অনন্যা দাশ
“এই বিমান, তুই একবার বলেছিলি না যে তোর এক বন্ধু আছে যে খুন টুনের কেসে তোকে সাহায্য করে?”
“হ্যাঁ, আছে তো, ওর নাম সজল, আমার স্কুলের সহপাঠী। এখানে একটা অফিসে সাধারণ চাকরি করে। বলে এখন টাকার দরকার তাই কাজ করছি। যেদিন দরকার হবে না ছেড়ে দেবো। গোয়েন্দা হতে চায়। কেন কিছু দরকার আছে নাকি অনিদা?”
“হ্যাঁ, একটা বেশ ঝামেলার কেসে ফেঁসে গেছি। ওকে একটু আসতে বলবি? তাড়াতাড়ি কিন্তু। এই ধর আধঘন্টার মধ্যে?” অনিকেত ভদ্রর স্বরে কাকুতি।
“ঠিক আছে বলছি। আমার মন বলছে ও অফিস কামাই করে হলেও পৌঁছে যাবে।”
“তাহলে খুব ভালো হয়। আসলে যিনি মারা গেছেন তাঁর বৈজ্ঞানিক হিসেবে বেশ নামডাক। ওপর মহল থেকে খুব চাপ আসছে। ওঁর মৃত্যুর রহস্যের কিনারা না করতে পারলে আমার কপালে প্রচুর দুর্ভোগ, তাই আর কী। নাহলে আর তোকে কেন বিরক্ত করব বল?”
“তুমি ও সব নিয়ে কিছু ভেব না অনিদা। আমি সজলকে রাজি করিয়েই ছাড়ব,” বিমান আশ্বাস দিয়ে বলল।
ইন্সপেক্টর অনিকেত ভদ্র হোটেলের সুইমিং পুলে ভেসে ওঠা দেহটাকে দেখলেন। স্লিপিং সুট পরে সুইমিং পুলে নামতে গেলেন কেন ভদ্রলোক কে জানে। আজ ভোরে ওদের থানাতে ফোন আসে এই ব্যাপারটা নিয়ে আর সেই থেকেই এই বিলাসবহুল হোটেলের চত্বরে রয়েছেন তিনি। ঘুমের দফারফা। ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। এবার বডিটাকে সরানো হবে। মৃতের নাম ডক্টর গঙ্গাধর শর্মা। ডক্টর মানে মেডিকেল ডাক্তার নয়। পিএইচডি – পেশায় নামকরা বৈজ্ঞানিক। বয়স পঞ্চান্ন। বিজ্ঞানের একটা কনফারেন্সে এসেছিলেন নিজের ল্যাবরেটারির লোকজনকে নিয়ে। গতকাল বিকেলে কনফারেন্সের উদ্যোক্তারা নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন, সেখানে খাওয়া দাওয়া করে সবাই হোটেলে ফেরেন আর আজ সকালে সুইমিং পুলে ডক্টর শর্মার দেহ ভাসতে দেখা যায়।
সজল এসে পড়তে ইন্সপেক্টর ভদ্র হোটেলেরই একটা ছোট কনফারেন্স ঘরে এক এক করে সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলেন। ঘর থেকে সুইমিং পুলটা দেখা যাচ্ছিল। সেখানে তখনও ভাসছিল দেহটা।
প্রথমেই পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ভাস্কর সেনগুপ্তর ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকেই সে জানালা দিয়ে সুইমিং পুলে ভাসমান দেহটাকে দেখতে পেল। তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কোনওরকমে মুখ চেপে সে পাশের বাথরুমে ছুটে গেল। যতক্ষণে সে ফিরল ততক্ষণে সজল তার বসার চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে যাতে সে বাইরে না দেখতে পায়।
“বসুন। এখন কেমন লাগছে?”
“ঠিক আছি। আসলে এমনটা তো কেউ আশা করে না।”
“মৃত্যু হয়েছে আজ খুব ভোরে। এই ধরুন পাঁচটা কী তারও আগে। তখন আপনি কী করছিলেন?”
“কাল তো কনফারেন্সে ডিনার ছিল। সেটা থেকে ফিরতে ফিরতেই রাত এগারোটা বেজে গিয়েছিল। কনফারেন্স আজ সকাল দশটা থেকে শুরু, তাই আমি দিব্যি ঘুমোচ্ছিলাম। আমার প্রেজেন্টেশানও গতকাল হয়ে গেছে তাই কোনও তাড়া ছিল না। ঘুম ভাঙলো রাজনদার ঠেলায়। সে জানতে পেরে আমার সেল ফোনে ফোন করেছিল কিন্তু আমি ফোন অফ করে ঘুমোচ্ছিলাম। রাজনদা খুব ভোরে ওঠে। আজকেও দেখলাম স্নান টান করে ফেলেছিল ওই ঘটনাটার আগেই।“
“রাজন মানে রাজন দিওয়ানের কথা বলছেন? যিনি আপনাদের সঙ্গে এসেছেন?”
“হ্যাঁ। রাজনদা আর আমি একটা ঘর শেয়ার করছিলাম হোটেলে। রাজনদা মাস ছয়েক হল আমাদের গ্রুপে এসে যোগ দিয়েছেন। অনেক সিনিয়ার অবশ্য, তাই উনি ল্যাব ম্যানেজার গোছের পোস্টে রয়েছেন। অনেক দিন হল নাকি রিসার্চ ছেড়ে দিয়েছিলেন তারপর সম্প্রতি মনে হয়েছে গবেষণার কাজ খুব মিস করছেন তাই আবার ফিরে এসেছেন। মাথা খুব পরিষ্কার আর জ্ঞান প্রচুর। ইদানীং আমাদের কাজে কিছু সমস্যা হলে আমরা, মানে আমি আর শঙ্কর রাজনদার কাছেই যেতাম। স্যার তো আমাদের কিছু বোঝাতে গেলে খুব রেগে যান, ইয়ে মানে যেতেন… কিন্তু রাজনদা কোন রাগ টাগ না করে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন।“
“শঙ্করটা কে?”
“ও পি এইচ ডি স্টুডেন্ট স্যার। ও কনফারেন্সে আসেনি।“
“আপনাদের কিছু বোঝাতে গেলে মানে? অন্যদের বোঝাতে গেলে রাগ করতেন না?”
“ইয়ে মানে…”
“কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন,” ইন্সপেক্টার অনিকেত ভদ্র একটু কড়া ভাবেই বললেন।
“মানে উনি তো মারা গেছেন ওঁর সম্পর্কে বাজে কথা বলব?” আমতা আমতা করে বলল ভাস্কর।
“ওঁর খুনি ধরা পড়ুক সেটা আপনি চান তো?”
“হ্যাঁ স্যার, তা চাই।“
“তাহলে বলুন।“
ইতস্তত করে ভাস্কর বলল, “মানে মেয়েরা জিগ্যেস করলে কিছু উনি তত রাগ করতেন না!”
“ও আচ্ছা, মেয়েরা মানে রাধিকা আর শুচিস্মিতা তো?”
“হ্যাঁ স্যার।“
“আচ্ছা উনি তো সাঁতার জানতেন না?”
“না, সেই নিয়ে কথাও হয়েছিল। স্যার বলেছিলেন আমার তো অন্য হোটেলে থাকলেও হত, এই হোটেলের ঘরের দাম বেশি শুধু সুইমিং পুলের জন্যে যেটা আমার কোনও কাজেই লাগবে না।“
“অবশ্য সাঁতার জানলেও যে খুব একটা লাভ হত তা নয়। কেউ জোর করে মাথাটা জলের তলায় চেপে ধরে রেখেছিল। নাহলে পুলের বেশ কিছুটা অংশে গভীরতা তত বেশি নয়। ডুবে যাওয়ার কথা নয় লম্বা মানুষের। কাজটা যে করেছে সে সাঁতার জানে ভালো, সেটা বোঝা যাচ্ছে,” অনিকেত বললেন।
এর পর শুচিস্মিতাকে ডাকা হল। সে বেশ সুন্দরী এবং সেটা সে ভালোমতন জানে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও তার সাজগোজ কিছু কম হয়নি। ততক্ষণে অবশ্য বডিটা জল থেকে তোলা হয়ে গেছে তাই তার অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। শুচিস্মিতাও ওই এক কথাই বলল। সে আর রাধিকা একটা ঘরে থাকছিল। ফিরতে রাত হয়েছিল তাই সকালে ওঠার চেষ্টা করেনি। দরজায় দুম দুম ধাক্কা পড়তে তবে তার ঘুম ভেঙেছে।
“আমার ঘুম খুব গাঢ়। রাধিকা উঠে চলে গেলেও আমি বুঝতে পারতাম না। রাধিকা অবশ্য সাঁতার জানে না। তাই ওর জলে নামার প্রশ্ন নেই। তবে আমার খবরটা শোনার পর থেকেই খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কোনও সময় কিছু আটকে গেলে বোঝাবার চেষ্টা করতেন।“
আর নতুন কিছু বলতে পারল না শুচিস্মিতা।
রাধিকাকে সাধারণ দেখতে আর সাজ পোশাকেরও তত বাহার নেই। চোখে চশমা, আর বেশ সিরিয়াস গোছের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছিল কিন্তু চশমার আড়ালে চোখদুটো ভারি উজ্জ্বল। ওই রাতে ফেরা ইত্যাদি একইরকম কয়েকটা কথা বলার পর কিন্তু সে একটু অন্য একটা কথা বলল।
“গতকাল রাতে পার্টিতে স্যার একটা সময়ের পর থেকে বেশ মনমরা অন্যমনস্ক মতন হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক কখন থেকে বলতে পারব না। পার্টির মাঝামাঝি সময় থেকেই মুখ একেবারে বাংলার পাঁচের মতন করে ঘুরছিলেন। আমার যতদূর মনে হয় ওই সেলফিটা তোলার পর থেকেই ওঁর মুড অফ হয়ে যায়। সেলফিটা তোলার পর দেখলাম ভূত দেখলে যেমন হয় তেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওঁর মুখ! অন্যরা পার্টিতে আনন্দ করতে ব্যস্ত ছিল তাই খেয়াল করেনি মনে হয় কিন্তু আমি দেখেছি। আমার মনে হয়েছিল হঠাৎ কাউকে দেখে ওঁর ওই রকম চেহারা হয়েছিল।“
“কোন সেলফি?” সজল জিগ্যেস করল। রাধিকা ফোনে একটা সেলফি বার করে দেখাল। ওদের ল্যাবের সবাই রয়েছে। রাজন এগিয়ে গিয়ে সেলফিটা নিয়েছে।
“রাজনদাই তুলেছিল। আমাদের সবাইকে ছবিটা ফরোয়ার্ড করে দিয়েছে।“
“ও, সেলফিতে তো সামনে কেউ রয়েছে কিনা বোঝা যাবে না। কী করে বোঝা যাবে উনি কাকে দেখেছিলেন? আচ্ছা শুচিস্মিতা ভোরবেলা উঠেছিলেন কিনা বলতে পারবেন?”
“না, ও ওঠেনি। ওর ঘুম খুব গাঢ় আর আমার ঘুম খুব পাতলা। ঘরে এক বিন্দু শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যায়। আমাদের ঘরের বাইরে দিয়ে ক্রমাগত লোকজনের যাতায়াত হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠিনি। আমি কী করে বুঝব ওইরকম কিছু হয়েছে। শেষে রাজনদা এসে দরজা ধাক্কা দিতে আমিই উঠে গিয়ে খুললাম, তখন জানলাম।“
এর পর এলেন রাজন দিওয়ান। গোঁফ, দাড়ি, লম্বা চুল সবেতেই একটু একটু করে পাক ধরেছে। চোখ দুটো কটা, মাঝারি গড়নের চেহারা। ফুল হাতা জামা পরে ফিটফাট, যেন এখুনি কনফারেন্সে যোগ দিতে চলে যাবেন।
বললেন, “আমি রাতে যখনই শুই না কেন আমার খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। অনেক দিনের অভ্যাস। আর রোজ ভোরে আমি মর্নিং ওয়াকে যাই। আজও তাই গিয়েছিলাম। মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে হোটেলের লবিতে হইচই দেখে জিগ্যেস করলাম কী হয়েছে। তখন ওরা বলল সুইমিং পুলে মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমি কৌতূহল মেটাতে গিয়ে দেখি…”
“ও। আচ্ছা গতকাল রাতে আপনি যখন সেলফি তুলছিলেন তখন কিছু একটা দেখে নাকি গঙ্গাধরবাবুর মুড অফ হয়ে গিয়েছিল। কাউকে দেখেছিলেন সেই রকম? বা উনি কিছু বলেছিলেন আপনাকে?”
“না, আমি তো কিছু বুঝতে পারিনি।“
আরও কয়েকটা প্রশ্ন করেও যখন নতুন কিছু পাওয়া গেল না তখন অনিকেত ভদ্র রাজনকে যেতে বলে সজলকে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কী করা যায়?”
“কনফারেন্স কতৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলে হয় ওরা ভিডিও করিয়েছিলেন কিনা কাউকে দিয়ে। তাতে যদি কিছু বোঝা যায়।“
ওদের ফোন করে জানা গেল পার্টিতে ভিডিও করা হয়েছিল। সজল বলল, “ঠিক আছে আমি গিয়ে দেখছি। আরেকটু রিসার্চও করা দরকার মৃত গবেষককে নিয়ে। এখন আসি। বিকেলে থানায় ঢুঁ মারব।“
বিকেলে সজল থানায় গিয়ে বলল, “আচ্ছা আপনাদের এখানে উর্দু পড়তে পারে এমন কেউ আছে? আমি চেষ্টা করেছি লেখাটা যেমন ছিল তেমনটাই কপি করে আনতে।“
“হ্যাঁ, কন্সটেবল মহিদুল আছে, সে মনে হয় উর্দু পড়তে পারে,“ বলে ঘন্টা বাজিয়ে তাকে ডেকে পাঠালেন।
“মহিদুল তুমি উর্দু পড়তে পারো?”
“হ্যাঁ স্যার, মোটামুটি পারি।“
সজল একটা কাগজের টুকরো তার সামনে মেলে ধরল।
মহিদুল কন্সটেবল দেখে বলল, “’মেহের’ কথাটা লেখা রয়েছে।“
অনিকেত আশ্চর্য হয়ে জিগ্যেস করলেন, “কোথা থেকে পেলে এটা? আর মানেই বা কী?”
“আপনার সঙ্গে হওয়া কথামত আমি গিয়ে পার্টির সময়কার ভিডিও ফুটেজ দেখে সামনে কেউ আছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম কিন্তু তেমন কাউকে দেখলাম না। ভাগ্য ভালো ভিডিওগ্রাফার ওদের পিছনেই ছিল। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল যে সেলফি তোলার জন্যে রাজন যখন তার হাতটা উঁচু করল তখন ওর জামার হাতাটা নেমে গিয়েছিল। তখনই ওর হাতের ওই উর্দুতে মেহের লেখা উল্কিটা দেখতে পাই। ওকে আরেকবার ডাকতে হবে। কারণ আমার ধারণা ওই উল্কিটাকে দেখেই গঙ্গাধরবাবুর মুড অফ হয়ে গিয়েছিল।“
অনিকেত ভদ্র হোটেলে ফোন করলেন। কিছুক্ষণ কথা বলা আর অপেক্ষার পর ফোন ছেড়ে দিয়ে বললেন, “রাজন দিওয়ান হোটেল থেকে হাওয়া! আমি ওদের প্রত্যেককে বলেছিলাম আমি না বলা পর্যন্ত ওখান থেকে নড়া চলবে না তাও সে পালিয়েছে। দেখি কী করতে পারি। বাকি তিনজনকে একত্র করতে বলেছি। চলো যাই।“
আবার সেই ছোটো কনফারেন্স ঘর। এবার ভাস্কর, রাধিকা আর শুচিস্মিতা এক সঙ্গে।
অনিকেত ভদ্র জিজ্ঞেস করলেন, “মেহের কার নাম আপনারা জানেন?”
শুচিস্মিতা দুম করে বলল, “মেহেরুন্নিসা স্যারের ওয়াইফের নাম ছিল। উনি বছর তিনেক হল গত হয়েছেন। তাঁকেই স্যার মেহের বলে ডাকতেন।“
অন্য দুজন শুনে মাথা নাড়ল।
সজল বলল, “আমি জানি আপনাদের তিনজনের মধ্যে কেউ খুনি নয়। ভাস্করের তো ভাসমান দেহ দেখে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওটা অভিনয় হতে পারে না। রাধিকা সাঁতার জানেন না আর শুচিস্মিতা ঘর থেকে বেরোননি তাই আপনাদের তিনজনকে যেতে দেওয়া হবে শীঘ্রই তবে তার আগে আমি একটা গল্প বলব। আজ সারাদিন ধরে রিসার্চ করে আমি এই গল্পটার টুকরো টুকরোকে জোড়া লাগিয়েছি। অনেক দিন আগেকার কথা, এক ছিলেন বৈজ্ঞানিক। একটা কলেজে গবেষণাগার খুলেছিলেন তিনি। নামডাক হতে শুরু হয়েছিল। অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেই কলেজের যুবক যুবতীদের। তাঁর ওই স্বপ্নের কথা শুনেই তাঁর কাছে কাজ করতে এল আর এক তরুণ বৈজ্ঞানিক। তার নাম নজর নাবিদ। নজর দিন রাত এক করে কাজ করছিল ওই বৈজ্ঞানিকের গবেষণাগারে। অনেক কিছু কাজ করেও ফেলেছিল সে অল্প দিনেই কিন্তু তারপর সে হঠাৎ জানতে পারল যে তার সারাদিন গবেষণাগারে পড়ে থাকার সুযোগ নিয়ে তার সুন্দরী স্ত্রী মেহেরুন্নিসাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের প্রেমের জালে জড়িয়ে ফেলেছেন তারই বস। সেই ধাক্কায় তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসত। এমনটা হবে সে ভাবতেও পারেনি। রাগে দুঃখে সে একেবারে বদ্ধ পাগল হয়ে যায় এবং তাকে একটা স্যানোটেরিয়ামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নজরের স্ত্রীকে আর তার করা সব কাজগুলোকে তার বস নিজের করে নেন। তিনি মনে করেছিলেন নজর পাগল হয়ে গেছে, সে আর কোনদিন ফিরবে না। কিন্তু নজর সেরে উঠে ফিরে এসেছিল।“
সবাই চুপ, ঘরে পিন পড়লেও শুনতে পাওয়া যাবে এমন অবস্থা।
হঠাৎ রাধিকা বলে উঠল, “বুঝতে পেরেছি! আমাদের স্যার গঙ্গাধর শর্মা ছিলেন সেই বস! কিন্তু নজরটা কে?”
সজল উঠে দাঁড়িয়ে কনফারেন্স রুমের বোর্ডে লিখল ‘NAJAR NAWID’। লিখে বলল “এই নামগুলোকে উল্টে পড়ে দেখুন। RAJAN DIWAN হচ্ছে কিনা? নজর সেরে উঠে দাড়ি গোঁফ রেখে, চোখের মণির রঙ আর নিজের নামটা পালটে তার প্রতিশোধ নিতে এসেছিল। হাতে মেহের লেখা উল্কি ছিল সেই জন্যে সে সব সময় ফুল হাতা শার্ট পরত। সেদিন সেলফি নেওয়ার সময় ঢোলা জামার হাতা নেমে যায় আর ওই উল্কি দেখেই গঙ্গাধর বুঝতে পারেন রাজন আসলে কে। তিনি নিশ্চয়ই পার্টির পর তাকে জিগ্যেস করেন। তারপর ভোর রাতে কথা বলার ছলে তাঁকে সুইমিং পুলের কাছে এনে প্রথমে জলে ঠেলে ফেলে দিয়ে তারপর মাথা ডুবিয়ে মেরে ফেলাটা রাজনের পক্ষে শক্ত কিছু ছিল না। ওই দিনটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে সারা জীবন। ভাস্কর বলেছিল না রাজনের স্নান হয়ে গিয়েছিল সেদিনও, আসলে সেদিন সে সুইমিং পুলে স্নান করেছিল, খুনটা করার সময়।“
অনিকেত ভদ্র বলে উঠলেন, “খুনের তো সমাধান হল মানলাম কিন্তু নজর ওরফে রাজনকে কী করে ধরব?”
সজল বলল, “প্রতিশোধই ছিল ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ। ছটা মাস সে কী করে ডক্টর শর্মার সঙ্গে একই গবেষণাগারে কাজ করেছিল আর প্রতিশোধের জন্যে অপেক্ষা করেছিল আমি জানি না। হয়তো দেখছিল গঙ্গাধর ওকে কবে চিনতে পারেন। আর চেনা মাত্রই সে ওঁকে শেষ করে দেয়। এবার আর ওর জীবনে কিছু নেই। বেঁচে থাকার কোন রকম তাগিদ বা অবলম্বন নেই। এই রকম অবস্থা যাদের হয় তাদের আর বাঁচার ইচ্ছে থাকে না। দেখেবেন আপনারা খুব শিগগির ওকে ধরে ফেলতে পারবেন। সে হয়তো নিজেই এসে ধরা দিয়ে দেবে। ওর বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দেখুন।“
সেই রাতেই নিজের বাড়িতে গিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন নজর নাবিদ ওরফে রাজন দিওয়ান। মৃত্যুর সময়ও উল্কি করা হাতে ধরা ছিল তাঁর প্রিয়তমা মেহেরের একটা ছবি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন