ্গিয়ে, বয়স-স্বাস্থ- টিস্যু-ম্যাচিং-এর মতো সকল বিবেচনার শেষে আমি, বত্রিশ বছরের এক বাঙালি যুবক, যে পাব সেই মহা দুস্প্রাপ্য সম্পদ, শরীরের সবচেয়ে জরুরী ও মৌলিক অঙ্গখানি, এটা প্রথমে বিশ্বাস হতে চায়নি।

যেখানে নিশ্চিত মৃত্যুর দিন গুণছিলাম বসে বসে, সেখানে আরেকজনের শরীরের অমূল্য ও দুর্লভ অঙ্গটি সঠিক সময়ে নিজ শরীরে স্থাপন করার পর আজো যে পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ,স্পর্শ সব অনুভব করতে পারছি, সেটা কি আর যে কোন প্রাপ্তি, অন্য কোন সৌভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়?  ফলে  সেই ধার করা হৃদপিন্ডের মা যদি দু’মাসে,  চার মাসে একবার পশ্চিম উপকূল থেকে নিজ খরচে উড়াল দিয়ে এসে, কানের ওপর থেকে চুল সরিয়ে একবার তার ডান কানটি আরেকবার বাম কানটি চেপে ধরে আমার বুকের ওপর, তারপর  নিঃশব্দে, একটুও না-নড়ে, মাঝে মাঝে প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে একটানা হৃদপিন্ডের ছাকুম,মাকুম , হৃদ-প্রিদ-কৃদ, শব্দ শুনতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে,  তাকে আমি নিবৃত্ত করি কীভাবে? ঐ অস্বাভাবিক মুহূর্তগুলোতে, লম্বা – অসহনীয় সময়টাতে খাঁচাবন্দি সিংহের মতো ছটফট করতে থাকি ভেতরে।  কিন্তু একান্ত ভদ্দরজনের মতো  বাহ্যিক ব্যবহারে নিস্পৃহতা বজায় রেখে, নিশ্চুপে প্রতিক্ষা করি কখন সে মুক্তি দেবে আমাকে, কখন ঐ কান এই শরীর থেকে বিছিন্ন হবে? এ ছাড়া ঐ দমবন্ধকর সময়ে আমার কী-ই বা করার থাকে?

বড়জোর আটত্রিশ চল্লিশ বছর বয়স হবে তার। নাম ক্যারল হার্ডিং। হলোই বা বিশ বছরের তরুণের মা, ক্যারল নিজের মুখেই আমাকে জানিয়েছে  মৃত সন্তানটি তার বিয়ের আগেই জন্মেছিল। আমি প্রায় নিশ্চিত, শুধু অবিবাহিতা অবস্থায় নয়,  আইনত সাবালিকা হয়ে ওঠার আগেই সন্তানবতী হয়েছিল ক্যারল।

ক্যারলের বয়সী এক নারী যার গঠন, আকৃতি যথেষ্ট আকর্ষনীয়, যদি আমার এতো কাছে এসে একবার সার্টের ওপর থেকে, আরেকবার সার্টের বোতাম খুলে  উদোম করে ন্যাংটো ত্বকের ওপর কান গুঁজে দেয়, আমি, চৌত্রিশ বছরের অবিবাহিত এক পুরুষ, আমার শরীরে প্রতিক্রিয়া কিছুই হবে না, এটা কেমন করে প্রত্যাশা করা যায়?  বরং শরীরের স্বাভাবিক ধর্মেই তার স্পর্শে আমি নির্ঘাত জেগে উঠি, যত-ই বোঝাবার চেষ্টা করি না কেন,  সে যেহেতু আমার ভেতর দিয়ে তার সন্তানকে অনুভব করে,  আমার ভেতর এই ধরণের প্রতিক্রিয়া মোটেও শোভন নয়। কিন্তু শরীর কিছুতেই মানতে চায় না আমার সাধু বাক্য – নীতি কথা।

এদিকে ডাক্তার গত ভিজিটের সময় সব পরীক্ষা নীরিক্ষা করে অবশেষে ঘোষনা দিয়েছেন, , কয়েকটি ওষুধ বাকি জীবন আমায় খেয়ে যেতেই হবে, এটা ঠিক। কিন্তু এছাড়া এখন  থেকে স্বাভাবিক জীবনের দৈর্ঘ আর গুণগত মান আমি আশা করতে পারি।  মনে হচ্ছে, আমার শরীরে ধার করা হৃদপিন্ডটা অবশেষে সেট হয়ে গেছে বেশ ভালো ভাবেই।

সত্যি বলতে কি ক্যারল কান পেতে যত-ই আমার বুকের খাঁচার ভেতর আবদ্ধ হৃদপিন্ডটির নির্দিষ্ট গতিতে বেজে যাওয়া একটানা ক্লিক ক্লিক শব্দের মধ্যে তার পুত্রের চলাচল, বেঁচে থাকা অনুভব করার চেষ্টা করুক না কেন, আমি, যার শরীর সেই হৃদপিন্ডটি ধারণ করে আছে,  তো আসলেই ক্যারলের পুত্র নই! এটা বোঝাই কী করে ক্যারলকে, যে একমাত্র পুত্রকে দুর্ঘটনায় হারিয়ে মানসিকভাবে আজো খুব সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না আমার।

আজ চার বছর হয়ে গেল আমার ধার করা হৃদপিন্ড শরীরের প্রতিটি কোনায় কোণায়  নিরলস রক্ত সরবরাহ করে চলেছে।  একটানা,  নিয়মিত, অক্লান্তভাবে। এখনো কিছু দিন পর পর উড়ে আসে ক্যারল, আমার মধ্যে তার জীবন্ত সন্তানকে টের পেতে। আমি আজকাল আর ক্যারলের এই আচরণ সহজভাবে মেনে নিতে পারি না। হ্যা, একটা সময় ছিল যখন তার শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে এক ধরণের সান্ত্বনার প্রলেপ বোলাতে আমি আমার বুক পেতে দিয়েছিলাম। তার কানের সঙ্গে সেঁটে দিয়েছিলাম আমার ঘণ কৃষ্ণবর্ণের অজস্র চুলে ঢাকা প্রশস্ত বক্ষ।  যাতে সে অনেক কাছে থেকে তার সন্তানের জীবন্ত সত্তাকে অনুভব করতে পারে চলন্ত হৃদপিন্ডের ধুক ধুক আওয়াজের মধ্য দিয়ে।  কিন্তু দিন গেলে এমন হলো যে তার পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে, পুনর্মিলনে, কোন বিশেষ পার্বন বা উৎসবেও আমাকে যেতে হয়, সাজতে হয় তাদের এক ঘণিষ্ঠজন অথবা কোন বিশেষ অতিথি। আর তখন সকলের সামনে আমার বুকে কান, মাথা রেখে ক্যারল যখন তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, একমাত্র পুত্র  গ্লেনকে অনুভব করার চেষ্টা করে, উপস্থিত অভ্যাগতরা সেই মুহুর্তে যে যা-ই করতে বা বলতে ব্যস্ত থাকুক না কেন, সব কিছু থামিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে আমার আর ক্যারলের দিকে। আমি অস্বস্তিতে ছটফট করি, কিন্তু করণীয় বুঝে উঠতে পারি না। কেবল মাঝে মাঝে  দম বন্ধ করে মনে মনে গুণতে থাকি, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ…। কখন এই অত্যাচার শেষ হবে?

সবচেয়ে বড় কথা ক্যারল কেন বোঝে না, হোক সেটা তার সন্তানের শরীরের একাংশ, আমার কাটা বুকের সেলাই করা অংশ একদিন যেমন ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়ে আমার বুকের বাকি চামড়ার সঙ্গে একাকার হয়ে একেবারে মিশে গেছে, এই খাঁচার ভেতরের লাফানো বস্তুটাও তো ধীরে ধীরে এক সময় আমার শরীরের-ই অংশ হয়ে গেছে! এই অঙ্গটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে যে ওটার গায়ে কিলবিল করে বয়ে যাওয়া অসংখ্য শাখাপ্রশাখার  রক্তনালী,  তার ভেতরে প্রবাহিত উষ্ণ রক্ত, অক্সিজেন, পুষ্টিকণা,- সব-ই তো আসছে আমার শরীর থেকেই। একটা সময় ছিল যখন বুকের ভেতর তীব্র ব্যথার মধ্য দিয়ে ওঈ অঙ্গটার একটা আলাদা উপস্থিতি আমি টের পেতাম,  ভুলতে পারতাম না কিছুতেই অন্য কোন কিছু এসে সংযোজিত হয়েছে আক্ষরিক অর্থে আমার বুকের ভেতর, যা আমার নয়।  কিন্তু দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে সে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে, অথবা শরীরের স্বাভাবিক নিয়মে তাকে মেনে নিয়েছে আমার অবশিষ্ট দেহ। আজ তো ওটার উপস্থিতি আলাদাভাবে আর বোধ করি না আমি। ক্যারল কেন আমাকে বার বার সেটা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়? ক্যারল যেমন ওটার টিক টিক শব্দে তার সন্তানের অনিঃশেষ বেঁচে থাকা অনুভব করতে চায়, সে কেন বোঝে না, এটা করে সে আমাকেও  প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, যত-ই আমি সুস্থ, স্বাভাবিক এক মানুষের অভিনয় করি না কেন, আমার শরীরের একটি অংশ রয়েছে যার উৎসে রয়েছে এক মৃত ব্যক্তি। অর্থাৎ আমার জীবন্ত শরীরের একটা অংশ মৃতের কাছ থেকে ধার নেওয়া। মানে আমি জীবন ও মৃত্যুর সংযোজনে বেঁচে আছি কোনমতে –  আমার যা নয়, তা নিয়ে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছি এই পৃথিবীতে। আমি স্বাভাবিক আর দশটা মানুষের মতো একজন নই। আমার অস্তিত্বের এক গোপন সত্য, অতীতের এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা,  মৃতের সাথে আমার জীবন্ত শরীরের এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, এই মেলবন্ধন সব কিছুর জন্যে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যারল। কিছতেইআগের সময়টা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দিচ্ছে না আমাকে ক্যারল।  অথচ আমি তো অতীতকে পেছনে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে চাই- আমি বর্তমান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই! সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে চাই।

আর তাই আজ যখন সে আমার সার্ট খুলে ন্যাংটো ত্বকে তার কান মেলে দিয়ে নিয়মমাফিক হৃদপিন্ডের পরিচিত সেই শব্দ শুনতে ব্যস্ত, আমি আমার বেঁচে থাকার স্বাভাবিক নিয়মে, ছত্রিশ বছর বয়সী একজন পুরুষের নারী সান্নিধ্যের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায়, আড়মোড়া ভেঙ্গে সম্পূর্ণ জেগে উঠি। তখন আমার পুষ্ট দু’টি হাত দুই দিক থেকে উঠে আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ক্যারলের ঘন বাদামী চুলের মাথাটি আস্তে  তুলে ধরে ওপরের দিকে। ক্যারলকে খুব গভীরভাবে দেখি আমি। সম্পূর্ণ নির্ভাজ, মোলায়েম উজ্জ্বল গৌরবর্ণের ত্বক। ঈষৎ লম্বা আঁখিপল্লবের  নিচে নিজস্ব আলোয় দীপ্তিময় দু’টি দুঃখী চোখ, রক্তাভ ওষ্ঠদ্বয়, না-খাঁড়া-না-চেপ্টা মানানসই নাক, হতবাকে স্বল্প ফাঁক হয়ে যাওয়া ছোট্ট মুখগহবর।  আমি দু’পাশ দিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দশটি আঙ্গুল দিয়ে অঞ্জলির ভঙ্গিতে ওর চিবুক, গাল আর কান স্পর্শ করে সম্পূর্ণ মুখম্নডলটি  শক্ত করে জাপটে ধরে কাছে টেনে আনি।  অতঃপর আমি ক্যারলের ওষ্ঠে গভীরভাবে চুমো খাই।

ছাড়া পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গিয়ে ক্যারল বলে, “এ কী করলে?  তুমি তো আর আমার গ্লেন রইলে না!  গ্লেনকে আর কখনো খুঁজে পাবো না তোমার মধ্যে! এ তুমি কী সর্বনাশ করলে?”  রাগে, কষ্টে, উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে ক্যারলের মুখমন্ডল।

আমি ক্যারলের কোন কথা আর শুনতে পাই না।

আমার কেবল মনে হয়, এতোদিন পরে আমি আবদ্ধ খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছি।

আমি বেঁচে আছি।

মনে হয়, সর্বাংশেই বেঁচে আছি আমি।

-সমাপ্ত-

 

3 thoughts on “Short Story – Ek Shatangsho Putro

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *