short-story-kobi-o-bulbul

কবি ও বুলবুল
বিনোদ ঘোষাল


(কাহিনি পাঠের আগে দু্’টি কথা- কাজী নজরুল ইসলাম এবং প্রমীলাদেবীর দ্বিতীয় পুত্রর নাম ছিল বুলবুল। অসামান্য স্মৃতিশক্তি এবং মেধা ছিল তাঁর। সঙ্গীতেও ছিল তার অসাধারণ প্রতিভা। কবি নজরুলের যোগ্য পুত্র হয়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর বয়সেই বসন্ত রোগে তার মৃত্যু হয়েছিল। এই কাহিনি বুলবুলকে নিয়েই রচিত। কাহিনিতে বর্ণিত মৈন বা খান মৈনুদ্দীন ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু, অনুরাগী। এবং গিরিবালাদেবী হলেন নজরুল ইসলামের শাশুড়ি)

মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের ছোট একটি তিনতলা বাড়ির দোতলার একটি ঘরে বিকেল চারটে নাগাদ নজরুল একমনে বসে লিখছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই হাফিসের অনুবাদের কাজ করছে। ভারি ভাল লাগছে অনুবাদ করতে। আজ দুপুর থেকে বসেছিল অনুবাদ নিয়ে। এমনসময় কাজী ও কাজীদা বলতে বলতে ঘরে এল মৈনুদ্দীন।

মৈন এসো। বলে মৃদু হাসল নজরুল।

মৈন বুঝল কাজীদার লেখার সময়ে চলে এসেছে। তাই ও আর কথা না বাড়িয়ে ঘরের একটি চেয়ারে চুপ করে বসে পড়ল। মৈনুদিনের গলার শব্দ পেয়ে, কাকা এসেছে কাকা এসেছে বলতে বলতে ঘরে ছুটে এল বুলবুল। মৈনুদ্দীনকে বেজায় ভালবাসে ও। অবশ্য বুলবুলের স্বভাবই এমন। বাড়িতে যেইই আসবে তার সঙ্গেই গল্প জুড়ে দেবে। চেনা হোক বা অচেনা সবাই ওর আপন, বিলকুল বাপ কা বেটা। ফোলাফোলা গাল, একমুখ হাসি, একমাথা কোঁকড়াচুল, আর মুখে অনর্গল কথা সেইসঙ্গে অবিশ্বাস্য সঙ্গীতপ্রতিভা-এই জন্য সকলে বুলবুলকে ভালবাসে। ওর সঙ্গে গল্প করতে ভাললাগে সবার। মৈনুদ্দীন জানে কাজীদা যখন লেখেন তখন তিনি নীরবতা পছন্দ করেন। তাই ও বুলবুলের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে থাকল, কিন্তু বুলবুল কি আর ফিসফিস করে কথা বলার ছেলে? ওইটুকু বাচ্চা ও আর ওসব কী বুঝবে? ঘরের মধ্যেই হৈ হৈ করতে শুরু করল। নজরুল একসময় খুব বিরক্ত হয়ে উঠে আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে প্রচণ্ড রেগে ধমকে উঠল বুলবুলকে। চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, যাও এখন অন্য ঘরে। একদম বিরক্ত করবে না। যাও!

বাবাকে এমন রূঢ়ভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠতে দেখে চমকে উঠল বুলবুল। ভয়ে কেঁপে উঠল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। নজরুল আবারও বলে উঠল, এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছ! যাও আমার সামনে থেকে। চলে যাও বলছি!

মৈনুদ্দীনও হতবাক। কাজীদা এইটুকু বাচ্চার ওপর এত রেগে কেন যাচ্ছেন! বুলবুলের দিকে তাকিয়ে দেখল বেচারা বাচ্চাটার হাসমুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে, চোখদুটো জলে ভরে উঠেছে। ও একবার মৈনুদ্দীনের দিকে তাকাল তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নিচু করে অন্য ঘরে চলে গেল। নজরুল কিন্তু সম্পূর্ণ নির্বিকার। বুলবুল পাশের ঘরে চলে যেতেই আবার ও লেখায় ডুবে গেল। মৈনুদ্দীন হতবাক হয়ে ভাবছিল শিল্পীরা বুঝি নিজের শিল্পসৃষ্টির সময় এমনই নির্মম হয়, নইলে কাজীদার প্রাণের থেকেও প্রিয় বুলবুল, তাকেও এইভাবে ভর্ৎসনা করতে পারেন লেখার ব্যাঘাত ঘটলে!

বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটল। মৈনুদ্দীন মাথা নীচু করে বসে রইল। ওর খুবই খারাপ লেগেছে। বুলবুলের বকা খাবার জন্য ওর নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে। অন্য ঘরে গিয়ে কথা বললেই ভাল হত, বাচ্চাটাকে কথা শুনতে হত না।

লেখা শেষ করে নজরুল কাগজ-কলম গুটিয়ে যখন মৈনুদ্দীনকে বলল, বলো কী সংবাদ? তখন সে যেন সেই হাসিখুশি চেনা কাজীদা।

মৈনুদ্দীন বলল, সংবাদ খুবই খারাপ।

কেন কী হল?

আপনি এইভাবে বুলবুলকে বকলেন? কাজটা ঠিক করেননি। এইভাবে কখনও রাগতে দেখিনি আপনাকে।

নজরুল মৈনুদ্দীনের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বলল, বুঝেছি, বসো এক মিনিট। বলে নজরুল উঠে পাশের ঘরে গিয়ে বুলবুলকে কোলে নিয়ে ফিরে এল। আমার বাবাটা কি আমার ওপর রাগ করেছে? কোথায় রয়েছে রাগটা? দেখি তো পেটের ভেতর কি না? বলে বুলবুলের পেটে আঙুল দিয়ে কাতুকুতু দিল নজরুল…তারপর বলল ওই যে রাগটা পালিয়ে এবার কানের পাশে লুকিয়েছে, এখনই ধরছি বলে বুলবুলের একটা কান আলতোভাবে মুলে দিল। ওই যাহ কান থেকেও পালিয়ে এবার গালের ওপর বসেছে দেখছি, এখনই আমি রাগটাকে খেয়ে ফেলব বলে বলুলবুলের গালে চুমু দিল নজরুল। অন্যান্য সময় বাবার এমন মজার খেলায় ও খুব খুশি হয় খিলখিলিয়ে হাসে, কিন্তু আজ এমন ধমক খেয়েছে যে ভেতরের কষ্টটা কিছুতেই যাচ্ছে না।

মৈনুদ্দীন বলল দিন ওকে আমার কাছে। নজরুল বুলবুলকে কোল থেকে নামিয়ে মৈনুদ্দীনের কোলে দিল। মৈনুদ্দীন ওকে অনেক আদর করে, মজার মজার কথা বলে হাসানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বুলবুলের মনখারাপ যেন ঠিকই হল না। ও যেমন ছটফটে প্রাণোচ্ছ্বল ছেলে, তাতে এতক্ষণে বাবার বকুনি ভুলে যাওয়ার কথা, কিন্তু আজ ওর এমই অভিমান হয়েছে যে কিছুতেই সহজ হতে পারল না। মৈনুদ্দীন একসময় হাল ছেড়ে দিল। বুলবুলকে আদর করে দিয়ে বলল যাও তুমি এখন ভাইয়ের সঙ্গে খেলা করো গিয়ে, আমি তোমার দুষ্টুবাবার সঙ্গে একটু কথা বলি।

নজরুল এই কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল ঠিকই কিন্তু বুলবুল হাসল না। যেমন চুপচাপ এসেছিল তেমনই ফিরে গেল।

আপনি আর এমন করবেন না কাজীদা। বুলবুল কিন্তু আর পাঁচটা বাচ্চার মত নয়, ও অনেক বেশি সেন্সেটিভ।

আচ্ছা আচ্ছা বেশ তুমি অত ভেবো না, বাচ্চারা অতশত মনে রাখে না। বলে মৈনুদ্দীনের কথা উড়িয়ে দিল নজরুল। তারপর দুজনে গল্পে ডুবে গেল।

বাড়ি ফেরার পরও মৈনুদ্দীনের মনটা ভাল লাগছিল না। আসলে বুলবুলকে ও বড়ই স্নেহ করে, বাচ্চাটার অমন গোমড়া মুখ দেখে ফিরে আসতে হল সেটা ওকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। তাই পরদিন সকালে দোকান থেকে কিছু লবেঞ্চুষ কিনে আবার গেল কাজীদার বাড়িতে। গিয়ে শুনল গতকাল রাত থেকে বুলবুলের প্রবল জ্বর এসেছে। নজরুল ঘরে ছিল না। মৈনুদ্দীন বুলবুলের কাছে গিয়ে দেখল প্রবল জ্বরে বুলবুল প্রায় বেঁহুশ। কোমল ঠোঁটদুটি জ্বরের উত্তাপে লাল হয়ে রয়েছে। বুকের ভেতরটা কষ্টে মুচড়ে উঠল মৈনুদ্দীনের। জ্বর তো সকলেরই হয় কিন্তু কেন জানা নেই ও শঙ্কিত হয়ে উঠল। প্রমীলা খাটে বসে ছোট ছেলে সানিকে দুধ খাওয়াচ্ছিল আর নজরুলের শাশুড়িমা গিরিবালাদেবী বুলবুলের কপালে জলপটি দিচ্ছিলেন। মৈনুদ্দীনকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন গিরিবালাদেবী, জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ বাবা মৈন, কাল নুরু বুলবুলকে কী বলেছিল?

তেমন কিছু নয় মাসিমা, বুলবুল একটু চেঁচামেচি করছিল তাই কাজীদা একটু ধমক দিয়েছিলেন। মূল ঘটনাটিকে একটু রেখেঢেকেই বলল মৈনুদ্দীন।

গিরিবালাদেবী বললেন, সত্যি কথা বলো মৈন কাল ঠিক কী হয়েছিল?

কেন মাসিমা? কী হয়েছে?

তুমি আগে বলো নুরু বুলবুলকে ঠিক কী বলেছিল?

তেমন কিছু না…কাজীদার লেখার ডিসটার্ব হচ্ছিল বলে একটু ধমক দিয়ে বুলবুলকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন।

গিরিবালাদেবীর চোখদুটি ছলছল করে উঠল। তিনি বললেন, নুরুর অমন কথা বলা উচিত হয়নি, এইভাবে কেউ ওইটুকু শিশুকে চলে যাওয়ার কথা বলে!

মৈনুদ্দীন চমকে উঠল। এ আপনি কী বলছেন মাসিমা। বাবা তার ছেলের ওপর কখনও রাগ করে কত কিছুই তো বলে, তা নিয়ে অত ভাবলে চলে? বুলবুলের কখন জ্বর এল?

কাল রাতেই। ও ছেলে তো সাধারণ ছেলে নয়, ঈশ্বর ওকে পাঠিয়েছেন। বাপের দেওয়া এই আঘাত ও নিতে পারেনি।

আপনি এমন বলবেন না মাসিমা। সামান্য জ্বরজারি সকলেরই হয়, দিন দুয়েকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধপত্র কিছু দিয়েছেন?

গিরিবালাদেবী যেন মৈনুদ্দীনের কথা শুনতেই পেলেন না। তুমি বুঝবে না বাবা…নুরু বড্ড ভুল করেছে…বুলবুল সাধারণ ছেলে নয়…নিজের মনে বিড়বিড় করে আরও কীসব বলতে বলতে বুলবুলের কাছে চলে গেলেন।

মৈনুদ্দীন কিছুক্ষণ একা নজরুলের ঘরে বসে থেকে তারপর ফিরে এল। আর তার ঠিক দিন দুয়েক বাদেই শুনল বুলবুলের খুব বাজে রকমের গুটিবসন্ত হয়েছে। গোটা গায়ে বড়বড় গুটি উঠেছে। নজরুল নিজের কাজকর্ম সব বন্ধ করে সারাক্ষণ বাড়িতে। মনে মনে ভীষণ অস্থির। সারাদিন ধরে ঘরে পাইচারি করে, বুলবুলের কাছে গিয়ে একবার মাথায় হাত বোলায়, আর বলে তুই শিগগির ঠিক হয়ে যাবি বাবা, আর তোকে কখনও বকব না। পাড়ার একজন ডাক্তারবাবু ওষুধ দিচ্ছেন। কিন্তু সেই ওষুধে বিশেষ কাজ দিচ্ছে না। জ্বর যেন নামতেই চাইছে না, ছোট শরীরটা ভরে গেছে ফোস্কায়। ব্যথায় গোঙায় বুলবুল আর নজরুল সেই কাতর শব্দ শুনে ছটফট করতে থাকে। নিজের চুল ধরে ঝাঁকায়। রাতে সকলে যখন শুয়ে পড়ে নজরুল তখন একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বুলবুলের মাথার কাছে বসে অনুবাদ করতে থাকে হাফিজের কবিতা। বুলবুলের কপালে জলপটি দিতে দিতে ও লিখতে থাকে-

তোমার ডাকার ও-পথ আছে ব্যথার কাঁটায় ভরে খালি।

এমন কোনো নেই মুসাফির ও-পথ বেয়ে চলবে, আলি!

জ্ঞানের রবি ভাস্বর যার, তুমি জান কে সে সুজন –

প্রাণের রূপের পিলসুজে যে দেয় গো ব্যথার প্রদীপ জ্বালি॥

মাঝেমাঝে বুলবুলের কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলে, বাবামনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? গান শিখবে না তুমি? শিগগির সুস্থ হয়ে ওঠো বাবা। আমি নতুন গান লিখব তোমায় নিয়ে। তুমি গাইবে। বুলবুলের কপালে চুমু দেয় নজরুল। চোখ তার ঝাপসা হয়ে আসে। আত্মগ্লানীতে কাতর হয়ে ওঠে।

এক সপ্তাহ কেটে গেল। বুলবুলের সামান্যতম উন্নতি নেই, বরং দিনে দিনে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। যে ডাক্তারবাবু দেখছেন তার ওষুধে কোনও কাজই দিচ্ছে না। দৈবে বিশ্বাসী নজরুলের মনে হল আর ওষুধ নয়, এবার দৈব দরকার। মৈনুদ্দীন প্রায় রোজই একবার করে আসে। কিছুক্ষণ বসে থাকে, বুলবুলের দিকে ও তাকাতে পারে না। ফুটফুটে ছেলেটার কী করুণ অবস্থা হয়েছে, চোখে দেখা যায় না। বুলবুল এখন যে ঘরে থাকে সেই ঘরে বাইরের লোকের ঢোকা বারণ। আজ বিকেলে নজরুলের বাড়ি সবে পৌঁছেছে তখনই নজরুল ওকে দেখতে পেয়ে প্রায় ছুটে এসে বলল, ভাই মৈন আমি তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম, দমদমে এক সাধুর সন্ধান পেয়েছি তিনি সর্বরোগে ধন্বন্তরী। তুমি একবারটি গিয়ে তাঁকে যেভাবে হোক নিয়ে এসো। বুলবুলকে বাঁচাও ভাই।

মৈনুদ্দীন বলল, কেন পারব না? কখন যেতে হবে বলুন? কাল যাব?

না ভাই না, কাল নয়, দেরি হয়ে যাবে। তুমি এখনই যাও।

দমদম অনেকটা দূরের পথ, আর মৈনুদ্দীনের অচেনা। তাই নজরুলকে বলল, বেশ এখনই যাচ্ছি, তবে আমার সঙ্গে কাউকে পেলে ভাল হত। কেউ কি আছে যাওয়ার মত?

নজরুল মৈনের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে বুলবুলের ঘরে চলে গেল। মৈনুদ্দীনের মনে হল কাজীদা কথাটা শুনতেই পেলেন না, উনি শোনার মত অবস্থাতেই নেই। কী করবে ভাবছে এমন সময় দেখল নজরুলের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র শান্তিপদ সিংহ আসছে। ওকে দেখতেই পেয়েই মৈনুদ্দীন গিয়ে ব্যাপারটা বলল। শান্তিপদ শুনে বলল, বেশ চলুন আমি যাব।

শান্তিকে নিয়ে মৈনুদ্দীন বেরিয়ে গেল। বাসে চেপে যখন দমদমের শেষ স্টপেজে নামল ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গছে। দুইদিকে ঘন বন আর আর মাঝখানে সরু মেটে রাস্তা। লোক চলাচল প্রায় নেই। শান্তি আর মৈন কারও মুখেই কথা নেই। দুজনে যত এগোতে থাকল গা ছমছম করতে থাকল, জঙ্গল এতই ঘন যে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার থাকাও আশ্চর্য নয়। সাধুবাবা কোথায় থাকেন সেটাও ওরা জানে না, কাউকে যে জিজ্ঞাসা করবে তারও উপায় নেই। অনেকটা পথ যাওয়ার পর শেষে একজন লোকের সঙ্গে দেখা হল। তাকে সাধুবাবার নাম বলতেই সে একটি পথ দেখিয়ে দিল বটে কিন্তু অন্ধকারে সেই পথে কীভাবে এগোবে সেটাই মহা সমস্যা। তাই লোকটিকেই অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে হাতে কিছু টাকা দিয়ে রাজি করিয়ে সেই সাধুবাবার বাড়ির দিকে রওনা হল দুইজনে। সে কী জটিল পথ! যতই এগোয় ততই জঙ্গল নিবিড় হয় সঙ্গে ঘন অন্ধকার। চেনা না থাকলে এই পথে নতুন কেউ অন্ধকারে কোনওভাবেই এগোতে পারবে না। অনেকক্ষণ ধরে অনেক আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে শেষে লোকটি ওদের দুজনকে নিয়ে হাজির হল একটি মাটির ঘরের সামনে। ঘরের দাওয়ায় একখানি কেরোসিন কুপি জ্বলছে। একটি কিশোরী মেয়ে উঠোনের তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে প্রণাম করছে। সন্ধ্যা দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর মেয়েটি মুখ তুলে মৈনুদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করল বলুন কী চাই?

শান্তিপদ বলল আমরা সাধুবাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

উনি বাড়ি নেই, দুপুরবেলায় কলকাতা শহরে গেছেন কখন ফিরবেন জানা নেই।

আমরা কলকাতা থেকেই এসেছি, কলকাতার কোথায় গেছেন জানো?

না তা বলতে পারব না।

মাথায় যেন বাজ পড়ল মৈনুদ্দীনের। এবার কী হবে! এত দূর থেকে এত কষ্ট করে এসেও সাধুবাবার সঙ্গে দেখা না করেই ফিরে যেতে হবে! মৈনুদ্দীন আর শান্তিপদ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সাধুবাবা কখন ফিরবেন তা যদি জানাই না যায় তাহলে আর অপেক্ষা করে লাভ কী?

এদিকে রাতও হয়ে গেছে। তাই শান্তিপদ নজরুলের বাড়ির ঠিকানা একটা কাগজে লিখে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, সাধুবাবা যখনই ফিরুন তার হাতে এই ঠিকানাটি দিয়ে বলবেন তিনি যেন অবশ্যি চলে আসেন, অত্যন্ত জরুরী দরকার। তারপর আর অপেক্ষা না করে সেই লোকটির সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হল দুজনে। পথে দুজনের মধ্যে বুলবুলের শারিরীক অবস্থা নিয়ে যেমন কথা হল তেমনই কথা হল নজরুলের এই সাধুসন্ন্যাসী তুলতাক ইত্যাদিতে বিশ্বাস নিয়েও। যে মানুষ খোদার আসন আরশ ছেদনের কথা বলে, ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়া কথা বলে সেইই আবার কীভাবে ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র-দৈবে এমন বিশ্বাসী কীভাবে হয় মাথায় আসে না। এমন বৈপরীত্য, এমন পরস্পরবিরোধীতা, এমন আনপ্রেডিক্টেবিলিটি নিয়েই নজরুল। কোনও হিসেবে তাকে মেলানো যায় না, কোনও ছাঁচেই তাকে ফেলা যায় না। লোকটা ওদের দুজনকে ঘুটঘুটে অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে যেতে বলতে থাকল তাড়াতাড়ি পা চালান। এটাই লাস্ট বাস। এটা না পেলে পায়ে হেঁটে দুই মাইল দূরে দমদম স্টেশনে যেতে হবে। আর রাস্তাও ভাল না। পুরোটাই ঝোপঝাড়, অন্ধকার। চোর-ছ্যাঁচ্চোর, সাপখোপ ইত্যাদির ভয় আছে।

যাইহোক দ্রুত পা চালিয়ে যখন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছল বাস তখন ছাড়ব ছাড়ব করছে। বাসে চেপে দমদম নেমে সেখান থেকে শিয়ালদা তারপর ট্রাম, আর শেষে বাকিপথ হেঁটে গলদঘর্ম হয়ে যখন দুজনে নজরুলের বাড়ি পৌঁছল তখন রাত প্রায় নয়টা। বাড়ির পরিবেশটা থমথমে। কয়েকজন লোক দোতলার ঘরে বসে রয়েছে। কাজীদা কাজীদা বলে মৃদুস্বরে দুইবার ডাকল মৈনুদ্দীন।

মৈনের গলা শুনে নজরুল ঘরের ভেতর থেকে উদভ্রান্তের মত ছুটে বেড়িয়ে এল। চোখদুটো জবাফুলের মত লাল, চুল এলোমেলো। মৈন…মৈন সাধুবাবা এসেছেন? কোথায় তিনি…কোথায়? আসেননি? আমার বুলবুলের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে এলেন না উনি? বলতে বলতে মৈনুদ্দীনকে জড়িয়ে শিশুর মত হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল নজরুল। মৈনুদ্দীন হতভম্ব।

নজরুল মৈনুদ্দীনের কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে থাকল, বলো কেন নিয়ে এলে না ওঁকে? কেন এলেন না তিনি? আমার পাপ…আমার পাপে…সব আমার পাপে…

মৈনুদ্দীন আর শান্তিপদ কিছুই বুঝতে পারল না। ঘরের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন আজ। শান্তিপদ খুব খারাপ কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করল। নজরুলের কাছে এগিয়ে এলেন একজন প্রতিবেশী। তাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে একটু শান্ত করে ঘরে নিয়ে গেলেন। মৈন ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছে। ওরও দুইচোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। শান্তিপদরও চোখে জল। ঘরের ভেতর থেকে গিরিবালাদেবী এবং প্রমীলার কান্নার শব্দ আসছে। অসহনীয় পরিবেশ। নজরুলের বন্ধুরা কেউই এখনও এই দুঃসংবাদ পায়নি।

নজরুল পাগলের মত ছটফট করছে। একবার কাঁদছে, একবার ছুটে যাচ্ছে বুলবুলের নিথর শরীরের কাছে। ওকে সামলানো যাচ্ছে না। কলকাতা কর্পোরেশনের দুইনম্বর ডিস্ট্রিক্ট গো-খানার সুপারিন্টেন্ডেন্ট আবদুল হামিদ খবর পেয়ে চলে এসেছিলেন। তিনি মৈনুদ্দীনের কাছে এসে বললেন এই ঘন্টাখানেক আগে বাচ্চাটা চলে গেল। আমি খবর পেয়েই চলে এসেছি।

উপস্থিত যারা ছিলেন তারা আলোচনা শুরু করলেন বুলবুলের অন্তেষ্টি কখন এবং কীভাবে করা যায়? এখন অনেক রাত হয়ে গেছে। এত রাতে সব ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাই স্থির হল আজ রাতটুকু বুলবুলকে ঘরেই রাখা হোক আগামীকাল সকালে ব্যবস্থা করা যাবে।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অনেকেই বাড়ি ফিরে গেলেন। শান্তিপদ নজরুলের কাছেই থেকে গেল। মৃত পুত্রকে দুইহাতে জড়িয়ে সারারাত বসে রইল নজরুল কখনও চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকল বুলবুলের গাল, কপাল। কখনও হাউহাউ করে কাঁদতে থাকল। শান্তিপদর মনে হচ্ছিল এই অভিশপ্ত রাত যেন আর শেষ হবে না। কাজীদার বুকফাটা কান্না রাতের নৈঃশব্দকে খানখান করে দিচ্ছিল। বসন্তরোগ বড়ই ছোঁয়াচে। সানিকে যেন সেই রোগ না ধরে সেইজন্যই সানি আর প্রমীলাকে অন্য ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মায়ের মন…আগে একটি পুত্রকে সে হারিয়েছে। এই নিয়ে দ্বিতীয়টিকেও হারাল। এই যন্ত্রণা যে কী অসহনীয় তা একজন মা ছাড়া অন্য কারও অনুভব করার সাধ্য নেই। প্রমীলা সানিকে খাটে শুইয়ে রেখে একবার করে বুলবুল যে ঘরে শুয়ে রয়েছে তার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়, আবার চলে যায়। গিরিবালাদেবী দিশাহারা। প্রমীলাকে সামলাবেন নাকি নজরুলকে তা বুঝতে পারছেন না। নিজের বড় আদরের নাতিকে হারিয়ে তার বুকের ভেতরটাও যন্ত্রণায় ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সেই আবেগকে আটকে তিনি নজরুল আর প্রমীলাকে স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলেন।

অসহ্য রাতের অন্ধকারও একসময় ফিকে হতে শুরু করল। কে যেন ঘরে ধূপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই গন্ধেও গা গুলোচ্ছে শান্তিপদর। মৃত্যুর গন্ধ সমস্ত সুবাসকেই তেতো করে দেয়।

সকাল হতেই একে একে সকলে আসতে শুরু করল। রাতে মৈনুদ্দীন নিজের বাড়িতে ফিরে গেছিল ঠিকই কিন্তু ছিঁটেফোঁটাও ঘুম হয়নি। কোনওরকমে রাতটুকু কাটিয়ে সকালের আলো ফুটতেই চলে এল নজরুলের বাড়িতে। পৌঁছে দেখল অনেকে চলে এসেছে। বেলা হতে আরও অনেকেই খবর পেয়ে এলেন। সকলে মিলে আলোচনা করে স্থির হল বাগমারী গোরস্থানেই বুলবুলকে কবর দেওয়া হবে। সেখানেই গোসল এবং কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা হবে।

ঘরের ভেতর নজরুল শায়িত বুলবুলের পাশে চুপ করে বসে রয়েছে। স্থির, শূন্যদৃষ্টি। কারও সঙ্গে একটি কথাও বলছে না। মানুষটাকে সম্পূর্ণ বাজপড়া গাছের মত রিক্ত, দগ্ধ মনে হচ্ছে। নজরুলের কাছে গিয়ে মৈনুদ্দীন দফনের ব্যবস্থার কথাটা বলতেই নজরুল বলল আমার বাবামনি ভোঁ-গাড়িতে চাপতে চেয়েছিল, ওকে আমি মোটরগাড়িতে নিয়ে যাব।

মৈনুদ্দীন সেই কথা সকলকে জানাতে অনেকে মতামত দিলেন, বসন্তরুগীর মৃতদেহ কোনও ড্রাইভার নিজের গাড়িতে তুলতে চাইবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। চেষ্টা করে দেখতে হবে।

রাস্তায় নেমে কয়েকজন ট্যাক্সি ধরার চেষ্টায় লেগে পড়লেন। কেউই রাজি হয় না। এদিকে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। কাল রাত থেকে বুলবুলের শরীর একইভাবে পড়ে রয়েছে। আর বেশি দেরি করা উচিত হবে না। কিন্তু নজরুলের ইচ্ছেটিকেও উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।

অনেক চেষ্টাচরিত্রের পর একজন শিখ ড্রাইভার রাজি হলেন, কিন্তু ভাড়া চাইলেন পাঁচটাকা। বাজারদরের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি। তাতেই রাজি হওয়া গেল। এবারে প্রশ্ন উঠল খরচ করার জন্য টাকা কোথায়? গিরিবালাদেবীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন ঘরে কোনও টাকা পয়সা নেই, যেটুকু ছিল এই ক’দিনের চিকিৎসায় সব শেষ। আর সঞ্চয় নজরুলের স্বভাবে নেই।

বাধ্য হয়ে বন্ধু-বান্ধবরা টাকা পয়সা সংগ্রহের সন্ধান শুরু করলেন। আর্য পাবলিশিং হাউজ, ডি এম লাইব্রেরি সহ আরও কিছু জায়গায় লোক পাঠানো হল টাকার জন্য। কারণ, শুধু ট্যাকসিভাড়াই তো নয়, কাফন, গোর-খোদাই, জমি কিনে কবরের স্থান রিজার্ভ করার ব্যবস্থা করা ইত্যাদির জন্য সবমিলিয়ে প্রায় দেড়শো টাকা প্রয়োজন। এত টাকা এই মুহুর্তে কোথায় পাওয়া যাবে? পুত্রহারা নজরুলকে এই নিয়ে বিশেষ কিছু বলাও যাচ্ছে না। নজরুলের দুই বন্ধু গেছিল প্রকাশকদের কাছে টাকা চাইতে, খালিহাতে ফিরে এল তারা। কোনও টাকাই পাওয়া যায়নি। সকলের মাথায় হাত। এবার কী হবে? আবারও লোক গেল ডি এম লাইব্রেরিতে, কিছু টাকা যেভাবেই হোক আদায় করে আনতে হবে। সে লোক বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও খালি হাতেই ফিরে এল। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। বেশি দেরি হলে মৃতদেহে পচন ধরার সম্ভাবনা রয়েছে। কী করা যায়? তখন ডি এম লাইব্রেরির প্রকাশক গোপাল দাস মজুমদার নিজেই এসে হাজির হলেন। নজরুলের সঙ্গে দেখা করলেন, সমবেদনা জানিয়ে পকেট থেকে পয়ত্রিশ টাকা বার করে হামিদসাহেবের হাতে দিয়ে সসংকোচে বললেন, আমার কাছে আপাতত এইই রয়েছে। এর বেশি ব্যবস্থা করতে পারলাম না। বলে উনি চলে গেলেন। দেড়শো টাকা খরচ আর আদায় হল মাত্র তিরিশটাকা। নজরুলের চারিদিকে এত পরিচিতি অথচ এই বিপদের সময় সকলেই প্রায় মুখ ফিরিয়ে রইলেন। গাঁটের কড়ি খরচ করার বেলায় সকল সুখের পায়রারা উধাও। শেষে আবদুল হামিদসাহেবই বললেন, আপনারা লাশ নামানোর ব্যবস্থা করুন, বাকি টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। বলে উনি টাকার জোগার করতে চলে গেলেন।

এবার সমস্যা হল বুলবুলের দেহকে কারা নামিয়ে এনে ট্যাকসিতে তুলবে। সকলেই দোনামনা করতে থাকল। বসন্তরোগীর মৃতদেহ ধরতে সকলেরই মনে ভয়। মৈনুদ্দীন নিজে অত্যন্ত ভিতু। পাঁচশো মাইল দূরের কোনও বসন্ত বা কলেরা রুগির খবর কানে এলে ওর ভয় লাগে এই বুঝি আমাকেও সেই রোগ ধরল, কিন্তু বুলবুলকে হারানোর শোক আর কাজীদা ও ভাবীর এই পুত্রহারা যন্ত্রণাকাতর মুখ ওকে বিবশ করে দিল। সকলেই ইতস্ততঃ করছে দেখে মৈনুদ্দীন বলল আমি নামিয়ে আনব।

মৈনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নজরুলের কৃষ্ণনগরের বন্ধু আকবরুদ্দীনের ছোটভাই জহুরউদ্দিন। তিনি বললেন মৈনভাই আমিও আপনার সঙ্গে যাব।

বেশ আসুন তাহলে।

দোতলার যে ঘরটিতে বুলবুলকে শুইয়ে রাখা রয়েছে সেই ঘরটা মাঝারি মাপের, কিন্তু তার দরজার প্রস্থ খুবই কম। দুজনে ঘরে ঢুকে চমকে উঠল। বুলবুলের শরীরটি ফুলে পূর্নবয়স্ক মানুষের মত হয়ে গেছে। হে আল্লাহ এইবার কী হবে? দুজনে মিলে এই মৃতদেহ ঘর থেকে বার করে আনা যে ভীষণ কঠিন। তবু চেষ্টা তো করতেই হবে। বুলবুলের শীতল শরীরটা ধরার সময় মৈনের আবারও কান্না পেয়ে গেল। এই কিছুদিন আগেই কাকা কাকা বলে কত গল্প করল ছেলেটা! কী ভাল যে বাসত! কোন অভিমানে আমাদের ছেড়ে চলে গেলি রে তুই! কোনওমতে নিজের আবেগ এবং চোখের জলকে সামলাল মৈনুদ্দীন। বুলবুলের কোমরের দিকটা ধরলেন জহুরুদ্দীন আর মৈনুদ্দীন ওর দুইহাত বুলবুলের কোমরের নিচ দিয়ে উঁচু করে তুলে ধরল। সেই ফুটফুটে বুলবুলের সুন্দর চেহারাটা কেমন ভয়ংকর হয়ে গেছে, তাকানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ধরাধরি করে তুলে দরজার কাছে নিয়ে এল। বসন্ত গুটির রস গলে, চামড়া উঠে গিয়ে মৈনুদ্দীন আর জহুরের গায়ে লাগছে। ওরা এগুলো ভ্রুক্ষেপ না করেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। জহুর আগে দরজা পার হয়ে গেল কিন্তু ভেতর থেকে মৈনুদ্দীন পড়ে গেল মুশকিলে। সাহায্য করার মত ওপরে আর কেউ নেই। সকলেই নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসলে কেউই ছুঁতে চাইছে না। এত সংকীর্ণ দরজা দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা শবদেহ বার করা খুবই কঠিন হয়ে গেল। বুলবুলের মাথা ঠেকে রয়েছে বারান্দার রেলিঙে। একটু জোর করে বার করতে গিয়েই দেহের হাঁটুর কাছটা চৌকাঠে আটকে গেল। দুজনেই হাঁফিয়ে পড়েছে। গায়ের জামা, দুইহাতে চটচট করছে ফোস্কা গলে যাওয়া রস। অনেক কসরত করে বুলবুলকে ওই দরজা দিয়ে বার করার সময় ওর হাঁটুর কাছ থেকে বেশ খানিকটা ছাল উঠে গেল। শরীরটাকে অক্ষত রাখা গেল না কিছুতেই। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামানোর সময় নজরুলের চোখে পড়ল ওই জায়গাটা। দেখে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল নজরুল। মৈন এইটুকু বাচ্চাকে কষ্ট দিলে! ওই ছাল ওঠা জায়গাটায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল নজরুল। প্রমীলা এবং গিরিবালাদেবী কেউই সামনে নেই। দরজা বন্ধ করে অন্য ঘরে রয়েছেন তারা। স্বাভাবিক। মৃত শিশুপুত্রকে এইভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোন মা তা দেখে সহ্য করতে পারে?

ট্যাক্সিতে ওঠা হল। পিছনের সিটে বুলবুলের মাথা কোলে নিয়ে নজরুল। মাঝে মৈনুদ্দীন আর জুহুরুদ্দীন। সামনে বসলেন হামিদসাহেব। বাকি যারা রইলেন তারা অন্য একটি ট্যাক্সিভাড়া করে নিলেন।

ট্যাক্সি এসে পৌঁছল বাগমারী গোরস্থানে। ওখানকার দুজন হাজি বুলবুলকে গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে দিল। মৈনুদ্দিনের গা ঘিনঘিন করছে। ওর গোটা গায়ে বুলবুলের ফোস্কাগলা রস মাখামাখি হয়ে রয়েছে। ও একবার ভাবল এখানে স্নান করে নিলে ভাল হয়। কিন্তু গোরস্থানের যে কলটা রয়েছে সেটা এতই নিচু এবং তার জলের প্রেসার এতই কম যে স্নান করা অসম্ভব ব্যাপার। একটি পুকুরও রয়েছে কিন্তু সেটা ভয়ংকর নোংরা। ওখানে স্নান করার প্রশ্নই আসে না। ওই কলের জলেই কোনওরকমে হাত-পা ধুয়ে অজু করে জানাজার নামাজের শরীক হল মৈনুদ্দীন। নজরুলও অজু করে মাথায় রুমাল বেঁধে এসে দাঁড়াল মৈনুদ্দিনের সামনে। গোটা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি নজরুল। একেবারে অচেনা মানুষ। এই ক’দিনের মধ্যে ওর চেহারা থেকে সমস্ত আলো যেন কেউ শুষে নিয়েছে। নজরুলের হিন্দুবন্ধুরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

নামাজগাহ থেকে শবদেহ কবরগাহ পর্যন্ত মৈনুদ্দীন আর জহুরুদ্দীনই বয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু এবার কবরে নামবে কে? বেলা দুপুর গড়িয়ে গেছে। মৈনের শরীর আর চলছে না। মাথা ঝিমঝিম করছে। অসম্ভব ক্লান্তি। জহুর কবরে নেমে মৈনুদ্দীনকে ডাকাডাকি শুরু করল। সবাই তাকিয়ে রইল মৈনের দিকে। বাধ্য হয়ে মৈনুদ্দীন কবরে নামার জন্য পা বাড়িয়েছে তখন কবি আবদুল কাদির এক লাফে কবরে নেমে পড়ে বললেন, থাক মৈনভাই, আপনি একটু জিরিয়ে নিন, অনেক ধকল গেছে আপনার।

গোরে মাটি দেওয়া ইত্যাদি হয়ে যাওয়ার পর ওই জায়গাটি নগদ পঞ্চাশটাকা দিয়ে কিনে রিজার্ভ করে রাখা হল। সব কাজ মিটে যাওয়ার পর সকলে ফিরে আসছে। এতক্ষণ চুপ করে থাকা নজরুল আচমকাই ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়ল কবরের ওপর। সে কী নিদারুণ কান্না! কবরের মাটিতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকল নজরুল। দুই হাতের মুঠোয় মাটি খামচে ধরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে থাকল। কেউ এগিয়ে এসে স্বান্ত্বনা দেওয়ার সাহসটুকু জোটাতে পারল না। বালক পুত্রের কবরের মাটি ভিজে উঠল পিতার অশ্রুতে।

বুলবুলের মৃত্যুটা কিছুতেই সহ্য করতে পারল না নজরুল। ওর ব্যবহৃত খেলনাগুলি, ওর গানের খাতা, বই বুকে জড়িয়ে ধরে সারাক্ষণ শুধু কাঁদে। একটা সময় এমন হল যে একটা মুহূর্তও তিষ্ঠোতে পারছে না, একবার…শুধু একবারের জন্য বুলবুলকে চোখে দেখার ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত করতে না পেরে অবশেষে শরণ নিল যোগীরাজ বরদাচরণের কাছে। দাদা আমাকে দয়া করুন, একটি বারের জন্য আমার সঙ্গে বুলবুলের দেখা করিয়ে দিন। আপনি শিব, আপনি চাইলে সব পারেন।

বরদাচরণ শুনে বললেন, কিন্তু কাজীভাই আমি পারলেই তো হল না, সে রয়েছে এখন অন্যলোকে, তাকে ডেকে আনা মানে তাকে কষ্ট দেওয়া, আর সে যদি আসেও তুমি নিজেকে সামলাতে পারবে না, আর তখন হবে মহা বিপদ।

তবু দাদা আপনি একবারটি তার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিন। ও কেমন আছে আমি শুধু একটিবার চোখের দেখা দেখতে চাই। কোনওদিন আপনার কাছে কিছু প্রার্থনা করিনি, এই হতভাগ্য পিতার এই ইচ্ছেটুকু পূরণ করুন।

বরদাচরণের দুই পা জড়িয়ে নজরুলের কান্নার সাক্ষী হল হাওয়ায় মিশে থাকা দীর্ঘশ্বাস। কাজীভাইকে ফেরাতে পারেননি বরদাচরণ। বলেছিলেন, বেশ বিশেষ যোগক্রিয়ার মাধ্যমে তুমি বুলবুলকে একবারের জন্য দেখতে পাবে, আমি সেই পদ্ধতি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সাবধানে তাকে দেখলেও তাকে খবরদার স্পর্শ করতে যেও না, কোনও কথা বলতে চেও না, তাহলে অনর্থ হবে।

তাই হবে দাদা, তাই হবে। তবু একটিবারের জন্য আমি আমার সোনাবাবাকে দেখতে চাই।

বেশ। তাই হবে। বলে বরদাচরণ নজরুলকে যোগের একটি বিশেষ মুদ্রা এবং মন্ত্র শিক্ষা দিলেন।

সেই শিক্ষা নিয়ে নজরুল বাড়ি ফিরে দিনরাত মন্ত্র জপতে থাকল। ঘরের দরজা বন্ধ, সারাক্ষণ যোগমুদ্রায় থাকতে থাকতে একসময় ও সহসাই দেখল ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বুলবুল। ঢুকে সেই একগাল হেসে নজরুলকে দেখল তারপর এগিয়ে গেল ঘরের তাকে রাখা ওর খেলনাগুলোর দিকে। তাক থেকে দুই একটি খালনা নামিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখল তারপর আবারও একবার নজরুলের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। নজরুল পুরো দৃশ্যটিই স্থির হয়ে দেখল, কিন্তু বরদাচরণের নির্দেশ অনুযায়ী একবারও বুলবুলের দিকে এগিয়ে গেল না, একবার নাম ধরে ডাকলও না। ওই একবারই দেখতে পেয়েছিলেন পুত্রকে, আর কোনওদিন নয়। মনের দগদগে ক্ষতে খুব সামান্য হলেও খানিকটা প্রলেপ লাগল সেদিন। একটু শান্ত হল মন। ঘরে থাকলে বুলবুলের অনুপস্থিতি তাঁকে পাগল করে দিত তাই পুত্রশোক ভোলার জন্য কবি ডি এম লাইব্রেরির একটি ছোট ঘরে বসে নিজের মনের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে চন্দ্রবিন্দু নাম দিয়ে গান লেখার চেষ্টা করতে শুরু করল। কবি জসিমউদ্দীন একদিন ডি এম লাইব্রেরিতে এসে সেই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল। কবির চোখদুটি কেঁদে কেঁদে জবা ফুলের মত লাল অথচ ওই কান্না ভুলতেই সে লিখে চলেছে –

তুমি দুখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি হরি?

দাও ব্যথা যতই তোমায় ততই নিবিড় করে ধরি

আমি ভয় করি কি হরি?

আমি শূন্য করে তোমার ঝুলি

দুঃখ নেব বক্ষে তুলি

আমার ব্যথা শোকের শতদলে তোমায় নেব বরি

আমি ভয় করি কি হরি?

যেদিন সন্ধেবেলা বুলবুল চলে গেল তার আগেরদিন রাতেই হাফিজের অনুবাদ শেষ করেছিল নজরুল। নির্জীব, নিশ্চল বুলবুলকে শুনিয়েছিল তাঁর অনুদিত শেষ কবিতাটি। রুবাইয়াৎ – ই- হাফিজ বইয়ের উৎসর্গপত্রে কবি লিখল-

বাবা বুলবুল

তোমার মৃত্য-শিয়রে বসে বুলবুল ই শিরাজ হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ শুরু করি। যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ! যে দেশে গেছ তুমি, সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও সুন্দর? জানি না তুমি কোথায়! যে-লোকেই থাক, তোমার শোক সন্তপ্ত পিতার এই শেষ দান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো। শিরাজি -বুলবুল কবি হাফিজের কথাতেই তোমাকে স্মরণ করি-

সোনার তাবিজ রূপার সেলেট

মানাত না বুকে রে যার

পাথর চাপা দিল বিধি

হায়, কবরের শিয়রে তার…

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *