রাসয়াত রহমান জিকো
জেলে ছিলাম অনেকদিন। কত বছর বয়স থেকে ছিলাম সে কথা পরে বলব। জেল থেকে বের হওয়ার সময় আমার বয়স ছিল ৩০ বছর। ৬ বছর ৬ মাস পর জেল থেকে বের হয়েছি। এখন তাহলে হিসাব করে বের করাই যায় কত বছর বয়সে জেলে গিয়েছিলাম। তবে আমার সাজা ৭ বছর ছিল। উত্তম ব্যবহারের কারণে ৬ মাস মওকুফ পেয়েছি। জেলের জীবনে মাথা পুরাই ঠান্ডা ছিল। অনুশোচনায় ভুগেছি। অনুতপ্ত হয়েছি। জীবনের অল্প বয়সে যা করেছি তা অনেক বড় ভুল ছিল। আমার বাবা অবস্থাসম্পন্ন না হলে মূল জীবনে আবার ফিরতে পারতাম কি না সেটাও একটা ব্যাপার।
জেলের জীবন কেমন ছিল এটা নিয়ে আমি কথা বলি না। একদিন জেলের দেয়ালে হাত রেখে চিন্তা করছিলাম এটা কোথায় আসলাম। এখানে থেকে কি কখনও বের হতে পারব? কেউ কিভাবে এখানে থাকে? তবে মানুষ অভ্যাসের দাস। যে কোনও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা নিয়েই সম্ভবত মানুষ জন্মায়। জেলের জীবন নিয়ে বাইরে কারো সাথে কথা বলি না। কথা বললেই যে কারণে জেলে গিয়েছিলাম সেই স্মৃতি ভেসে উঠবে, আবার মন খারাপ হবে। তবে মন খারাপ ভাব আমার যায় না। অদ্ভুত বিষণ্ণতায় থাকি। খুব ভাল জীবন কাটাতে পারতাম। এই বিষণ্ণতার সঙ্গী না হলেও আমার চলত।
বাবার কথা বলছিলাম। তিনি নামকরা ব্যবসায়ী। আমার দাদাও ছিলেন নামকরা ব্যবসায়ী। ৩ পুরুষের বনেদী ব্যবসা আমাদের। জেল থেকে বের হয়ে বাবার ব্যবসার চেয়ার দখল করলাম। এক জেনারেশন কষ্ট করে পরের জেনারেশন ভোগ করে। দাদার পরিবহন ব্যবসা ফুলে ফেঁপে গিয়েছিল বাবার আমলে। বাবাই সামলেছেন এতদিন। এখন আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে। পাল বংশের শেষ রাজা ছিলেন মদন পাল। তার আমলের পর পাল বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। আমি মদন পাল হতে চাচ্ছি না। ধর্মপাল বা রামপাল হলেই চলে।
দীর্ঘদিন জেলে থাকার কারণে চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। জেলে থাকতে চোখের উপর অনেক অত্যাচার গিয়েছে। তাই চোখের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এমনিতে আমি এদিক সেদিক তেমন যাই না। জেল থেকে ফেরা আসামীকে নিয়ে কেউ সুস্থ স্বাভাবিক কথা বলে না। স্বাভাবিক জীবনে ফেরা আমাদের জন্য অনেক কঠিন। আড়ালে মানুষ ফিসফাস করে বুঝি। সেই ফিসফাস যেন নিজের কাছে না আসে সেই চেষ্টা করতে থাকি সবসময়। বাবা প্রভাবশালী তাই কেউ হয়ত সামনা সামনি কিছু বলে না কিন্তু ফিসফাস আমাকে নিয়ে সব জায়গায় হয়। তেমনই এক সমস্যায় পড়লাম চোখে দেখাতে গিয়ে। ডাক্তার আঙ্কল বলেই ফেললেন কতজন কত কিছু করে তোমার বাবা এত টাকা পয়সা দিয়েও তোমাকে বাঁচাতে পারল না? এই কথা শুনতে কার ভাল লাগে?
তবে তিনি কথাটা খুব একটা বুঝে বলেননি। বলতে হয় তাই বলে ফেলেছেন। কিন্তু আমার তো খারাপ লাগল। আমি বলেই ফেললাম, অপরাধী যতই প্রভাবশালী হোক তার জেলে যাওয়া উচিত। না হলে সে একই অপরাধ বারবার করে যাবে। বিচারহীন সংস্কৃতি খুব ভালো কিছু না। আঙ্কল শুনলেন কিন্তু এমন ভাব করলেন যে বাবা তুমি জেল খাটা আসামী তুমি পণ্ডিতের মত কথা বললে কিভাবে হবে। কিন্তু জেলে থেকেও আমি লেখাপড়া করে গিয়েছিলাম। সরকার আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছিল। আমি গ্র্যাজুয়েট হয়েছি। জেলে অবসর সময়ে বইপত্র আর আমার পেপার পড়তাম। তাই জ্ঞানলাভ কম হয়নি।
যার সাক্ষীতে আমি জেলে গিয়েছিলাম, তিনি ছিলেন আমি যে কলেজে পড়তাম, সেখানকার প্রফেসর। ওঁর নাম প্রাণ দত্ত। ফিজিক্সের প্রফেসর। দেখতে যেন আইনস্টাইনের মত লাগে বেশভূষা সেরকম রাখতেন। আইনস্টাইন পৃথিবীর সবথেকে স্মার্ট ব্যক্তি, প্রত্যেককে অন্ততপক্ষে দশবার সেটা তিনি মনে করিয়ে দিতেন। আইনস্ট্যান্ড নোবেল পুরস্কার না পেলে নোবেল পুরস্কারের যে কোন মূল্যই থাকত না, ওঁর মাধ্যমে আমরা এটা জানতে পেরেছিলাম। তবে ফটো ইলেকট্রিক ক্রিয়ার থেকে সময় জিনিসটা নিয়ে স্যার অনেক বেশি সিরিয়াস থাকতে। উনি কেমন যেন একটা ঘড়ি পড়তেন হাতে। এই ঘড়িতে ৬০ সেকেন্ডে এক মিনিট বা ৬০ মিনিটে এক ঘন্টা হতো না আমরা নিশ্চিত। ঘড়িতে আদৌ মিনিট বা সেকেন্ডের কোনও ব্যাপার ছিল কিনা সেটাও কেউ জানত বলে মনে হয় না।
অফিসে একদিন কাজ করার সময় জানলাম উনি ইহলোক ত্যাগ গিয়েছেন। এই খবর আমার কাছে কীভাবে আসলো সেটাও একটা ব্যাপার। কারণ কলেজের বন্ধুবান্ধবদের সাথে আমার তেমন খাতির নেই। জেল থেকে বের হয়ে সঙ্গত কারণেই যোগাযোগ রাখিনি তেমন একটা।
কিন্তু প্রফেসরের মৃত্যুর খবর আমার কাছে আসল কারণ আমি জানতে চাচ্ছিলাম। না কোন প্রতিহিংসা আমার মধ্যে কাজ করছিল না। আমার শাস্তি হওয়ার পর শুরুতে আমি ভেবেছিলাম সবার উপর প্রতিশোধ নেব কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি তো আসলে অপরাধীই। ব্যাপারটা এমন না যে কেউ আমাকে ফাঁসিয়েছে। আমি অপরাধ করেছি আমার ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার হয়েছে দেখে আমি শাস্তি ভোগ করেছি।
স্যারের শ্রাদ্ধের কাজ শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর ওঁর বাসায় গেলাম। স্যার বিয়ে করেননি। বিদেশে থাকা তাঁর ভাইপোরা কেয়ারটেকার রেখে দিয়েছে বাসা দেখভাল করার। কেয়ারটেকারের নাম শামীম। বেশি কথা বলে। সে ঢুকাল আমাকে। শামীমের চোখ বলে সে টাকা খুব ভাল চিনে। শুরুতে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিল না। টাকা দিয়ে ম্যানেজ করলাম। স্যারের রুম বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। শামীমকে ভাল বখশিশ দেওয়া আছে, বলেছি ২ ঘন্টা আমাকে বিরক্ত না করতে। স্যারের কোনও ডায়েরী আছে কি না খোঁজার চেষ্টা করলাম। স্যারের ব্যবহার করা মোবাইল লক করা। সেটার পাসওয়ার্ড কেউ জানে না।
স্যার আমাদের ফিজিক্স পড়াতেন কলেজে। সময় নিয়ে তাঁর ব্যাপক আগ্রহ আর গবেষণা ছিল। পড়ানোর সময় বিড়বিড় করে কী জানি বলত। একই বস্তু বিভিন্ন জায়গায় থাকার সম্ভাবনা বিষয়ক আলোচনা। সেগুলাকে সরলরৈখিক পথে কী করলে মানুষ বিভিন্ন টাইম ফ্রেমে বিচরণ করবে। স্যারের রুম ঘেঁটে একটা পুরানো মোবাইল পেলাম। সেটা নিয়ে ফেরত আসলাম। শামীমের কাছে এই মোবাইলের জন্য ১০ হাজার টাকা দিলাম। শামীম নাকি ৫০০ টাকায় বিক্রী করতে চাইছিল কেউ কিনে নায়। এই ঘটনা অবশ্য শামীম বলে না। শামীমকে বললাম, আমি আবার আসব।
পরের কয়েকদিন অফিসে ব্যস্ত ছিলাম। এরপর বহু বছর পর এক কলেজ বন্ধু ফোন দিল। তানিমা কই থাকে জানতে পারলাম। ঢাকার বাইরে কোন এক স্কুলে চাকরি করে। আমি ঠিক করলাম দেখতে যাব। তাঁর সামনে যাওয়ার সাহস নেই দূর থেকে দেখব শুধু একবার। আমি অনুতপ্ত। ভীষনভাবে অনুতপ্ত। স্যারের পুরান মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু একটা ঝামেলা হয়ে গেল। আমার সামনের জগৎ চেঞ্জ হতে লাগল। এ কী অবস্থা! আমি ১০ বছর পিছিয়ে যাচ্ছি কীভাবে!
আমি আমার সময় থেকে ১০ বছর পিছিয়ে গেছি বুঝতে পারলাম কারণ আমার বাবার অফিসের রুমটা আমার সামনেই পরিবর্তন হয়ে গেল। এই রুম ১০ বছর আগেও আমি চিনতাম। ক্যালেন্ডার চেঞ্জ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি পরিবর্তন হই নাই। দৈহিকভাবে আমি ২৮ বছর বয়সেই আছি। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম। আজ সেই দিন যার কারণে আমার জেল হয়েছিল। ঘটনা কোথায় ঘটেছিল আমি জানি, আমি সেদিকেই রওনা দিলাম।
কলেজে পড়ার সময় তানিমাকে পছন্দ করতাম আমি। কিন্তু সে পাত্তা দিত না আমাকে। ইগোতে লাগত আমার। আমি ছিলাম মোটামুটি টাকা পয়সাওয়ালা লোকের ছেলে। গাড়ি নিয়ে যেতাম কলেজে। আমাকে পাত্তা দিবে না কেন? তানিমাকে আসতে যেতে কয়েকবার প্রপোজ করেছিলাম। জানিয়েছিলাম ভালবাসার কথা। সে কখনোই পাত্তা দেয়নি। তাই দুই বন্ধু মিলে একদিন ড্রিংক করছিলাম। দুই বন্ধু বলল চল তানিমাকে উঠিয়ে আনি যা করবার করবি। তিনজন মিলে জোর করে গাড়িতে তুলেছিলাম। ঘটনা দেখে ফেলে প্রাণ দত্ত স্যার।
এই ঘটনা আজ আমি ঘটতে দিব না। আমি জায়গা মত চলে এসেছি। এই তো সামনে তিনজন। এদের একজন আমি নিজেই। সরাসরি বললাম, দাঁড়াও। তিনজনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমার আমি আমাকেই বলল, আপনি কে। সরাসরি বললাম, তোমাকে মারতে আসছি, অভিশপ্ত জীবন চাই না আমি। ঠিক তখন আমার পিছন থেকে আরেকজন বলল, দাঁড়াও। আমি ঘুরে তাকিয়ে চমকে গেলাম। আমার মত দেখতে আরেকজন যার কোলে ছোট ফুটফুটে বাচ্চা। সে বলল, তোমার পরের জীবনটাও জেনে নাও।
আমি নাকি গিয়েছিলাম নদীর পাড়ে থাকা সুন্দর এক স্কুলে। তানিমা সেই স্কুলে পড়াত। সে আমাকে চিনতে পারেনি শুরুতে। আমি অপরিচিত কেউ হয়েই তার সাথে দেখা করেছিলাম। ধীরে ধীরে পরিচিত হলে একদিন তানিমা তার জীবনে ঘটে যাওয়া খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলে। আমি তাকে বিয়ে করব বলি। কিন্তু নিজের পরিচয় জানাইনি। তানিমাও দূরে নিরবে নিভৃতে নিজের মত থাকত। কলেজ জীবনের কারো সাথে যোগাযোগ ছিল না। বিয়ে হয়েছিল আমাদের। বিয়ের আগে জানিয়েছিলাম সব। তারপর ১ মাস সে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। প্রতিদিন তার স্কুল থেকে দূরে বসে থাকতাম। কাছে যেতাম না ভয়ে। চোখ নামিয়ে রাখতাম। ক্ষমা সে আসলে করবেই বা কীভাবে! সবই বুঝি। কিন্তু সে করেছিল। আমরা বিয়ে করি। ভালই চলছিল সব। আমাদের একটা মেয়ে হয়। মেয়ে হওয়ার পর আরেকবার বুঝি কত বড় অপরাধ করেছিলাম আমি। তবে তানিমা আর নেই। ক্যান্সার ধরা পড়ে।
১৮ বছর, ২৮ বছর, ৩৮ বছর আমার তিন সত্ত্বা বর্তমানে একই সময়ে বিচরণ করছি। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সময়ের কোনও একটা পরিবর্তন ঘটছে, কোনওভাবে আমি আবার এখন জেলে ঢোকার জায়গায় চলে গেলাম। বর্তমানে প্রচন্ড রেগে আছি, মাথায় ঘুরছে প্রাণ দত্তকে আমি দেখে নিব, তানিমারও আরও সর্বনাশ করব। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ চুপ হয়ে গেলাম, এখন বুঝতে পারলাম, কেন আমি প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে বের হতে পেরেছিলাম। টাইম ফ্রেমের কোনও এক জটে বুঝতে পেরেছিলাম, সামনে কখনও ভালো সময়ও আসবে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন