সুজয় দত্ত
কলেজস্ট্রীট আজ কলেজস্ট্রীটের মতো দেখাচ্ছে না মোটেই। সেই ভীড়ে ভীড়াক্কার রাস্তাঘাট, এখানে সেখানে মানুষের জটলা, এগোতে না পারা গাড়ীর হর্ণে মুখরিত প্রতিটা মোড় — কোথায় গেল সেসব? চারদিক বেশ ফাঁকাফাঁকা, সন্ধ্যের ঝলমলে আলোয় রাস্তার দুপাশের সারি সারি দোকানগুলো তাদের বইয়ের সম্ভার নিয়ে কেমন যেন নিঃঝুম, নিস্তব্ধ। অল্প কিছু খদ্দেরের আনাগোনা, সামান্য কেনাকাটা আর মাঝে মাঝে দোকানিদের উত্তেজিত আলোচনা কালকের মহাসম্মেলমন নিয়ে। হ্যাঁ, মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে রাজ্যের শাসক দল তাদের বার্ষিক শহীদ দিবসের বিরাট জনসভা ডেকেছে কাল। দিকে দিকে নাকি মানুষের ঢল নামবে। তার উত্তরে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল দিয়ে রেখেছে পথ অবরোধ আর ঘেরাওয়ের হুমকি। খেলা জমে যাবে মনে হচ্ছে। সে-খেলার ‘মাঠ’ তৈরী রাখতে শহরের পুলিশ আজ বিকেল থেকেই রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড আর ‘ওয়ান ওয়ে’ সাইন দিয়ে নিজেদের অতিসক্রিয়তা জাহির করছে। সেইজন্যই বোধহয় কলেজস্ট্রীটের অতিপরিচিত চেহারাটা আজ গরহাজির।
বেছে বেছে আজই শুভ্রকেতনের এই বইপাড়ায় আসার সিদ্ধান্তের পিছনে অবশ্য অন্য কারণ। লন্ডন থেকে অল্পদিনের ছুটিতে কলকাতায় এসে পৌঁছনোর পর বেশ কয়েক দিন এত প্রচন্ড ব্যস্ততা ছিল ওর যে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়নি। বহু দশকের পুরোনো পৈতৃক বাড়ীটার টুকটাক মেরামতি, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের বাড়ী নেমন্তন্ন আর অশীতিপর মা-বাবার চিকিৎসা-সংক্রান্ত কিছু জরুরী পদক্ষেপ ছাড়াও আরেকটা কাজ ওকে এ-কদিন ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলতে দেয়নি। এই মাসের শেষেই ওর বহুপ্রতীক্ষিত দুটো বই কলকাতার দুই প্রকাশনী থেকে ছেপে বেরোচ্ছে। না, অর্থনীতির জটিল তত্ত্বের বই নয় ওগুলো, যদিও সেটাই বিলেতের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর অধ্যাপনার ক্ষেত্র। একটা বই বাংলা কবিতার। অন্যটা ছোটগল্প আর রম্যরচনার। হ্যাঁ, ডঃ শুভ্রকেতন রায়ের একটি সমান্তরাল পরিচয় হল সে একজন সাহিত্যিক। লেখার গুণে বিলেতের প্রবাসী বাংলা সাহিত্যজগতে এক সুপরিচিত নাম। বিলেত-আমেরিকার নানা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে আসছে বেশ কয়েক বছর। তো, সেই আসন্ন বইদুটোর প্রুফ সংশোধন করতে গিয়ে কয়েকটা বিনিদ্র রজনী কাটাতে হল ওকে। প্রচুর ছোটখাটো ভুল। সেসব উকুন বাছার মতো একটা একটা করে দাগিয়ে তবে শান্তি। সেই পর্বের শেষে আজ একটু ফুরসৎ পেয়েই ছুটে এসেছে এই চিরকালীন ভালবাসার জায়গায় — যা ওর জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেই প্রেসিডেন্সী কলেজের দিনগুলো থেকে। কিংবা হয়তো তারও আগে থেকে।
“স্যার, আপনি মনে হচ্ছে কবিতা-টবিতা পড়েন। দাঁড়ান, আপনার জন্যে একটা — অ্যাই সুবল, ওই ওপরের তাকের পেছনের কোণ থেকে নীল মলাটের বইটা নামা।” ফুটপাথ-সংলগ্ন দোকানের সারির মধ্যে একটায় সাজিয়ে রাখা পুরোনো কিছু বাংলা বইয়ের দিকে নজর পড়ায় সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল শুভ্রকেতন। তার মধ্যে লাল রেক্সিনে বাঁধানো ‘বাংলা কবিতার হীরক সংগ্রহ’ বইটা হাতে নিয়ে সাগ্রহে সূচীপত্রে চোখ বোলাতে দেখে দোকানির এই প্রতিক্রিয়া। কোনো এক ধুলোজমা আলমারির প্রত্যন্ত কোণ থেকে যে মোটাসোটা নীল বইটি বেরোলো, সেটা একেবারে রত্নখনি। দুই জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী উর্মিমালা বসু আর সৃজন সরকার সম্পাদিত সেরা কবিতা সংগ্রহ। আর বাক্যব্যয় না করে দ্রুত দাম মিটিয়ে পাশের খুপরি দোকানটায় গিয়ে দাঁড়ায় শুভ্রকেতন। কারণ জায়গার অভাবে সেই দোকানের সামনে ফুটপাথের ওপর যে বইগুলো স্তূপাকার করে রাখা, তার মধ্যে উঁকি মারছে একটা আস্ত তারাশঙ্কর রচনাসমগ্র। একটু পুরোনো, হলদেটে, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? স্তুপের তলা থেকে তারাশঙ্কর উদ্ধার করতে গিয়ে আচমকা বেরিয়ে পড়ল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দু-খন্ড অনূদিত কবিতা। চোখ চকচক করে ওঠে শুভ্রকেতনের। এই কারণেই — স্রেফ এই কারণেই ইদানীং কালেভদ্রে কলেজস্ট্রীটে আসার সুযোগ হলে নামকরা প্রকাশনীর বড় বড় দোকানগুলোয় না গিয়ে ফুটপাথের ধারের ছোট দোকানগুলোয় সময় কাটায় ও। এই হঠাৎ আবিষ্কারের আনন্দ।
ক্রমে ক্রমে আশপাশের আরও গোটাতিনেক খুপরি দোকান থেকে পাওয়া নজরুলের ‘সঞ্চিতা’, জরাসন্ধের গল্পসংকলন, জ্যোতির্ময় ঘোষের ‘সাহিত্যে প্রগতির দর্শন’, নবনীতা দেবসেনের ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকম্যাহন’ ইত্যাদিতে ভরে উঠতে থাকে ঝুলি। দুচারজন দোকানীর সাথে খুচরো আলাপচারিতায় উঠে আসে করোনা অতিমারী আর আমফান ঘূর্ণিঝড়ের জোড়া ধাক্কায় কলেজস্ট্রীটের বই ব্যবসার বেহাল অবস্থার কথা। একজন সাচ্চা বইপ্রেমী হিসেবে মনে মনে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে শুভ্রকান্তি, আন্তরিক সহানুভূতি জানিয়ে বলে “আপনারা এক কাজ করুন, কোনোভাবে বিদেশের বাজারটা ধরার চেষ্টা করুন। সামগ্রিকভাবে বাঙালীর বইপ্রীতি হয়তো কমেছে, কিন্তু প্রবাসী বাঙালীদের একটা বড় অংশ এখনো ভাল বাংলা বই খুঁজে খুঁজে চড়া দামে কেনে। বিদেশের প্রচন্ড ব্যস্ত জীবনে পড়ার সময় কতটা পায় জানিনা, কিন্তু লাইব্রেরীতে বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখে দেয়। কলকাতার সবচেয়ে বড় পাবলিশিং হাউসগুলো ইতিমধ্যেই এর সুযোগ নিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। আপনাদের সংগঠনকে বলুন সরাসরি প্রবাসী পাঠকদের কাছে পৌঁছনোর একটা রাস্তা বার করতে, তাদের সামনে একটা অপেক্ষাকৃত কমদামী বিকল্প খাড়া করতে। দেখবেন, অনেকেই আগ্রহী হবে।” এরকম অযাচিত উপদেশ পেয়ে আরো কৌতূহলী হয় দোকানীরা, জিজ্ঞেস করে ঠিক কোন পথে এগোলে এটা সম্ভব, কিভাবে শুরু করতে হবে, ইত্যাদি। কেউ কেউ বাড়িয়ে দেয় নিজেদের নাম-ঠিকানা লেখা কার্ড। কথোপকথন গড়াতে গড়াতে ঘড়ির কাঁটা কখন যে আটটা ছুঁয়েছে, খেয়াল হয়নি কারোরই। চমক ভাঙল হঠাৎই ঝরঝর করে বৃষ্টি শুরু হওয়ায়। দোকানীরা সব যে যার দোকানের ঝাঁপ ফেলতে ছুটল আর শুভ্রকেতন হাতের ছাতাটা খুলে ছাট বঁচিয়ে ডানদিকে কফি হাউসের গলির মুখে একটা আধখোলা দোকানের শেডের তলায় গিয়ে দাঁড়াল। এবং তখনই ঘটল সেই ঘটনাটা।
এ-দোকানে বাংলা বই নেই। শুধুই ইংরেজী। দিল্লী বোর্ড আর সেন্ট্রাল বোর্ডের পাঠ্যবইয়ে ঠাসা, বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষার গাইডও রয়েছে প্রচুর। তার সঙ্গে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর স্তরের অল্প কিছু। এর মধ্যে থেকে উঁকি মারছে ইংরেজী সাহিত্যের টুকরো টুকরো মণিমুক্তো — শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ-ওথেলো-হ্যামলেট, ডিকেন্সের গল্পসংকলন, মার্ক টোয়েন, জেন অস্টেন, হেমিংওয়ে, আগাথা ক্রিস্টি, কোনান ডয়েল, স্টিফেন কিং, ইত্যাদি। সবই পুরোনো বইয়ের রি-সেল। আনমনে চোখ বোলাতে থাকে শুভ্রকেতন। আরেঃ, বাঁদিকের ওপরের তাকটায় কোণের দিকে ওটা কী? লাল মলাট, ছেঁড়া ছেঁড়া বাঁধাই, হলদেটে পাতা, কিন্তু স্পাইনে লেখা নামটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। — ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস অফ রুমি’। কোলম্যান বার্কস-এর অনুবাদ। “রিয়েলি? দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি জালাল-আল-দিন মোহাম্মদ রুমি? ওয়ান্ডারফুল” — উৎফুল্ল স্বগোতোক্তিটা করেই ও হাত বাড়ায় সেই তাকের দিকে। কিন্তু বইটা টেনে বার করতে গিয়ে মুহূর্তের অনবধানতায় তাকের সব বই হুড়মুড় করে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলে। দোকানী ভেতরে কাজ করছিল, শব্দ শুনে বেরিয়ে এসে “ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন, আমি তুলছি” বলে গোছাতে থাকে। আর শুভ্রকেতনের ডানপায়ের কাছে যে রংচটা ঘিয়ে মলাটের ছোটখাটো বইটা ছিটকে পড়েছিল, সেটা ভদ্রতাবশতঃ কুড়িয়ে ফেরত দিতে গিয়ে ও যেন ইলেকট্রিক শক খায়। বইটা দুষ্প্রাপ্য কিছু নয়, প্যালগ্রেভের বহুলপঠিত গোল্ডেন ট্রেজারি। কিন্তু — কিন্তু প্রথম পাতায় ওটা কী লেখা? এও কি সম্ভব? ও স্বপ্ন দেখছে না তো? এ যে স্বপ্নেরও অতীত ! নিয়তি কি তাহলে এটা দেখাবার জন্যই তাকে এই বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় প্রায়-শুনশান বইপাড়ায় টেনে এনেছে? চারপাশের সব বাস্তবতা মুহূর্তে লুপ্ত হয়ে যায় ওর চেতনা থেকে। স্মৃতির অতলে ডুব দেয় ও।
“কেমন লাগল লেখাটা, জিজ্ঞেস করলে না তো?”
“জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? কারো ভাল লাগলে সে নিজে থেকেই বলবে।”
“তার মানে পাঠকের মতামত চাওয়ার সাহস নেই, এই তো?”
“আচ্ছা, আমার সমালোচনা না করলে কী রাতে ঘুম হয়না তোমার?
“উঁহুঁ, আমার রাতে অন্য কারণে ঘুম হয়না।”
“কী কারণ?”
“এইত্তো, এই প্রশ্নটা থেকেই বোঝা যায় কে ইকোনোমিস্ট আর কে সাহিত্যিক।”
“মানে?”
“একজন সাচ্চা সাহিত্যিককে তো ওই প্রশ্নের উত্তর বলে দিতে হয়না।”
“ওঃ, সারাদিন শুধু শেলী-কীট্স-ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়ে পড়ে মুখটাই একটা রোম্যান্টিক অ্যান্থোলজি হয়ে গেছে, সোজাসাপ্টা কথা আর বেরোয় না।”
“ব্যস, মসজিদ অবধি দৌড় হয়ে গেল, আর কোনো নাম নিশ্চয়ই স্টকে নেই বাবুর? ব্লেক-কোলরিজ-গর্ডনের কবিতাও কিন্তু আমি কম পড়ি না।”
“আমার দৌড়কে অতটা আন্ডারএস্টিমেট করবেন না ম্যাডাম। ব্লেক আর কোলরিজ তো আমাদের স্কুলের সিলেবাসেই ছিল। কিন্তু গর্ডন-টা তো ঠিক মনে পড়ছে না –”
“হি হি হি, ফান্ডায় আটকে গেল তো? জর্জ গর্ডন বায়রন। এবার বোঝা গেছে স্যার?”
“ও, লর্ড বায়রন? সেই এডা লাভলেসের বাবা?”
“এই রে, এবার নিশ্চয়ই কম্পিউটার সায়েন্স কপচানো শুরু হবে। আচ্ছা, এই এডা লাভলেস অঙ্ক আর কম্পিউটার নিয়ে কাজ করা ছাড়াও যে একজন ভাল লেখক ছিলেন, জানা আছে আশা করি?”
“নাঃ, জানা নেই। সব জানা থাকলে আর তোমার কাছে শিখব কী?”
“যাক, তাও ভাল, একজন নারীর কাছে শেখার কথা শুনলাম একজন পুরুষের মুখে।”
“হোয়াট ডু ইউ মীন? আমার মধ্যে মেল্ শোভিনিজম কোথায় দেখলে তুমি? ক্যান ইউ গিভ মি অ্যান এক্সাম্পল?”
“অমনি গায়ে লেগে গেল? কথাটা তোমাকে বলিনি। বলেছি তোমাদের পুরুষ জাতটাকে।”
“এই ধরণের জেনারেলাইজেশন কিন্তু গ্রোস ওভারসিমপ্লিফিকেশন। ঠিক আছে, পুরুষ জাতের হয়ে আমি চ্যালেঞ্জটা নিলাম। সারা জীবন ধরে প্রমাণ দেব একজন পুরুষ ঠিক কতটা –”
“সারা জীবনের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে?”
“না, মানে, ইয়ে, আমি বলতে চাইছি –”
“হি হি হি। আচ্ছা আচ্ছা, আর বোঝাতে হবে না। এবারে আমি কি বলতে পারি তোমার লেখাটা কেমন লেগেছে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই”
“কনশাসলি অর আনকনশাসলি, এই লেখাটায় স্যামুয়েল বেকেটের মিনিমালিজম আর শার্ল বোদলেয়ার-স্টাইল ইম্প্রেশনিজম-এর এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটিয়ে ফেলেছ তুমি।”
“উরিসসাবাশ! আমি স্বপ্নেও ঐসব ভেবে লিখিনি। জাস্ট এমনি — অনেকদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল প্লটটা, তাই আরকি –। তবে তোমার এই মন্তব্য আমি শিরোধার্য করলাম। প্রচুর পজিটিভ এনার্জি পাব এটা থেকে, যখন লিখতে বসব” –
“কী, লাইব্রেরীর এক কোণে লুকিয়ে লুকিয়ে কী হচ্ছে?”
“উঃ, চমকে দিয়েছ। লুকোব কেন? একগাদা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেই তো বসে আছি।”
“মানে? কাউকেই তো দেখছিনা। ভূতেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব নাকি তোমার?”
“ভূত? হি হি হি। তা বলতে পারো। এদের কেউই আর বেঁচে নেই। পল লরেন্স ডানবার, জেমস ল্যাংস্টন হিউজ, ওয়াল্ট হুইটম্যান –”
“ও, আজ বুঝি যত রাজ্যের আমেরিকান কবিতা ঘাঁটা হচ্ছে? অনার্সের সেকেন্ড পেপারের সিলেবাসে ঐসব আছে নাকি?”
“কী বলব বলতো এমন প্রশ্নের উত্তরে? আচ্ছা, আমি কি শুধু পরীক্ষার জন্য কবিতা পড়ি?”
“সরি, সেটা মীন করিনি, কিন্তু এখন সন্ধ্যে সাতটা চল্লিশ। লাইব্রেরী বন্ধ হয়ে যাবে একটু পরে। আর দেরী করলে বাড়ী ফেরার বাস পাবে?”
“না পেলে অটো নিয়ে নেব। রিক্সা আর অটো মিলিয়ে বাসের চেয়ে খুব বেশী সময় লাগবে না। একটু দাঁড়াও, এটা শেষ করতে দাও।”
“ও বাবা, এ তো মোটা বই। শেষ হবে তাড়াতাড়ি? নামটা কী, দেখি। মন্তাজ অফ এ ড্রীম ডেফার্ড? কার ড্রীম?”
“সেকি, শোনোনি এটার কথা কখনো? ল্যাংস্টন হিউজের বিখ্যাত বই।”
“আচ্ছা, তুমি মিল্টন ফ্রীডম্যান আর পল স্যামুয়েলসনের নাম শুনেছ?”
“হি হি হি, ব্যস, শুরু হয়ে গেল লড়াই। নাঃ, জানিনা। কারা ওরা? নিশ্চয়ই বড় বড় ইকোনমিস্ট। বলেছি তো আমার অতো বিদ্যে নেই। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, শুধু কবিতা পড়ি –”
“হয়েছে, আর ন্যাকামি করতে হবে না। এবার ওঠো তো, আটটা বাজতে চলল, মাসীমা ওদিকে চিন্তা করবে। বইটা বাড়ী নিয়ে গেলেই তো হয় –”
“সে-গুড়ে বালি। লাইব্রেরীর কার্ড আনতে ভুলে গেছি।”
“ও, তা সেটা বললেই হতো এতক্ষণ। আমার কার্ডে নিয়ে নিচ্ছি।”
“সত্যি? থ্যাংকস। এই জন্যে তোমাকে এত্ত ভাললাগে। বুঝলে?”
“আই সী। শুধু এইজন্য?”
“না, তা নয়, অন্য কারণেও লাগে। শুধু একটা জিনিস ছাড়া –”
“এই রে, কী সেটা?”
“বলব?”
“বলে ফেল, নাহলে তো কৌতূহলে রাতে ঘুম হবে না।”
“একটু ঝগড়ুটে আছেন আপনি, স্যার। সোজাসাপ্টা কথাও আঁতে লেগে যায়।”
“ধ্যাৎ, কোথায় আবার ঝগড়ুটে? তোমাতে আমাতে যেটা হয় সেটাকে বড়জোর ওই — কী যেন বলছিলে সেদিন কোন একটা কবিতা থেকে — লাভার্স কোয়ারেল না কোয়ারেল অফ লাভ, সেই।”
“বটে! এমনিতে তো কবিতার কথা শুনলে নাক সিঁটকাও, কিন্তু ওই শব্দটা ঠিক মনে আছে। কার কোন কবিতায় আছে বল তো ওটা?”
“দাঁড়াও, একটা রিক্সা ডাকি, সামনের ট্রামরাস্তার মোড় থেকে অটো নিয়ে নেব –”
“আরে দূর, রিক্সা-ফিক্সা লাগবে না। চল না, হাঁটি। কই, বললে না তো কার কোন কবিতায় –”
“জানলে তো বলব।”
“তিনিও আমেরিকান কবি। রবার্ট লি ফ্রস্ট। ইন ফ্যাক্ট তাঁর সমাধিতে যে এপিটাফ আছে, তাতে ওই কথাটা লেখা আছে — ‘আই হ্যাড এ লাভার্স কোয়ারেল উইথ লাইফ।’ কবিদের ব্যাপারই আলাদা — তাদের কবরও কাব্যিক।”
“আচ্ছা আচ্ছা, ওসব কবর-টবরের কথা না বললেই নয়? ফ্রস্টের কবিতা তো আমাদের মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক – দুটোর সিলেবাসেই ছিল। কি যেন সেই — ‘স্টপিং বাই দ্য উডস’ আর ‘দ্য রোড নট টেকেন’।”
“হ্যাঁ, ‘স্টপিং বাই দ্য উডস অন এ স্নোয়ি ইভনিং’। সেই যে সেই বিখ্যাত লাইন — ‘বাট আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কীপ, অ্যান্ড মাইল্স্ টু গো বিফোর আই স্লিপ’।”
“হুঁ, আমাদেরও আজ ঘুমোবার আগে অনেক মাইল হাঁটতে হবে মনে হচ্ছে। ট্রামরাস্তার মোড়ে একটা অটো নেই। অটোস্ট্যান্ডেও না।”
“হি হি হি। হোক না। উই টু হ্যাভ প্রমিসেস টু কীপ — রাইট?”
“তুমি জিজ্ঞেস করার আগেই বলি, তোমার চিঠিটা পেয়েছি। সে এক কান্ড। পড়বি তো পড়, টুসির হাতে পড়েছে। কলেজ থেকে ফেরার পথে সিঁড়ির নীচে লেটারবক্স থেকে চিঠিগুলো ওই এনেছিল। এমন বিচ্ছু মেয়ে, চিঠি খুলে পড়ে-টড়ে তারপর রাতে শুতে যাবার আগে আমার ঘরে এসে বলে — দাদা, এই নে।”
“হি হি হি, ভালই তো। ওতে তো আর যুবতী মেয়ের কান লাল হয়ে যাওয়ার মতো কোনো কথা লেখা ছিল না, একটা কবিতা ছিল শুধু।”
“তা ঠিক। আমার জন্মদিনের সেরা সারপ্রাইজ ওটা। যদিও আসল দিনের একদিন আগেই পৌঁছে গেছে। তো, কার কবিতা ওটা? শক্তি? সুনীল? অলোকরঞ্জন? দারুণ লাগল। নামটাও অনবদ্য।”
“হিঃ হিঃহিঃ। কার কবিতা বল তো?”
“আরে, জানোই তো আমার অত সাহিত্যজ্ঞান নেই –”
“বলছি, কিন্তু শোনার পর কবিকে দই-ফুচকা খাওয়াবে তো?”
“মানে!!”
“কবিতাটা আমার। অর্থাৎ অনুবাদটা আমার। একচুয়ালি ওটা ল্যাংস্টন হিউজের জীবনের শেষ কবিতা — ‘দ্য প্যান্থার অ্যান্ড দ্য ল্যাশ’। তাই বাংলায় নাম দিয়েছি ‘চিতা ও চাবুক’। অবশ্য চিতা পড়ে লোকে প্রথমে ভাবতে পারে শ্মশানের চিতার কথা বলছি –”
“ওঃ, রাতদিন মুখে অলক্ষুণে কথা! কিন্তু — কিন্তু — তুমি তো, মানে, বাংলায় কবিতা -”
“কী? শেষ কর কথাটা। আমি বাংলায় অষ্টরম্ভা, তাই তো? হি হি হি।”
“না না, তা নয়, তবু কবিতার অনুবাদ কি চাট্টিখানি কথা? তোমার এই গুণটার কথা এতদিন –”
“তো, এবার দই-ফুচকা হয়ে যাক? এই লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকের রাস্তাটায় মিনিট দশেক হাঁটলেই যে মোড়টা পড়ে, ওখানেই ‘জলযোগ’ বলে দোকানটায় –”
“উঁহু, আজ তো দই-ফুচকা হবে না। অন্য জিনিস হবে।”
“কী?”
“জানতে হলে আরেকটু কাছে আসতে হবে। এই যে, এইরকম করে –”
“অ্যাই, অ্যাই, কী হচ্ছে কী এটা, লাইব্রেরীর মধ্যে? ছাড়ো –”
“এখন রাত পৌনে আটটা ডার্লিং। এই বৃষ্টির রাতে লাইব্রেরীতে জনপ্রাণী নেই। উঁহু, উঁহু, ঠোঁট সরিয়ে নিলে হয় কখনো? লজ্জাটা কাকে, শুনি?”
“আঃ! কী হ্যাংলামি হচ্ছে? ছাড়ো না –”
“হ্যাংলাই তো আমি। সত্যিটা যখন জেনেই গেলে, আর তো ছাড়ার প্রশ্ন নেই। এইভাবে — এইভাবে ধরে রেখে দেব।”
“ছাড়ো, লক্ষ্মী সোনা, প্লীজ, দেরী হয়ে যাচ্ছে –”
“কিসের দেরী? সারাজীবন ঠিক এমনি করে জড়িয়ে থাকব তোমাকে।”
“সব দুষ্টুমি একদিনে করে ফেললে এরপর তো –”
“একী! এটা কী?”
“কী হল?”
“এটা কী তোমার বুকে? এইযে, এখানে, শক্তমতো?”
“ওহ। ও কিছু না। ওটা তো অনেকদিন ধরেই –”
“কী বলছ কী প্রিয়দর্শিনী? অনেকদিন ধরে মানে? এতদিন কাউকে কিচ্ছু জানাওনি!!”
“মানে? কী জানাব? ওতে তো ব্যথা-ট্যথা কিছু নেই।”
“তুমি — তুমি — চল, এক্ষুণি বাড়ী চল, মাসীমার সঙ্গে কথা আছে আমার।”
“আমার শুভ্র,
এই চিঠিটা আর পোস্টে পাঠালাম না। আজ সুনন্দদা আর ওর স্ত্রী মানে চিত্রা এসেছিল আমাকে দেখতে। ওরা তো তোমার বাড়ীর কাছেই থাকে, তাই ওদের বললাম পৌঁছে দিতে। কারণ চিঠির সঙ্গে একটা ছোট্ট জিনিসও আছে। কাল কেমোথেরাপির চতুর্থ ডোজটা নিয়ে এসে ভীষণ দুর্বল লাগছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই চিঠিটা লিখতে কতবার যে হাত কেঁপে গেল। তোমার পি এইচ ডির ইন্টারভিউ কেমন হল? পরশু তো তোমার কলকাতায় ফেরার কথা, তাই না? চারদিন আসোনি এখানে, বড্ডো মিস করেছি তোমাকে। বাড়ীতে সারাক্ষণ কেমন যেন একটা শোকের আবহ, ভাল লাগে না। এখন তো কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই। অপারেশনের দিন ঠিক হয়ে গেছে। যাইহোক, গত সপ্তাহে যে বলেছিলাম না, আমার একটা প্রাণভোমরা তোমায় সোঁপে দিয়ে যাব? সেটাই সুনন্দদার হাত দিয়ে পাঠিয়েছি। আমার প্রথম ট্যুইশানির টাকায় কেনা প্যালগ্রেভের ‘গোল্ডেন ট্রেজারি’ বইটা। যত্ন করে রেখো, আর হ্যাঁ, প্লীজ একটু পাতা উল্টে দেখো। ইকোনোমিস্টদের কবিতা পড়া নিষিদ্ধ — এরকম কোনো ‘হিপোক্র্যাটিক ওথ’ নিতে হয় না তোমাদের আশা করি।
জানি, আমি যাওয়ার কথা লিখলাম বলে তুমি রাগ করবে। কিন্তু আমি তো আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় নই যে মরণকে হাত নেড়ে বলব “আমার এখন সময় নেই, যাও”। থাক ওসব কথা এখন। কলকাতায় ফিরেই আমাকে খবর দিও কিন্তু। দেখা হবে। আমার কাছে তুমি যা যা চাও, চেয়েছ, চাইবে বলে ঠিক করে রেখেছ — সব পাঠালাম এই চিঠির মধ্যে।
ইতি,
প্রিয়দর্শিনী
শুভ্র ইন্টারভিউয়ের পর কলকাতায় ফেরে ৯ই আগস্ট। বইটা ওর হাতে আসে ১০ই আগস্ট। তার ঠিক দুদিন আগে, সেই অভিশপ্ত ৮/৮/৮৮-র বিকেলে, ক্যান্সার জিতে যায় চিরদিনের মতো। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবেদন মঞ্জুরের খবর আসে ৬/৪/৮৯-এ। কলকাতা-লন্ডন ফ্লাইটের যাত্রীতালিকায় ‘শুভ্রকেতন রায়’ নামটি দেখা যায় ৫/৭/৮৯-এ। সঙ্গে বইপত্র কিছুই ছিলনা, সেসব গড়িয়াহাটের বাড়ীতেই রয়ে গেছিল। ১/৩/৯০-এ শ্রী সলিল কুমার রায় চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর সরকারী আবাসন ছেড়ে কৈখালির নতুন বাড়ীতে উঠে যাওয়ার সময় জলের দরে বিক্রি হয়ে যায় ওগুলো।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন