সৎ মা
(চুমকি চট্টোপাধ্যায়)
– লিটন, ব্রেকফাস্ট দিয়েছি টেবিলে, খেয়ে নিস।
– আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, খাব না।
– না খেয়ে বাড়ি থেকে কেউ বেরোয় না, খেয়ে নে প্লিজ। আলুর পরোটা করেছি। তুই ভালোবাসিস তো ! খেয়ে নে।
দরজা টানার আওয়াজে মিঠু বুঝল লিটন বেরিয়ে গেল। খেল না। বেশির ভাগ দিনই এটা করে। ওর বাবা থাকলে তবুও টেবিলে বসে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে খুঁটে খুঁটে কিছুটা হলেও খায়। কিন্তু সমরেশ না থাকলে কিছুতেই মিঠুর মুখোমুখি হতে চায় না লিটন।
মিঠুর কান্না পেয়ে যায়। ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে হাতের ওপর মাথা নীচু করে কেঁদে ফেলে। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া হাত বুলিয়ে যায় ওর শরীরে। মুখ তোলে মিঠু। অন্য ভাবনা আসে মনে। বৃষ্টি আসবে নাকি ? হাওয়া এত ঠান্ডা !
তাড়াতাড়ি উঠে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখে মিঠু। ছাদে কাপড়, চাদর সব মেলা আছে। এতক্ষণে হয়তো শুকিয়েও গেছে। বৃষ্টি এলে সব ভিজে যাবে।
জামাকাপড় সব খাটের ওপর রেখেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় মিঠু। চিকেন ম্যারিনেট করা আছে। মেথি চিকেন খুব পছন্দ লিটন সমরেশ দুজনেরই। দ্রুত ছাদে যাওয়া আসার ফলে একটু হাঁপিয়ে গেছে মিঠু। আজকাল যেন পায়ের স্টেপিং -এও গন্ডগোল হয়।
ফ্রাইং প্যান গ্যাসে বসিয়ে তেল ঢালে মিঠু। একটু বেশি পড়ে যায় তেল। নন-স্টিকে এত তেল লাগেনা। আসলে মিঠু একটু অন্যমনস্ক। সাড়ে তিন বছর হয়ে গেছে কিন্তু লিটন এখনো ওকে অ্যাকসেপ্ট করেনি। অতীতের হাজার স্মৃতি ঝাঁপিয়ে আসে মিঠুর মগজে।
………………………………………………………………………………
একটা বহুজাতিক সংস্থায় চাকরির সুবাদে আসামে পোস্টেড ছিল মিঠু। পড়াশোনা, কেরিয়ার, বাবা-মা, ভাই… সব সামলে চল্লিশের কোঠায় পৌঁছলেও বিয়েটা আর করা হয়ে ওঠেনি ওর।
মিঠুর কোম্পানিতেই ডেপুটেশনে আসে সমরেশ। আলাপ হয় মিঠুর সঙ্গে। অফিসের কাজ শেষ করে একটা ক্যাফেটেরিয়ায় বসে দুজনে। মিঠু সমরেশকে বলে, “আপনি তো সদ্য এসেছেন তাই আপনি এখন আমাদের গেস্ট। গার্লিক ব্রেড আর কফি খাওয়া যাক, কী বলেন ? ট্রিট কিন্তু আমার তরফ থেকে। আপত্তি করবেন না যেন।”
– না না, আপত্তি কেন করব। নতুন পরিবেশে এমনিতেই মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। তার ওপর আমার মানসিক স্থিতি একটু বেসামাল এই মুহূর্তে। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালো লাগছে।
– মানসিক স্থিতি বেসামাল কেন? শরীর খারাপ নাকি?
-উঁহু, তা নয়। ছাড়ুন, পরে কখনো বলা যাবে। এখন এই সুন্দর মুহূর্তটা এনজয় করি বরং।
– না, পরে নয়, এখনই বলুন। দরকারে আমি কিছু হেল্প করতে পারি হয়তো।
– হেল্প ? না, মনে হয় পারবেন না। আমারি এসব বলা উচিত হয় নি। এসেই নিজের দুখ ভরি কাহানি শোনাতে বসেছি।
– আরে মশাই বলুন না… এত কিন্তু কিন্তু কেন করছেন? আমাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না নাকি !
– এমা, ছি ছি, এ কী বলছেন !
খানিক চুপ করে থেকে সমরেশ বলে, “বছর দুয়েক হতে চলল আমার স্ত্রী চন্দ্রা মারা গেছে। আমাদের একটাই ছেলে। চন্দ্রা যখন চলে যায় লিটন তখন ক্লাস টেনে পড়ে। ওকে সামলাতে গিয়ে আমার আর চন্দ্রার কথা ভাবাই হয়নি জানেন। ওর জন্য একটু চোখের জলও ফেলিনি। কীভাবে যে লিটন মাধ্যমিক পাশ করেছে… সিমপ্যাথি গ্রাউন্ডে কোম্পানি বছর খানেক আমাকে কোথাও বদলি করেনি। কিন্তু অনন্তকাল তো আর সেটা চলতে পারেনা। বদলি হল। এবার আর এক সমস্যা শুরু। লিটনের কাছে কে থাকবে। বিশেষ করে ওর খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে। ”
– কী ব্যবস্থা করেছেন এখন ?
– ওই একজন মহিলা এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে, জামাকাপড় কেচে মেলে দিয়ে যায়। আর খাবার আপাতত হোম ডেলিভারিতে চলছে। কিন্তু…
– পেটের সমস্যা হচ্ছে তো ?
– সেও হচ্ছে আর টাইম ম্যানেজমেন্টে গন্ডগোল হচ্ছে। ওর এখন ক্লাস টুয়েলভ। স্কুলের পরে টিউশন থাকে, ফেরার কোন ঠিক নেই। আমার তো আরো ভয় লাগে, নজরদারি করার কেউ নেই বলে খারাপ সঙ্গে না পড়ে যায়। আজকাল তো…
– আহারে, ছেলেমানুষ, এই সময়টাতেই তো মায়ের বেশি প্রয়োজন। ঈশ্বরের যে কি বিচার !
– পরিবেশটা ভারী করে দিলাম তো ! এজন্যই আমি এখন বলতে চাইছিলাম না।
মাস চারেক মেলামেশার পর মিঠু বিয়ের প্রস্তাব দেয় সমরেশকে। মিঠুকে সমরেশের খুব ভালো লাগলেও লিটনের কথা ভেবে কিছু বলেনি এতদিন।
– মিঠু, আমি সত্যিই খুব খুশি। তুমি চন্দ্রার সংসারের হাল ধরো। চন্দ্রাও স্বস্তি পাবে। আমার একটাই চিন্তা– লিটন। বড় হয়ে গেছে তো। তোমাকে যদি অ্যাকসেপ্ট না করে ?
– তুমি ভেব না ও নিয়ে। আমি বন্ধুর মতো মিশব ওর সঙ্গে। হ্যাঁ, হয়তো আমাকে ওর পছন্দ হবে না। আমি মোটা, রঙ ময়লা। চন্দ্রা সুন্দরী ছিল। তা, সেসব আমি ম্যানেজ করে নেব। সামনাসামনি না দেখলেও, কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার ওপর।
#
অসহ্য লাগে এই মহিলাকে। বাবাকে ভালো মানুষ পেয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে। আমার মা হতে এসেছে। মুটকি হাতি একটা।
লিটনের মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে যবে থেকে মিঠু এসেছে এ বাড়িতে। সমরেশ ছেলেকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে, “মিঠু খারাপ মানুষ নয় রে। দেখ, আমাদের সংসারের জন্যেই তো চাকরি ছেড়ে এখানে চলে এল। কদিন দেখলেই বুঝবি। ”
লিটনকে ভালো রাখতে চেষ্টার ত্রুটি নেই মিঠুর। সমরেশের বদলি হয়েছে ঝাড়গ্রামে। মাঝে মাঝে আসে। ও বোঝে, মিঠু চেষ্টা চালালেও লিটন গ্রহণ করেনি মিঠুকে। কথাই বলে না ভালো করে। প্রয়োজনে দু একটা। মিঠু বরং ইয়ার্কি ফাজলামি করে লিটনের সঙ্গে। বন্ধুর মতো মেশে তবে, সবটাই এক তরফা।
এভাবেই কাটতে থাকে দিন। সমরেশকে এখন আর বাড়ির জন্য চিন্তা করতে হয়না। মিঠু খুব সুন্দর করে সংসারের হাল ধরেছে। মেয়েটা সত্যিই ভালো। লিটন ক্যাট পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছে।
#
সমরেশ বাড়ি এসেছে। ওর সম্পর্কিত এক ভাইঝির বিয়ে। তিনজনেই যাবে ওরা।
– মিঠু, তুমি রেডি? আমি আর লিটন রেডি। হাঁক দেয় সমরেশ।
মিঠু সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনল লিটন ওর বাবাকে বলছে, ‘ দাঁড়াও, ভুরু কালো করা শেষ হোক। সাজগোজ কম করতে হয় নাকি বয়েস ঢাকতে?’
সমরেশ ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলে ছেলেলে। মনে মনে আহত হয়। মিঠু এত করে ওর জন্য তাও দেখো…
#
লিটন ব্রেকফাস্ট করছে। চা নিয়ে এসে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে মিঠু।
– লিটন। আমার একটাই আবদার তোর কাছে। আমি মারা গেলে ডেডবডি দেখতে সবাই আসার আগে প্লিজ আমার ভুরু দুটো কালো করে দিস। একে তো আমি কালো তায় মোটা। সাদা ভুরু কুৎসিত লাগে। এটা আমাদের বংশের ধারা, তিরিশ পেরোলেই চুল, ভুরু পাকতে শুরু করে। মনে রাখিস কিন্তু… হেসে হেসে বলে মিঠু।
লিটনের মুখে-চোখে বিরক্তির মেঘ। যত্ত সব ছ্যাবলামি মনে মনে ভাবে ও। কবে যাবে তার নেই ঠিক, আমি বসে থাকব ওনার ভুরু রঙ করার জন্য।
#
মিঠু অসুস্থ। ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে। লোকেশন ভালো নয়। অপারেশন হলেও সেরে ওঠার গ্যারান্টি দিতে পারছে না ডাক্তাররা। প্যারালিসিস হয়ে যাবার সম্ভাবনা। সমরেশের স্ত্রীভাগ্য নিতান্তই খারাপ,কে যেন বলেছিল খড়ম পা-অলা পুরুষদের বউ মারা যায়।
মিঠু ভোগেনি। ওর সুকর্ম ওকে এটুকু রেহাই দিয়েছে। আরো সৌভাগ্য, শেষ সময়ে সমরেশ ছিল ওর পাশে। লিটনকে খবর দেওয়া হয়েছে।
অনেক ওপর থেকে একটা ঝরনা যেন ঝাঁপিয়ে এসে আচমকা ভাসিয়ে নিয়ে গেল লিটনকে। আসার পথে একটা আইব্রাও পেন্সিল কিনল ও। সৎ মায়ের ভুরু দুটো কালো করে দেবে লোকজন চলে আসার আগে।
Congrats.খূবই সূন্দর। Excellent.
May I have the contacts ( i.e. email or mobile) of Chumki Chattopadhyay Mam.
নীলম শর্মা ‘অংশু’
Oshadhaaron laglo…..khub ee pathetic sesh taa