রম্যাণী গোস্বামী
আমার হাতে দড়িটা ধরা। হাতটা এতক্ষণ কাঁপছিল। এখন কাঁপুনিটা একটু কমেছে। ঘামে ভিজে জবজব করছে হাতের তালুর ভিতরে দড়ির অংশটা। তা ঘামের আর দোষ কী? যা গরমটা পড়েছে এবার। এই গরমের মধ্যেই আবার মা বাবা বিয়েবাড়ি গেল। মা আমাকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য সাধাসাধি করল কত। পড়া আছে এই বাহানায় কাটিয়ে দিলাম। এমন সুযোগ কি বারবার আসে? একে কাজে লাগাতে হবে না?
বাবা কিছু বলেনি। শুধু বেরনোর আগে একবার এসে দাঁড়িয়েছিল পড়ার ঘরের দরজার কাছে। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে বসে থাকলেও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম বাবার মুখখানা। আসলে সেই সময় আমার পিঠ ফুঁড়ে দুটো চোখ গজিয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাবা সরে গেল। একটু পরে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম।
আচ্ছা? বাবা কি বুঝতে পেরেছে যে একমাত্র সন্তানের সঙ্গে এই তার শেষ দেখা?
এখন দড়িটা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফ্যানের ব্লেডের ভিতরে গলানোর চেষ্টা করছি। কষ্টের পকেটমানি থেকে কেনা জিনিসটা। কিন্তু শালা এমন বেইমান যে আমার সব প্রচেষ্টা ভেস্তে দিয়ে বারবার পিছলে যাচ্ছে। তবে হাতে এখনও অনেকটা সময়। মাত্র রাত আটটা। ধীরেসুস্থে কয়েকবারের চেষ্টায় দড়িটা শক্ত করে কামড়ে ধরল ফ্যানটাকে। বেশ কয়েকটা পাক দিয়ে টেনেটুনে দেখলাম। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে অন্য প্রান্তে একটা মজবুত ফাঁস বানালাম ধৈর্য ধরে। এই করতেই গলা ব্লটিং পেপারের মত শুকিয়ে খরখরে। হাতের কাঁপুনি ঘষটে ঘষটে কখন যেন চলে এসেছে বুক থেকে তলপেটে, তলপেট থেকে পায়ে। হাঁটুদুটো এমনভাবে কাঁপছে যে চেয়ারের উপরে ব্যালেন্স করে দাঁড়ানোই মুশকিল। তবু টলমল পায়ে উঠলাম। ইস্, একটু জল খেয়ে নিলে ভালো হত। থাক। একবার নেমে পড়লে আর যদি উঠতে না পারি?
ফাঁসটা গলায় পরাতেই সমস্ত শরীরের এ মাথা থেকে ও মাথা একটা অজানা শিরশিরানি দৌড়ে বেড়াতে লাগল বিদ্যুতগতিতে। ওদিকে দড়িটা আমার ঘেমো গলাকে প্রাণপণ চাটছে ওর জিভ দিয়ে। পড়াশোনায় সাদামাটা হলেও আমি কলেজের সেরা অ্যাথলিট। বড় রেসের স্টার্টিং পয়েন্টে দাঁড়িয়েও আগে কখনও এই জাতীয় অনুভূতি হয়নি।
চোখ বুজতেই কলেজের বিশাল মাঠ লাফিয়ে নেমে এল বন্ধ চোখের পর্দায়। আর তারপরই এল সুন্দরী ঋতজা। আমাদের ক্লাসের টপার। ওর ভাসা ভাসা খানিকটা অবাক হয়ে যাওয়া চোখদুটো, ছিপছিপে গোলাপি ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের বাঁকা হাসি – উফ্! আমার বুকের বাঁ কোণে ব্যর্থতার হুল ফুটিয়ে দিল। রোজ রোজ এই কাঁকড়াবিছের কামড় আর সহ্য হয় না। ইম্পসিবল। সর্বক্ষণ মনে হয় মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছি আর উইনিং পয়েন্টটা ক্রমশই দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ঝাপসা হতে হতে।
গলায় যখন চেপে বসাচ্ছি ফাঁসটাকে, তখন হঠাৎ শুনলাম কে যেন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, ছিটকিনিটা না খুলেই চলে যাচ্ছ বাবা? ও অনি…
আরে! এটা তো রতনজেঠুর গলা! এইসময় এখানে ওই বুড়ো এল কীভাবে? আমাদের ফ্ল্যাটের তলাতেই ছোটমতো মুদি দোকান আছে রতনজেঠুর। রোজ বিকেলে আমি সেখানে যাই দুধের প্যাকেট আনতে। কাছেই বাড়ি জেঠুর। দোকানে ঢোকার মূল দরজায় একটু উঁচুতে একটা ছিটকিনি আছে। আগে জেঠু টুলের উপরে দাঁড়িয়ে হাত পেত। কিন্তু এখন ভার্টিগোর জন্য রিস্ক নিতে পারে না। একা মানুষ। একবার তো পড়ে গিয়ে মাথাটাথা ফেটে কেলেঙ্কারি। রোজ খুব সকালে জগিংয়ে বেরনোর সময় ছিটকিনিটা খুলে দেওয়াই আমার ডিউটি। এজন্য রতনজেঠু কাকভোর হতে না হতেই হাঁ করে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে আমার অপেক্ষায়।
তাই তো! আমি না থাকলে কে খুলে দেবে বুড়োকে ওই ছিটকিনি? পাড়ার ঘুমন্ত কুকুরগুলো?
চিন্তাটা কেন যেন জগদ্দল পাথরের মতো বুকে চেপে বসেছে। কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। আবার ডাকল রতনজেঠু, অনি, অনির্বাণ,
লক্ষ্মী বাবা আমার, ছিটকিনিটা খুলে দাও না। কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছি হাঁটু ব্যথা নিয়ে।
মাথার উপরে হতচ্ছাড়া ছিটকিনিটাও খটখট শব্দে নড়ছে। জেঠুর ফ্যালফ্যালে অসহায় চাহনি আর ফোকলা দাঁতের সরল হাসিটা খচ করে বিঁধল বুকে। তড়িঘড়ি ছিটকিনিটা খোলার জন্য হাত টানটান করে দিলাম উপরের দিকে। খট করে ওটা খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুক থেকে যেন একটা পাথর সরে গেল। চেয়ার থেকে নেমে পড়লাম মেঝেতে। আমার হাতের মধ্যে মৃত সাপের মতো নেতিয়ে আছে দড়িটা। ব্যালকনিতে গিয়ে নীচের ট্রাশবিন লক্ষ করে ওটাকে ছুঁড়ে ফেলতেই স্পষ্ট দেখতে পেলাম উইনিং পয়েন্টটা ঝকঝক করছে সূর্যের আলোয়। সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে এগিয়ে যাচ্ছি চারপাশের বিপুল জয়ধ্বনি আর করতালি শুনতে শুনতে।
রেসটা কি তাহলে জিতেই গেলাম?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
দারুণ দারুণ লাগলো, অনির্বাণ তো রেস জিতলোই,আর আপনি ও , এমন সুচেতনাই ছড়িয়ে যাক সকলযুব সমাজের মধ্যে,
অনেক ধন্যবাদ। আপনি পড়লেন, জানালেন, ভালো লাগলো খুব।