অজিতেশ নাগ
“ভাত ভাঙ, ডাল দেবো।”
বলা মাত্র প্রদ্যোত তার পাতে দেওয়া ভাতের সামনের অংশ খানিকটা টেনে মাঝখানে আঙুল দিয়ে গর্ত করে দিল। সুবিমল তার মধ্যে হাতা দিয়ে অল্প খানিকটা ডাল ঢেলে দিয়ে বললেন, “খেয়ে দেখ দেখি খোকা, ভাল লাগলে আরও দেব। বৌমা, তুমিও একবার টেস্ট করে দেখো দেখি।”
প্রদ্যোত একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। হিসেব করলে বেশ আয়েস করে খাওয়ার মতো যথেষ্ট সময় রয়েছে হাতে। কিন্তু সুস্মিতার দিকে তাকিয়ে তাকে মাথা নামিয়ে নিতে হল। সুস্মিতা সদ্য স্নান সেরে এসেছে। এখনও ওর কপালে ভেজা চুল লেপ্টে আছে। সুস্মিতার অফিস পার্ক স্ট্রিটে। তাকে ন’টার মধ্যে বেরোতেই হয়। তার পরে অটো আর মেট্রো ধরে অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দশটা বেজে যায়। সেটাই অবশ্য অ্যাটেন্ডেন্স টাইম। সুস্মিতার কাজের যে মারাত্মক চাপ তা নয়, তবে বসের চেয়ারে যিনি বসে আছেন, তিনি খুব কড়া মানুষ, মারাত্মক লেভেলের পাঙ্কচুয়াল। কাজ না থাকলে চেয়ারে বসে থাকো, তাও ভী আচ্ছা, কিন্তু ডট দশটা অথবা ম্যাক্সিমাম দশটা পাঁচের মধ্যে কাঁচের দরজা ঠেলে প্রত্যেককে ঢুকতেই হবে। বসের চেম্বারটিও এমন জায়গায় যে, তিনি সরাসরি মেইন ডোর দেখতে পান। ছুটি ঠিক ছ’টায়। পাঁচ মিনিট আগেও না, পরেও না।
সেই অর্থে প্রদ্যোতের স্কুলের চাকরিটা বেশ নরম সরম। গড়িয়ে গড়িয়ে মোটামুটি সাড়ে দশটার মধ্যে ঢুকলেই চলে। এগারোটা বেজে গেলেও কোনও ব্যাপার না। আবার সাড়ে চারটে, পাঁচটার মধ্যেই বাড়ির দরজায় সে। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে আজকাল এমনিতেই ছাত্রের সংখ্যা কম আর স্কুলটিও বাড়ির কাছেই। হেঁটে বড়জোর দশ মিনিট। কিন্তু হলে কী হবে, সুস্মিতা সটান নিদান দিয়েছে, “তোমার জন্য কি বাবা আরেকবার খাবার বাড়তে বসবেন নাকি? দু’ জনে একসঙ্গে বসে খেয়ে নিলে বাবারও সুবিধে আর…”
এই ‘আর’টা উহ্য রাখলেও প্রদ্যোতের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সুস্মিতা তাকে সামনে বসিয়ে তার খাওয়া তদারক করে। দিনে আর রাতে। মাস ছয়েক আগে প্রদ্যোতের সুগার ধরা পড়েছে, তারও আগে কোলেস্টেরল। আগে এই বাড়িতে প্রচুর ভাজাভুজি খাওয়া হতো, সঙ্গে পুরু তেলওয়ালা মাছ, চর্বিওয়ালা পাঁঠার মাংস, শেষ পাতে একটা মিষ্টি, নয়তো দই। সুস্মিতা জানে, চোখ ঘোরালেই প্রদ্যোত সেই সব নিষিদ্ধ খাবার মুখে চালান করে দেবে। শ্বশুরমশাইয়ের অবশ্য এই উনষাট বছর বয়সেও রোগবালাইয়ের কোনও ব্যাপার নেই। সুস্মিতা বলে, “সারাদিন স্কুলে বসে আছো, পাঁচ মিনিট হেঁটে বাড়িতে এসে কাগজ মুখে বসে আছো, তার পরে খেয়েও শুয়ে পড়ছো। এক্সারসাইজ নেই, যোগব্যায়াম নেই। অ্যাট লিস্ট বাবার মতো যদি খাটতে আর হাঁটতে, সুগার-মুগার কবে পালিয়ে যেতো।”
তা ঠিক। ছেলে আর ছেলের বৌ নিজের নিজের কাজে চলে গেলেই সুবিমলের কাজ শেষ হয়ে যায় না। এমনিতেই তিনি ওঠেন ভোর পাঁচটায়। উঠেই তিনি প্রাতঃভ্রমণে চলে যান, সে শীত হোক বা বর্ষা। ফেরার পথে একেবারে বাজার করে ফেরেন। তিনিই হয়তো বাজারের প্রথম খদ্দের। তখনও দোকানিরা ভাল করে পসরা সাজিয়ে বসতে পারেনি, সুবিমল হাজির। তার যুক্তি, “সকালে গেলে যে ফ্রেস জিনিসটা আমি পাব, যা কিছু কেনার সব টিপেটুপে, বেছেবুছে আনতে পারবো, কানকো নেড়েচেড়ে টাটকা মাছটা আনতে পারবো, সেটা কি আর বেলা বাড়লে সম্ভব রে?” বাড়ি ফিরেই শুরু চা বানানো এবং ছেলে আর বৌমার ঘরের দরজায় একবার কড়া নেড়ে দিয়ে বাইরে রাখা টেবিলে পেয়াল পিরিচ রেখে চলে আসা। তার পরে নিজের কাপে চুমুক দিতে দিতে একবার খবরের কাগজের হেডিংয়ে চোখ বুলিয়ে রান্নার প্রস্তুতি।
কতো দিন সুস্মিতা বলেছে, “বাবা, আপনি এই বয়সেও আমাদের রান্না করে খাওয়ান, খেতে দেন। কী রকম লাগে বলুন তো?”
সুবিমল হেসে ফেলেছে, “আরে, এটা তো আমার কাছে প্যাশন। আর তোমাদের মা যদ্দিন বেঁচেছিলেন, তার সিংহভাগ বছরই তো আমিই তাকে রেঁধে খাইয়েছি। খোকাকেও।”
সুস্মিতার শাশুড়ি তারাসুন্দরীদেবী সুস্মিতার বিয়ের আগেই পরলোকগমন করেছিলেন। বিয়ে করে এ বাড়িতে এসে শ্বশুরমশাইকে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে দেখে, খাবার সার্ভ করতে দেখে, সুস্মিতার প্রথম প্রথম চোখ কপালে উঠতো। নেহাত লাভ ম্যারেজ, নইলে সুস্মিতা যে ঘরের মেয়ে, তাতে তার চোখ বিস্ফারিত হওয়ারই কথা, প্রদ্যোতের গলায় মালা দেওয়ারই কথা নয়। সুস্মিতা উত্তর কোলকাতার শোভাবাজারের বনেদি বাড়ির একমাত্র মেয়ে। তাদের বাড়িতে কর্তা কেন, গিন্নিরাও কেউ রান্নাঘরের ভেতরে প্রবেশ করে না। শুধু রান্নাবান্নার জন্যই দু চারজন লোক রয়েছে।
“বাবা কেন রান্নাঘরে? তোমাদের কাজের মাসি নেই?”
সুস্মিতার অবাক প্রশ্নের উত্তরে সে জেনেছিল, তার পরলোকগতা শাশুড়িমা, যখন প্রদ্যোতের বয়স দশ কী এগারো, তখন থেকে মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। প্রচুর ডাক্তার, কোবরেজ দেখিয়েও সেই মহিলাকে চিরতরে শয্যাশায়ী হওয়ার হাত থেকে বাঁচানো যায়নি। তিনি যতো বছর বেঁচে ছিলেন, শেষ সাত-আট বছর শুয়েই থাকতেন। বেড সোর হয়ে গিয়েছিল। দুর্গন্ধে ঘরে ঢোকা যেতো না। এই সুবিমলই তখন, অফিস থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে, একা হাতে স্ত্রীর পরিচর্যা করেছেন, ছেলের দেখাশোনা করেছেন, রান্না-বান্না করেছেন, ঘর সাফসাফাই করেছেন। একজন কাজের মহিলা তখন ছিল বটে, কিন্তু তার কাজ ছিল শুধু বাসনমাজা, ঘর মোছা আর কাপড়জামা ধোয়া। বাকি কাজ, বিশেষ করে, অসুস্থ স্ত্রীর সব কাজ, সুবিমল নিজে হাতেই করতেন। রেঁধে খাওয়ানোর অভ্যেসটা তখন থেকেই।
“আরে বাহ। দারুণ করেছ তো।”
সুবিমল নিঃশব্দে হাসেন, “যাক। তাহলে আরও একটু নে।”
সুস্মিতাও বলে “এতে কী দিয়েছেন বাবা?”
“মাছের মাথা, পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, রসুন বাটা, লঙ্কাগুঁড়ো, শুকনোলঙ্কা, জিরে, ধনে, গরম মশলা ঘি, তেজ পাতা এই সব আর কী। আসলে হয়েছে কী, কাল দুপুরে আমার ছোট বোন এসেছিল…”
প্রদ্যোত মাথা তোলে, “পিসি এসেছিল? কখন?”
“আর ছুটকির আসা মানে তো ঘোড়ায় জিন পরিয়ে আসা। তুই তো চিনিস তোর ছোট পিসিকে। এসেই যাই যাই। বেলা বারোটা নাগাদ শাঁ করে এসে চারটেই মধ্যে ধাঁ হয়ে গেল। সে-ই এই রেসিপিটা দিয়ে গেছে। তবে ডাউট ছিল, কী বানাতে কী বানিয়ে ফেলব।”
সুস্মিতা আড়চোখে তাকায় প্রদ্যোতের দিকে। এই তাকানোর অর্থও প্রদ্যোতের কাছে পরিষ্কার। এই বাড়িতে সাকুল্যে তিনটে ঘর। তার মধ্যে একটা ঘর বেশ বড়। এই ঘরটায় সুবিমল সস্ত্রীক থাকতেন, এখন একা থাকেন। একার পক্ষে বিশাল বললেও হয়। একটা প্রমাণ আকারের মেহগনি কাঠের পালঙ্কও ঘরটার মধ্যে ক্ষুদ্র দেখায়। সব মিলিয়ে ছ’টা জানালা, দুটো দরজা। তার পাশের ঘরটি স্টোর রুম। তার পাশের ঘরে প্রদ্যোত একা থাকতো, এখন সস্ত্রীক। সুবিমলের ঘরটার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে বলতে হয়, চৌবাচ্চার পাশে গোস্পদ। প্রদ্যোতদের ঘরটায় একটা মাত্র জানালা। তাতে অবশ্য কোনদিনই প্রদ্যোতের অসুবিধা হতো না। বরং একটা সিঙ্গল বেড চৌকি আর একটা টেবিল, চেয়ারে তার দিব্য চলে যেতো। বাড়িতে অতিথি এলে পড়ার অসুবিধা হবে বলে প্রদ্যোত অনেক আগে থেকেই আলাদা থাকে, শোয়। অতিথিরা রাতে কেউ থাকলে, এক দু’জন, তারা প্রদ্যোতের ঘরে শয়ন করতেন আর প্রদ্যোত বাবা মায়ের সঙ্গে। সুবিমলবাবুর বিয়েতে পাওয়া এই পালঙ্কে চারজন হাত পা খেলিয়ে শুতে পারে। ঘরের বোঝাই আসবাব কোনদিনই তারাসুন্দরীর পছন্দ ছিল না। শোনা যায় পালঙ্কটাও তারই আবদারে সুবিমলের শ্বশুরমশাই বানিয়ে দিয়েছিলেন। পালঙ্ক বাদে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল, একটা লোহার আলমারি আর একটা ড্রেসিংটেবিল। ব্যস। তারাসুন্দরী নাকি বলতেন, যতো ঘর হাল্কা রাখবে, ততো ঘর নিঃশ্বাস নিতে পারবে। হক কথা। বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে সুস্মিতা যতোবার বড় ঘরটায় পা দিয়েছে, ততোবারই পর্দা-ওড়ানো হাওয়ায় সে যেন ভেসে গেছে। তার সঙ্গে তার দীর্ঘনিঃশ্বাস মিশে গেছে সেই হাওয়ায়।
মুশকিল হয়েছিল প্রদ্যোতের বিয়ের পর। প্রদ্যোতের সঙ্গে সুস্মিতা অবশ্য বিয়ের আগেই এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার পা রেখেছে আর রেখেই নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরখানি দেখে চোখ কপালে তুলেছিল, “এই ঘরে আমরা থাকব!”
প্রদ্যোত সরল গলায় বলেছিল, “নিশ্চয়ই। এটা আমার ঘর। এই ঘরে পড়াশোনা করেই আমি ক্লাশ সিক্স থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। দিব্য ঘর। লাকি ঘর।”
সুস্মিতা অবাক হয়ে তাকিয়েছে, “তোমার বুদ্ধিটা কিন্তু ক্লাশ সিক্সেই আটকে আছে।”
“কেন?”
“আরে এই ঘরটা ব্যাচেলর-রুম হিসেবে ঠিক আছে। দু’জনে থাকব কী করে?”
“হয়ে যাবে তো। জাস্ট এই সিঙ্গল বেডটা পাল্টে ডাবল বেড। একটু জায়গা কমবে, বাট…”
প্রচ্ছন্ন ধমকে উঠেছে সুস্মিতা, “স্টপ ইট প্রদ্যোত। অ্যাট লিস্ট একটা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, আমার বইয়ের র্যাক আরও কতো জিনিস আছে আমার। সেগুলো রাখবো কোথায়? বাইরের ড্রয়িংরুমে? আর এটা তো শুধু আমার কথা বললাম। তোমার জিনিসপত্র?”
ঢোক গিলেছে প্রদ্যোত, “হয়ে যাবে। হবে না?”
হবার কথাও নয় আর হলও না। বিয়ের আগে পাকা কথা বলতে এসে ঘর দেখে প্রদ্যোতের শ্বশুরমশাই গম্ভীর হলেন। তার পরে সুবিমলের দিকে যে ভাবে তাকালেন, তার একটাই অর্থ হয়, একটা ছাপোষা স্কুলমাস্টারকে ভালবেসে তার একমাত্র মেয়েটা দুর্দশাগ্রস্ত হল। কথায় কথায় তার ইঙ্গিত দিতেও ছাড়েননি ভদ্রলোক। বলেছেন, বিয়েতে মেয়েকে তিনি লাখ, দু-লাখ টাকার ফার্নিচার প্রোভাইড করতেই পারেন, কিন্তু…
পরে কথাটা কানে গেলে সুস্মিতা বলেছিল, “ভেবো না। বাবার কাছ থেকে পণ নিয়ে তোমাকে অপমানিত করব না। যা করব, নিজেরা করব। এবার খুশি?”
সবই ঠিক ছিল, কিন্তু ঘর নিয়ে সুস্মিতার খুঁতখুঁতুনিটা রয়েই গেল। সেটা অবশ্য প্রদ্যোতও টের পেয়েছিল। বিশেষ করে গরমের দিনে আর বৃষ্টি নামলে। ঘরের একমাত্র জানালাটার বাইরে রেন-শেড না থাকার কারণে জলের ঝাপটা আসা বন্ধ করতে সেটাও বন্ধ করে দিতে হতো। তাতে ঘরের ভ্যাপসা ভাবটা বাড়ত আরও। প্রদ্যোত মিন মিন করে বলতো, “এবার রেন-শেডটা লাগিয়ে নিলেই…।”
সুস্মিতা মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়তো, “থাক, অনেক হয়েছে। কুয়োর ভেতরে আবার প্লাস্টিক পেইন্ট।”
নিজের এতো দিনের ভালবাসার ঘরটা সুস্মিতার কাছে কুয়ো! মনে মনে ক্ষুন্ন হলেও মুখে কিছু বলে না প্রদ্যোত। সুবিমলের ঘরে আরও একটা সুবিধে আছে। অ্যাটাচড বাথ। প্রদ্যোতদের টয়লেট ড্রয়িংরুম লাগোয়া। সুস্মিতা বলেছে, “বাবার বুদ্ধি আছে বলেই, আমি অফিস থেকে ফিরলে আর সকালে তিনি ঘণ্টাখানেক রান্নাঘরে ঢুকে থাকেন। কিন্তু কোনওদিন যদি স্নান সেরে বেরিয়ে তার সামনাসামনি হয়ে যাই, কী কাণ্ডটা হবে ভাবতে পারছ?”
সুস্মিতা আবার স্নান সেরে টয়লেটে ড্রেস চেঞ্জ করতে পারে না। কাচা কাপড়চোপড়ে টয়লেটের মেঝের জল লেগে গেলে বড্ড গা ঘিনঘিন করে তার। সেটা টের পেয়েই সুবিমল নিজেই, কাজ না থাকলেও, রান্নাঘরে খুটখাট করতে থাকেন। ছেলের ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলেই তিনি বাইরে আসেন।
রবিবার এলে এই কুয়োর অস্তিত্ব আরও বেশি করে টের পায় প্রদ্যোত। সকালের জলখাবার খেয়ে সুবিমল বেরিয়ে গেলেই সুস্মিতা ঢুকে পড়ে সুবিমলের ঘরে। নিজের মনে ঘরের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় সে। কখনও জানালার শিক ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে অপলক। গুনগুন করে গান করে। কখনও মোবাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে নেচে নেয় দু’ চার পাক। রান্নাবান্নাটা বাদ দিলে প্রচুর গুণ আছে ওর। সুস্মিতা নাচ জানে, গানের গলা ভাল, বইপড়ার অভ্যেস আছে। এই বাড়িতে এসে সেই গুণ-ফুণ চুলোয় গেছে। নিজের ঘরে হাঁটারই জায়গা নেই তো নাচ! প্রদ্যোত হয়তো জিজ্ঞাসা করেছে, “কী করছ গো বাবার ঘরে? আমাকে এক কাপ…”
কথা শেষ করতে পারে না, সুস্মিতা বলে, “ঘরে আছি। বাবা ফিরলেই তো কুয়োয় ঢুকতে হবে।”
একদিন সুস্মিতা ফিরে এল হাতে তিন চারটে প্যাকেট নিয়ে। বিকেলের চা’টা প্রদ্যোতই করে। সে নিজে খায় আর সুবিমলকেও দেয়। পরে অবশ্য সুস্মিতার জন্যও আরেক কাপ বানায়, সঙ্গে নিজের হাতে বানানো অমলেট আর সুবিমলের বানানো হাতরুটি। প্রদ্যোত গর্বের ভঙ্গিতে হয়তো বলেছে, “অমলেট আর চা-টা কিন্তু আমি বানিয়েছি।”
সুস্মিতা মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে জবাব দিয়েছে, “ওটুকুই পারো। বাবার মতো যদি অর্ধেকও হতে।”
আজ সুস্মিতার মুখ হাসি হাসি। নিজে থেকেই সুবিমলকে প্রণাম করে বলল, “আমার ইনক্রিমেন্ট হয়েছে বাবা। তাই ঘরের দরকারি দু চারটে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে এলাম। সঙ্গে আপনার ছেলের জন্য একটা পায়জামা আর আপনার শার্ট। দেখুন তো কেমন হল?”
সুবিমল শার্ট হাতে নিয়ে শশব্যস্ত হলেন, “আরে আরে, করেছ কী বৌমা। তোমার শাশুড়ি মায়ের দেওয়া এক গাদা জামা প্যান্ট ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখছে আলমারিতে। আমি আর যাই কোথায়? বড় জোর বাজারে বা চায়ের দোকানে।”
“আপনি দেখেননি। আপনার বাজারে যাওয়ার ফতুয়াটার সাইড পকেট ছিঁড়ে ঝুলছে। কাল থেকে এটা পরে যাবেন।”
“সে না হয় হল, কিন্তু তোমার জন্য কিছু কেনোনি বৌমা?”
সুস্মিতা সোজা চোখে তাকায় প্রদ্যোতের দিকে। প্রদ্যোত মাথা নামিয়ে নেয়। সুস্মিতা বর্ণিত কুয়োতে কোনওমতে একটা মাঝারি সাইজের আলমারি ঢোকান গেছে। তাতে সুস্মিতার নিজের কাপড়চোপড়ই আঁটে না, তো নতুন ড্রেস।
আধা ঘণ্টা পরে নিজের ঘরে প্রদ্যোত ফিরে এলে, সুস্মিতা একটা কাগজ ধরিয়ে দেয় হাতে।
“কী এটা?”
“পড়েই দেখো।”
“তুমি এসি বুক করেছ!!” বিস্ময়ে গলা আটকে আসে প্রদ্যোতের।
“হ্যাঁ। এতে ক্যাবলা হওয়ার কী আছে? এই ঘরে পাখা কোনও কাজ দেয়? ডোন্ট বি টেন্সড ডার্লিং। ইনস্টলমেন্টে নিলাম। পরশু ডেলিভারি। আঃ! কদ্দিন বাদে একটু আরাম করে ঘুমোব।”
প্রদ্যোত জানে সুস্মিতার বাপের বাড়িতে ঘরে ঘরে এসি। সে বিড়বিড় করে, “কিন্তু বাবা কী ভাববে?”
“তুমি বাবার ঘরে এসি লাগাতে চাও? ওই ঘরে এসির দরকার আছে? পাখা না চালালেও তো… থাক তোমাকে বলে লাভ নেই।”
রবিবারের বদলে তার আগের দিনই দুপুর তিনটে নাগাদ সুস্মিতার ফোন এল প্রদ্যোতের মোবাইলে, “তুমি প্লিজ বাড়ি চলে যাও। ওরা আজই ডেলিভারি দিচ্ছে।”
সুবিমল জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এটা আবার কী রে?”
প্রদ্যোত বলেছিল, “এসি। আমি না, সুস্মিতা অর্ডার করেছিল। আসলে ও…”
“এত হেজিটেট করছিস কেন? ওর কষ্টটা আমি বুঝতে পারি। কতো বড় বাড়ির মেয়ে। গুড ডিসিশন।”
যেদিন রাতে তাদের ঘরে এসি লাগলো, সে রাতে প্রদ্যোতকে অনেক আদর-টাদর করে সুস্মিতা হাত পা খেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আর প্রদ্যোতের প্রায় সারা রাত ঘুম এলো না। সকালে উঠে সুস্মিতা এক গাল হেসে বলেছিল, “কী, কেমন রিল্যাক্স করলে কাল?”
কাশতে কাশতে প্রদ্যোত বলেছিল, “ভালই। তবে ঠাণ্ডাটা কী করে যেন লেগে গেছে। আজ যদি একটা কম্বল-টম্বল গোছের থাকে…”
সুস্মিতা মুখ বেঁকিয়ে বলেছে, “প্রথম প্রথম ও’রম হয়, পরে অভ্যেস হয়ে যাবে।”
প্রদ্যোতের অভ্যেস গেঁড়ে বসবার আগেই সুস্মিতার আরেক অভ্যেস চাগিয়ে উঠল। ফলে দেড় মাস যেতে না যেতেই বাড়িতে একটি ওয়াশিং মেশিনের শুভ আগমন।
“রাখবে কোথায়!! ড্রয়িংরুমে তো আর…”
“বাবার ঘরে। সাফিসিয়েন্ট স্পেস। একটা ওয়াশিং মেশিনে ঘরের কোনাও ভরবে না।”
তার পরে এল একটা কালার স্মার্ট টিভি। সঙ্গে ঘুড়ির সঙ্গে লাটাইয়ের মতো সেট-টপ বক্স। তারও জায়গা হল বাবার ঘরেই। এই সব অবশ্য সুস্মিতা নিজেই করেছে, ড্রয়িংরুমে বসে ছাত্রদের খাতা দেখতে দেখতে এই সব দৃশ্য দেখা ছাড়া প্রদ্যোতের আর কোনও ভূমিকা ছিল না। সুস্মিতার যুক্তি, “বই পড়া তো আজকাল লাটে উঠেছে। সারাটা সন্ধ্যে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম। বাঁচা যাবে এবার। স্পেশালি রাতের দিকে ব্লকবাস্টার হিট হলিউড মুভিগুলো তো দেখা যাবে। সবাই মিলে বসে দেখব।”
সুবিমল নীরবে দেখলেন, তারাসুন্দরীর স্বপ্নের ফাঁকা ঘর কী ভাবে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসছে। তিনি আজকাল রাতের দিকে জানালার শিক ধরে অনেক ক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কিন্তু মুভি দেখব বললেই তো আর হয় না। কোথায় বসে দেখা যায়? মানে একটু আয়েস করে আর কী। ফলে ঝকঝকে টিভিকে অনুসরণ করেই হয়তো বাবার ঘরের মাঝ বরাবর বসল তকতকে দুটো সোফা সেট। প্রদ্যোত বাবার দিকে অসহায় তাকায়। সুবিমল ম্লান হেসে সুস্মিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এটা এক দিক থেকে ভালই হল বৌমা। তোমাদের মা’র সঙ্গে আগে কতো সিনেমা দেখেছি। আর দুপুরে ঘুমোই বলে রাতে চট করে ঘুম আসতে চায় না। ভালই হবে। সবাই মিলে সিনেমা-টিনেমা দেখে টাইম পাশ করা যাবে।”
কিন্তু হলিউড মুভিতে প্রায়শই যে দৃশ্যগুলো পর্দা জুড়ে চলে আসে, তার সামনে স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে বসা সম্ভব হলেও, পিতৃস্থানীয় কারও সামনে ভয়ঙ্কর অস্বস্তিকর। ফলে মাঝে মধ্যেই রিমোটের বোতামে আঙুল ঠেকিয়ে সুস্মিতাকে ফার্স্ট-ফরোয়ার্ড করতে হয়। সুস্মিতা বিরক্তিতে মুখ কোঁচকায়। রাতে বিছানায় শুয়ে বিড়বিড় করে, “এই ভাবে সিনেমা দেখা যায় নাকি?”
প্রদ্যোত বলে, “আমরাই তো গিয়ে বাবার ঘরে বসে আছি। বাবা যাবে কোথায়? এই রাতে তো আর রাস্তায় দাঁড়াবে না, রান্নাঘরেও ঢুকে থাকতে পারবে না।”
“বড় অদ্ভুত কথা বলো তুমি। বাবাকে তো মনে হয় ইনসমনিয়ায় ধরেছে। সিনেমা মেরে কেটে একটা দেড়টা অবধি। তত ক্ষণ বাবা ড্রয়িংরুমে, একটা বইটই নিয়ে, বসে থাকতে পারবেন না?”
প্রদ্যোতের গলা উষ্ণ শোনায়, “বলতে হলে বাবাকে তুমি বলো, তুমিই মুভি দেখো। রোজ রোজ রাত জাগলে আমার শরীর খারাপ করবে।”
খুব ধীরে ধীরে হলেও ঝামেলা পাকিয়ে উঠল, হয়তো বা অবশ্যম্ভাবীরূপেই। আজকাল বন্ধ দরজার ভেতরের কোলাহল সুবিমলের কানে এসে আঘাত করে। তিনি যা কোনদিনই করেন না, একদিন করলেন। ছেলের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন।
দরজা খুলে দিল সুস্মিতা। তার চোখে গভীর বিস্ময়, “বাবা!”
ঘরে ঢুকে প্রস্তাবটা তিনিই দিলেন। তার বয়স হয়েছে। স্ত্রী থাকতে না হয় একটা কথা ছিল, এখন অত বড়ো ঘর তার সত্যিই দরকার নেই। অতএব সুস্মিতা যেন প্রদ্যোতকে নিয়ে তার ঘরে চলে আসে। প্রদ্যোতদের ঘরটা তার জন্য যথেষ্ট।
সুস্মিতা যতো না আপত্তি তুলল, প্রদ্যোত তার চাইতে বেশি। কিন্তু সুবিমল শুনলেন না। ঠিক হল, আসছে মাসের গোড়ায় তিনি দিনাজপুরে ছোট বোনের বাড়িতে যাবেন, এক হপ্তা থাকবেন। ততোদিনে নিশ্চয়ই দরকারি শিফটিং-টিফটিং প্রদ্যোত-সুস্মিতা করে নিতে পারবে।
বাবার ঘরে প্রদ্যোতদের আজ প্রথম রাত। মুখে কিছু না বললেও সুস্মিতার নীরব উল্লাস প্রদ্যোতের চোখ এড়াচ্ছে না। দরজা বন্ধ করে প্রথমেই সে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ পুরোটাই নেচে নিলো। প্রদ্যোত খেয়াল করল, আজ এসি চালায়নি সুস্মিতা। জানালা দিয়ে তখন শেষ হেমন্তের দামাল বাতাস ঢুকছে হু হু করে। পর্দা উড়ছে ফিনফিনে পতাকার মতো।
“জানালা বন্ধ করবে না?” প্রদ্যোত ধরা গলায় জানতে চাইল।
হাহা করে হেসে উঠল সুস্মিতা, “পাগল? আজ…” কথা শেষ না করে সে গুনগুন করে উঠল, “পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার… এই শোনো না, আসছে মাসে ভাবছি একটা ওয়ার্ডড্রব বানাব। কিনব না, কাঠের মিস্ত্রি ডেকে… এই… এই দেওয়ালটা জুড়ে মাটি থেকে ছাদ অবধি। ভাল হবে না?”
নীরবে মাথা নাড়ে প্রদ্যোত। বাবার কি গরম লাগছে এখন? বাবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? প্রতিদিন শোয়ার আগে বাবাকে গুডনাইট জানায় সে। আজ তার ব্যতিক্রম। আজ কি সে বাবার কাছে থেকে পালাতে চেয়েছে? বাবার বড় বড় প্রশান্ত দুটো চোখে নিজের চোখ রাখতে চায়নি সে? প্রদ্যোত চোখ বুজল। তখনও সুস্মিতা খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। উন্মত্ত হাওয়ায় ওর চুলগুলো উড়ছিল। আজ কি ঝড় আসবে নাকি? নাকি আজকাল রোজই এমন বাতাস দেয়?
তখন কতো রাত জানা নেই। আচমকা সুস্মিতার ধাক্কায় চোখ খুলে গেল প্রদ্যোতের।
“কী হয়েছে!!”
“ওরা কারা গো?”
সুস্মিতার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রদ্যোত দেখল, খোলা জানালার বাইরে কালো কালো অবয়ব। প্রচুর। চারটে জানালার বাইরেই। সে সভয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল। ওগুলো কি মানুষ? নাকি জানোয়ার? গরিলা নাকি অশরীরী? সুস্মিতা চিৎকার করে উঠল, “বন্ধ করে দাও, জানালাগুলো বন্ধ করে দাও।”
প্রদ্যোত অনেক চেষ্টা করেও বিছানা ছেড়ে নামতে পারছে না। অথবা বিছানাটাই তাকে নামতে দিচ্ছে না। সে যতোবারই পা ঘষটে ঘষটে একটা ধারের দিকে এগোচ্ছে, ততোবারই যেন বিছানাটা একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে। বিছানাটা কতো বড়? বাবা কী করে একা শুতেন এই দিগন্তবিস্তৃত বিছানায়? সে প্রবল আতঙ্কে তাকিয়ে দেখল, অবয়বগুলো জানালার আরও কাছে সরে এসেছে। তাদের মেঘের মত শরীর যেন প্রবেশ করতে চাইছে সেই পর্দা-ওড়ানো জানালার বাইরে থেকে। প্রদ্যোত কুঁকড়ে গেল। এতো শীত করছে কেন? যেন বাইরে হেমন্তের হাওয়া নয়, বরফের ঝড় উঠেছে।
“বাবাআআ!”
এক লাফে বিছানা থেকে নেমে এই হিমায়িত কক্ষ ছেড়ে সেই কুয়ো-ঘরের দিকে দৌড়ল প্রদ্যোত। সুস্মিতা কী অবস্থায় রয়েছে, দেখার মতো অবস্থায় ছিল না সে। প্রদ্যোত বাবার ঘরের কড়া নাড়তে লাগল পাগলের মতো।
সুবিমল দরজা খুলে মৃদু হেসে ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন, “ভয় পেয়েছিস খোকা? আয়, আমার কাছে আয়। আমি আছি তো। তোর ভয় কিসের?”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন