ফিচার
তৃষ্ণা বসাক
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বিখ্যাত গল্প ‘অবতরণিকা’, যা নিয়ে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন ‘মহানগর’ ছবিটি। যেখানে বাঙালি মেয়ের চাকরিজীবনের শুরুর নিখুঁত ডকুমেন্টেশন আছে। আর সে চাকরিটিও মেয়েদের জন্যে একেবারে ছকে বাঁধা ইস্কুলের দিদিমনিগিরি নয়। যদিও হাতেকলমে মেশিনে উল বোনা শেখাতে হয়, উল বোনার মেশিন বেচতে গিয়ে। মানে কাজটি সেলস গার্লের। অর্থাৎ এখানেও একটা নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। মেয়েরা একদম প্রথম থেকেই ছকে বাঁধা চাকরির বাইরে অন্যরকম পেশায় যাচ্ছে। এবং সেই মেয়েও খুব উচ্চবিত্ত ঘরের নয়, নেহাতই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহবধূ, যে স্বামীর আগে খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে শাশুড়ি বিলাপ করেন। সে কিনা তার উপার্জন শুরুই করছে একটি বিলিতি যন্ত্রের কলা কৌশল বুঝিয়ে। সেখানে একটি ধনী গৃহে যখন বাড়ির বউটি কিছুতেই যন্ত্রের কাজের পদ্ধতি বুঝতে পারছে না, তখন মৃদু অনুযোগের সুরে আরতি বলে ‘আপনার তো ভারি মোটাবুদ্ধি’। সে কথায় রুষ্ট হন বউটির শাশুড়ি, তিনি আরতিকে বুঝিয়ে দেন তাঁদের মতো ঘরে মেয়েদের বুদ্ধি একটু কম হলেও চলে।
দেখা যাচ্ছে শুরু থেকেও মেয়েদের চাকরির ব্যাপারে একটা ‘ওরা’ ‘আমরা’ করে এসেছে সমাজ। এক হচ্ছে ‘আমাদের মতো ঘরের’ দুধ ননীতে লালিত মেয়ে বউ, ধনীগৃহে যারা ‘চারুলতা’র মতো কীভাবে সময় কাটাবে বুঝে পায় না। তাদের সময় কাটে গ্রাবু খেলে বা পশম বুনে কিংবা সিনেমা পত্রিকা পড়ে। তাদের বুদ্ধির সেভাবে দরকার নেই, কারণ তাদের পেটের দায়ে উপার্জনের জন্যে রাস্তায় বেরোতে হয় না। অন্যদিকে যারা ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতার মতো পেটের দায়ে রাস্তায় বেরোয়, যাদের চটির ছেঁড়া স্ট্র্যাপে সেফটিপিন লাগাতে হয়, যাদের ‘অবতরণিকা’র আরতির মতো দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় মেশিন বেচার জন্যে। তাদের বুদ্ধি না থাকলে চলবে কী করে? তাদের তো রাখতেই হবে দুনিয়াদারির খবর।
কেমন ছিল মেয়ে চাকুরেদের অফিস যাওয়ার অভিজ্ঞতা? সবাই তো আরতির মতো স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে হারানো রোমান্স ফিরে পেত না। বেশিরভাগই যেত ট্রেনের লেডিস কামরায় কিংবা ট্রামে।
কয়েক দশক পরে হয়তো মেয়েরা ট্রামে অনেক কম অফিসে যায়। বাস, মেট্রো, ট্রেন, নিজের গাড়ি কি ভাড়ার ক্যাব- নানান যানবাহন এখন। তাদের পোশাক, সাজ আরও আধুনিক হয়েছে। সংখ্যায় তারা আগের থেকে ঢের বেশি। কিন্তু আসল কথা হল, মেয়েরা আজ শুধুই অফিসে কলম পেশে না বা কম্পিউটারে কাজ করে না। নানান বৃত্তিতে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষিকা, নার্স, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজার, শেফ, শিল্পী, এয়ার হোস্টেস, পাইলট, সেনা অফিসার, মডেল এমনকি গাড়ির চালক। অনেকে আবার স্বনিযুক্ত। আর তাদের এই নানান বৃত্তির বিবর্তন ধরে রেখেছে বাংলা সাহিত্য। একদম প্রথম থেকেই যে মেয়েরা নানা বৃত্তিতে ছিল, তার নিদর্শন পাই বাংলা সাহিত্যে।
‘নাপিতানী সধবা, খাটো রাঙাপেড়ে শাড়ি পরা-শাড়ির রাঙা দেওয়া আঁচলা আছে, হাতে আলতার চুপড়ি।’ (চন্দ্রশেখর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) অনেক নাপিতানী আবার ছিল শল্যচিকিৎসায় অতীব দক্ষ। স্বয়ং কবি ঈশ্বর গুপ্ত ছড়া বেঁধেছিলেন নাপিতানী রাজুর মার শল্যচিকিৎসায় হাতযশ নিয়ে-
‘নরুনের কারিকুরি যাই বলিহারি।
নরুন হারায়ে দিল সাহেবের ছুরি।’
একদম প্রথম দিকের বাংলা সাহিত্যে পাই এদের কথা।
লোকগানে আছে ‘ও চিকন গোয়ালিনী, রসের বিনোদিনী, ও রূপ যৌবন তোমার জোয়ারের পানি’ এই চিকন গোয়ালিনী যে রাধা তাতে আর সন্দেহ কী। এই গোয়ালিনীরা কিন্তু একেবারে প্রথম যুগের স্বনির্ভর নারী, যারা দুধ, বেচে, দই ও ননী তৈরি করে বেচে কড়ি উপার্জন করত। ময়মনসিংহ গীতিকার কমলা পালায় আছে এরকম এক গোয়ালিনীর কথা-
‘গেরামে আছয়ে এক চিকন গোয়ালিনী
যৌবনে আছিল যেমন সবরি-কলা-চিনি
বড় রসিক আছিল এক চিকন গোয়ালিনী
এক সের দইতে দিত তিন সের পানি
সদাই আনন্দ মন করে হাসিখুশী
দই-দুধ হইতে সে কথা বেচে বেশী।’
এই ছবি বলে দেয়, ব্যবসার ট্রিক্স গোয়ালিনীর নখদর্পণে ছিল।
তারাশংকরের ‘কবি’ উপন্যাসে পাই এক অপূর্ব গোয়ালিনীকে। কাহিনী অনুযায়ী রাজার শ্যালিকা ঠাকুরঝির সঙ্গে নিতাইয়ের পরিচয় ঘটে। সে ছিলো পাশের গ্রামের বধূ। এই গ্রামে সে দুধের যোগান দিত। কৃষ্ণবর্ণ, দ্রুতহাসিনী, ছিপছিপে গড়নের মিষ্টি-মেয়ে ঠাকুরঝির “দেহখানাই শুধু লতার মত নয়, মনও যেন তাহার দীঘল দেহের অনুরূপ।”
একবুক বেদনা ও সহজ সরল ঠাকুরঝিকে মনের গহীনকোণে সঙ্গী করে নিয়েই নিতাই বসন্তের ডাকে ঝুমুর দলে পাড়ি জমায়। ঠাকুরঝির প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পায় এভাবে-
“চাঁদ তুমি আকাশে থাকো আমি তোমায় দেখবো খালি।
ছুঁতে তোমায় চায়না কো হে চাঁদ, তোমার সোনার অঙ্গে লাগবে কালি। ”
এদের বলা যেতে পারে নারী গুপ্তচর বা ফড়ে, বা আড়কাঠি। এরা খবর বেচে খেত। এদের মূল কাজ ছিল সুন্দরী নারীর খবর প্রশাসনিক মাথা যেমন কাজী বা দেওয়ানের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তারপর কথার ফাঁদে, নানান টোপ ফেলে মেয়েটিকে কাজী বা দেওয়ানের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
‘গেরামে আছিল দুষ্ট নেতাই কুটুনি
তার স্বভাবের কথা কিছু লও শুনি।
বয়সেতে বেশ্যা মতি কত পতি ধরে
বয়স হারাইয়া এখন বসিয়াছে ঘরে।’
কুটুনী যাদের সন্ধান দেয়, তাদের অনেককেরই শেষ পর্যন্ত নিতে হয় যৌনকর্মীর পেশা। যাকে বলা হয় পৃথিবীর আদিম পেশা। এদের নিয়ে অসাধারণ গল্প উপন্যাস আছে।
‘চল্লিশ বছরের আগুনে শুদ্ধ করা জীবন যৌবন, তার সব খাদ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। ধনিয়া নিজের মনের মতো করে সাজল। ঘরের ভেতর ঝাড়ের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে চুড়ো করে খোঁপা বাঁধল। একটা সোনালি চুমকিদার রুমাল জড়িয়ে নিল তার ওপর। ঝুটা মতির মালা দিল গলায়। একটা পাতলা নীল রেশমি শাড়িকে সায়া ছাড়াই কোমরে এক পাক জড়িয়ে নিল…। এক পেয়ালা নির্জলা দেশী মদ খেয়ে গরম করে নিল গলাটা। সর্বাঙ্গ ছাপিয়ে এক বিদ্ঘুটে আনন্দের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠল ধনিয়া। তবু প্রতীক্ষায় শান্ত হয়ে থাকে। সে আজ দাঁড়িয়ে থাকবে, মাঝরাত্রি পর্যন্ত, শেষরাত্রি পর্যন্ত – যতক্ষণ না তার নতুন জীবনের প্রথম বাবু দোরে এসে কড়া নামবে, তার নতুন নাম ধরে ডাকবে।’ (পরশুরামের কুঠার, বাছাই গল্প, সুবোধ ঘোষ)
আরেকটি অসাধারণ গল্প বিমল করের ‘আঙুর’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব জোড়া মন্দা আর দেশভাগের ফলে পুববাংলা থেকে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল – এ দু’য়ের ফলে অনেক মেয়েকেই ঘর ছেড়ে পথে নামতে হয়েছিল আর তারা বেশিরভাগ পেয়েছিল কেরানীর কাজ।
‘গয়নাগাটি বিক্রি করে কিছু টাকা আগাম দিয়ে বাকিটা কিস্তিবন্দী করে সেলাইর কল কিনে মা হলেন দর্জি। আর অনেক ধরা করার পর কল্যাণী ঢুকল মার্চেন্ট অফিসে রুটিন ক্লার্ক হয়ে। ছুটির পর কমার্শিয়াল কলেজে গিয়ে টাইপ আর শর্টহ্যান্ড শিখে নিল বছরখানেকের মধ্যে। তাতে পদোন্নতি আর বেতনবৃদ্ধি দুই-ই হল।’ (উত্তরণ, গল্পমালা ২, নরেন্দ্রনাথ মিত্র)
ডাক্তারের আদি রূপে আমরা দেখি বশীকরণ বিশারদ মেয়েদের। প্রণয়ী বশের কলাকৌশল, বন্ধ্যাত্ব নিবারণ, যৌন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে রাষ্ট্র ও সমাজ বরাবরই তাদের দ্বারস্থ হত। যেমন রম্ভাবতী। চণ্ডীমঙ্গলে পাই রম্ভাবতীর বশীকরণ ঔষধ সংগ্রহের অনুপুঙ্খ বর্ণনা।
‘ঔষধ করিয়া রম্ভা ফিরে বাড়ি বাড়ি
দোছট করিয়া পরে তসরের শাড়ী’
অনেক সময় অশিক্ষিত এইসব রমণীর অনুমান নির্ভর প্রয়োগে হিতে বিপরীত ঘটত। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই, এঁদের অনেকেরই বিষ, ভেষজ, ধাতু ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান ছিল অভিজ্ঞ ভিষকের মতোই। আসলে তাঁদের চর্চার বিষয়টি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানেরই একটি হীন কিন্তু সম্পর্কিত শাখা। এঁদের অনেক ওপরে সম্মান ও সম্ভ্রম নিয়ে যে বৈদ্যরা বসে থাকতেন, সেখানে মহাশয়ের মতো মহাশয়ারাও বিরল ছিলেন না। অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘নয়নতারা’ উপন্যাসের নয়নতারা বস্ত্রবয়ন ও কবিরাজি একসঙ্গেই করত।
সুবোধ ঘোষের বিখ্যাত গল্প ‘পরশুরামের কুঠার’ গল্পে জেনানা হাসপাতালের লেডি ডাক্তারের ডাক্তারির পাশাপাশি মরাল পুলিশিং বেশ কৌতুককর।
‘এদিকে জেনানা হাসপাতালে সন্ধ্যার আলো জ্বলছে। ধনিয়ার বেড ঘিরে নার্সদের ভিড়। সকলের মুখে অনুনয় – অন্তত এই বাচ্চাটাকে সঙ্গে রাখ ধনিয়া।
না, মিস বহিন, পারব না।
লেডী ডাক্তার- তোমার বদনামের কথা কে না জানে? চাপা দিতে তো পারবে না। তবে নিজের কাছে রাখো না কেন?
না ডাক্তারনীজী, আমি খাওয়াতে পরাতে পারব না। ছেলে কষ্ট পাবে আর বড় হয়ে আমার দুশমন হবে। ছেলেকে মানুষ করার মতো পয়সা আমার নেই।
লেডি ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন – বাচ্চাকা বাপকা নাম?
ধনিয়া – তা জানি না।
লেডি ডাক্তার রেগে উঠলেন – বারবার তোমার ওই এক কথা। যার সঙ্গে আজকাল থাকো, তারই নাম বল না কেন?
অনেকের সঙ্গেই থাকি, তার মধ্যে অনেকের নামও জানি না। কসুর মাপ করবেন ডাক্তারনীজি, যে কোনও একটা নাম লিখে দিন।’ (পরশুরামের কুঠার, বাছাই গল্প, সুবোধঘোষ)
পরশুরামের স্বভাবসিদ্ধ হাস্যরসের আড়ালে একটি খুব জরুরি বার্তা দেওয়া থাকে চিকিৎসা সঙ্কট গল্পে। যেখানে বিয়ের পর ডক্টর মিস বিপুলা মল্লিক স্বামী ভিন্ন আর কারো চিকিৎসা করেন না। এইভাবে অনেক ডিগ্রিধারী ডাক্তারই যে স্টেথোর বদলে খুন্তি নেড়েই জীবন কাটিয়ে দেন, তা নিয়ে একটি নির্মম স্যাটায়ার এই গল্পটি। যেমন সমাজে তেমনি সাহিত্যেও সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যে পেশাটি আছে, তা বোধহয় শিক্ষিকা।
‘সকলেই জানেন মিসেস সেনের মতো একজন বড় দিদিমণি ছিলেন বলেই এই মেয়ে স্কুলের এত উন্নতি হয়েছে। আট বছরের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা আট গুণ বেড়ে গিয়েছে। … বড় দিদিমণি মীরা সেন এখন কিন্তু এই মেয়ে-স্কুলের কেউ নন। একটানা আট বছর ধরে কাজ করবার পর আজ তিনি সরে গিয়েছেন।
না, ঠিক অবসর গ্রহণের ব্যাপার নয়। মীরা দিদিমণি রিটায়ার করেননি। তিনি শুধু কাজ ছেড়ে সরে গিয়েছেন। কিন্তু সকলেই জানেন, মীরা সেন এখনও এই মেয়ে-স্কুলের সব খবর রাখেন। উন্নতির খবর শুনলে খুশি হন। কোন অসুবিধার কিংবা কোন নিন্দার খবর শুনলে দুঃখিত হন।
একটা সময় বাঙালি জীবনে এইরকম প্রচুর মীরা সেনের দেখা পাওয়া যেত, যারা প্রায় একার চেষ্টায় কোন বালিকা বিদ্যালয় দাঁড় করাতেন, আর সেই ভয়ানক পরিশ্রমের প্রভাব পড়ত তাঁদের শরীরে মনে। যেমন মীরা সেন এত বেশি খাটতে গিয়ে টিবি বাধিয়ে বসেছেন। শুধু ছাত্রীদের পড়ানো বা প্রশাসনিক দায়িত্বভার নয়, স্কুলের বাগানের সব ফুল গাছে মীরাদি নিজের হাতে জল ঢালতেন। টিচারদের সকলেই স্বীকার করে ‘মীরাদির মতো খেটে পড়াবার শক্তি আমাদের নেই।’ (ব্রততী, বাছাই গল্প, সুবোধ ঘোষ)
‘হেডমিস্ট্রেস মিস পামার ছিলেন শান্তশিষ্ট নির্বিবাদী মানুষ। স্কুলের কাজ আর পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। লেখার অভ্যেসও তাঁর ছিল। থিয়োলজির ওপর তাঁর অনেক আর্টিকেল শুধু মিশনারি পত্রিকায় নয়, অন্য কাগজেও বেরত। সেকেন্ড টিচার রেবাদির ইন্টারেস্ট ছিল সাহিত্যে। তিনি ইংরেজি নাটক নভেল পড়তে ভালবাসতেন। থার্ড টিচার সুনন্দাদির ঝোঁক ছিল খেলাধূলা আর গার্ডেনিং-এ। তিনি মেয়েদের নিয়ে টেনিস ব্যাডমিন্টন খেলতেন। আমরাও তাঁকে খুব পছন্দ করতাম।’ (বন্দিনী, গল্পমালা ২ নরেন্দ্রনাথ মিত্র )
আর যে পেশার কাজ অন্যদের জীবনকথা লিখে রাখা, সেই লেখকরাও বিরল নন। আশাপূর্ণা দেবীর বকুলকথা, সুচিত্রা ভট্টাচার্যর হেমন্তের পাখি তার উদাহরণ। শুধু উপন্যাসের প্লটই নন, একজন আস্ত লেখিকাই তো হারিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগে কেউ জানতে পারেনি সৌদামিনী দেবী লিখতেন। মৃত্যুর পর তাঁর ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসে একটি হলুদ হয়ে যাওয়া কবিতার খাতা। ক্রমে জানা যায় তিনি কবিতা লিখতেন । একদিন কবিতা লেখায় মগ্ন যখন, তখন তাঁর ছোট মেয়েটি খেলতে খেলতে গরম দুধের কড়ায় এসে পড়ে, সে ক্রমে সেরে ওঠে, কিন্তু সৌদামিনীর মনের ঘা শুকোতে দেন না তাঁর স্বামী। তিনি পকেট থেকে এক বাক্স দেশলাইকাঠি বার করে বলেন, এক এক করে পুড়িয়ে মারতে সময় লাগবে, তার চেয়ে এক কাজ করো। বাড়ি সুদ্ধু সবাইকে পুড়িয়ে মারো। তাতে তুমি নিশ্চিন্তে বসে কবিতা লিখতে পারবে। এই প্রতিদিনের তীব্র বাক্যবাণ, যাকে এখন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বলা হয়, সহ্য করতে না পেরে সৌদামিনী স্বামীর পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেন তিনি আর কোনওদিন কবিতা লিখবেন না। তিনি নিজের মনকে মেরে সংসারে নিয়োজিত করেন। তাঁর পুত্ররা সব কৃতী হয়। মায়ের মৃত্যুর পর একখানা চিঠিও বেরোয় ট্রাঙ্ক থেকে। তাতে তিনি লিখে গেছেন – মা সৌদামিনী, স্ত্রী সৌদামিনী স্বামী, সন্তানের কৃতিত্বের মধ্যে সব কিছু পেয়ে গেছেন। তিনি পূর্ণ। কিন্তু লেখিকা সৌদামিনী? যে একটি চটি কবিতার বই আর খানকতক কবিতা ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারল না, সে বড় দুঃখ, বড় অপ্রাপ্তি নিয়ে যাচ্ছে। স্বামীর প্রেমে যার পাওয়া হয় না, সন্তানের সাফল্যে যার সার্থকতা হয় না, যাকে কেবলই অক্ষর গুনে গুনে পেতে হয়, তার দুঃখ কে ঠেকাবে?
এই চিঠির শেষে সন্তানদের আশীর্বাদ করে গেছেন সৌদামিনী, শত বাধাতেও তারা যেন অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে সরে না আসে, শিল্পীজীবনের অনিবার্য দুঃখকে তারা যেন ভয় না পায়।
না, সৌদামিনী রক্তমাংসের নারী নন, তিনি নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘লেখিকা’ গল্পের চরিত্র। কিন্তু তিনি বাস্তব থেকেই উঠে এসেছেন। হাজার হাজার সৌদামিনী আজও আঁচলের জায়গায় অ্যাপ্রনে হলুদ তেল মুছতে মুছতে তাদের স্বপ্নের অক্ষরটি লিখে যাচ্ছে। হয়তো, সংসার তাদের একটু পরিসর দিলে আমরা আরও অনেক সফল লেখিকাকে পেতাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন