Short Story – Chakkorkata Jotir Adrishyo Howar Age

চক্করকাটা জটির অদৃশ্য হওয়ার আগে
(মোজাফ্‌ফর হোসেন)

উঠে দাঁড়িয়েই তিনটা চক্কর দিয়ে হাঁটা শুরু করলো মালতিপাড়ার দিকে। কোনো জায়গায় সে কিছুক্ষণ থেমে থাকলেই পুনরায় চলতে শুরু করার আগে একস্থানে দাঁড়িয়ে তিনটা চক্কর দেবে। কেনো দেবে তার সরল উত্তর ওর মাথায় সিট আছে। যার মাথায় সিট থাকে সে যা ইচ্ছা করার অধিকার রাখে। কোনো কার্যকারণ তাকে কারো কাছে তুলে ধরতে হয় না। মাথায় সিট আছে শুনলে লোকজন তার প্রয়োজনও বোধ করে না। আমরা যারা ছোট ছিলাম তারা জটিকে থেমে থাকা দেখলে এটা-সেটা বলে বা অঙ্গভঙ্গি করে ফেউ দিতাম যেন সে চলতে শুরু করে। এর সরল কৈফিয়ত হলো, আমরা তার তিনটা চক্কর মারার দৃশ্য দেখে মজা পেতাম। যখন সে হাঁটতো তখন তার প্রতি আমাদের খেয়াল থাকতো না। কিন্তু বসে আছে বা থেমে আছে দেখলেই মনে হতো ওর চলাকে উসকে দেয়াটা দায়িত্বের ভেতর পড়ে। বড়রা আমাদের বকতেন বটে কিন্তু আশকারা দিতেন মুখ টিপে হেসে।

গাঁয়ের আমরাই শেষ প্রজন্ম যারা জটির চক্করকাটা নিয়ে ভাবতাম, মজা পেতাম। আমাদের পরের প্রজন্ম, যারা বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই জটিকে চক্কর মেরে হাঁটতে দেখেছে, জটির চক্কর দেওয়া সূর্যের পূবে উঠে পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার মতো অতি সাধারণ সত্য বলে জেনেছে, তারা জটির প্রতি বিশেষ আগ্রহ বোধ করেনি। আস্তে আস্তে গাঁয়ের সকলের কাছে, আমাদের কাছেও, জটির চক্কর মেরে চলা অতি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক ঘটনার অংশ হয়ে উঠেছে। গাঁয়ে যারা নতুন বৌ বা জামাই হয়ে আসতো তারাও কিছুদিনের ভেতর জেনে যেতো এই গাঁয়ে এক জটি আছে যে প্রতিবার চলার আগে তিনবার পাক দিয়ে নেয়। তারা জটিকে দেখতো কিংবা দেখতো না। তারা এমন করে ঘটনাটা জানতো যে অতি স্বাভাবিক এই ঘটনাটা আর দেখার প্রয়োজন বোধ করতো না। এবং যেভাবে তারা শুনতো সেভাবেই নিজ গাঁয়ে ঘটনার বর্ণনা দিতো। ফলে ভিনগাঁয়ের যারা জটির কথা শুনতো তারাও অতি তুচ্ছ সাধারণ ঘটনা হিসেবে মেনে নিত। এভাবে জীবিত থাকতেই জটি আমাদের এলাকার মিথে পরিণত হয়েছিল। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটিও আর স্মরণ করতে পারেন না জটি শেষ কবে চক্কর না কেটে হেঁটেছে। শুধু একটা সংক্ষিপ্ত ঘটনার অবতারণা তিনি করেন। তিনি বলেন যে, হাফিজউদ্দিন চেয়ারম্যান সেবার সালিশ ডেকেছিল সফেলার। গাঁয়ের মহিলারা অভিযোগ তুলেছিল সফেলার বিরুদ্ধে। তার কারণে নাকি মাঝরাতে স্বামীরা তাদের বিছানায় ছটফট করে। সঙ্গমের চরম মুহূর্তে সফেলার নাম ধরে চিক্কুর পাড়ে। বাজ্জি পেয়েছে বলে বদনা হাতে নিরুদ্দেশ হয়। আর সফেলার বাড়ির দিকের পথগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নতুন নতুন পথ গজায়। সফেলার সালিশ বসে চেয়ারম্যানের উঠোনে। অনেকগুলো কাঁচা কঞ্চি একাট্টা করা হলো। কিন্তু কোনো পুরুষ সফেলার শরীরে সেগুলো ব্যবহার করে নিজেদের হাতকে অপবিত্র করতে চায় না। চেয়ারম্যানের নির্দেশে তার ছাতাধরা জটিকে একটার পর একটা কঞ্চি হাতে তুলে নিতে হলো। গাঁয়ের জটিই একমাত্র পুরুষ যে সফেলার কাছে যেত রাতের অন্ধকারে নয়, দিনের আলোয়। সকলের সামনে দিয়ে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে দিতো অকপটে, ‘সফেলা বুউন ডেকি পাঠিছে।’ কেউ হয়ত মশকরা করে বলত, ‘বুলিস রাইতি দুলাভাই আসবি!’ সেই জটিকেই তুলে নিতে হলো কঞ্চি। রাতের পথচারিরা খানিক দূরে নিজেদের বউদের শরীরঘেঁষে দাঁড়িয়ে; জটির চোখে চোখ রাখার সাহস হয় না তাদের।

যখন সবগুলো কঞ্চি শেষ হলো, যখন সফেলাও শক্ত হয়ে লেপ্টে গেল মাটিতে। জটি দাঁড়ায় সোজা হয়ে। হাজার হাজার মানুষের মাঝে তিনটা চক্কর দিয়ে জনতা ভেদ করে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। ঘটনার একবছর পর গাঁয়ের মানুষ ফের যখন তাকে দেখলো, তাকে দেখলো চক্কর কেটে হাঁটতে, তারা ভুলে গেলো তার চক্কর না কেটে হাঁটার ইতিহাস।

বৃদ্ধের এই কথা আমরা বিশ্বাস করতে পারতাম, কিন্তু যখন শুনি এই গাঁয়ে সফেলা নামে কোনো নারী কোনোদিনই ছিল না, তখন ঘটনার বিশ্বস্ততা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু আবার যখন জানতে পারি যে, সুদূর অতীতে কথিত সফেলার মতো অনেক নারীর বিচার চেয়ারম্যানের উঠোনে হয়েছে, তাদের একেকজনের লোকমুখে অনেক নামই শোনা যেত, এবং তাদের অনেকের কোনো নামই আজ আর গ্রামের মানুষেরা মনে করতে পারে না, তখন তাদের ভেতর কারো নাম সফেলা ছিল বলে ধরে নিয়ে ঘটনার সত্যতা আমরা দাঁড় করাতে চেষ্টা করি।

আমরা যখন জটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, সে যে আর বেঁচে থাকতে পারে এই ধারণাই যখন বিশ্বাস থেকে উঠে গিয়েছিল তখন একদিন জটির চক্কর না মেরে চলার খবরটি বজ্রপাতের মতো আমাদের সকলের কানে এসে বাড়ি মারলো। কেউ একজন বলল জটি আর চক্কর দিচ্ছে না। আমাদের সকলের মতো উঠে দাঁড়িয়ে সটান হাঁটা দিচ্ছে, সামনে কিংবা পেছন ফিরে। বয়সের কারণে পা’দুটা একটু ল্যাংচায়ে হাঁটছে বটে কিন্তু চক্কর আর সে দিচ্ছে না। শোনার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে জটির সন্ধান শুরু হলো। আমরা বহুদিন ওর খোঁজ নিইনি বলে ওর সন্ধান বের করতে দিন গড়িয়ে গেল। সূর্য যখন শেষবারের মতো উঁকি মারছিল পশ্চিমের আকাশে তখনই ওকে পাওয়া গেল প্রাইমারি স্কুলের পেছনে প্রাচীন বটগাছটার নিচে। রাত নামলে গাঁয়ের ছেলেরা এখানে ফেনসিডিল খায় বলে এদিকে ওই ধান্দার বাইরের কেউ আসে না। পরনের লুঙ্গিটার কিছুটা পরে কিছুটা পেড়ে শুয়ে আছে জটি। আমাদের কয়েকজনকে একসঙ্গে এভাবে দেখে ও ভড়কে গেছে বলে মনে হলো। 

‘জটি দাদা, তুই নাকি চক্করকাটা থামি দিছিস? কথা কি ঠিক?’ মেজাজটা চড়িয়ে প্রশ্ন করল মফেদুল, ওর গলার স্বরটাই এমন, ফলে রাগ করে বলছে না স্বাভাবিকভাবে বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে।

‘তুই থাম-তো! জটি চাচা তুমার কি কোনো সমস্যা হয়িচে? শরীল খারাপ?’ মফেদুলকে থামিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে সবুর।

‘একবার চেক করার দরকার না; কথা সত্যি কি-না?’ সবকিছুতেই সন্দেহ করার বাতিক ছিল সবদারের। ওর কথায় আরো কয়েকজন সাই দিলো পেছন থেকে। আসলে আমরা ভুলেই গেছি কবে জটিকে চক্করকাটা ছাড়া হাঁটতে দেখেছি বা আদৌ দেখেছি কিনা। সুতরাং ওর প্রস্তাবে মৌন সম্মতি দিতেই হলো। অন্ধকার হয়ে এসেছে, তার ওপর বাঁশঝাড় ও বটগাছ মিলে এদিকটাই এমনিতেই আঁধার থাকে সবসময়। আমাদের কথামতো ইক্তার আর মুক্তার শূন্য করে জটিকে তুলে স্কুলের সামনে নিয়ে বসালো। ওরা দুজন জটির দুই ছেলের নাতিছেলে। সকলে দাদা সম্বোধন করে বলে ওরাও দাদা ডাকে জটিকে। ‘দাদা, তুই ইবার আমাদের হেঁটি দেখা তো!’ ইক্তার বলে। স্কুল ময়দানে ততক্ষণে শতশত মানুষ জড় হয়েছে। মহিলারাও আসতে শুরু করেছে কোলের শিশুদের নিয়ে। আমরা জটিকে একটু জায়গা করে দিয়ে সরে দাঁড়ালাম। জটি আবছা অন্ধকারে আমাদের প্রতিটা মুখের দিকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করছিল। মনে হলো সে ভিনগাঁয়ে চলে এসেছে। নির্বাক হয়েছে কবে কিংবা আগেও কথা বলতো কিনা আমাদের মনে পড়ে না। অপেক্ষা করতে করতে যখন আমাদের পা ব্যথা হয়ে আসছিল তখন কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘জটির চক্কর না কেটি হাঁটার খবরটা দিলু কে রে? পুরাই ঢপ মেরিছে। শ্যালাকে আমি পানিতে চুবাবো।’ তখন আমরা সকলে মনে করার চেষ্টা করলাম ঘটনাটি কার কাছ থেকে প্রথম শুনেছি। ঘটনার বর্ণনাকারী হিসেবে আমরা পরস্পর পরস্পরকে চিহ্নিত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমরা যখন হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনই জটি উঠে দাঁড়াল। কোনো রকম চক্কর না দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটতে শুরু করল স্কুলের সামনে দিয়ে ব্যাঙগাড়ির মাঠের দিকে। মুহূর্তেই অন্ধকারে মিলে গেল ওর অস্তিত্ব। আমরা নির্বাক হয়ে বিস্ময় এঁটে দেখলাম ওর চক্কর না কেটে হেঁটে যাওয়া।

সকাল হতে না হতেই ঘটনাটি গ্রাম থেকে রাষ্ট্র হলো। আশেপাশের গাঁ থেকে কাজকাম ফেলে ছুটে এলো মানুষ। গাঁয়ের যাদের আত্মীয় থাকে জেলা শহরে, তারাও কেউ কেউ এলো। পুরো গ্রামজুড়ে মানুষের কলরব। হৈহল্লা। জটিকে কিছুক্ষণ পরপর হাঁটতে হচ্ছে। হাঁটতে একরকম বাধ্যই করা হচ্ছে। গ্রামের চ্যাংড়া পোলাপান অতি উৎসাহে জটিকে জোরজবরদস্তি করছিল বলে মেম্বারকে দায়িত্ব দিলেন চেয়ারম্যান। মেম্বার কয়েকঘণ্টা পরপর অনেকগুলো মানুষকে একসঙ্গে জড়ো করে তারপর জটিকে বলছেন উঠে দাঁড়াতে। এক চেয়ার থেকে উঠে অন্য চেয়ারে বসছে জটি। কোনো রকম চক্কর না দিয়েই। বিশ ফিট অন্তর দুটি চেয়ার পাতা আছে তার জন্য।

জটিকে দেখতে আমাদের গ্রামে জেলা শহরের বাইরে থেকে প্রথম অতিথি হয়ে এলেন আমার বড়ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু হাফিজুল ভাই। বাড়ি বগুড়া, কর্মসূত্রে থাকেন রাজশাহী। বড়ভাইয়ের বিয়েতে এসেছিলেন। তখন জটির হাঁটার আগে চক্কর মারার কথা শুনেছিলেন, সময়ের অভাবে দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু এবার জটি যে আর চক্কর কাটছে না সেই সংবাদ খবরের কাগজে পড়ে না দেখে থাকতে পারলেন না। বড়ভাই বাড়ি ছিলেন না, আমিই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম স্কুলমাঠে। জটি তখন বিশ্রামে। সারাদিন হেঁটে পা-ব্যথা হয়ে গেছে। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে বলে গেছেন আজকের মতো আর না। সকালে এমপি আসছেন। তাই আর কোনো ঝুঁকি নিতে চান না চেয়ারম্যান ও গ্রাম্য নেতারা। ফলে স্কুল মাঠে যে অস্থায়ীভাবে চায়ের দোকান গড়ে উঠেছে সেখানে বসে জমায়েত লোকজন হতাশা চেপে চা-বিড়ি নিয়ে সময় পার করছে। শহর থেকে দুটি টেলিভিশনের দুজন প্রতিনিধি এসেছেন ক্যামেরা নিয়ে। জটির ফুটেজ নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপাতত চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনের সাথে কথা বলছেন। মেম্বারকে প্রশ্ন করলেন একজন, ‘এই যে জটি হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। চক্করকাটা থামিয়ে দিয়েছে, এর কারণ কি বলে মনে হচ্ছে আপনার?’ ‘দেখেন, এইটা একটা সাংঘাতিক ঘটনা! কারণটা আমরা একুনই বুলতি পারবু না। জটির ব্যাপারে আমরা মিটিং করিছি। ও আমাদের গাঁয়ির সবচেয়ে মুরুব্বি মানুষ। এমপি নিজি উকে দেখতি আসবি বুলে কথা দিছেন।’ অন্য টেলিভিশনের প্রতিনিধি আছেন হাফি-চাচার সামনে। হাফিচাচা বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ। প্রায়ই পলাতক থাকেন। সম্ভবত এই ঘটনা শুনে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘দেখেন, দ্যাশটা যে ঠিক মতোন চলচি না, তারই একটা নমুনা এইটা। তাছাড়া জটির মতোন নরমাল মানুষ; হঠাত এমুন অ-নরমাল আচরণ করবি ক্যানে?’ কথা কোন দিকে গড় নিতে পারে সেটি আন্দাজ করতে পেরে প্রতিবেদক সঙ্গে সঙ্গে অন্যকথা বলে সরে গেলেন দেলু মাস্টারের কাছে। তখনই খবরটা এলো। ইবাদত ঘরামির নয় বছর বয়সী মেয়েটা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। লাশ মিলেছে ছবদাগাড়ির মাঠে। ধানক্ষেতে। ধর্ষক ইবাদতের আপন চাচাতো ভাই। ঘরে ফেরার সময় আবছা আলোয় কয়েকজন রাখাল ঠিকই চিনেছে। ইবাদত ছুটে এসেছে চেয়ারম্যানের কাছে। দুজন পুলিশ আছে জটির প্রহরায়। তাদের দিকেও একবার ছুটে যায় সে। এতগুলো মানুষের মাঝে নিজের বুকফাটা চিৎকার শোনানোর মতো কোনো মানুষই যেন খুঁজে পাচ্ছে না সে। আমরা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। কেঁদে কেঁদে কি বলছে কিছুই ধরতে পারলাম না।

‘বাড়ি যা, কাল এমপি ঘুরি যাক, আমি দেখবু।’ চেয়ারম্যান চাচা ইবাদতের মাথায় হাত রেখে বললেন।

ইবাদত ফুঁসছে। এত এত অপরিচিত মানুষের সামনে লজ্জায় কাঁদতে পারছে না গলা ফেঁড়ে। বিস্ফোরণের অবস্থা তার।

‘ধর্ষক-খুনি যেকুন তোরই চাচাইতু ভাই। পালাবে আর কুতায়? দুদিন গেলিই বিচারের ব্যবস্থা করবু। কিছু নি মিটমাট কইরলি করবি, না কইরতি চালি পুলিশে তুলি দেবো।’ চেয়ারম্যান চাচা বলেন।

ইবাদত ফুঁসতে থাকে। চোখদুটো ফেটে যাওয়ার অবস্থা হয়।

‘লাশটা মাটি দি-দে—মরি যেকুন গিছে — থানা-পুলিশ করতি চালি উরা উঠি নেবে। আমি তো আছি। হক বিচার পাবি। আগে জটির একটা সুরাহা হোক। পুরা দেশ একুন আমাদের দিকে তাকি। দেখছিস না টেলিভিশন এইছে? একুন আর দগদাশনি।’ চেয়ারম্যান কোমল স্বরে ইবাদতকে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি ইশারা করায় কয়েকজন তরুণ এসে ওকে একরকম পাঁজা করে তুলে নিয়ে যায়। আমরা মোটামুটিভাবে মেনেই নিই, আপাতত এই গাঁয়ে ধর্ষণের কিংবা খুনের চেয়ে বড় বিষয় জটির চক্করমারা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাটি। বিশেষ করে গাঁয়ে এই প্রথম টেলিভিশন ক্যামেরা আসায় আমাদের ভেতর এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না। তার ওপর এমপি মহোদয় আসছেন সকালে। তিনিও প্রথম আসছেন। একবার এই স্কুল-মাঠেই মাদকবিরোধী সভা করেছিলাম আমরা গাঁয়ের তরুণরা। এলাকায় ফেনসিডিলের যত সাপ্লাই তার অর্ধেক প্রায় এই গাঁয়ের বর্ডার দিয়েই আসে। এমপি সাহেবকে খুব অনুনয় বিনয় করেও আনতে পারিনি সেই সভায়। এখন স্বেচ্ছায় জটির কারণে আসছেন তিনি।

রাতে আর আমরা জটির দেখা পেলাম না। আশেপাশের কয়েক গ্রাম মিলে মাইকে ঘোষণা করা হলো স্কুলমাঠে এমপির সামনে জটির হাঁটা প্রদর্শন করা হবে। আমি হাফিজুল ভাইকে নিয়ে সকাল সকাল মোটামুটি সামনের দিকে গিয়ে বসলাম। এমপি মহোদয়ের ১১টায় আসবার কথা ছিল। এলেনও তাই। বসলেন মঞ্চে প্রধান অতিথির আসনে। সামনে কিছুটা দূরে চেয়ারে বসা জটি। আর চারিদিক দিয়ে গোল করে আমরা। আমরা মানে হাজার হাজার মানুষ। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই এলাকায় এত মানুষের জমায়েত দেখেনি কেউ। আজ প্রধান আকর্ষণ এমপির ভাষণ নয়, জটির হাঁটা। জটির আগে হেঁটে ফেললে জনতা আর নাও থাকতে পারে, তাই এমপি মহোদয়ের ভাষণের ব্যবস্থা হলো আগে। তিনি টানা দু’ঘণ্টা ভাষণ দিলেন। মাঝে একটা সংক্ষিপ্ত বিরতিও নিলেন। অতি আবেগে এ গাঁয়ের ভালো-মন্দ দেখার দায়-দায়িত্ব একরকম নিয়েই ফেললেন তিনি। জোর দিয়ে বলেছেন, জটির অবস্থা গুরুতর হলে তিনি নিজে রাজধানী শহরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবেন। দরকার হলে সিঙ্গাপুরেও পাঠাবেন।

এমপি মহোদয়ের বক্তৃতা শেষ হলে সকলে নড়েচড়ে বসল। চাঙ্গা হয়ে উঠলাম আমরা। জটি এখন হেঁটে এক চেয়ার থেকে অন্য চেয়ারে বসবে। অনেকেই এই প্রথম দেখবে জটির চক্কর না কেটে সোজা হেঁটে চলা। জটিকেই এই প্রথম দেখছে এমন মানুষের সংখ্যাও কম হবে না। তারা এতদিন শুনে এসেছে জটির তিনবার চক্কর দিয়ে হাঁটতে শুরু করার কথা। আজ তারা নিজ চোখে দেখতে এসেছে জটির চক্কর না মেরে হাঁটার দৃশ্যখানা।

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জটি আর তিনবার চক্কর কাটবে না। আমাদের শিরায় তখন টানটান উত্তেজনা। জটি উঠে দাঁড়িয়েছে। উঠে দাঁড়িয়েছেন এমপি মহোদয়, সঙ্গে চেয়ারম্যান ও মঞ্চের চেনা-অচেনা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চলেছেন সকলে। জটিকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সামনের চেয়ারে গিয়ে বসার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। কয়েকবার। জটির নির্বিকার বসে থাকা দেখে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তেড়ে উঠলেন চেয়ারম্যান চাচা। জটি উঠে দাঁড়াল। চেয়ারম্যান চাচাকে এই বয়সেও, মাথায় কিঞ্চিৎ সিট থাকার পরও, কেন এত ভয় করে সে আমরা ঠিকঠিক বলতে পারবো না। আমরা কেবল জানি, চেয়ারম্যান চাচার বাবা হাফিজউদ্দিন চেয়ারম্যানের খাসলোক ছিল জটি। আর যা শুনেছি সবই শোনা কথা।

জটি হাঁটা শুরু করলো, তবে তার আগে সবাইকে অবাক করে জায়গাতে দাঁড়িয়েই তিনবার চক্কর কেটে নিলো সে। জনতার দিকে মুখ করে হাঁটতে হাঁটতে জনতার ভেতর মিশে গেলো নিমিষে। আমরা বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করলাম হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে জটিকে অদৃশ্য হয়ে যেতে।

-সমাপ্ত-

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *