রুমা মোদক
কোনও ডাক্তারই আমার রোগ ধরতে পারেন না। সবাই এক ও অভিন্ন সুরে “কবে থেকে আপনার এ অবস্থা”, “ঠিক কখন আপনার এমন মনে হয়” ইত্যাদি কতগুলো রুটিনমাফিক গতে বাঁধা প্রশ্ন করেন। কবে থেকে আমার এ অবস্থা, কখন আমার এসব মনে হয় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি জানি। কিন্তু কোনও ডাক্তারের মধ্যেই আমার উত্তর শোনার বিশেষ কোন আগ্রহ দেখি না। তারা তাদের বহুল চর্চিত পদ্ধতিতেই পেশাগত দায়িত্বের দায় সারেন। আমার মূল সমস্যার সাথে যার আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। আমি বারবার তাদের বলার চেষ্টা করি, এটা আমার রোগ নয় মোটেই, এটা একটা ইঙ্গিত, যা আমি আগে থেকে পাই। আমার চিকিৎসা থেকে বেশি জরুরি এসবের আগাম প্রতিরোধ। আমার কথা বিশ্বাস দূরে থাকুক গুরুত্ব দিয়ে শোনার ব্যাপারেই কারো কোনও আগ্রহ নেই। তবু আমাকে জোর করে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। এক ডাক্তার না হলে অন্য ডাক্তার। এ পর্যন্ত গোটা চারেক ডাক্তার পরিবর্তন করা হয়েছে। আমার অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। হবার সম্ভাবনাও দেখি না। কারণ কোনও ডাক্তারই আমার সমস্যার মূলে প্রবেশ করেন না।
মূল ঘটনার সাথে সম্পর্কহীন প্রশ্নগুলো শেষে ডাক্তার একগাদা ঘুমের ওষুধ ধরিয়ে দেন। যেন ঘুমের মধ্যেই যাবতীয় সমস্যার সমাধান। আমি প্রথম প্রথম এগুলো খেতাম, ভাবতাম হয়তো বা এগুলো আমার ভালো হওয়ারই ওষুধ। এগুলো খেলে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো প্রতিরোধ না হোক, আমার রোগ নিরাময় হবে। কোন ইঙ্গিতে আমি আর বিপন্ন হবো না। একসময় আমি বুঝতে পারলাম এগুলো নেহাতই ঘুমের ওষুধ। আমার ঘুমে ইঙ্গিত হয়তো বা আমার বিপন্ন করতে পারে না কিন্তু আদতে এতে তো কোনও রোগ নিরাময় হয় না। শুধু ডাক্তার কেন, পুরো সমাজটাতে সবাই একে অপরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায়। এই ঘুমে ঘুমে রোগ থেকে যাবে নিরাময়হীন। ঘুমের কাছে জয়ী হয়ে আরও দ্বিগুন চতুর্গুণ হয়ে ছড়াতেই থাকবে… ছড়াতেই থাকবে প্রতিরোধহীন। না আমি ঘুমাবো না। তারপর থেকে ভাইয়া ভাবির পীড়াপীড়িতে ডাক্তারের কাছে যাই বটে কিন্তু ডাক্তারের দেয়া ওষুধ আমি আর খাই না।
এবারও ডাক্তারের চেম্বারে আমি যখন চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি, ভাবি ব্যাকুল হয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করছেন আচ্ছা ওর কেন এমন হয় ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার আমার নাড়ি টিপতে টিপতে, চোখের মনি দেখতে দেখতে উত্তর দিলেন, এই বয়সে নিজের স্বামী সংসার নেই। উনার মানসিক যন্ত্রণাটা বুঝবেন না? আমি শুনতে পাই কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারি না। স্বামী সংসারের অভাবে আমার জীবন পর্যদুস্ত এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে আমার পরিবার, পরিজন, বন্ধু, প্রতিবেশী কেউ বের হতে পারে না, এমনকি ডাক্তারও। ডাক্তার যখন এসব বলছেন, আধো ঘুম, আধো জাগরণে আমি তখনো শিপ্রার মুখখানা দেখছি দূর থেকে আসা আবছা আলোয়। স্পষ্ট নয়। আলো আঁধারিতে একদম স্পষ্ট নয় শিপ্রার চেহারাটা। কিন্তু এ যে শিপ্রাই আমি নিশ্চিত। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত শিপ্রা। আমাকে রেখে আগে ওর কাছে যাওয়া দরকার, কিন্তু আমি জানি আমি যতই বলি, কেউ আমার কোন কথা শুনবে না। আগেও কখনও শুনেনি।
এই মূহুর্তেও আমার এই একা থাকার কারণটা সামনে চলে আসায় ভাইয়া ভাবি মাথা নুইয়ে ফেলেন অপরাধবোধে। ভাইয়ার বন্ধু সায়েমের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিলো ভাইয়ার ইচ্ছা আর পছন্দে। পিএইচডি করতে জাপান গিয়ে সায়েম আর আমার খোঁজ নেয়নি, আমিও ওর খোঁজ পাইনি। দু’বছর পর সায়েমের খোঁজ নিয়ে এসেছে তার ডিভোর্সের চিঠি। আমি অবাক হইনি। দু’বছরের যোগাযোগহীনতা যে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত আর তার পরিণতি যে এই হবে আমি মোটামুটি আঁচ করেই রেখেছিলাম। এর সম্পূর্ণ মানসিক প্রস্তুতিও আমার ছিলো। কিন্তু অপরাধবোধ আর আমার ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা দুইয়ের যুগপৎ ধাক্কায় ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন ভাইয়া। পরিবেশ, পরিস্থিতির চাপে আমার জীবন যাপন নানা আলোচনা সমালোচনায় গড়াতে গড়াতে বাড়ির কাছের খোয়াই নদীর পানির মতো ঘোলাটে হয়ে উঠতে থাকলে ভাইয়া ভাবি সম্মিলিতভাবে আমার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে স্ত্রী পরিত্যক্ত, বিপত্নীক পুরুষ খুঁজতে কোন ত্রুটি করেন না। উপযুক্ত দুয়েকটা পাননি তাও নয়। কিন্তু ভাইয়া ভাবির অনেক পীড়াপীড়িতেও আমি দ্বিতীয়বার বিয়ের কনে সাজতে পার্লারের চেয়ারে বসতে রাজি হইনি। আমার এই চেতন অবচেতনের ঘোরে চক্কর খাওয়ার মাঝে আমার বিয়েশাদি, ঘরসংসার বাচ্চাকাচ্চা ইত্যাদি সম্পর্কিত কোনও হতাশা কাজ করে না। ভাইয়া ভাবি ডাক্তার সহ যাকে আমি যতই কথাটা বুঝানোর চেষ্টা করি কেউ বুঝতে চায় না।
প্রথম আমি আমার এই চক্করটি ধরতে পারি গৌতম ওস্তাদজীর বেলায়। তখনও আমাদের ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ ‘নজরুলজয়ন্তী’র প্রস্তুতিতে মশগুল মফস্বলকে এইসব ‘বেদাত’, ‘নাজায়েজ’ শব্দগুলো গিলে খায়নি। অন্ধকার কাটতে থাকা ভোর আর অন্ধকার ডেকে আনা সন্ধ্যায় গানের রেওয়াজ পাড়াময় ঘুরে বেড়াতো আদুরে বেড়ালের মতো। আমি সপ্তাহের প্রতি রবিবার নিয়ম করে ওস্তাদজীর বাসায় যেতাম নাচ শিখতে। ওস্তাদজী আর ওস্তাদজীর মা দুজন মাত্র মানুষ বাড়িতে। আম্মাই নিয়ে যেতেন। প্রায়ই গিয়ে দেখতাম সাদা ফিনফিনে ধুতি পরে, কপালে সিঁদুরের লম্বা টান দিয়ে ওস্তাদজী ঠাকুরঘরে ধ্যান করছেন। ঘন্টা ধরে ধ্যান করতেন ওস্তাদজী। খালি গায়ে কোনাকুনি করে বাঁধা কয়েকগাছি সুতা, যাকে ওস্তাদজী বলতেন ‘পৈতে’ সেটি কেমন করে পেঁচিয়ে রাখতেন ডান হাতে। গভীর মগ্নতায় ধ্যান করতেন ওস্তাদজী। পাশের বাড়িতে উচ্চস্বরে ঝগড়া লাগলেও ওস্তাদজীর ধ্যানে বিঘ্ন ঘটতো না। রাস্তার পাশে ক্যাসেটের দোকানে ফুল ভলিউমে ‘তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত’ গান বাজলেও ওস্তাদজীর নির্বিকারত্বে ফাটল ধরাতে পারতো না।
ধ্যান শেষ করে গায়ে ফতুয়া পরে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ওস্তাদজী নাচ শিখাতে আসতেন। তা ধিন ধিন তা, তা ধিন তা…। মসজিদে মাগরিবের আজান হতো। আম্মা ওস্তাদজীর মায়ের ঘরে কাপড় বিছিয়ে নামাজ পড়তেন। ওস্তাদজী ততক্ষণ নাচ শিখানো বন্ধ রাখতেন। চুপ করে বসে থাকতেন, সেই ধ্যান করার মতোই, আমাদেরও বসিয়ে রাখতেন।
এক সন্ধ্যায় ওস্তাদজীর মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমরা তড়িঘড়ি ওস্তাদজীর বাড়ি গিয়ে দেখি, তুলসীতলায় পাটি বিছিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওস্তাদজীর মাকে। একজন দুজন করে মানুষ জমে জমে ভীড় ঘনীভূত হচ্ছে ওস্তাদজীর বাড়িতে। আত্মীয় পরিজন কেউ একজন অনুচ্চ চিকন সুরে মাতম করছেন, সেই সুর মৃতবাড়ির আবহ ছড়িয়ে দিয়েছে বাড়ির আনাচে-কানাচে। ওস্তাদজী ধ্যানস্থ বসে আছেন ঠাকুরঘরে। সন্ধ্যা ক্রমে জমাট বেঁধে রাত হয়ে এলে কয়েকজন ওস্তাদজীকে টেনে তুললেন ধ্যান থেকে। কেউ একজন সান্ত্বনা দিতে চাইলেন, কারো মা কি আর চিরদিন থাকে, চলো দ্রুত সৎকার করি…। ওস্তাদজী শান্ত স্থির। যেন পার্থিব শোক কিংবা সান্ত্বনা কিছুই স্পর্শ করেনা তাকে। ধ্যানী ঋষির মতো ওস্তাদজী সান্ত্বনা দাতাকে বললেন, আত্মার মৃত্যু নেই। আত্মা অবিনশ্বর।
তখনই হঠাৎ আমার কী হলো, মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। আমি দেখলাম ওস্তাদজীর গা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। পরনের সাদা ধবধবে ধুতি, পৈতে সব কিছুতে ছোপ ছোপ রক্ত। মাথার চক্করে আমার চোখে ঝাপসা হয়ে আসতে থাকলো সবকিছু। চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি এক ঘোর, সব শুনতে পাচ্ছি হয়তো বা দেখতেও পাচ্ছি কিছু কিছু কিন্তু বুঝতে পারছি না কিছুই। বেশ খানিকক্ষণ কথাও বলতে পারছি না।
সেবার আমার চক্করটা ডাক্তার পর্যন্ত গড়ায়নি। প্রথমবার বলে বোধহয় কেউ এটা নিয়ে তেমন ভাবেনি। রাতে আম্মা যখন আব্বার কাছে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করছিলেন, অকৃতদার ওস্তাদজী বিশাল বাড়িটিতে একা একা কী করে থাকবেন, তখন এক ফাঁকে আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, আম্মা, আমি যে হঠাৎ দেখলাম ওস্তাদজীর গা ভরতি রক্ত! মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নির্ভয় দিয়ে বিষয়টা ভুলাতে চাইলেন, কী থেকে কী দেখেছিস! ঘুমিয়ে পড়তো,আমী আছি। আম্মা আব্বার সাথে আবার পূর্বের আলোচনায় ফিরে যেতে যেতে কখন আমি ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পেলাম না।
কিন্তু এর সাতদিন পর ওস্তাদজীর ঠাকুরঘরে ওস্তাদজীর গলাকাটা লাশ পাওয়া গেলে সবাই থানা পুলিশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমার মনে পড়ে গেলো ওস্তাদজীর গায়ে রক্ত দেখার কথা। আমার মাথা আবার চক্কর দেয়। এবার ডাক্তারের চেম্বার, পরীক্ষানিরীক্ষা নানাকিছু হয়। কোথাও কোন সমস্যা নেই জানিয়ে ডাক্তার সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানোর পরামর্শ দেয়। ওস্তাদজীর রক্তমাখা সত্যিকারের দেহখানা আমাকে যদিও দেখতে দেয়া হয়নি, আমি নিশ্চিত করে জানতাম তা হুবহু আমার সেদিনের দেখার মতোই। জানা যায় ওস্তাদজীকে হত্যার সন্দেহভাজন হিসাবে পাশ্ববর্তী বাসার কলিমউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। কলিমউদ্দিন এ অজুহাত সে অজুহাতে ঝগড়াঝাটি বাধিয়ে প্রায়ই ওস্তাদজীর বাড়ির এক হাত এক হাত করে সীমান্ত বেড়ার ভেতরে নিয়ে যেত। বাড়িটার প্রতি খুব লোভ ছিল কলিমউদ্দিনের। প্রায়ই ওস্তাদজীকে প্রস্তাব দিত তার কাছে বিক্রি করে দেয়ার। অবশ্য কলিমউদ্দিনের প্রয়োজনও ছিলো বেশি। ওস্তাদজী অকৃতদার, বাড়িতে থাকার মতো উত্তরাধিকারই নেই। আর তার অর্ধডজন ছেলে। গাদাগাদি করে থাকে। ওস্তাদজীর বাড়িটি পেলে সবাই হাত পা মেলে থাকার জন্য প্রস্থে দীঘে বেশ যুৎসই করে বাসাবাড়ি বানানো যেত।
আমার দ্বিতীয় চক্করটির বেলায় আমি নিজেই সচেতন উদ্যোগ নিয়ে অমিতাভ দাদাকে বলে আসি ইলেকশনে এতো গলা না ফাটাতে। অমিতাভ দাদা ঠা ঠা হাসে। আমি স্পষ্ট দেখলাম মিছিলে অমিতাভদাদা সবার সামনে থেকে শ্লোগান দিচ্ছে, “রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়”। আর তখনই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো আর আমি দেখলাম অমিতাভদাদা রক্তাক্ত, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার গায়ের চেগুয়েভারার পোট্রেট আঁকা টিশার্ট, ডেনিম নীল প্যান্ট। আমার কথা মোটেই পাত্তা দেয় না অমিতাভদাদা। এবার দল ক্ষমতায় আসবেই আসবে। এতো বছরের জেল জুলুম উসুল হবে এবার। অমিতাভদাদা ভাইয়ার বন্ধু, আমাদের বাসায় খায় দায় ঘুমায় আর ভাইয়ার সাথে দরজা লাগিয়ে সিগারেট টানে। উষাদির কাছে আমাকে দিয়ে চিঠি পাঠায়। এবার ইলেকশনে দল ক্ষমতায় এলে প্রথমেই একটা চাকরি বাগাবে। তারপর উষাদিকে বিয়ে করে রাজনীতি ছেড়ে দেবে। অনেক হয়েছে এই জেল জুলুম খাটা উদ্ভ্রান্ত জীবন। সব ছেড়েছুড়ে এবার মনের মতো সংসার সাজাবে।
কিন্তু ইলেকশনের আগের রাতে অমিতাভদাদা লাশ হয়ে গেলেন মুখোমুখি সংঘর্ষে। শুনে আমার মাথা আবার চক্কর দেয়, চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে সবকিছু, আমি খাড়া থেকে সটান মাটিতে পড়ে যাই। খাটের কোনায় লেগে কপালটা কেটেও যায় খানিকটা। আবার ডাক্তার। এবার বাড়তি লাগে সেলাই আর মাথায় ব্যান্ডিজ। সেবার অমিতাভদাদার দল ক্ষমতায় এসেছিলো ঠিক, আসনটিও পেয়েছিলো অমিতাভদাদার নেতা। উষাদিরও বিয়ে হয়ে গেলো কয়েক মাসের মাথায় আর শহরে কানাকানি হতে থাকলো, আগের দিন রাতে একটা হিন্দুর লাশ না পড়লে অমিতাভদাদার নেতা এই আসনে পাশ করতে পারতো না। মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্ধকারে কে যে অমিতাভদাদার পেটে ভোজালি ঢুকিয়েছিল তা অমীমাংসিতই রয়ে গেলো।
এই দুই দুইটি ঘটনার পর আমি নিজেকে নিজে ভয় পেতাম, যদি কারো গায়ে রক্ত দেখে ফেলি! আমি প্রিয় কারো দিকে ফিরে দুইবার তাকাতে চাইতাম না। ভালোই ছিলাম বেশ কদিন। কিন্তু শিপ্রা! শিপ্রার সাথে দেখা নেই অনেক বছর। অথচ ওকে দেখলাম অস্পষ্ট, স্বপ্নের মতো। শিপ্রার সারা গায়ে রক্ত। শহরের মঞ্চে আমি নাচতাম আর শিপ্রা গাইতো, মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে…। একদম মোমের পুতুলের মতোই শিপ্রা। যেনো কাছে আগুন ছোঁয়ালেই গলে যাবে। ভাইয়া রিহার্সালের তবলা বাজানোর ফাঁকে সুযোগ পেলেই শিপ্রার গানের খাতায় চিঠি ঢুকিয়ে রাখতো। কোনদিন আমার কাছেও দিয়ে দিতো। আমি ভাইয়াকে সাবধান করতাম, ভাইয়া আব্বা জানতে পারলে…। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগতো শিপ্রার মতো সুকণ্ঠী, মোহময়ী সুন্দরী মেয়েটি আমাদের ঘরে থাকবে। হাঁটতে, চলবে, ঘর গোছাবে। আমাদের ঘরে প্রতিদিন উৎসবের মতো আলো জ্বলবে। শিপ্রার রূপ আর গুণের যৌথ আলো। শিপ্রা আমাকে ফিরতি উত্তর লিখে দিত। ‘একদিন আমি জিজ্ঞেস করতাম, তুই সত্যি ভাইয়াকে বিয়ে করবি? মুসলমান হবি? শিপ্রা হাতজোড় করে অদৃশ্য কাউকে প্রণাম করলো। উত্তর দিলো, বিয়ে করবো। কিন্তু আমি হিন্দুই থাকবো, আর তোর ভাইয়া মুসলমান। আমি মানতে পারলেও কল্পনায় কিছুতেই আব্বা আম্মাকে মানাতে পারলাম না। ধুর এ কখনো হয়? আব্বা আম্মা কখনো মানবে না। শুনে কেমন চুপসে যায় শিপ্রা। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। অসহায়ের মতো বার কয়েক জিজ্ঞেস করে আমাকে, তারা সত্যি মানবেন না?
ক’দিন পরই দেখি শিপ্রার ধুমধাম বাজনা বাজিয়ে বিয়ে হয়ে যায় অথচ ভাইয়া নির্বিকার। আর তারও কদিন পর ভাইয়া নিজেও বিয়ে করে ভাবিকে। একবেলাও নামাজ কাজা না করা ভাবি। ভাইয়াও এখন পুরদস্তুর পরহেজগার। দুইবার হজ্জ করেছেন ভাবি সহ।
শিপ্রাকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ স্বপ্ন না দেখলে মনেই পড়তো না শিপ্রার সাথে দেখা হয় না প্রায় এক যুগ। ডাক্তারের চেম্বারে কিছুটা জ্ঞান ফিরে এলে আমি ভাইয়াকে জোড় হাত করি, ভাইয়া তুই যা। শিপ্রাকে বাঁচা ভাইয়া। ভাবি জানতে চায়, শিপ্রা কে? ভাবিকে কখনও বলা হয়নি শিপ্রার কথা। আমরা কেউ কোন উত্তর দেই না। ভাইয়া যেন অচল পাথরের মতো পা টেনে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। ডাক্তার একটা সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে আসে আমার দিকে। ইঞ্জেকশন দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়ানো দরকার।
বাসায় পরদিন ঘুম ভাঙলে ভাবিই প্রথম খবরটা দেয়। শিপ্রা ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কলেজে বোরখা পরে আসা একটা মেয়েকে অপদস্থ করার দায়ে পরদিন ভরা সালিশে তার নাকে খত দেয়ার কথা। টেলিভিশনের খবরে ব্রেকিং দেখাচ্ছে। ভাবি আবার জানতে চায়, এই শিপ্রাটা কে? তোমরা কী করে চেনো? আমার মাথা আবার চক্কর দেয়, চোখের সামনে সব অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে…।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন