novel-sokhi-o-pakhi

সখী ও পাখি (ঔপন্যাসিকা)
সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

দু’ধরনের ভ্রমণ পিপাসু মানুষ হয়। এক ধরন হচ্ছে যারা কখনওই পরিস্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পায় না। অপর ধরন হচ্ছে তারা হামেশাই ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে। ইভানা হল গিয়ে প্রথম ধরনের মানুষ। আজ পর্যন্ত যতবার সে কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে এসেছে, মেঘ আড়াল করেছে পর্বতশৃঙ্গকে। এই মুহূর্তে সেই একই অবস্থা। মেজাজ বিগড়ে আছে ইভানার।

উত্তরবঙ্গের চটকপুরের এসেছে ইভানা আর তার মা দিতি। এখন দু’জনে চটকপুরের ওয়াচ টাওয়ারে। টাওয়ারটা দারুণ দেখতে! প্যাগোডা টাইপ ছাদ। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গোল ভিউ পয়েন্ট। এটাই চটকপুরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ভিউ। দূরে পাহাড়শ্রেণি। খাঁজে খাঁজে মেঘ। বেশ খানিকটা মেঘ আড়াল করে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। মেঘখণ্ডের নড়ার নাম নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘার আবছা একটা অবয়ব শুধু বোঝা যাচ্ছে। মেঘ ভেদ করে সদ্য উদিত সূর্যের হাল্কা কমলা রং পড়েছে সেই অবয়বের গায়ে। দৃশ্যটা দেখে তেমন তৃপ্তি হচ্ছে না। একটু বুঝি অস্থির হয়ে পড়ছে ইভানা।

পাশে চাদর মুড়ি দিয়ে টুলের উপরবসে আছে মা। টুলটা গাছের গুড়ি দিয়ে বানানো। মায়ের কোনও বিকার নেই। সামনে সিমেন্ট বাঁধানো নিচু পাঁচিলে দু’হাত রেখে ওই আবছা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। ইভানা মাকে বলে, মা, তুমি কোনওদিন ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছ?

–দেখেছি। বেশ ক’বার দেখেছি।

–নিশ্চয়ই আমার জ্ঞান হওয়ার আগে। বাবার সঙ্গে দেখেছ?

–না, তোকে নিয়ে যতবারই এসেছি, কাঞ্চনঘঙ্ঘা ভাল ভাবে দেখা যায়নি। তুই হচ্ছিস মেঘ কপালে মেয়ে। বলে মিষ্টি করে হাসল মা।

ইভানা বলে, তারমানে হনিমুন করতে এসে দেখেছ।

–কেন রে? মেয়েদের জীবন কি শুধু বিয়ের পরই শুরু হয়। বিয়ের আগে আমার বাবা-মা’র সঙ্গে চারবার দার্জিলিং এসেছি। চারবারই দেখা পেয়েছি কাঞ্চনজঙ্ঘার। কী তার আলো, কত রং! একবারে ঠিকরে বেরোচ্ছে সৌন্দর্য!

ইভানা আর কিছু বলে না। সত্যিই সিলি মিসটেক করে ফেলেছে। মেয়েদের তো সত্যিই দুটো জীবন, একটা বিয়ের আগে। আরেকটা বিয়ের পরে।

আরও মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ক্লাসমেট বৃষ্টি বলেছিল, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে হলে শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে পড়বি। তারপর ভোর ভোর পৌঁছে যাবি ভিউ পয়েন্টে। নয়তো যত বেলা বাড়বে, মেঘেরা নীচ থেকে উঠে আড়াল করে দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে।

বৃষ্টি ফ্যামেলির সঙ্গে জুলাই মাসে এসেছিল চটকপুর। ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে এমন বর্ণনা করেছিল এখানকার, ইভানা তখনই ঠিক করে নেয় মাকে নিয়ে চটকপুর যেতে হবে। একটানা চার রাত, পাঁচদিন থাকবে। সেই মতো সেপ্টেম্বরের শেষে এখানে এসেছে। ইউনিভার্সিটিতে ছুটি চলছে এখন।

গতকাল দুপুরে চটকপুরে এসে পৌঁছেছে ইভানারা। অত্যন্ত খারাপ রাস্তা। গাড়ির ঝাঁকুনির চোটে গা-কোমর ব্যথা হয়ে গেছে মা-ইভানার। তবু পাহাড়ের উপরে এই গ্রামটায় এসে চারপাশ এত সুন্দর লেগেছিল, গা ব্যথার কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিল দু’জনে। এ গ্রামের সব বাড়িতেই বোধহয় হোমস্টের ব্যবস্থা। প্রত্যেক হোমস্টেই কটেজ টাইপ এবং নানান রং দিয়ে পেইন্ট করা। হোমস্টের সামনে সবজির খেত, ফুলের বাগান। বারান্দায় সার দিয়ে সাজানো ফুলের টব। ইভানারা যখন পৌঁছেছিল রোদ ছিল বেশ। তবে ঠান্ডা হাওয়াও দিচ্ছিল। গ্রামের নীচের দিকে ভাসমান মেঘ। মনে হচ্ছিল আকাশের মাঝেই এই গ্রাম।

ইভানাদের হোমস্টের নাম ‘পাইন হোমস্টে’। অনলাইনে বুক করেছিল ইভানা। এরাই পিকআপের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।

হোমস্টেটা খুব সুন্দর লোকেশানে। সামনে গাছ বা অন্য কিছুর আড়াল নেই। শুধুই অপার প্রকৃতি। বারান্দার নীচে সবজি খেত। খেত ঘিরে নানান ফুল গাছের বেড়া। হোমস্টের পর পর দুটো রুমের পর একটা চাতাল, যার পিছনে কিচেন। চাতালের পর আরও দুটো রুম।

কাল ওয়েলকাম ড্রিংক্স হিসেবে এরা দার্জিলিং-টি দিয়েছিল। তার একটু পরে লাঞ্চ। অত ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও লাঞ্চের পর রুমে বেশিক্ষণ শুতে পারেনি মা-মেয়ে।প্রকৃতি তাদের ডাকছিল। বারান্দায় এসে বসেছিল দু’জনে। টুকটাক কথাবার্তা চলছিল। বারান্দা উঠে এসেছিল দুটো কিউট বিড়াল বাচ্চা। কোলে নিয়ে আদর করেছে ইভানা। মা বিড়াল কুকুর তেমন পছন্দ করে না। সবজি খেতের মধ্যে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল দেশি মুরগি। যেমন তাদের গড়ন, তেমনি তাদের গতি।

বিকেলের চা এল। সূর্যাস্তের রং ধরল মেঘেদের গায়ে। কী অপূর্ব লাগছিল আকাশটা। ইভনিংস্ন্যাক্স মোমো এবং কফি। পশ্চিম আকাশ তখন লালে লাল। মোমো কফি নিয়ে এসেছিল যে মহিলা, ইভানা তাকে জিজ্ঞেস করে, কাল কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখ নো কো মিলেগা?

মহিলা বলেছিল, কই গ্যারেন্টি নেহি। পরশো দিখাদিয়া। একদম ক্লিয়ার।

অনিশ্চয়তা একটা আছে, তখনই বুঝেছিল ইভানা। এখন সেটাই প্রমাণ হল। মায়ের দিকে চোখ গেল ইভানার। একই ভঙ্গিতে সামনের দিকে চেয়ে আছে। গায়ের চাদরটা ভাল করে জড়ায়নি। যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। হাওয়াও দিচ্ছে সজোরে। ইভানা মায়ের শরীরে চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে দেয়। মা ইভানার দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো হাসে। এই হাসিটাই মা গত সাত মাস ধরে হাসেনি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা পুরোপুরি গুম মেরে গিয়েছিল। ইভানারও মনের অবস্থা একেবারেই ভাল ছিল না। দু’মাস ট্রমার মধ্যে কাটিয়ে ইভানা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মায়ের কিন্তু স্বাভাবিক হওয়ার কোনও লক্ষণ ছিল না। আসানসোলের বাড়িতে শুধু মা আর ইভানা। কাজের লোক অবশ্য দু’জন আছে। তারা কেউই সব সময়ের জন্য নয়।

ইভানা যাদবপুরে ইকনমিক্সে মাস্টার্স করছে। কলকাতার একটা পিজিতে থাকে। বাবা মারা যাওয়াতে দু’মাস ক্লাস করতে পারেনি ইভানা। আসানসোলে মায়ের পাশে ছিল। কিন্তু ফিরতে তো হবেই ইউনিভার্সিটির জন্য। এদিকে মা-কেও একা আসানসোলে রাখার ভরসা পাচ্ছিল না ইভানা। তখন মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। মাকে নিয়ে চলে আসে মামারবাড়ি, কোন্নগরে। সেখানে দেখার লোক থাকবে। দাদু তো আছেই, আর আছে মামিমা।

মামার বাড়ি এসেও মায়ের তেমন কোনও উন্নতি হল না। সারাক্ষণ চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবে! আর একা থাকতে পছন্দ করে। ইভানা ততদিনে টালিগঞ্জের পিজিতে ফিরে গেছে। ইউকএন্ডে মা’কে দেখতে আসে। দাদু একদিন বলল দিদিভাই, মাকে নিয়ে বাইরে কোথাও কয়েকটা দিন ঘুরে আয়। যদি মনটা একটু হালকা হয়।

দাদুর কথা মতো কোথায় যাওয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে বসল ইভানা। কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছিল না। একদিন বৃষ্টি বলল, চটকপুর যেতে পারিস তো। দারুন জায়গা। নর্থ বেঙ্গলে যে ক’টা জায়গায় ঘুরলাম, তার মধ্যে বেস্ট।

চটকপুর সম্বন্ধে বৃষ্টির থেকে বেশ কিছু তথ্য পেল ইভানা। ঠিক করল মাকে নিয়ে এখানেই আসবে। মাকে বলতে এককথায় রাজি হয়ে গেল। সব চেয়ে বড় ব্যাপার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে, যে মা কখনও হাসেনি। এখানে এসে বেশ ক’বার হেসেছে। গানও গেয়েছে গুন গুন করে। মা রীতিমতো ভাল গায়। মায়ের এই বদল এখনও দাদুকে জানানো হয়নি। শুধু পৌঁছনো সংবাদটুকু জানিয়েছে ইভানা। বলেনি চটকপুরে যতই মেঘ থাকুক, মায়ের মুখ থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে মেঘ।

–চল, ফিরে যাই। এর থেকে বেশি আর দেখা যাবে না। পাশ থেকে বলল মা।

ইভানা বলল, ফিরে গিয়েইবা কী করব? এই স্পট থেকে চারদিকটা কী সুন্দর লাগছে না?

–তা লাগছে। বলে চুপ করে গেল মা।

এই নির্জনতার মধ্যে কোথা থেকে যেন একটা পাখি ডেকে উঠল, চি ই ই প, চি ই ই প। কী মিষ্টি পাখিটার ডাক! ওয়াচ টাওয়ারের আশেপাশেই আছে হয়তো। ইভানা ওয়াচ টাওয়ারের কোমর সমান পাঁচিলে হাত রেখে নীচের দিকটা দেখে, না কোথাও দেখা যাচ্ছে না পাখিটাকে। ডেকেই যাচ্ছে পাখিটা।

ইভানা মাকে বলে আচ্ছা, ওয়াচ টাওয়ারে আর কোনও ট্যুরিস্ট এল না কেন বলো তো? শুধু আমরাই।

–সবাই কি তোর মতো বোকা নাকি? রাত থাকতে টর্চ জ্বেলে আমাকে এখানে নিয়ে এলি। বাকিরা ঘুম থেকে উঠেছে দেরি করে। হোমস্টে থেকেই দেখে নিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে না। সেই জন্যই আর আসেনি এখানে।

এটা ঠিক বলেছে মা। এখানকার হোমস্টেগুলো পাহাড়ের ধাপে ধাপে। সব হোমস্টে থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু ইভানা কী করবে, বৃ্ষ্টি যে বলে দিয়েছিল যত ভোর ভোর উঠবি, দেখতে পাবি কাঞ্চনজঙ্ঘা। বেলা বাড়লেই মেঘে ঢেকে যাবে সব।…ভাবতে ভাবতেই দূর থেকে কাদের যেন কণ্ঠস্বর কানে আসে ইভানার। ঘাড় ফেরায় শব্দের দিকে। ওই তো দু’জন আসছেন ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। স্বামী-স্ত্রী নিশ্চয়ই। মাঝবয়সী। ওঁরা ইভানাদের মতো শর্ট রুটে আসছেন না। ওয়াচ টাওয়ারে আসার একটা আঁকা বাঁকা রাস্তা আছে। যেটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা, সেই পথে আসছেন দু’জন। ওই রাস্তা দিয়ে আসেনি ইভানারা। হাতে দুটো লাঠি ধরিয়ে দিয়ে শর্ট রুট দেখিয়ে দিয়েছিল হোমস্টের ছেলেটা। শর্ট রুটটা ছিল বেশ খাড়াই। লাঠি ছাড়া আসাই যেত না। অন্যান্য হোমস্টের পার্সোনাল সিঁড়ি, চাতাল ধরে আসতে হচ্ছিল। যা বড় অস্বস্তির। এখানে এসে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা আঁকা বাঁকা রাস্তাটা ইভানার মন কেড়ে নেয়। বাঁশের বেড়াটা নানান রং দিয়ে পেইন্ট করা হয়েছে। বেড়ার নীচে ছোট ছোট ফুল সুদ্ধ গাছ।

ওই দুজন চলে এসেছেন ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। ভদ্রলোকের পঞ্চাশ পার বয়স। পরনে জগিং ট্রাউজার আর জ্যাকেট। লোকটিকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে ইভানার। এমন চেনা, যেন বাক্যালাপ হয়েছে আগে। অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না। ভদ্রমহিলাকে অবশ্য কখনও দেখেনি ইভানা। ওঁর পরনে জিন্স আর হুডি দেওয়া জ্যাকেট। ভদ্রলোকের গলায় ঝুলছে লম্বা লেন্সের ক্যামেরা।

এবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন দু’জনে। কাঠের সিঁড়ি, তাই আওয়াজ হচ্ছে পায়ের। এতক্ষণ টানা জনহীন হয়ে থাকতে ভাল লাগছিল না ইভানার। এরা আসছে দেখে ভালই লাগছে। মাকে বলে, দ্যাখো, আমরা ছাড়াও বোকা লোক আছে। দু’জন আসছেন ওয়াচ টাওয়ারে।

এ কথার জবাব না দিয়ে মা বলল, তুই তো একটাও ছবি তুললি না কাঞ্চনজঙ্ঘার। যতটুকু দেখা যাচ্ছে তুলে নে। কাল হয়তো এতটুকুও দেখা যাবে না।

–ধুর, মোবাইলে এ ছবি তুললে আলাদা করে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বোঝাই যাবে না। ক্যামেরা কিনতে হবে। ভাল দেখে একটা ডি এস এল আর কিনতে হবে।

ইভানার কথা শেষ হল, ওয়াচ টাওয়ারের চাতালে উঠে এলেন দুই ট্যুরিস্ট। সৌজন্যের হাসিসহ ভদ্রলোক ইভানাকে ‘হ্যালো’ বললেন। ইভানাও হাসি মুখে ‘হাই’ বলল। ভদ্রমহিলা ইভানার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। প্রত্যুত্তরে ইভানাও হাসল। ভদ্রলোককে এখনও ইভানার ভীষণ চেনা লাগছে। কিছুতেই প্লেস করতে পারছে না। মায়ের দিকে তাকায় ইভানা, বাই এনি চান্স। মা হয়তো চিনতে পারে ভদ্রলোককে। হয়তো ইভানাদের আত্মীয়। কিন্তু এ কী! মা এমন ভাবে চাদর মুড়ি দিয়েছে কেন? চোখ দুটো বাদে মুখের সবটা ঢাকা! ইভানা মায়ের কানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী গো, তোমার কি খুব ঠান্ডা লাগছে?

মাথা নেড়ে সায় দিল মা। ইভানা বলল, হঠাৎ ঠান্ডা লাগছে কেন? জ্বরটর কিছু এল?

বলার পর মায়ের কপালে হাত রাখতে যায় ইভানা। মা সরিয়ে নেয় মাথা। ইভানা জোর করতে পারত। এখানে যেহেতু আর দু’জন অচেনা মানুষ আছে, তাই কিছু করল না। মাকে বলল, চলো, নীচে যাবে। রেস্ট নেবে একটু?

মা কোনও উত্তর দিল না। ওই চাদর মুড়ি অবস্থায় মেঝে থেকে লাঠি তুলে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।




কালকের মতো আজকেও একটা সুন্দর সূর্যাস্ত হচ্ছে। মেঘেদের গায়ে লেগেছে সিঁদুরের ছিটে। দৃশ্যটা মিস করছে মা। সকালবেলা ওয়াচ টাওয়ার থেকে আসার পর মা সেই যে বিছানায় শুয়েছে, ওঠার নাম নেই। ব্রেকফাস্ট সেরেছে রুমে বসেই। লাঞ্চের জন্য অবশ্য হোটেলের ডাইনিং-এ গিয়েছিল।

মায়ের গায়ে জ্বর নেই, কিচ্ছু নেই। শুধু বলছে, শরীরটা ভাল লাগছে না। বিকেলে ইভানা বলল, চলো, বারান্দায় গিয়ে একটু বসি।

মা বলল, তুই যা। শরীর ভাল বুঝলে আমি যাব।

বিকেলে ইভানা হোমস্টের চারপাশটা একটু পায়চারি করল। মোবাইলে ছবি তুলল কয়েকটা। রাতে ফেসবুকে নিজের ওয়ালে পোস্ট করবে। বন্ধুরা বলে দিয়েছে বেড়াতে গিয়ে যা কিছু ভাল লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলে পোস্ট করবি। বাড়ি এসে করবি না।

ছবি তোলার এন্থুটাই চলে গেছে ইভানার। যে ক’টা তুলেছে জোর করে। মায়ের মুড বদলটা নিয়েই ভাবছে বেশি। কী এমন হল যে, মা হঠাৎ নিজেকে গুটিয়ে নিল? কোনও কারণই মাথায় আসছে না ইভানার। একটা সম্ভাবনাই শুধু দেখতে পাচ্ছে, আজ সকালে ওয়াচ টাওয়ারে যে ভদ্রলোককে ইভানার চেনা লেগেছিল, কিন্তু চিনতে পারেনি, মা মনে হচ্ছে চিনে ফেলেছে। শুধু চিনে ফেলা নয়, মা ওদের দুজনকে অ্যাভয়েড করতে চাইছে। তাই বোধহয় ওদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে চাদরে নিজের মুখটা ঢেকে নিয়েছিল মা। ওদের সামনা সামনি হতে চায়নি! পরে মা ওদের ব্যাপারে ইভানাকে কিছু বলল না। অর্থাৎ মা বিষয়টা গোপন রাখতে চায়। তাই ইভানাও মাকে এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি। মায়ের মনের অবস্থায় কথা ভেবেই করেনি। মাকে এখানে মন ভাল করার জন্য নিয়ে এসেছে ইভানা। প্রশ্ন করে অস্বস্তিতে ফেলার কোনও মানে হয় না। ইভানা নিজেই এ প্রশ্নর উত্তর বার করে ফেলবে।

সন্ধে নেমে এল প্রায়। ইভানাদের হোমস্টের এক ধাপ নীচে একটা দোকান দেখা যাচ্ছে। দোকানটার আলো জ্বলে উঠল বলেই দেখতে পেল ইভানা। ওখানে কী কী পাওয়া যায়, জানার খুব কৌতুহল হচ্ছে ইভানার। চিপসের প্যাকেট ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। চটকপুরে এই প্রথম একটা দোকান চোখে পড়ল। বারান্দার চেয়ার থেকে উঠে পড়ে ইভানা। দোকানটায় যাবে। কিছু না হোক চিপসই কিনে আনবে।

পায়ে চলা পাথুরে রাস্তা ধরে নীচে নামতে থাকে ইভানা। টর্চ নিয়ে এলে ভাল হত কি? আকাশের দিকে তাকায় ইভানা, নাঃ, আলো আরও কিছুক্ষণ থাকবে মনে হচ্ছে।

রাস্তা নীচে নামতে নামতে দু’বার বাঁক নিল। এবার রাস্তার গা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে। তারপরই দোকানটার চত্বর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে থমকে গেল ইভানা। দোকানের বাইরে একটা বাঁশের মাচার উপর বসে আছেন সেই ভদ্রলোক, সকালে ওয়াচ টাওয়ারে ইভানাকে ‘হ্যালো’ বলেছিলেন যিনি। সম্ভবত ইনি মায়ের চেনা কেউ। ইভানা ভদ্রলোকের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দোকানের কাউন্টারে পৌঁছোয়। দেখে, চা বানানো হচ্ছে। দোকানি একজন স্থানীয় মহিলা। ইভানা দোকানিকে বলে, কফি হোগা?

–হাঁ, গো যায় গা। থোরা বৈঠ না পড়ে গা। বলল দোকানি।

বসতে গেলে বাইরেই বসতে হবে। ভিতরের বেশ কিছু স্থানীয় পুরুষ মানুষ। ইভানা বাঁশের মাচাটার দিকে ঘাড় ফেরাতেই সেই ভদ্রলোক বললেন, তোমার যদি কোনও অসুবিধে না হয় এখানে বসতে পারো।

–না না, অসুবিধের কী আছে। বলে ইভানা মাচাটার দিকে এগোয়। চোখ যায় ভদ্রলোকের পাশে থাকা বিয়ারের বোতলের দিকে। পাশে একটা চিপসের প্যাকেটও আছে। মাচাটা বেশ লম্বা। ইভানা ভদ্রলোকের থেকে খানিকটা তফাৎ রেখে বসে। ভদ্রলোক বিয়ারের বোতল, চিপসের প্যাকেটটা নিজের বাঁ পাশে নিয়ে নেন। মানে যে দিকে ইভানা নেই। তারপর ইভানাকে বললেন, কোন হোমস্টেতে উঠেছ তোমরা?

ইভানা আঙুল তুলে বলে, ওই যে পাইন হোমস্টে। বারান্দায় এল ই ডি লাইটের মালা ঝুলছে।

–ও আচ্ছা। আমাদের হোমস্টেটা তোমাদের পিছনে। দুধাপ উপরে। রমিলা হোমস্টে। বলার পর ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কবে এসেছ?

–গতকাল।

–আমরাও তাই। বলে নিয়ে বাঁ হাতে বিয়ারের বোতল তুলে বললেন, আমি একটু বিয়ার খাচ্ছি। তোমার অস্বস্তি হচ্ছে না তো?

–অস্বস্তি হলে কী করবেন?

–দোকানের ভিতরে গিয়ে খাবো।

–না, অস্বস্তি হচ্ছে না। আপনি খেতে পারেন।

–থ্যাঙ্ক ইউ। বলে বোতল থেকে লম্বা একটা ঢোঁক দিলেন ভদ্রলোক। তারপর মুখে চিপস দিয়ে চিবোতে লাগলেন।

ইভানারও কফি এসে গেল। দিয়ে গেল দোকানের ভিতর থাকা একটা লোক। কফিতে চুমুক দিল ইভানা। ফোন বাজছে ইভানার, মনে হচ্ছে মায়ের ফোন। মোবাইল বার করে জিন্সের পকেট থেকে। হ্যাঁ, মায়ের ফোন। রিসিভ করে বলে, এই তো কাছেই আছি। তার পর কেটে দেয় কল। চারপাশের আলো বেশ কমে এসেছে। উজ্জ্বল হয়ে উঠছে দোকানের চাতালটা। উপরে লাঠিতে বাঁধা একটা ল্যাম্প ঝুলছে।

–তোমার নামটা জানতে পারি কি? বললেন ভদ্রলোক।

–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ইভানা চৌধুরী। বলল ইভানা।

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ, তেমন কোনও সুবিধে হল না।

–মানে! অবাক হয় ইভানা।

ভদ্রলোক বলেন, আসলে হয়েছে কী, তোমাকে আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। আজ সকালে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল চেনা কেউ! নামটা জানলে হয়তো মনে পড়বে এমনটা ভেবেছিলাম। কিন্তু এই নাম জীবনে প্রথম শুনলাম আমি। এবং ভারী সুন্দর নাম!

ইভানা কফির মগে সিপ দিচ্ছিল, ওই অবস্থাতেই বড় বড় চোখ করে তাকায় ভদ্রলোকের দিকে। চুমুকটা গিলে নিয়ে বলে, আরেঃ আশ্চর্য ব্যাপার তো! আপনাকেও তো প্রথম দেখা থেকে চেনা লাগছে আমার!

ভদ্রলোক একটু যেন লজ্জা পেলেন। মাথা নামিয়ে নিয়ে মৃদু হাসছেন। ওঁর কি ইভানার কথা বিশ্বাস হল না? ফের ইভানা বলে, বলুন না, কেন আপনাকে ভীষণ চেনা লাগছে আমার?

–তুমি কি বাংলা সিরিয়াল দেখো? খানিক দূর থেকে ভেসে এল মহিলা কণ্ঠ।

ঘাড় ঘোরায় ইভানা। দেখে ভদ্রলোকের স্ত্রী এগিয়ে আসছেন। এখন পরনে সালোয়ার কামিজ আর শাল। মহিলার প্রশ্নের উত্তরে ইভানা বলে, না, বাংলা টিভি সিরিয়াল দেখি না। কেন বলুন তো?

মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, বাংলা সিরিয়াল দেখো, হয়তো খুব কম। তাই তোমার চেনা লাগছে সুগতকে।

ইভানা ভদ্রলোকের দিকে একবার তাকায়। তারপর মুখ ফিরিয়ে মহিলাকে বলে, হতে পারে। মা তো সিরিয়াল দেখে নিয়ম করে। মাঝে মাঝে গিয়ে বসি মায়ের পাশে। তখন হয়তো দেখেছি ওঁকে। উনি তারমানে অভিনয় করেন সিরিয়ালে?

–হ্যাঁ, নায়ক, নায়িকার বাবা, মামা, কাকা এই সব রোল করে। বলে, ভদ্রমহিলা পিছন ফিরে একটু লাফিয়ে উঠে বসলেন মাচায়। ইভানার ডানপাশে। হ্যাজবেন্ডের পাশে নয়। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?

ইভানাকে উত্তর দিতে হল না। সুগতবাবু বলে উঠলেন, ইভানা। ইভানা চৌধুরী। কী সুন্দর নাম না অর্পিতা?

–হ্যাঁ, খুবই আনকমন। সহমত হলেন মহিলা। এবার ইভানাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাড়ি কোথায়?

–আসানসোল। বলল ইভানা। পাল্টা জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথায় থাকেন?

–ঢাকুরিয়া। বললেন অর্পিতা।

সুগতবাবু বাঁ পাশ থেকে বলে উঠলেন, অর্পিতা তুমি কি বিয়ার নেবে?

অর্পিতা বললেন, না, বিয়ার নয়। আমি ইভানার মতো কফি খাবো।

সুগতবাবু মাচা থেকে নেমে কফির অর্ডার করতে গেলেন সম্ভবত।

অর্পিতা ইভানাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কী করছ? মানে কোনও জব না পড়াশোনা?

–ইকোনমিক্সে মাস্টার্স। ফার্স্ট ইয়ার।

–কোন ইউনিভার্সিটি?

–যাদবপুর।

–বাহ্, সে তো আমাদের বাড়ির কাছেই। যাদবপুরে পড়ছ মানে কলকাতার হোস্টল বা পিজিতে থাকো।

–পিজিতে থাকি। টালিগঞ্জে। এখন অবশ্য মামার বাড়ি থেকে যাতায়াত করছি।

–মামার বাড়ি কোথায়?

–কোন্নগর।

–আরে বাহ্! কোন্নগরের পাশেই তো আমার বাপের বাড়ি। হিন্দমোটরে।

স্ত্রীর জন্য কফি নিয়ে ফিরলেন সুগত। মগটা ওঁর হাতে দিয়ে বললেন, কিন্তু আমার সমস্যাটার তো সমাধান হল না। ইভানাকে কেন আমার এত চেনা লাগছে?

কফিতে চুমুক দিয়ে অর্পিতা বললেন, ইন্ডাস্ট্রিতে রোজ কত মেয়ে দেখছ, তাদের কারুর সঙ্গে হয়তো মিল আছে এর। তুমি গুলিয়ে ফেলছ।

উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না সুগত মাথা নাড়তে নাড়তে ফের আগের জায়গায় বসলেন। বললেন, ইন্ডাস্ট্রির কারুর সঙ্গে গোলাচ্ছি না। ওরা সব সময় মেকআপ করে থাকে। ইভানাকে আমি অন্য কোথাও দেখেছি।

সুগতর কথা শেষ হতেই দেখা গেল সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে তিন যুবক, এক যুবতী। নিজেদের মধ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে ওরা, হাসছে। পা টলছে তিনজনেরই। মর্ডান সাজপোশাক ওদের। এই যে তিনটে ছেলে, একটা মেয়ে… এ সব দেখলে কেমন যেন ভয় ভয় করে ইভানার। মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়।

গ্রুপটা দোকানে ঢুকে বিয়ার কিনছে। সুগত প্যাকেটখুলে সিগারেট বার করলেন। অর্পিতা বললেন, আমাকে একটা দিও তো। বেশ ঠান্ডা লাগছে।

সুগত ইভানার সামনে দিয়ে সিগারেট বাড়ালেন স্ত্রীর দিকে। নিজে সিগারেট ধরিয়ে, লাইটারটা এগিয়ে ধরলেন। এমন সময় ইভানার কানে এল মায়ের গলা, তুই এখানে! চারদিকে খুঁজে মরছি! ফোনটা ধরেই কেটে দিলি কেন?

মা এত ঝাঁঝিয়ে বকে না কখনও। দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির উপরে। মুখে রাগ। পাঁচজনের সামনে মায়ের বকুনিটা গায়ে লেগেছে ইভানার। মাকে বলে, খুঁজছ কেন? আমি কি বাচ্চা, যে হারিয়ে যাব!

–চা-পাকোড়া দিয়ে গেছে হোমস্টে থেকে। ঠান্ডা হয়ে যাবে না চা-টা! বলল মা।

–ও, আচ্ছা। চলো। বলে মাচা থেকে নেমে দাঁড়ায় ইভানা। মা ঘুরে যায় হোমস্টের দিকে। এমন সময় অর্পিতা গলা তুলে বলে উঠলেন, দিতি না!

মা ঘুরে দাঁড়াল। অল্প বিরক্তির কণ্ঠে বলল, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না!

–আমি অর্পিতা। হিন্দমোটরে বাপের বাড়ি।

–তাও চিনতে পারছি না। বলে মা ইভানাকে ডাকে, চলে আয় ইনা।

‘ইনা’ ইভানার ডাক নাম। মা ঘুরে গিয়ে হাঁটা দিতে যাবে, অর্পিতা বলে ওঠেন, তুমি হয়তো আমাকে না চিনতে পারো, তোমার সুগতদাকে তো চেনো!

ইভানা ঘাড় ফেরায় সুগতর দিকে উনি বিয়ারের বোতলটা পিছনে রাখলেন। ইভানা শিওর হল সুগতবাবুকে মা চেনে। অর্পিতার প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে মা ফিরতে থাকে হোমস্টেতে। ইভানা সিঁড়ি ধরে উঠে পড়ে রাস্তায় অনুসরণ করে মাকে।




আবার ইভানা হোমস্টের বারান্দায়। দূরে ডান দিকের পাহাড়ের মাথায় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশে মেঘ আছে বলে কোনও পাহাড়ের গায়েই গ্রাম-শহরের আলো দেখা যাচ্ছে না।

ইভানার মাথাতেও জমেছে অনেক মেঘ। মাকে সে যেন ঠিক চিনতে পারছে না। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে মা সুগতবাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনে। পরোক্ষে কিছুক্ষণ আগে সেটা স্বীকার করেছে মা। সকালে সুগতবাবু, অর্পিতা আন্টিকে এড়ানোর জন্যই ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নিজেকে চাদরে মুড়ে নিয়েছিল। সন্ধেবেলা অর্পিতা আন্টিকে চিনতে অস্বীকার করল মা। অর্পিতা আন্টি সে ক্ষেত্রে মায়ের উপর জোর করতে পারলেন না। বলতে পারলেন না, তুমি আমাকে চেনো। ইচ্ছে করে না চেনার ভান করছ। অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে অর্পিতা আন্টির মুখোমুখি কখনও পরিচয় হয়নি, তাই জোর করতে পারেননি। সুগতবাবুর সঙ্গে হয়েছে। সেটা শুধু একবার নয়। অর্পিতা আন্টির কথা শুনে মনে হল সুগতবাবুর সঙ্গে মায়ের দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। কিন্তু মায়ের মুখ থেকে ভদ্রলোকের নাম কোনওদিন শোনেনি ইভানা। শোনাটা স্বাভাবিক ছিল কারণ, সুগতবাবু একজন সেলিব্রেটি। মা কোনও একদিন টিভির দিকে আঙুল তুলে বলতেই পারত, এই দ্যাখ, এই অ্যাক্টারটা না আমার পরিচিত,… অনেকেই তো সেলিব্রেটির সঙ্গে আলাপ থাকাটা গর্বের মনে করে। মা কেন করল না? সুগতবাবু মাকে কি কোনও কারণে আঘাত দিয়েছেন?

সেই সব প্রশ্ন নিয়ে নীচের দোকান থেকে মায়ের পিছু পিছু হোমস্টের রুমে এসেছিল ইভানা। চা ঠান্ডা হয়ে যাওয়াটা অজুহাত ছিল। কারণ, ফ্লাক্সে চা দিয়েছিল হোমস্টে থেকে। পাকোড়াগুলো সত্যিই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। চা-পাকোড়া খেতে খেতে ইভানা মাকে জিজ্ঞেস করে, সুগতবাবুর সঙ্গে তোমার কী ভাবে আলাপ?

এবার আর বিষয়টা এড়িয়ে যায়নি মা। বলেছিল, আমাদের কলেজের জি এস ছিল।

–তোমার সঙ্গে কি ওঁর ঝগড়া হয়েছিল? তুমি ওঁকে এড়িয়ে যেতে চাইছ কেন? জানতে চেয়েছিল ইভানা।

মা বলল, হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে মনোমালিন্য হয়েছিল?

–কীরকম মনোনমালিন্য? কী নিয়ে? কৌতুহল দেখিয়ে ছিল ইভানা।

মা উদাস গলায় উত্তর দিল, সে সব অনেকদিন আগের কথা, তোর শুনে কাজ নেই।

–অনেকদিন আগের কথা হলেও, ওঁর উপর রাগটা তো তোমার এখনও ষোলো আনা আছে। তার মানে সেই মনোমালিন্য আজও প্রাসঙ্গিক।

হেসে ফেলেছিল মা। বলল, একদম বাপের মতো হয়েছিস। সব সময় উকিলের মতো জেরা। ল নিয়ে পড়তে পারতিস।

মা বিষয় থেকে সরে যাচ্ছে দেখে ইভানা আবদারের গলায় বলেছিল, বলো না মা, তোমার সঙ্গে সুগতবাবুর কেমন আলাপ ছিল?

–এখন মুড নেই। পরে বলব। বলেছিল মা।

ইভানা তখন বলে, ওঁর টাইটেলটা বলো তো?

–টাইটেল জেনে কী হবে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মা।

ইভানা বলে, হবে হবে। এখন ইন্টার নেটের যুগ। টাইটেল জানলেই ওঁর সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে নিতে পারব।

–বুঝেছি। ফেসবুকে খুঁজবি। ওর কিন্তু কোনও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। আর ওর টাইটেল হল সেনগুপ্ত।

মায়ের কথা শুনে বারান্দায় চলে এসেছিল ইভানা। হাতে ছিল নিজের মোবাইল। অসতর্কতায়, নাকি সচেতনভাবে মা বুঝিয়ে দিল সুগত সেনগুপ্তর খবর এখনও রাখে। খোঁজে ফেসবুকে। মায়ের সঙ্গে কি সুগতবাবুর প্রেমছিল?… এই সম্ভবনাটাই মাথায় চলে আসছে প্রথমে। আর ভীষণ রাগ হচ্ছে মায়ের উপর। দুঃখ হচ্ছে বাবার জন্য। বাবা নিশ্চয়ই সুগতবাবুর খবর জানত না। মায়ের সঙ্গে দারুন অ্যাডজাস্টমেন্ট ছিল বাবার। দু’জনের মধ্যে কখনও ঝগড়া হয়েছে বলে মনে পড়ে না ইভানার। মা এমনিতে চুপচাপ, তবে বাবার উপস্থিতিতে বেশ হাসি খুশি থাকত। মা কি তা হলে বাবাকে ঠকিয়েছে?… এই সব ভাবতে ভাবতে মোবাইলে ফেসবুক সার্চ করছে ইভানা। বাবার জন্য মন খারাপ করছে তার। নাঃ, সুগত সেনগুপ্তকে ফেসবুকে পাওয়া গেল না। মা তার মানে লেটেস্ট খবর দিয়েছে। ইভানা ভেবেছিল মা যখন খুঁজেছে ওঁকে, তখন হয়তো ফেসবুকে ছিলেন না। এখন হয়তো অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। কারণ, ফেসবুক তো এখন যোগাযোগের নেসেসারি মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আর সেলিব্রেটিদের ফেসবুক থাকা তো খুবই প্রয়োজন। ফেসবুক আত্মপ্রচারের একটা বলিষ্ঠ মিডিয়াম। বোঝা যাচ্ছে সুগতবাবুর আত্মপ্রচারে অনীহা আছে। তার মানে মানুষটা একটু অন্যরকম।

ইভানা এখন খুঁজছে অর্পিতা সেনগুপ্তর প্রোফাইল। বাপের বাড়ির টাইটেল আর শ্বশুরবাড়ির টাইটেল এক সঙ্গে রেখেছেন কি নামের পিছনে? না, রাখেননি। এই তো অর্পিতা সেনগুপ্তর প্রোফাইল। কিন্তু কিছু দেখা যাবে না। লক করা আছে প্রোফাইল।

পিছনে দরজা খোলার আওয়াজ হল। রুম থেকে বেরিয়ে এল মা। বলল, আর কতক্ষণ এখানে বসবি! ঠান্ডা লেগে যাবে যে।

–বেড়াতে এসে শুধু ঘরেই বসে থাকব! বাইরেটা দেখো না, কী সুন্দর লাগছে! মনে হচ্ছে সব কিছু ভেসে আছে যেন, আমরাও।

মা কোনও উত্তর করল না। বারান্দার রেলিং ধরে তাকিয়ে আছে দূরে। বারান্দার শেডে ঝুলছে রঙিন এলইডি আলো। মায়ের মুখটাও রঙিন হয়ে গেছে। মাকে কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে! অনেকে বলে ইভানা নাকি মায়ের মতো দেখতে। ইভানা জানে হালকা একটা মিল আছে, কিন্তু মা তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর! তবে সুগতবাবুর যে ইভানাকে চেনা লাগছিল, তার কারণ কি মা? মায়ের সঙ্গে উনি মিল পেয়েছেন ইভানার? মা হয়তো ইভানার বয়সে এমনই দেখতে ছিল। আর এই বয়সেই সুগতবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মায়ের। মা তো নিজেই বলল সুগতবাবু জি এস ছিলেন মায়ের কলেজ লাইফে।

–এখানে তো সব কিছু দেখা হয়ে গেল। চল, কাল অন্য কোথাও যাই। বলে উঠল মা।

তারমানে পালাতে চাইছে। সুগতবাবুর জন্যই চলে যেতে চাইছে এখান থেকে। ইভানা বলে, কোথায় সব দেখা হল। এখানে তো একটা স্পটেই শুধু গেছি, ভিউ পয়েন্টে। তাও কাঞ্চনজঙ্ঘা ভাল ভাবে দেখা যায়নি। কাল ভোরে আবার যাব।

–ইভানার কথা শেষ হতেই হোমস্টের এক মহিলা বারান্দার মুখে এসে দাঁড়াল জিজ্ঞেস করল, আপ লোগ চায়ে পিয়েঙ্গে?

মা বলে ওঠে, খুব ভাল হয়। আমার লিকার চা। চিনি কম।

–দিদি, আপ ক্যায়সা চায়ে পিয়েঙ্গে? ইভানাকে জিজ্ঞেস করল মহিলা।

ইভানা বলল, ম্যায় নেহি পিউঙ্গা।

–আচ্ছা। বলে চলে গেল মহিলা। মা বলল, খেতে পারতিস। যা ঠান্ডা এখানে!

–না না, এখন চা খেলে রাতে খিদে থাকবে না। হিল স্টেশনে আবার বড্ড তাড়তাড়ি ডিনার সার্ভ করে দেয়।

–সেটা ঠিক বলেছিস। কিন্তু আমার মাথাটা এমন ধরেছে, চা না খেলেই নয়। হোমস্টেটাও বেশ ভাল। এই সময় তো ওদের চা দেওয়ার কথা নয়। তবু কেমন জিজ্ঞেস করে গেল!

–এরা যখন এত ভাল সার্ভিস দিচ্ছে, তুমি কাল চলে যেতে চাইছ কেন?

মা চুপ করে থাকে। একটু পরে বলে, তোর বাবাকে খুব মিস করছি। চটকপুরের নামটা প্রথম ওর মুখেই শুনেছিলাম। তুই তখন খুব ছোট। একদিন অফিস থেকে এসে বলল, দার্জিলিঙের কাছে চটকপুর বলে একটা দারুণ হিল স্টেশন আছে। অফিসের শোভন ওখানে হনিমুনে গিয়েছিল। জায়গাটার যা ডেসক্রিপশন দিল না, ভাবতে পারবে না। তবে রাস্তা খুব খারাপ। মেয়েটা একটু বড় হোক, তারপর আমরা যাব। মেয়ে হয়তো অত ধকল নিতে পারবে না।

থামল মা। ফের বলে, তখন গাড়িতে একটু লং জার্নি হলেই বমি করতিস তুই।

আবারও থেমে গেল মা। ইভানার পাশে একটা চেয়ার ফাঁকা আছে। ইভানা মাকে বলে, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! বসো না চেয়ারে।

মা এসে চেয়ারে বসে। ফের বলতে থাকে, আর চটকপুরের কথা ওঠেনি। তুই বড় হতে থাকলি। তোর বাবার প্রমোশন হল কোম্পানিতে। ব্যস্ততা বাড়তে থাকল। খুব বেশি জায়গায় বেড়াতে যেতে পারিনি আমরা। তোর বাবা বলত রিটায়ারেমন্টটা হতে দাও, তারপর শুধু বেড়াব। বাড়িতে থাকব কম।… সেই চটকপুর এলাম আমরা। ওকে আনতে পারলাম না।

মা আবার চুপ। এতক্ষণ যা বলল মা, তাতে একটা কষ্ট জমাট বাঁধল ইভানার গলায়। চোখ দু’টোও জ্বালা জ্বালা করছে। আবার একই সঙ্গে মনে হচ্ছে মা কথাগুলো মন থেকে বলছে না। একটা পরিকল্পনা থেকে বলছে। বুঝতে পেরেছে অতীত এসে পড়েছে কাছে। মেয়ে সুগত সেনগুপ্তর ব্যাপারে অনেক কিছুই জেনে যাবে। তাই বাবার প্রতি মা কতটা লয়াল ছিল, সেটাই ইভানার সামনে প্রমাণ করতে চাইছে।

ট্রে-তে করে এক কাপ চা নিয়ে এল হোমস্টের ছেলে। ট্রে-টা মায়ের সামনে ধরল। মা তুলে নিল কাপ-ডিস। ছেলেটা চলে যাচ্ছিল, ইভানা ডাকে, এই ভাই, একটু দাঁড়াও।

ছেলেটি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, বলিয়ে?

–এখানে দেখার কী কী আছে গো?

–বহুত কুছ হ্যায়। আজ লোক তো ওয়াচ টাওয়ার মে গেয়ি থি। উসকে বাদ হ্যায় লোয়ার চটকপুর। উঁহা সরকারি গেস্ট হাউস হ্যায়। বৈঠনেকা জাগা হ্যায়, বঢিয়া দুকান হ্যায়। উসকে বাদ আপ কালা পোখরি যা সকতে হ্যায়। উহ জঙ্গল কা ভিতর। সাত মে গাইড লেনা পড়ে গা। কালা পোখরি হো কর লাভার্স পয়েন্ট ভি যা সকতে হ্যায়। লেকিন আজ কাল ট্যুরিস্ট লোক কম যাতে হ্যায়।

–কিঁউ কম যাতা হ্যায়? জানতে চায় ইভানা।

ছেলেটি বলে, পহেলে উঁহা রক ক্লাইম্বিং কা ট্রেনিং হোতা থা। আভি বন্ধ হো গ্যায়া। খালি পিক হ্যায়। কই কই যাতা হ্যায়। অউর একঠো ট্রেক রুট ভি হ্যায় ইঁহা। দার্জিলিং কা টাইগার হিল তক।

–থ্যাঙ্ক ইউ, ভাইয়া। হাসি মুখে ছেলেটিকে বিদায় জানায় ইভানা।

ছেলেটি চলে যায়। ইভানা এবার মাকে বলে, দেখলে, কত জায়গায় যাওয়ার আছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে মা বলল, তা বলে তুই ট্রেক করবি নাকি? আমি তো বাবা পারবই না।

–এখনই কেন ডিসিশন নিতে যাচ্ছো? লোকাল কোনও গাইডের সঙ্গে কথা বলি আগে।

–আমার বাবা, অতো হাঁটা পোষাবে না। তার চেয়ে চল, এমন কোথাও যাই যেখানে অত হাঁটাহাঁটির ব্যাপার নেই। হোমস্টেতে বসেই প্রকৃতিকে এনজয় করা যাবে।

–সে তো তুমি এখানেও বসে করতে পারো। কোথাও যেয়ো না।

–কিন্তু তুই যে আমায় একা ফেলে চলে যাবি।

মায়ের একথার কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না ইভানা। এমন সময় রুমে ফোন বেজে ওঠে। মায়ের ফোন। চায়ের কাপ-ডিস ফ্লোরে নামিয়ে রেখে মা চলে গেল ফোন ধরতে।

না, এবার বেশ শীত করছে ইভানার। গায়ে জ্যাকেট আছে, তা সত্ত্বেও। ইচ্ছে করলে রুমে যাওয়াই যায়। তবে থাক, মা ফোনে কথাটা সেরে নিক!

হোমস্টের আশপাশ থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে। জঙ্গলের ভিতর গেলে এই ডাক দিনের বেলাতেও শোনা যায়।

প্রথম যেবার মা-বাবার সঙ্গে দার্জিলিং এসেছিল ইভানা, ম্যালের পিছন দিকে জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল এই ডাক। এর থেকেও জোরে। ইভানা বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এটা কীসের আওয়াজ বাবা? কীরকম যেন ঘণ্টা বাজছে মনে হচ্ছে।

বাবা বলেছিল, হ্যাঁ, ঘণ্টাই তো। এই জঙ্গলের ভিতরে, মানে অনেক ভিতরে একটা মন্দির আছে। সেই মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ এটা।

–আমরা ওই মন্দিরটায় যাবো না বাবা? জানতে চেয়েছিল ইভানা।

বাবা বলেছিল, না মা, ঘন জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরের ওই রাস্তা ভীষণ বিপদসংকুল। ভয়ানক সব জন্তু-জানোয়ার থাকে। খুব সাহসী যারা হয়, তারাই একমাত্র যায়।

ইভানা বড় হয়ে জেনেছে ওগুলো এক ধরনের পোকা। গ্রামের ঝিঁঝিঁ পোকার মতো। তবে জঙ্গলের পোকাগুলো বেশ বড়। গলার জোরও অনেক বেশি। এটা জানার পরও ইভানার বাবার কথাটাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হত। জঙ্গলের অনেক গভীরে একটা মন্দির যেখান থেকে ভেসে আসছে একটানা ঘণ্টা ধ্বনি। কখনও আবার থেমেও যাচ্ছে।

সিঞ্চল ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে গাড়ি করে যখন চটকপুর আসছিল ইভানারা, তখন এই পোকার আওয়াজ তীব্র ভাবে শোনা যাচ্ছিল। কেন জানি ইভানার মনে হচ্ছিল। এই জঙ্গলের গভীরেও একটা মন্দির আছে। বাবা চলে গেছে সেই মন্দিরে। বাবা আমাদের কাছেই আছে। আসলে বাবা চলে যাওয়াটা এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি ইভানা।

ভারী প্রাণবন্ত মানুষ ছিল বাবা। সব সময় হইচই। জোরে জোরে কথা বলা। জমিয়ে রাখত পরিবেশ। প্রচণ্ড কাজ পাগল ছিল। অফিসের কাজে ডুবে থাকত। ইসিএল-এ ম্যানেজেরিয়াল পোস্টে চাকরি করত। তবে অফিসের কাজে যতই ব্যস্ত থাকুক, মাঝে মাঝেই ফোন করত ইভানাকে। ‘তুই এখন কোথায়? কী করছিস?’ মায়েরও খবর নিত। সংসার অন্তপ্রাণ ছিল বাবা।

পাড়াতেও খুব পপুলার ছিল। ইভানাদের গোপালভাঙা এলাকায় যে কোনও অনুষ্ঠানে মোটা টাকা চাঁদা দিত বাবা। ছুটিছাটায় পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। মা ইভানাকে পাঠাত বাবাকে ডেকে আনতে। মানুষটা শরীর খারাপ হয়ে শুয়ে আছে, বড় রোগটার আগে কখনও দেখেনি ইভানা। মাস আটেক আগে বার বার জ্বরে পড়ছিল, তার সঙ্গে কাশি, বুকে জমে ছিল সর্দি। লোকাল ডাক্তার দেখানো হচ্ছিল। অফিস যাওয়া বন্ধ হল। দ্রুত শরীর ভাঙতে শুরু করল। কাশির সঙ্গে মাঝে মাঝে রক্ত উঠে আসছিল। মা বাবাকে নিয়ে কোন্নগরে গেল। সেখানে থেকে কলকাতার বড় ডাক্তার দেখানো হল। উনি পেশেন্ট দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন কী হয়েছে! কয়েকটা পরীক্ষা করালেন নামী হসপিটালে রেখে। রিপোর্ট এল লাং ক্যানসার। বাবাকে ভর্তি করা হল কলকাতা টাটা ক্যানসার হসপিটালে। সেই প্রথম বাবার মুখে গাঢ় বিষাদ দেখেছিল ইভানা। মা, ইভানা ছিল লড়াইয়ের মুডে। যে করে হোক বাবাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। ইভানা বাবাকে বোঝাত, বাবা ক্যানসার আর আগের মতো মারাত্মক অসুখ নয়। প্রচুর ওষুধ বেরিয়ে গেছে। তুমি মনের জোর রাখো। সব আগের মতো হয়ে যাবে।

বাবা বলত, হবে না মা। আমি বুঝতে পারছি আমার জীবনী শক্তি ফুরিয়ে আসছে। আমাকে চলে যেতে হবে। তোদের ছেড়ে চলে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে মা।

মনের জোর রেখে ইভানা যতটা পারত বাবাকে সান্ত্বনা দিত। মা এই কাজটা পারত না। বেশিক্ষণ থাকতে পারত না বাবার বেডের কাছে। বেরিয়ে এসে কাঁদত, একা একা।

মারা যাওয়ার দু’দিন আগে বাবা হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা বলল! বলেছিল, আমি মরে গেলে মায়ের উপর ভাল করে নজর রাখিস। ওর কিন্তু বাড়ি থেকে পালানোর একটা ঝোঁক আছে।

কথাটার তখন মানে বোঝেনি ইভানা। মা তো সংসার নিয়েই মত্ত থাকে। পালানোর কোনও লক্ষণ কখনও দেখা যায়নি। বাবার কথাটা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা পেশেন্টের প্রলাপ ভেবেছিল ইভানা। কিন্তু এখন কেন জানি মনে হচ্ছে বাবার ওই কথার মধ্যে সারবত্তা ছিল। মা কোথায় পালিয়ে যেতে পারে, আশংকা করছিল বাবা? সুগতবাবুর কাছে কি? বাবা কি সুগত সেনগুপ্তর সঙ্গে মায়ের রিলেশনটা জানত। আদৌ কি বিশেষ কোনও রিলেশন ছিল? এখন অবধি তেমন কোনও প্রমাণ পায়নি ইভানা। আর একটা কথাও ভাবছে ইভানা, বাবা মারা যাওয়ার পর মা কেন পালিয়ে যাবে সুগতবাবুর কাছে? সুগতবাবু তো বিবাহিত। তা হলে কি বাবা সেই ভেবে কথাটা বলেনি? মায়ের কি সত্যিই বাড়ি থেকে পালানোর কোনও অতীত আছে? দাদুকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। দাদুর সঙ্গে ইভানার দারুণ রিলেশন। একেবারে বন্ধুর মতো।

–দিদি, ডিনার রেডি হ্যায়। বারান্দার মুখে এসে বলল, হোমস্টের মহিলা।

ইভানা মোবাইল দেখে নিয়ে বলে, ইতনা জলদি! সাড়ে আট ভি নেহি বাজা।

–কই বাত নেহি। হাম লোগ ক্যাসারোল মে খানা ভরকে টেবিল মে দেতা হু। আপ লোগ জব মন চাহে খা লেনা। কিচেন খুলা রহে গা। বলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মহিলা।

সারা রাত ইভানাদের কারণে কিচেন খোলাই রাখবে। চুরি টুরির ভয় এখানে নেই।




সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে চুপি সাড়ে। ভোর হতেই রাজার সাজ সেজে সূর্য উঠেছে আজ। কাঞ্চনজঙ্ঘাও দেখা যাচ্ছে পরিস্কার। তবু মেয়ের মুখে খুশি নেই। ইভানাকে নিয়ে দিতি চিন্তায় পড়ে গেছে। আজ সানরাইজ দেখার কোনও ইচ্ছেই ছিল না মেয়ের। ঘুমোচ্ছিল অঘোরে। সারা রাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হয়েছে দিতির। ভোর পাঁচটায় মেয়েকে ঠেলা দিল। কীরে, সানরাইজ দেখতে যাবি না?

মুখে আদুরে আওয়াজ করে পাশ ফিরে শুল মেয়ে। দিতি তখন রুমের দরজা খুলে বাইরে গিয়েছিল। কী প্রচণ্ড ঠান্ডা! আকাশে মেঘ নেই, তারা দেখা যাচ্ছে। দিতি বুঝে গিয়েছিল আজ দারুণ সানরাইজ হবে। দেখা যাবে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। রুমে ঢুকে এসে ফের মেয়েকে ঠেলা দিয়ে দিতি বলেছিল, ওরে ওই। আজ আকাশ একদম ক্লিয়ার। চল, ভিউ পয়েন্টে যাই।

তাই শুনে আড়মোড়া ভেঙে উঠল মেয়ে। প্রথমে বলল, বারান্দা থেকেই দেখি চলো। আবার অতদূর উঠতে ইচ্ছে করছে না।

দিতি বলেছিল, তুই না বলছিলি ট্রেক করবি! এখন এইটুকু উঠতেই কুড়েমি লাগছে! তা ছাড়া বারান্দা থেকে শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘাটাই দেখা যাবে। সানরাইজ দেখতে পাবি না। ওটা একমাত্র ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যাবে ভাল।

এরপর মেয়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়েছিল। কাল ইভানা বুদ্ধি করে হোমস্টের বাগান থেকে লাঠি দুটো রেখে দিয়েছিল। দু’জনে লাঠি নিয়ে ধরল শর্টকাট রাস্তা।

ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছানোর আগে সূর্য উঁকি দিয়েছে পূব আকাশে। কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ অন্যান্য বরফশৃঙ্গর গায়ে পড়েছে লাল ছিটে। বর্ণনাতীত এক সৌন্দর্য! অদ্ভুত অপার্থিব এক অনুভূতি। মুখ দিয়ে বিস্ময় প্রকাশও করে উঠতে পারছিল না দিতি। অনেক কষ্টে মেয়েকে বলে, এত সুন্দর সূর্যোদয় আমি আগে কখনও দেখিনি।

আশ্চর্য, মেয়ে কোনও উত্তর করল না! ওর মধ্যে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। মুখটা এখনও থমথমে। দিতি ভাবছে, একবার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ভয়ও হচ্ছে। যদি মেয়ে বলে, হ্যাঁ, রাগ করেছি। কেন তুমি আমায় সুগত সেনগুপ্তর সঙ্গে তোমার আলাপের ব্যাপারে কিছু বলছ না?

বলতে হয়তো হবেই। এমনই কপাল দিতির ঠিক এই সময়েই চটকপুরে আসতে হল সুগতদের। যদি না আসত, কোনওদিনই মেয়ের এই অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হত না দিতিকে। সুগত এখানে আসাতে আর একটা ক্ষতি হয়েছে দিতির, বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো সব কথা। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রথম দেখে সুগতকে। কোনও এক বান্ধবী আঙুল তুলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুগতকে দেখিয়ে বলেছিল, ওই দ্যাখ, আমাদের জি এস। দারুন দেখতে না? এত ভাল স্পিচ দেয়, একেবারে মুগ্ধ হয়ে যাবি।

দিতি বলেছিল, তুই কী করে শুনলি স্পিচ? এই তো ভর্তি হলি কলেজে।

পর্ণা বলেছিল, আমি কলেজে এসে শুনে গেছি ওর স্পিচ। ওকে দেখারও ইচ্ছে ছিল। আমার পাড়ার এক দিদি ওর সম্বন্ধে বলেছে। মেয়েরা নাকি ওদের জি এসকে চোখে হারায়।

দূর থেকে সুগতকে তেমন কিছু দেখতে লাগেনি দিতির। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঝাঁকড়া চুল মাথায়। পরনে জিনস আর পাঞ্জাবি। আর পাঁচটা কমিউনিস্ট পার্টি করা ছেলেদের মতো দেখতে। ওর বক্তৃতা শোনার তখনও সুযোগ হয়নি। ফ্রেশার্স ওয়েলকামে গান গাওয়ার কথা ছিল দিতির। হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা গান গেয়েছিল। হাততালি, উৎসাহ প্রদান হল খুব। স্টেজ থেকে নেমে এসে বন্ধুদের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল দিতি। ওরা জড়িয়ে টড়িয়ে ধরে বলছিল, কী সুন্দর গলারে তোর! কী অপূর্ব গাইলি! এমন সময় খানিক দূরে এসে দাঁড়াল সুগত। তখন সুগতদা। বাংলার ফাইনাল ইয়ার। হাতের ইশারায় কাছে ডাকছিল দিতিকে। বন্ধুরা বলল, যা কী বলছে শুনে আয়। আমাদের জি এস বলে কথা!

ধীর পায়ে সুগতর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল দিতি। সুগত বলল, কার কাছে গান শিখিস?

দিতি বলেছিল, একা কারুর কাছে নয়। শ্যামবাজারে গীতবিতানে যাই গান শিখতে।

সুগত বলল, খুব ভাল করিস। কোনও একজন বড় শিল্পীর কাছে গান শিখবি না। তোর উপর তাঁর এমন প্রভাব পড়বে, তার থেকে বেরনো কঠিন হয়ে যাবে। কোনও স্বকীয়তা তৈরি হবে না। যেটা এখন তোর আছে। স্বকীয়তা ছাড়া কখনওই নিজের পরিচয় তৈরি হবে না।

কথাগুলো পুরোপুরি না বুঝেই মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল দিতি। তারপর সুগত বলেছিল, যা, ভাল করে রেওয়াজ চালা। তোকে আমি অনেক প্রোগ্রাম দেব।

দিতি ফিরে এসেছিল বন্ধুদের মধ্যে। তারা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কী বলল রে?

দিতি বলল, কিছু না। গানের প্রশংসা করল।

কোনও এক বন্ধু বলেছিল, এতক্ষণ ধরে প্রশংসা! ধুর, তুই আমাদের গুল মারছিস।

দিতি উদাস মুখ করে রইল। দু’চার দিনের পরেই ক্লাস শুরু হল কলেজে। শুরুতেই ছোট একটা স্পিচ দিল সুগত। ওদের ইউনিয়নে যোগ দিতে বলল। কেন যোগ দিতে হবে বলল সুন্দর করে গুছিয়ে। স্পিচটা সত্যিই ভাল দেয় সুগত। ক্লাস পুরোদমে চালু হয়ে গেল কলেজে। সুগত প্রচুর ব্যস্ত হঠাৎ কখনও দিতির সঙ্গে চোখাচোখি হলে হাত তুলে মিষ্টি করে হাসে। কোনও প্রোগ্রামের কথা বলে না।

দিতি ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎ একদিন বাড়িতে এসে হাজির সুগত। দরজা খুলে দিতি তো অবাক। সেদিন ছিল রবিবার। সুগত বলল, আজ নিশ্চয়ই তোর বাবা বাড়ি আছে। ওঁকে একবার ডাক। কথা আছে।

দিতি তো কিছুই বুঝতে পারছে না। সুগত সোজা ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ল। দিতি গেল বাবাকে ডাকতে। কলেজের জি এস এসেছে শুনে হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িংরুমে এল বাবা। সুগতকে বলল, হ্যাঁ ভাই, বলো কী ব্যাপার?

সুগত বলেছিল, সেরকম কিছু না। আপনি বসুন আমি বলছি,

বাবা সোফায় বসার পর সুগত বলল, দিতি তো বেশ ভাল গান গায়। আমার চেনা একটা গ্রুপের অনুষ্ঠান আছে কলামন্দিরে। আমি চাই দিতি সেখানে সোলো পারফরমেন্স করুক। এবার শুধু আপনার অনুমতির প্রতীক্ষা।

বাবা এক কথায় রাজি হয়ে গেল। শুধু বলেছিল, এরপর থেকে আমার অনুমতি আর নিতে হবে না। আমিও চাই মেয়ে স্টেজ পারফর্ম করুক। শুধু কলকাতায় যদি কোনও প্রোগ্রাম থাকে, তা হলে কেউ যেন ওকে দেওয়া নেওয়া করে। ও তো কলকাতা ভাল চেনে না।

সেই শুরু। দেওয়া নেওয়াটা করত সুগত নিজে। দিতি শুধু বাবাকে ইনফর্মেশনটা দিয়ে রাখত। মা তো চলে গেছে অনেক আগেই। দিতির তখন ক্লাস নাইন। দাদা ক্লাস টুয়েলভ। বাড়িতে দূর সম্পর্কের এক পিসি, সেই মিঠু পিসির জিম্মায় ছিল ঘর গৃহস্থালির ভার।

মাঝ মাঝেই প্রোগ্রাম নিয়ে আসছিল সুগত। কিছু কলকাতার, বেশির ভাগটাই কোন্নগরের আশপাশের অঞ্চলের। কয়েকটা গানের দলে রিহার্সাল দিতে যেতে হত। সঙ্গে সব সময় থাকত সুগত। মফস্‌সলের গাছপালায় মোড়া আলো-আঁধারি রাস্তায় সুগতর সঙ্গে যাতায়াত করতে করতে কবে থেকে যেন সম্পর্কটা প্রেমে পরিণত হল। কেউ কিন্তু কাউকে ভালবাসি বলেনি। এদিকে কলেজ থাকলে সুগত এমন ভাব করত, যেন দিতি আর পাঁচটা স্টুডেন্টের মতো, তার ইউনিয়নের একজন কমরেড।

দিতি একদিন জিজ্ঞেস করেছিল। কলেজে তুমি আমার সঙ্গে এমন পর পর ভাব করো কেন?

সুগত বলে, স্টুডেন্টরা আমাদের ব্যাপারটা জানতে পারলে আমার ওজনটা কমে যাবে ওদের কাছে। আমাকে মানবে কম।

দিতি তখন বলেছিল, নাকি তুমি ফ্রি, সিঙ্গল এই ম্যাসেজটাই দিতে চাইছ কলেজের ছাত্রীদের? লাভ হবে না কোনও। প্রায় সবাই জানে তোমার আমার সম্পর্ক।

সুগত বলেছিল, হ্যাঁ, সেটা আমিও বুঝতে পারি। কিন্তু কী ভাবে জানল বলো তো?

–কী ভাবে আবার। তোমার প্রতি যাদের নজর, যারা তোমাকে পেতে চায়, তোমার সমস্ত গতিবিধির খবর রাখে তারা। তাই কলেজে আমাকে পাত্তা না দেওয়ার অভিনয়টা একেবারেই অচল। স্টুডেন্টরা আড়ালে হাসে। হাসতে হাসতে বলেছিল দিতি।

সে যাই হোক, এক সময় কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে চলে গেল সুগত। অন্যান্য জিএসদের মতো নিজের পদ রাখার জন্য কলেজে অন্য স্ট্রিমে ভর্তি হয়নি। সময় সুযোগ পেলে আসত কলেজ ইউনিয়নের জুনিয়ারদের উদ্বুদ্ধ করত। তবে আগের মতো আর পার্টিতে অ্যাকটিভ ছিল না। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সুগত নাটক দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। অভিনয় করত সুগত। ওর প্রথম অভিনয় দেখে অবাক হয়েছিল দিতি। অদ্ভুত সুন্দর দেখতে লাগছিল ওকে! কী পার্সোনালিটি! দেখতে সুন্দরটা না বলে, দিতি সুগতকে শুধু বলেছিল, তুমি অ্যাতো ভাল অভিনয় করো। কোনওদিন তো বলোনি আমায়!

–মুখে বললে তুমি যদি বিশ্বাস না করো, তাই করে দেখালাম। দুষ্টুমির হাসি হেসে বলেছিল সুগত। পরে দিতি সুগতর থেকে জেনেছিল অভিনয়টাও ছোট থেকেই করত, পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সুগতর বাবা চাকরি করলেও, মাঝে মাঝে শখের যাত্রা করতেন। সুগত বহুবার সে সব যাত্রায় শিশুচরিত্র করেছে। নাটকের একটা চর্চা ছিল ওদের বাড়িতে।

সুগত একটা সময় নাটকের দলে টেনে নিল দিতিকে। না, অভিনয়ের জন্য নয়। গানের কারণে। অভিনয় একেবারেই পারত না দিতি। সুগত ট্রাই করেছিল। দিতিকে দিয়ে রিহার্সাল করাত। দিতি ডাহা ফেল। দিতির জন্যই গান থাকা নাটক বাছল সুগতরা। গানের জন্যই সেই নাটক অন্য মাত্রা পেল। তারপর থেকে ওদের দল গান থাকা নাটকই নির্বাচন করতে থাকল। সুগতর পাল্লায় পড়ে গণসংগীতের দলে ভিড়ল দিতি। একদিন বাড়িতে একটা গণসংগীত রিহার্স করছিল, বাবা ঘরে এসে উপস্থিত। বলল, এ সব কী গাইছিস তুই! রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে গায়কিটা তৈরি হয়েছে তোর গলায়, সব নষ্ট হয়ে যাবে।

দিতি বলেছিল, গানকে এভাবে আলাদা করো না বাবা। সব গানের একটাই মূল কথা, সুর। ওই সাতটা স্বর।

–এসব তোকে সুগত শিখিয়েছে, তাই না? দাঁড়া একদিন ওকে কড়কে দিতে হবে। বলেছিল বাবা। তারপর থেকে বাবা বাড়িতে থাকলে গণসংগীত গাইত না দিতি। বাবাও সুগতকে কড়কাতে পারেনি। বাবার মতামতটা সুগতকে জানিয়েছিল দিতি। সুগত যাওবা বাড়িতে কচিৎ কদাচিত আসত, বাবার ভয়ে তাও বন্ধ করে দিল।

দাদা একদিন দিতিকে জিজ্ঞেস করেছিল, হ্যাঁ রে, তুই যে ছেলেটার সঙ্গে ঘুরিস, তাকে ভালবাসিস? বিয়ে করবি ছেলেটাকে?

সতর্ক হয়েছিল দিতি। সুগত চাকরি বাকরি কিছু করে না। এখনই ওকে বিয়ে করব বললে বাড়ির লোক জোগাড় যন্ত্র শুরু করে দেবে। তাই দিতি বলেছিল, ভালবাসি কিনা বলতে পারছি না। তবে পছন্দ করি।

দাদা তখন বলল, কিন্তু তোরা যেভাবে ঘোরাঘুরি করিস, লোকে তোদের সম্বন্ধে যা ভাবে এবং ভাবাটাই স্বাভাবিক। তাতে পরে অন্য কারও সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে আমাদের সমস্যায় পড়তে হবে। তাই বলছি ওর সঙ্গে মেলামেশাটা কমা।

দাদা কম কথার মানুষ। খুব প্রয়োজন ছাড়া এত সিরিয়াস কমেন্ট করে না। ও নিজের লেখাপড়া নিয়ে থাকে। তখন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দাদার সঙ্গে কথাবার্তাগুলো সুগতকে বলেছিল দিতি। তার সঙ্গে এটাও জানালো, তোমাকে যে ভালবাসি, একথা বলতে পারলাম না, যেহেতু তুমি চাকরি বাকরি কিছু করো না। ভালবাসি বললেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিত বাড়িতে।

সুগত বলেছিল, চাকরি একদিন না একদিন করতেই হবে। যতদিন পারা যায় এই স্বাধীন জীবনটা কাটানো যাক। তুমি বাড়িকে ঠেকিয়ে রাখো। তোমার বাবা তো বিয়ে নিয়ে কোনও তাড়া দিচ্ছেন না। এত চিন্তা করছ কেন?

কথাটার মধ্যে অনিশ্চয়তার গন্ধ পেয়েছিল দিতি। তা হলে কি সুগত তাদের সম্পর্কটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না? ও স্বাধীন জীবন যাপন করতে চায়? ভার নিতে চায় না দিতির? তাই যদি হয় দিতিকে এ সব গান নাটকের দলে টানল কেন? বলতে পারত আমি কোনওদিন চাকরি করব না। বিয়ে করতে হলে তুমি চাকরি খোঁজো। সংসারের দায়িত্ব তুমি নাও।… এই প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে যেত দিতি। কারণ, ততদিনে তার জীবনে সুগত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সুগতকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না।

দিতির মাথায় আর একটা সন্দেহের উদ্রেক হল। সুগত কোনওদিন দিতির শরীর পাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। চুমুটুমু যা খাওয়া হয়েছে দিতির উদ্যোগে। দিতি বেশি ঘনিষ্ট হতে গেলেই সুগত বলত, এ সব বিয়ে অবধি তোলা থাক। নয়তো বাসি হয়ে যাবে। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই বিস্বাদ লাগবে সব কিছু।

এই কথাগুলো কি দিতির শারীরিক পবিত্রতা বজায় রাখতেই বলত সুগত? আসলে সুগতর কোনও ইচ্ছেই নেই দিতিকে বিয়ে করার। সে ক্ষেত্রে দিতিও জোর দিয়ে বলতে পারবে না, তোমাকে বিয়ে করতেই হবে। তুমি আমাকে নষ্ট করেছ।

কিন্তু কেন সুগত দিতিকে দূরে রাখতে চাইছে? ও তো অন্য কাউকে ভালবাসে না। তা হলে কি কমিটমেন্টে ভয় পায়? দিতি জানে কিছু মানুষ এরকম চরিত্রের হয়। এমনটা ধরে নিয়ে বিয়ের জন্য সুগতকে আর চাপ দিত না দিতি।

কিন্তু মেঘহীন বজ্রপাতের মতো বাবা একদিন অফিস থেকে এসে দিতিকে বলল, সামনের রবিবার বিকেলে তোকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। রেডি থাকিস।

দিতি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বাবার দিকে। তারপর বলেছিল, তুমি আমার জন্য পাত্র দেখছ, অথচ আমায় কিছু জানাওনি!

–এতে জানানোর কী আছে! মেয়ে বিবাহযোগ্যা হয়েছে, বাবাকে তো পাত্র দেখতেই হবে। আর কিছুদিন পরেই আমার রিটায়ারমেন্ট। তার আগেই এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সেরে ফেলতে চাইছি। বলল বাবা।

দিতি দেখল বাবাকে আটকাতে গেলে সত্যি কথাটা এখনই বলে দিতে হবে। তাই দিতি বাবাকে সরাসরি বলেছিল, আমি একজনকে ভালবাসি বাবা।

–ও, তাই নাকি। এ কথা তো তুমিও আমাকে জানাওনি। তা হলে আমি পাত্রপক্ষকে আসতে বলতাম না। তা ছেলেটি কে? জানতে চেয়েছিল বাবা।

দিতি সুগতর নাম বলেছিল। বাবা বলল, সে তো চাকরি বাকরি কিছু করে না। খালি পার্টি আর নাটক করে। বিয়ে করলে তোমাকে খাওয়াবে কী?

দিতির উত্তর ছিল, এখন চাকরি করে না, পরে করবে। তখন আমরা বিয়ে করব।

–ঠিক আছে। আমার কোন আপত্তি নেই। আটমাস পরেই আমার রিটায়ারমেন্ট। এর মধ্যে সুগত একটা ভদ্রস্থ চাকরি পেয়ে দেখাক। আমি দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের বিয়ে দেব।

বাবার এই কথার পর চুপ করেছিল দিতি। খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলেছিল, আটমাসই কেন? আর তো সময় দেওয়া যায়। আমার এমন কিছু বয়স হয়নি।

–আমার হয়েছে। আমি যে কোনওদিন চলে যেতে পারি। তারপর উপরে গিয়ে তোমার মাকে কী বলব? মেয়ের বিয়ে দিয়ে আসতে পারেনি। বলেছিল বাবা।

এই সব সেন্টিমেন্টাল কথার সামনে কীইবা বলা যায়! পরের দিন সুগতর বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল দিতি। সেই প্রথমবার ওর বাড়িতে যাওয়া। সুগতর মুখেই শুনেছিল ওদের একান্তবর্তী পরিবার। সেটা যে কত ঘোরপ্যাঁচের গিয়ে বুঝেছিল দিতি। প্রায় পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করে দোতলা বাড়ির ছাদের ঘরে সুগতকে পেয়েছিল। ওই পাঁচজনের চারজন নিশ্চিত করে বলতে পারেনি সুগত বাড়িতে আছে কি নেই। শেষ জন বলেছিল, একবার ছাদের ঘরে গিয়ে দেখো পাও কিনা।

সুগত ঘরে পড়াশোনা করছিল। দিতিকে দেখে তো অবাক। বলেছিল, কী ব্যাপার! সোজা বাড়ি চলে এলে? ফোন করতে পারতে তো।

তখন ল্যান্ডফোনের যুগ। দিতি বলেছিল, তোমাকে ফোন করলে অনেক সময় পাওয়া যায় না। তোমাকে ডেকে দিচ্ছে বলে ডাকতে ভুলে যায় এ বাড়ির লোক। যেটা বলতে এসেছি সেটা খুব আর্জেন্ট। ফোনের উপর ডিপেন্ড করতে পারলাম না।

সুগত জানতে চাইল কী বলতে এসেছে দিতি। বাবা যা যা বলেছে, সবই সুগতকে বলল দিতি। শেষে বলল, তুমি বাবার সঙ্গে গিয়ে কথা বলো, নয়তো সামনের রবিবার আমাকে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হবে।

সুগত বলেছিল, তোমার বাবাকে গিয়ে কী বলব আমি? আট মাসের মধ্যে ভদ্রস্থ একটা চাকরি পেয়ে তোমাকে বিয়ে করব? চাকরির যা বাজার, এটা কি সম্ভব? তার চেয়ে আপাতত তুমি পাত্রপক্ষর সামনে বসে পড়ো। পরে বলে দিও পাত্র তোমার পছন্দ নয়। তোমাকে তো আর ধরে বেঁধে বিয়ে দিতে পারবে না কেউ। ততদিনে আমি চেষ্টা করছি একটা চাকরির।

সুগতর কথায় যুক্তি ছিল। তাই সামনের রবিবার পাত্রপক্ষর সামনে বসার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিল দিতি। পরে পাত্রকে নাকচ করে দেবে।

রবিবার পাত্রপক্ষ এল না। বাবা সকাল থেকে একবারও বলেনি ওরা আসবে না। সন্ধেবলা দিতিকে বলল, কই রে, সুগত একবারও এল না আমার সঙ্গে কথা বলতে। আমি ভেবেছিলাম তোর অন্যত্র বিয়ে আটকাতে সে আমার কাছে আসবে।তাই তো আমি পাত্রপক্ষকে আজ আসতে বারণ করে দিলাম। তুই সুগতকে বলেছিস তো তোর জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে?

ঘাড় কাত করে ‘হ্যাঁ’ বুঝিয়ে ছিল দিতি। তার সিক্সথ সেন্স বলেছিল বাবা আসলে কোনও পাত্রপক্ষর সঙ্গে কথা বলেনি। দিতির উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য পাত্রপক্ষ আসার কথা বলেছিল। বাবা সুগতর সব খবরই নিয়েছে। জেনেছে চাকরি করে না, নাটক-পলিটিক্স করে বেড়ায়। তাই দিতিকে দিয়ে সুগতকে সতর্কবাণী শুনিয়েছে।

তাতে অবশ্য সুগতর কোনও বিকার নেই। ওকে চাকরি খুঁজতে দেখা যাচ্ছিল না। আগের মতোই নাটক-পার্টি নিয়ে মেতে থাকছিল।

দিতি একদিন মিথ্যে বলল সুগতকে। বলেছিল, বাবা যে আটমাস সময় দিয়েছিল, তার চার মাস কেটে গেল। তুমি এদিকে চাকর বাকরির কোনও চেষ্টাই করছ না। আমাকে কিন্তু আট মাস বাদে বাবার পছন্দ পাত্রকে বিয়ে করতে হবে।

সুগত বলল, চাকরির চেষ্টা করছি। তবে আগামী চার মাসের মধ্যে হবে কিনা গ্যারান্টি দিতে পারছি না। তার চেয়ে এক কাজ করা যাক বিয়েটা আমরা আগে সেরে ফেলি।

দিতি তো অবাক। বলেছিল, বেকার অবস্থায় বিয়ে! তুমি দু’জনের খরচ জোগাবে কোথা থেকে?

সুগত তখন বলে, দু’জনের নয়, একজনের। আমাদের বাড়িতে রোজ চল্লিশটা পাত পড়ে। তুমি গেলে একচল্লিশটা হবে। কিছু বোঝাই যাবে না। তবু তোমার হাত খরচ আছে। সে না হয় আমি টিউশানি করে তুলে ফেলব।

দিতি বলেছিল, টিউশানি তো আমিও করতে পারি। গানের টিউশানি। তুমি আমায় স্টুডেন্ট খুঁজে দিও।

–খুব ভাল কথা। দেব জোগাড় করে। বলেছিল সুগত।

তারপরই দিতির মাথায় এসেছিল আর একটা সমস্যার কথা। সুগতর কাছে জানতে চেয়েছিল, বিয়ের খরচ কে দেবে?

–বিয়ের আর কত খরচ হবে! আপাতত আমার বাবা দিয়ে দেবে। তোমার বাড়িতে তো আমাকে মানবে না। তুমি আমাদের বাড়ি চলে আসবে। ম্যারেজ রেজিস্টার ডেকে আমাদের বাড়িতে বিয়ে করে নেব। তুমি তো জানোই মন্ত্রটন্ত্রতে আমার বিশ্বাস নেই। বিয়েতে লোকজন খাওয়াবো খুব কম। বাড়ির চল্লিশজন, আর কিছু আত্মীয় পরিজন। যাদের না বললেই। এই ধরো গোটা একশো জন মতো হবে। ওই টাকাটা বাবা দিয়ে দেবে। পরে তুমি আমি শোধ করে দেব।

পরিকল্পনাটা নিখুঁত। তবু মনটা খিচ খিচ করছিল দিতির। সুগত সেটা টের পেয়ে বলেছিল, কী হল পছন্দ হল না প্ল্যানটা?

দিতি তখন বলে বেনারসী পরব না? সারা বাড়ি আলো জ্বলবে না? আমি ছোট থেকে এসব কল্পনা করে বড় হয়েছি।

–সে সব হবে। তুমি বেনারসীও পড়বে। আমাদের এবাড়ি আলো দিয়ে সাজানোও হবে। এতে আমার কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সব চেয়ে আগে দু’জনের ব্লাড টেস্ট করাতে হবে। জানতে হবে আমরা থ্যালাসিমিয়া বা অন্য কোনও রোগের বাহক কি না? আমি চাই না আমাদের বিয়ের কারণে পৃথিবী কোনও অসুস্থ শিশু জন্ম নিক। বলেছিল সুগত।

বিয়ের আগে ব্লাড টেস্ট যে কতটা জরুরি, সেই সচেতনাটা সে সময় সমাজে এসে গেছে। যার ফলে একটা আশংকা ভর করেছিল দিতির মাথায়। তাই সে জানতে চেয়েছিল, যদি ব্লাড টেস্ট আমাদের অনুকূলে না যায়, তখন কী করব আমরা?

–বিয়ে করব না। বন্ধুর মতো থেকে যাব আজীবন। অবশ্য ডিসিশন তোমার। তুমি বাহক না হলে, তুমিই সিদ্ধান্ত নেবে কী করবে। আর আমি যদি বাহক না হই, তবু অন্য কাউকে বিয়ে করব না। তোমার বন্ধু হয়ে থেকে যেতে চাইব। বলল সুগত।

মাথাটা কেমন গুলিয়ে গিয়েছিল দিতির। তখন বয়সটা তো অল্প, ভুল-ঠিক কিছু বুঝতে পারছিল না। অগত্যা বুলবুলির শরণাপন্ন হল। বুলবুলিই ছিল দিতির সব চেয়ে কাছের বন্ধু। ওদের বাড়ি দিতিদের দুটো বাড়ি পরেই। দুই বন্ধু এক সঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছে। তবে কলেজ শেষ না করে সরকারি নার্সিং কোর্সে ঢুকে পড়েছিল বুলবুলি। বাড়িতে অভাব ছিল ওদের।

সব শুনে বুলবুলি বলল, সুগতদা প্রকৃত শিক্ষিত এবং বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ বলেই ব্লাড টেস্টের কথা বলেছে। ওটা অবশ্যই করে নেওয়া দরকার। ধরে নেওয়াই যায় খারাপ রিপোর্ট আসবে না। খুব খুব কম এরকম ঘটনা ঘটে। তবে মেসোমশাইকে না জানিয়ে বিয়েটা করা কতটা ঠিক হবে, বুঝতে পারছি না। ভীষণ কষ্ট পাবেন।

দিতি বলেছিল, বলতে গেলে বাবা রাজি হবে না বিয়েতে। বিয়ের পর আমি ঠিক বাবাকে ম্যানেজ করে ফেলতে পারব। মা-বাবারা আলটিমেটলি সন্তানের বিয়ে মেনেই নেয়। সে যতই অপছন্দ হোক তার পার্টনারকে।

রক্ত পরীক্ষা হল। কারুর দিক থেকে কোনও সমস্যা নেই। ঠিক হয়ে গেল বিয়ের দিন। ততদিনে কলেজ পাস করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে দিতি। ইউনিভার্সিটিতে বেরনোর নাম করে সকাল বাড়ি থেকে বেরোবে। আগের দিনই সুগতর সঙ্গে গিয়ে বেনারসী কিনেছে দিতি। সে শাড়ি সুগত বাড়ি নিয়ে গেছে। ব্যাগে বইপত্তর ঢোকানোর বদলে টুকটাক কাপড় জামা ঢোকাচ্ছিল দিতি। দূর থেকে ভেসে আসছিল সানাইয়ের সুর। সেদিন বিয়ের ডেট ছিল। সুগতর বাবা চেয়েছিলেন পুরোহিত বিয়ে না দিক, বিয়েটা যেন বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট দিনেই হয়। সুগত মেনে নিয়েছিল। তবে বাতাসে যে সানাইয়ে সুরটা ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেটা নিশ্চয়ই সুগতদের বাড়ির নয়। সুগতদের বাড়ি রেললাইনের ওপারে। নবগ্রামে। দিতি তখন ভাবছিল, সুগতকে বললে হত বিয়ের অনুষ্ঠানে মাইকে সানাই বাজাতে। সানাই ছাড়া বিয়ে বাড়ি ঠিক জমে না… এ সব ভাবনার মাঝেই দরজা বন্ধর আওয়াজ পায় দিতি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল, হ্যাঁ, দরজাটা বন্ধ। দৌড়ে গিয়ে দরজার পাশের জানলায় গিয়ে দাঁড়ায়, দেখে বাবা দরজায় তালা দিয়ে চলে যাচ্ছে। দিতি কাতর গলায় জানতে চেয়েছিল, বাবা! ও বাবা! দরজা বন্ধ করলে কেন?

কোনও উত্তর দেয়নি বাবা। ঘাড় ফিরিয়ে দিতিকে একবার দেখেওনি। দিতির বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, বাবা বিয়ের ব্যাপারটা জেনে গেছে। কিন্তু এরকম আচরণ করার মানুষ নয় বাবা। বিয়ের ব্যাপারটা যদি জেনে গিয়েও থাকে, বাবার চরিত্র অনুযায়ী মেয়েকে ডেকে খোলাখুলি আলোচনা করার কথা। এরকম ঘরবন্দি কেন করে রাখল, তখন তো বোঝেইনি। আজও জানে না।

যাই হোক, দরজাটা খুলে দেওয়ার জন্য অনেক চেঁচিয়েছিল দিতি। লাথি-ঘুসি মেরেছিল দরজায়। কেউ খুলে দেয় নি। দিতি কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ওই ঘরে ল্যান্ডফোন ছিল না। মোবাইল ফোন তো তখন আসেইনি। বিছানায় শুয়ে কাঁদতে থাকল দিতি। মনে তখন একটাই শেষ আশা। দিতি আসছে না দেখে সুগত এ বাড়ি চলে আসবে। দিতিকে নিয়ে যাবে বাবার সামনে দিয়ে। সে পার্টি করা ছেলে, তার তো বাবাকে ভয় পাওয়ার কথা নয়। মনে করলে সঙ্গে ইউনিয়নের পাঁচ-ছ’টা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসবে।

কিন্তু এল না সুগত। পরের দিন সকালে দরজা খুলে দিল বাবা। দিতি বাবাকে কিচ্ছু্টি বলেনি। অভিমানে গলা আটকে গিয়েছিল। আগের দিন বন্ধ ঘরের দরজা সামান্য খুলে সময় মতো খাবার দিয়েছিল মিঠু পিসি। সে সব কিছু খায়নি দিতি। পরের দিন সকালে শুধু চা খেতে ইচ্ছে করছিল। মিঠু পিসিকে বলতে, চা দিয়ে গিয়েছিল ডাইনিং টেবিলে। দিতি যখন চা-য়ে চুমুক দিচ্ছে, ফোন এল বাড়ির ল্যান্ড ফোনে। নিশ্চয়ই সুগতর ফোন। কালও বন্ধ ঘর থেকে শুনেছে বারংবার ফোনের আওয়াজ। সেই কল বাড়ির কেউ ধরছিল না। সকালে ধরল বাবা। ফোন কানে নিয়ে ও প্রান্তের কথা শুনে বলল, দিচ্ছি… তারপর দিতিকে বলল, তোর ফোন।

দিতি সিওর ছিল সুগত ফোন করেছে। ফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলার পর ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল নবারুনদার গলা। সুগতর খুব ক্লোজড ফ্রেন্ড নবারুনদা। অবাক গলায় জানতে চাইল, কী হল তোর? কাল এলি না কেন?

দিতি বলেছিল, বাবা যেতে দেয় নি।… বাবা দরজায় তালা মেরে দিয়েছিল ঘরে, সেটা লজ্জায় বলতে পারেনি দিতি। ওদিক থেকে নবারুনদা বলল, বাবা যেতে দেয়নি, আর তুই এলি না! এটা কি সিনেমা দেখার প্রোগ্রাম ছিল নাকি? তুই জোর করে চলে আসতে পারলি না।

দিতি কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সত্যি কথাটা একমাত্র সে সুগতকেই বলতে পারবে। তাই জিজ্ঞস করেছিল, সুগত কোথায় গো? ওকে একবার ফোন করতে বলো না।

নবারুনদা বলেছিল, সুগতর খবর দিতেই তো তোকে ফোন করলাম। সে সকালবেলা ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। কোথায় যাচ্ছে, কাউকে কিছু বলে যায়নি।

পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিল দিতির। বলে উঠেছিল, কেন চলে গেল?

–বোধহয় অপমানে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-পরিজন। ম্যারেজ রেজিস্টারও চলে এসেছে। এদিকে তোর দেখা নেই। সবাই নানা প্রশ্ন করছিল সুগতকে। তার মধ্যে কিছু খোঁচা মারা কথাও ছিল। সেগুলোই বোধহয় ও সহ্য করতে পারল না। পালিয়ে বাঁচতে চাইল। বলেছিল নবারুনদা।

মাথা ঝিমঝিম করছিল দিতির। কোনওক্রমে বলে, এবার আমি কী করব?

–তোর তেমন কিছু করার নেই। তুই তো আর ওকে খুঁজতে বেরোতে পারবি না। খুঁজব আমরাই। তোকে শুধু একটা কথাই বলার, ও যদি তোকে কখনও ফোন করে, কথায় কথায় জেনে নিবি সে আছে কোথায়? রাখছি। বলে ফোন কেটে দিয়েছিল নবারুনদা।

দিতি তখন পুরোপুরি অসহায়। সত্যিই তো সে সুগতকে খুঁজতে বেরিয়ে যেতে পারবে না। এখন শুধু ওর ফোনের অপেক্ষা।

বাবার সঙ্গে কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল দিতির। বাবাও যেচে কথা বলতে আসত না। বাড়ি আর ইউনিভার্সিটির মধ্যে নিজের জীবনটাকে বেঁধে নিল দিতি। গান প্রায় ছেড়েই দিল। কোনও ক্লাব খুব পেড়াপেড়ি করলে একটা দুটো অনুষ্ঠানে গেয়ে দিত। বাড়িতে রেওয়াজ করত না।

এই ভাবে কাটছিল দিন। মাসও কেটে গেল বেশ ক’টা। হঠাৎ বুলবুলি বাড়ি এসে খবর দিল, সুগত ফিরে এসেছে। আগামীকাল ওর বিয়ে।

আকাশ থেকে পড়ল দিতি। জানতে চেয়েছিল, কার সঙ্গে বিয়ে?

বুলবুলি বলেছিল, হিন্দমোটরে ডাক্তার মজুমদার আছে না, তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে। মেয়েটার নাম অর্পিতা। আমাদের কলেজেই পড়ত, সেম ইয়ার। সায়ন্স নিয়ে পড়ত।

খবরটা শোনার পর কানে-মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল দিতির। বলেছিল, তুই আমার সঙ্গে একটু যাবি?

—কোথায়? জানতে চেয়েছিল বুলবুলি।

দিতি বলেছিল, সুগতদের বাড়ি যাব। ও কে বলব কোন সাহসে তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করছ? তুমি আমি একসঙ্গে জীবন কাটাব এমনটাই তো কথা ছিল। তুমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বুলবুলি বোঝানোর স্বরে বলেছিল, প্রথমত সুগতর বাড়ির লোক তোকে সদর থেকেই তাড়িয়ে দেবে। তোর জন্য ওদের আগের বিয়ের আয়োজন পণ্ড হয়েছে। সম্মানহানিও হয়েছে। তুই কোন মুখে যাবি ওখানে? আর সুগতর সঙ্গে যদি বাইরেও দেখা হয়ে যায়, ও স্পষ্ট বলবে, বিয়ে তো তোমাকেই করতে চেয়েছিলাম। তুমি আসোনি সেদিন।

বলে থেমেছিল বুলবুলি। ফের বলে ওঠে, তা ছাড়া সুগত যখন তোকে ভুলে গিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করছে, তখন তার উপর আর জোর খাটিয়ে কী লাভ? জোর করে আর যা কিছুই করা যাক, ভালবাসা আদায় করা যায় না।

–কিন্তু আমি যে ওকে এখনও ওকে পাগলের মতো ভালবাসি। তার কী হবে? অসহায় কণ্ঠে জানতে চেয়েছিল দিতি।

বুলবুলি বলল, তোর ভালবাসাটা কুলুঙ্গিতে তুলে রাখ। মাঝে মাঝে ফুল-চন্দন দিবি। ধূপ-ধুনো দেখাবি। বহু মেয়ের জীবনেই কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা ভালবাসা থাকে। অন্য কারুর সঙ্গে বিয়ে করে দিব্যি ঘর-সংসার সামলায় তারা।

বুলবুলি খুবই প্র্যাকটিকাল মেয়ে। অভাবে মানুষ হয়েছে, সেদিন বুলবুলি ওই কথাগুলো না বললে দিতি নির্ঘাত চলে যেত সুগতদের বাড়ি।

সুগতর বিয়ের দিন নিজের ঘরে দরজা-জানলা বন্ধ করে কাটিয়ে দিল দিতি।

হপ্তা খানেক যেতে না যেতে বুলবুলি এসে খবর দিল সুগত বউ নিয়ে রাঁচি চলে যাচ্ছে। ওখানে কীসের একটা যেন চাকরি পেয়েছে। চাকরিটা করে দিয়েছে ওর শ্বশুরমশাই।

খবর শুনে শ্লেষের হাসি হেসেছিল দিতি। মনে মনে বলেছিল, চাকরি সেই করতেই হল তোমাকে!

এ সবের মধ্যেই বাবা কবে যেন রিটায়ার করে গেল! মাঝে একবারও দিতিকে বিয়ের কথা বলেনি। তখনই বলল, যখন সুগত বিয়ে করে চলে গেছে রাঁচিতে। আসলে বাবা সুগতর সব খবরই রাখত। অনেকদিন বাদে দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলল বাবা। বলেছিল, একটা ভাল পাত্র সন্ধানে আছে। ই সি এল-এ চাকরি করে। আসানসোলে থাকে। মা-বাবা, ভাই-বোন থাকে শ্যামবাজারে। ওদের পৈতৃক বাড়িতে। বিয়ের পর ছেলে বউকে নিয়ে থাকবে আসানসোলে। নিজের মতো করে গুছিয়ে সংসার করতে পারবি। তোর ছবি দেখে তাদের পছন্দ হয়েছে। বাড়িতে আসতে বলি?

দিতি হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। ছেলের ছবিও দেখতে চায়নি। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বাবা এক রবিবার বিকেলে পাত্রপক্ষকে ডাকল। পাত্র নিজেও এসেছিল মা-বাবার সঙ্গে। ভদ্র-বিনয়ী দীপঙ্করকে দেখে বেশ ভরসাযোগ্য মনে হয়েছিল দিতির। বাবার আদেশে পাত্রপক্ষকে গান শুনিয়েছিল দিতি। ওরা একেবারে মুগ্ধ! দেখাশোনার শেষ পর্বে বাবা পাত্রপক্ষকে বলেছিল, ছেলে ও মেয়ে দু’জনের মধ্যে একটু আলাদা করে কথা বলে নিক নাকি? দীপঙ্করের বাবা মা দু’জনেই বলেছিলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই।

দীপঙ্করকে নিয়ে বাড়ির ছাদে গিয়েছিল দিতি। হাসি খুশি স্বভাবের দীপঙ্কর ছাদে পা রেখেই বলেছিল, আমাকে নিশ্চয়ই শুনতে হবে না আপনার বিয়েতে মত নেই, বাবা জোর করে পাত্রপক্ষর সামনে বসিয়েছে।

–কী করে বুঝলেন এ কথা শুনতে হবে না? জিজ্ঞেস করেছিল দিতি।

দীপঙ্কর বলেছিল, আপনার গান শুনে। আপনার যদি পাত্রপক্ষর সামনে বসতে অনীহা থাকত, তা হল এত সুন্দর গাইতে পারতেন না।

একথার পরই দিতি অনেক ফ্রি হয়ে গিয়েছিল। দু’জনের কথাবার্তা চলল সাধারণ কিছু বিষয়ে। কে কী খেতে ভালবাসে, কী কী রান্না করতে পারে। কোন গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা পছন্দ। কোন লেখকের লেখা পড়তে ভাল লাগে… এই সব। মাস দুয়েক পরেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল দিতির। অল্প ক’দিন শ্যামবাজারের শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে দিতি-দীপঙ্কর চলে এল আসানসোলে, গোপালডাঙার বাড়িতে। একতলা বাড়িটা দীপঙ্করই কিনেছিল। অগোছাল ছিল বাড়িটা। দিতি সব গুছিয়ে নিয়ে জমিয়ে সংসার করতে লাগল। সুগতর অধ্যায়টা তখন মনে হত গত জন্মের। কিন্তু না, এখানে সুগতর সঙ্গে দেখা হতেই কুলুঙ্গির ঠাকুর নড়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে সুগতকে অনেক কথা বলার আছে। কী কথা, তা অবশ্য জানে না দিতি। এদিকে ইভানা আঁচ করতে পেরেছে সুগতর সঙ্গে কোনও একটা সম্পর্ক ছিল মায়ের। মেয়েকে এখন পুরোপুরি অ্যাডাল্ট। সে মায়ের কাছে জানতে চাইতেই পারে সুগতর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল দিতির? বলতেও কোনও দ্বিধা নেই দিতির। সেই কবেকার সব কথা! সেই প্রেম তো বেঁচে নেই আর। অতীতের এক উপখ্যান হয়ে আছে মাত্র… ভাবতে ভাবতে দিতির খেয়াল হয়, মেয়ের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? ইভানা তো এতক্ষণ চুপ করে থাকার মেয়ে নয়।

পিছনে ঘাড় ফেরায় দিতি, এ কী ওয়াচ টাওয়ারে তো কেউ নেই। ইভানা কোথায় গেল? বুকটা একবার ধড়াস করে ওঠে দিতির। পরক্ষণেই নিজেকে সামলায়। কোথায় আর যাবে? আশে পাশে আছে হয়তো।

ওয়াচ টাওয়ারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে দিতি। না, নীচে তো নেই। বাঁশের ফেনসিং দেওয়া রাস্তা ধরে দিতি এগোতে থাকে। একবার গলা তুলে ডাকে, ইভানা। এই ইভানা, কোথায় গেলি?

কোনও জবাব নেই। কতদূর চলে গেল? দিতি হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল ফোন তোলে চোখের সামনে, ইভানাকে কি একটা ফোন করবে? ও কি ফিরে গেল হোম স্টেতে? না বলে কি যাবে? তবে গিয়েছিল কাল বিকেলে। না বলে। হোমস্টের নীচের দোকানে। যেখানে ওর সঙ্গে দেখা হয় সুগতর। তখনও একবার ফোন করেছিল দিতি, মেয়ে একটা কথা বলেই কেটে দিয়েছিল। এখনও যদি সেরকম করে? বোঝাই যাবে না ঠিক কোথায় আছে। দিতি ফোন নামিয়ে নিয়ে আবার হাঁক পাড়ে, ইভানা! ইভানা!

ফেনসিং-এর ছোট গাছগুলোর ফুল-পাতা মাথা নাড়ছে। যেন ওরা জানে ইভানা কোথায়, কিন্তু বলবে না। দিতি পা চালায় রাস্তাটা ধরে। চারপাশে পাহাড় আর মেঘ। দিতি একা। পাশে মেয়েটাও নেই। মাকে ছেড়ে চলে গেছে। গলার কাছে কষ্ট গুটুলি পাকায়। ভাঙা স্বরে দিতি ফের ডেকে ওঠে, ইভানা…

এমন সময় চোখ যায় বাঁ দিকে বিশাল এক পাথর খণ্ডের দিকে। দেখে ইভানা বসে রয়েছে। মেয়ের একঢাল চুল ছুয়েছে উপত্যকার মাঠ। দৃষ্টি কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে।

গলার কষ্টটা গিয়ে নিল দিতি। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ডাকল মেয়েকে কই রে, আয়। ইভানা!

শুনতে পাওয়ার রেঞ্জের মধ্যেই আছে মেয়ে, তবু ঘাড় ফেরাল না। অভিমান? ওর কাছে যেতে হলে হয় তিন ফুটের ফেনসিং ডিঙোতে হবে অথবা বেড়ার তলা দিয়ে যেতে হবে।

পরনে যেহেতু সালোয়ার কামিজ, বেড়া ডিঙিয়ে ফেলল দিতি। মেয়ের কাছে গিয়ে বলল, কী রে, কখন এখানে এলি? আমায় বলে এলি না তো!

ইভানা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে উত্তর দিল, বলেছি, তুমি শুনতে পাওনি।–একটু থেমে পাহাড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে ইভানা বলে, কার ধ্যানে ডুবে গিয়েছিলে মা? নাকি কারুর অপেক্ষায় ছিলে?

খোঁচা হজম করে নেয় দিতি। একটু বুঝি আমোদও অনুভব করে। এই প্রশ্নগুলো তো মায়েরা মেয়েদের করে। এখন দেখা যাচ্ছে মেয়ে প্রশ্ন করছে মাকে। দিতি এবার মেয়েকে বলে, চল, ফিরে যাই। জমিয়ে চা খেতে হবে বেড-টিটাই তো খাওয়া হয়নি এখনও।

মেয়ে ফেনসিং লক্ষ্য করে এগোতে থাকে। দিতি ফের বলে, শর্ট রুটেই ফিরব বুঝলি। ফেনসিং এর রাস্তা ধরে যাব না।

মায়ের দিকে না তাকিয়েই ইভানা বলে শর্ট রুটে যে যাবে, লাঠিটা এনেছো?

–এই যাঃ। ওটা তো ওয়াচ টাওয়ারেই ফেলে এলাম মনে হচ্ছে।

–তুমি আসতে থাকো। আমি নিয়ে আসছি লাঠিটা। বলে ফেনসিং ডিঙিয়ে এগোতে থাকল ইভানা।

#       #        #


কখনও এই হোমস্টের পাশ দিয়ে, কখনও ওই হোমস্টের সিঁড়ি ধরে মা-মেয়ে নামছে নীচে। লাঠি ছাড়া এই রুটে আসা দিতির পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। সবক’টা হোমস্টের বাগানে, বারন্দার টবে নানা ফুল ভরা গাছ। চোখ জুড়িয়ে যায়।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে বড় সড় সুন্দর হোমস্টের চাতালে পা রাখল মা-মেয়ে। হোমস্টটার দিকে ভাল করে দেখতে যাবে দিতি, আরেঃ, এসো এসো! বলে কে যেন ডেকে উঠল। মহিলা কণ্ঠ। দিতি টেরাসের কোণের দিকে তাকিয়ে দেখে সুগতদার বউ তাকে ডাকছে। ওরা চা খেতে বসেছে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অর্পিতা। দিতি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিকে ঘুরে যায়।

–আরেঃ, চলে যাচ্ছে কেন? এসো না দিতি, একসঙ্গে চা খাই। বলতে বলতে এগিয়ে আসছে অর্পিতা।

দিতি গ্রাহ্য না করে সিঁড়ির ধাপে পা রাখে।

ইভানা মায়ের হাত ধরে নেয়। বলে, উনি অত করে ডাকছেন, চলো না যাই।

অর্পিতা চলে এসেছে কাছে। ইভানার কথা শুনেছে। বলে, এসো দিতি। সুগতর কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি। আলাপ করার ইচ্ছে ছিল বহুদিন ধরেই।

দিতি অবাক হয়ে অর্পিতার দিকে তাকায়। ভাবে মেয়েটা সব শুনেও সুগতকে মেনে নিয়েছে? নাকি সুগত সবটা বলেনি?

ইভানা মায়ের হাত ধরে এগিয়ে যায় টি-টেবিলের দিকে। সুগত চেয়ারে, বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দিতিদের দেখছে। তিনজন কাছে যেতে সুগত একটা চেয়ার ধরে এগিয়ে দেয়। বলে বোসো দিতি।

দিতি বসে সুগতর পাশের চেয়ারে। ইভানা চলে যায় সুগতর ডান পাশের চেয়ারে। অর্পিতা নিজের চেয়ারটাতে বসে, সবার মুখোমুখি। ইভানা সুগতকে বলে, আপনারা আজ গেলেন না কেন ওয়াচ টাওয়ারে? দারুন সানরাইজ হল। ক্লিয়ার দেখা গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ। এভারেস্টও দেখলাম মনে হল।

–দ্যাখো না, আমি কত করে বললাম চলো ভিউ পয়েন্টে যাই। গেল না। শুয়ে শুয়ে আলসেমি করল। বলল অর্পিতা।

সুগত বউয়ের কথা এড়িয়ে ইভানাকে বলল, ওয়েদার ক্লিয়ার থাকলে এখান থেকেও এভারেস্ট দেখা যায়।

–তা হলে গেলেন না কেন? সানরাইজটাও দেখতে পারতেন। আমি ভাবছিলাম আপনারা আসবেন। বলল ইভানা।

সুগত চুপ করে তাকিয়ে থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে।

অর্পিতা দিতিকে বলে, তোমার মেয়েটি ভারী মিষ্টি। খুব আলাপী। আমার খুব ভাল লেগেছে ইভানাকে।

এদের হোমস্টের লোক এসে দু’কাপ চা দিয়ে গেল। অর্ডার করতে হল না। দিতি কাপ তুলে চায়ে চুমুক মারে। মুখ তুলে অর্পিতাকে জিজ্ঞেস করে, তোমকে, তুমি বলছি কিন্তু। আগে কোথাও দেখেছি কি? সরি, আমি কিন্তু মনে করতে পারছি না।

ইভানা বুঝতে পারে মা অ্যাটাকে যাচ্ছে। অর্পিতা কিন্তু গায়ে মাখলেন না। বললেন, আমরা কলেজে পড়েছি। তবে আমি সায়েন্স স্ট্রিম। অনেকবার তোমার মুখোমুখি হয়েছি আমি। তুমি নজর করোনি। করবেই বা কেন? তুমি তো কলেজের সেলিব্রেটি। দারুন গান গাও। জি এস-এর ঘনিষ্ট বান্ধবী…

ভদ্রমহিলা ভদ্রতা করলেন। জি এস-এর প্রেমিকা বললেন না। সেটা ইভানা উপস্থিত আছে বলে। মা এখন চুপ। পাল্টা আক্রমণে পর্যুদস্ত। মাকে অপ্রস্তুত অবস্থা থেকে বার করতে সুগত বললেন, তোমার বাবা কেমন আছেন দিতি?

–ভাল।

–তোমার ওখানে যান মাঝে মধ্যে?

–আমার ওখানে বলতে?

–আসানসোলের কথা বলছি।

–তুমি জানো আমি আসানসোলে থাকি?

–পূর্ব পরিচিতদের এটুকু খবর তো রাখতেই হয়। তুমি অবশ্য রাখো না। জানো না আমরা কোথায় থাকি। তোমার কোথায় থাকো, সেটা কাল তোমার মেয়ে আমায় বলেছে। যদিও তখনও আমি জানি না ও তোমার মেয়ে।

সুগতর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে দিতি চায়ে চুমুক দেয়। ইভানা খেয়াল করে সেই পাখিটা আবার ডাকছে, চি ই ই প, চি ই ই প… এই হোমস্টের আশেপাশের কোনও গাছে বসেছে পাখিটা। ইভানা ঘাড় ঘুড়িয়ে পাখিটাকে খোঁজে। মা এবার অর্পিতা আন্টিকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ছেলে-মেয়ে…

–একটিই। ছেলে। ডুয়ার্সের মেটেলি চা বাগানের ম্যানেজার।

–বাহ্, তা্রমানে তো উত্তরবঙ্গেই থাকে। তা সে এল না কেন?

অর্পিতার বদলে সুগত উত্তর দিতে থাকে, বলেছিলাম আসতে। বলল ভীষণ কাজের প্রেশার। দেখি, আমরা যদি পারি ফেরার সময় ওর কাছে একটা রাত কাটিয়ে ফিরব।

–যদি কেন? ছেলের কাছে একটা দিন থাকতে ইচ্ছে করে না? বলে দিতি।

উত্তরে সুগত বলে, ইচ্ছে তো হয়। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কোনও ঠিক নেই। প্রোডাকশন থেকে যে কোনও সময় ডেকে পাঠাতে পারে। ইপি-দের হঠাৎ মনে হল একটা দু’টো সিন বাড়াতে হবে। স্ক্রিপ্টরাইটারকে দিয়ে একবেলায় স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে নিয়ে ডিরেক্টরকে দিল। ডিরেক্টর প্রোডাকশনকে বলল, আমায় ডেকে পাঠাতে। তবে কিছু স্টার আর্টিস্ট আছে, তাদের সঙ্গে এই আচরণ করে না।

–তার মানে অভিনয়টাও তোমার কাছে চাকরির মতো হয়ে গেল! বলল দিতি।

সুগত বলে, আমাদের মতো গরিব দেশে তাই হয় দিতি। বাবার জমিদারি থাকলে হত না।

কথা কেড়ে নেয় অর্পিতা। বলে, তবু কাজটা অভিনয় বলে করতে পারছে। চাকরিটা তো টেকাতে পারেনি। বিয়ের পর যেটা ধরেছিল।

–তোমার বাবা দিয়েছিল সেই চাকরি। কী ধরনের চাকরি ছিল সেটা। জানতে চাইল দিতি।

অর্পিতা বলে, নার্সিংহোমের ম্যানেজারের চাকরি। রাঁচিতে বাবার এক ডাক্তার বন্ধুর নার্সিংহোম ছিল। সেখানে। রাঁচিতে তো থাকতেই চাইত না। পালিয়ে আসত কলকাতায়। নাটক করতে চলে যেত। আমি রাঁচিতে একা থাকতাম। ছেলে হওয়ার পরও তাই। অতিরিক্ত কামাই করার ফলে চাকরি থেকে ফায়ার হল। ভাগ্যিস তখন ব্রেক পেল ‘খেলাঘর’ সিরিয়ালটায়। তুমি দেখেছ ‘খেলাঘর’? দারুণ অভিনয় করেছিল ওখানে।

দিতি মাথা নাড়ে, অর্থাৎ সিরিয়ালটা দেখেনি। সুগত জানতে চায়, তুমি কি আমার কোনও সিরিয়ালই দেখোনি?

–দেখেছি।

–আমার অভিনয় কেমন লাগে তোমার?

— অভিনয় ভালই লাগে। সিরিয়ালগুলো টানা দেখতে ইচ্ছে করে না। এত বাজে গল্প। চ্যানেল পাল্টে পাল্টে পাঁচ-দশ মিনিট করে দেখি।

ইভানা দেখল বড়দের এই আড্ডায় তার থাকা না থাকা প্রায় সমান। এদের অপ্রস্তুত করতে বলে ওঠে, জানো সুগত আঙ্কল, তুমি যে মায়ের চেনা আমাকে, বাবাকে কাউকে বলেনি। বললে আমরাও একটু প্রাউড ফিল করতাম।

তিনজনেই এখন চুপ। একটু পরে অর্পিতা-দিতিকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, তোমার হাজবেন্ড কেন এলেন না বেড়াতে? অফিসে চাপ আছে খুব?

দিতি জবাব দিতে পারছে না। মাথা নিচু করে নিয়েছে। ইভানা বলে, ছ’মাস হল বাবা মারা গেছে।

–কী! বলে চমকে উঠল সুগত। চেয়ারে নড়ে চড়ে বসে ফের বলল, এই খবরটা তো আমার কানে আসেনি। কী ভাবে মারা গেলেন? কী হয়েছিল?

দিতি মাথা নামিয়ে নিয়েছে। ইভানা বলতে শুরু করে বাবার মৃত্যুর ঘটনা।




বিকেলে সাইটসিন-এর জন্য রেডি হচ্ছে মা আর ইভানা। রুমের বাইরে হঠাৎ সুগত আঙ্কলের গলা, ইভানা, তাড়াতাড়ি করো। জঙ্গলের রাস্তা। ফেরার সময় অন্ধকার হয়ে যাবে। আমরা কিন্তু রেডি।

–এই তো, আমরাও বেরোচ্ছি। বলল ইভানা।

সুগত আঙ্কল এই মুহূর্তে এমনভাবে ডাকল। যেন কতদিনের চেনা। মানুষটা কিন্তু ভারী আন্তরিক! সেই কারণে ওদের আর আপনি করে ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

আজ সকালে যখন বাবার মারা যাওয়ার ঘটনাটা বলল ইভানা, স্পষ্ট সুগত আঙ্কলের চোখে জল দেখেছিল। তবে সে জল গড়িয়ে পড়তে দেয়নি আঙ্কল। মুখটা আকাশের দিকে তুলে রেখেছিল। একেবারে থম মেরে গিয়েছিল পরিবেশ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ইভানা অর্পিতা আন্টিকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে এসে তোমরা সাইটসিন-এ গেছো নাকি কোথাও?

–কোথায় আর যাব। পরশু এলাম। গতকাল শুয়ে বসে কেটে গেল। আজ ঠিক করেছি বিকেলে বেরোব। বলেছিল অর্পিতা অ্যান্টি।

ইভানা জানতে চেয়েছিল, কোথায় যাবে?

–কালিপোখরি। উত্তর দিয়েছিল সুগত আঙ্কল।

অর্পিতা আন্টি জিজ্ঞেস করল, তোমরা গেছ নাকি? ইভানা মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে ছিল। অর্পিতা আন্টি বলল, চলো তা হলে, আমরা এক সঙ্গে যাই।

ইভানা মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। মা ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কোনও ইশারাই করল না। সুগত আঙ্কল বলতে থাকল, কালিপোখরি যেতে হলে লোয়ার চটকপুরে যেতে হবে। সেখান থেকে একটা শর্ট ট্রেক রুট। তোমরা কি সঙ্গে গাড়ি রেখেছো।

–না, তবে গাড়ির দরকার পড়লে হোমস্টের মালিককে বললেই হয়ে যাবে। বলেছিল ইভানা।

সুগত আঙ্কল বলল, বলার দরকার নেই। আমরা তো গাড়িটা রেখেই দিয়েছি। ওতে করে লোয়ার চটকপুর যাব। তারপর কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে।রাস্তা খুব সরু আর উঁচু নিচু। পারবে তো তোমরা?

ইভানা বলেছিল, কোনও ব্যাপার না।

–আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি। বাকি দু’জনকে জিজ্ঞেস করেছি। বলেছিল সুগত আঙ্কল

অর্পিতা আন্টি বলল, যতদূর পারব যাব। যখন আর পারব না। বসে পড়ব। তোমরা যখন ফিরবে, আমাকে নিয়ে ফিরবে।

–ফেরার সময় তোমাকে পাওয়া নাও যেতে পারে। ওই জঙ্গলে লেপার্ড ছাড়াও ভাল্লুক, হায়না অনেক কিছু আছে। বলল সুগত আঙ্কল।

অর্পিতা আন্টি রাগ দেখিয়ে বলে, মিছিমিছি ভয় দেখাবে না তো।

–মিছি মিছি নয়, তুমি স্থানীয় যে কোনও লোককে জিজ্ঞস করো, জঙ্গলে লেপার্ড আছে কিনা, দেখো কী উত্তর পাও। বলেছিল সুগত আঙ্কল।

মা চুপচাপ বসে সব শুনছিল। মুখে কোনও বিকার নেই। তখন ঠিক হল লাঞ্চ করে একটু রেস্ট নিয়ে বেলা সাড়ে তিনটের সময় বেরনো হবে।

ইভানাদের একটু দেরি হয়ে গেল মায়ের জন্য। শাড়ি পরে ফেলেছিল মা। ইভানা বলল, তোমার কী মাথা খারাপ। শাড়ি পরে ট্রেক করবে। হাঁটতেই পারবে না, পা জড়িয়ে পড়ে যাবে।

–তা হলে কী পরব? জানতে চেয়েছিল মা।

ইভানা বলল, প্লাজা আর কুর্তি পরো।

সেই ড্রেসটা আবার ইভানাকেই বেছে দিতে হল। কারণ, মা ম্যাড় ম্যাড়ে কলারের কুর্তি পরতে যাচ্ছিল।

আপাতত জগিং শু পরছে মা। পাহাড়ে ঘুরতে হবে বলে ইভানাই কিনিয়েছিল। জুতোর ফিতে বেঁধে মা বলল, চল, আমি রেডি।

রুমে তালা দিয়ে মা-মেয়ে বারান্দায় এসে দেখে সুগত, অর্পিতা হোমস্টের পাশে চাতালে রাখা চেয়ারে বসে আছে। অর্পিতা পরেছে জিনস। ইভানা ঠিক করে এবার থেকে মাকে বেড়াতে নিয়ে গেলে জিনস পরাবে। অর্পিতা আন্টির থেকে মায়ের ফিগার অনেক ভাল। মাকে আজ পর্যন্ত কোনও দিন জিনস পরতে দেখেনি ইভানা।

সুগতরা উঠে পড়েছে। চেয়ার ছেড়ে। সুগত তাড়া দেয়। চলো চলো। আমরা অলরেডি লেট।

ইভানা বলে, আমরা দু’জন কল টাইম মিস করেছি।

সুগত প্রাণ খুলে হেসে ওঠে। কারণ ‘কলটাইম’টা তার জগতের শব্দ।

#       #        #


সুগতদের গাড়ি করে লোয়ার চটকপুরে নেমে এসেছে ইভানারা। স্পটে ঢোকার মুখে একটা তোরণ পড়ল। উপরে লেখা ‘চটকপুর ইকো ভিলেজ’ গেট পেরিয়ে গাড়ি থেকে নামতে হল ইভানাদের। এখানে বিরাট চত্বর। দু’পাশে পর পর সব সরকারি বাংলো। কিছু পাকাপোক্ত দোকানও চোখে পড়ছে। গাড়ি থেকে নেমে এল চারজনে। সুগত দু’হাত তুল আড়মোড়া ভেঙে বলল, যাই, এক বোতল জল কিনে আনি।

দিতির কাঁধে ব্যাগ। বলল, আমি জল নিয়েছি।

–তবু আর এক বোতল কেনা থাক। ট্রেক করার সময় জলতেষ্ট পায়। বলে সুগত দোকানের দিকে এগিয়ে গেল।

ইভানা পায়চারি করতে করতে দেখে খানিক দূরে সিমেন্ট বাঁধানো বিশাল একটা ছাতার শেড আছে। যার নীচে বসেছে একটা দল। ছবি তুলছে তারা। দলটার মধ্যে কিছু ইয়াং ছেলে আছে। কেউ খুব একটা পদের মনে হচ্ছে না। বেড়াতে এসে একটা দুটো হ্যান্ডু ছেলে না দেখতে পেলে চলে? এখন অবধি একটাও চোখে পড়েনি ইভানার।

–গাইড লাগে গা আপ লোগো কো?

পাশ কে যেন বলে উঠল। ঘাড় ফেরায় ইভানা, স্থানীয় এক বয়স্ক মানুষ।

ইভানা বলে, দাঁড়ান, টিম লিডারকে জিজ্ঞেস করি। চোখ তুলে ইভানা দেখে সুগত আঙ্কলকে ঘিরে ধরেছে বেশ কিছু নারী-পুরুষ, মানে ফ্যান পরিবেষ্টিত। তারা সুগত আঙ্কলের সঙ্গে সেলফি তুলছে, কথা বলছে। কখন ফ্রি হবে, কে জানে!

বেশিক্ষণ লাগল না। ফ্যানেদের ম্যানেজ করে এগিয়ে আসছে সুগত আঙ্কল। এক হাতে জলের বোতল, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। মা আর অর্পিতা আন্টি নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ওদের ক্রস করে সুগত আঙ্কল ইভানার কাছে এল। বয়স্ক মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে ইভানাকে জিজ্ঞস করল, এ কি গাইড?

ইভানা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝাল। সুগত আঙ্কল গাইডের তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কালিপোখরি যানে আনে মে কিতনা টাইম লাগে গা?

–এক ঘণ্টা তো লাগেগাই। বলল লোকটা।

ফের সুগত আঙ্কল জানতে চাইল, তুমাহারা ফিজ?

–আপন কা জো মর্জি দিজিয়ে গা।

উত্তর শুনে সুগত আঙ্কল ইভানাকে বলল, দেখো, কী অবস্থা! লোকটা কত গরিব অথচ কোনও ডিমান্ড নেই।

ইভানা সঙ্গে সঙ্গে বলে, এমনও তো হতে পারে, এই ট্রেক রুটে গাইডের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই, তাই নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট বলতে পারছে না।

মতটা মেনে নেওয়ার মতো মাথা নাড়ে সুগত আঙ্কল। বলে, তোমাদের জেনারেশনটা সত্যিই বড্ড প্র্যাকটিকাল। তোমাদের বয়সে আমরা এরকম ভাবে ভাবতাম না। সময় খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

–কী হল, চলো। অর্পিতা আন্টি কাছে এসে বলল, মা-ও আছে আন্টির সঙ্গে।

–হ্যাঁ, চলো। আমরা একটা গাইড নিলাম সঙ্গে। এই যে। বলে বয়স্ক লোকটিকে দেখায় সুগত আঙ্কল।

মানুষটি সকলের উদ্দেশ্যে হাত জোর করে নমস্কার জানায়। তারপর এগোতে থাকে ছাতাওলা বেদীটার দিকে। বেদীটার পর থেকেই জঙ্গলের শুরু।

#       #        #


জঙ্গলে প্রবেশ করল ইভানারা। এখানে রাস্তা মোটামুটি চওড়া। দু’পাশে পাইন ছাড়াও আরও নানান গাছ। এখনও রোদ আছে আকাশে। জঙ্গল যেহেতু এখানে ঘন নয়, ছায়া সমেত রোদ পড়েছে রাস্তায়। তৈরি হয়েছে ছায়ার আলপনা।

চারজনের হাতেই এখন লাঠি। ফেলে আসা ছাতাওলা বেদীর পাশেই ছিল লাঠিগুলো। গাইড এনে দিয়েছিল। মনে হচ্ছে যারাই কালিপোখরি যায় তারা লাঠিগুলো নিয়ে যায়। ফেরার সময় আবার বেদীর পাশে রেখে দেয়।

আবার জঙ্গলের ভিতর থেকে ঘণ্টা ধ্বনির মতো পোকার ডাক ভেসে আসছে। বেশ জোরে। মনে হচ্ছে মন্দিরটা খুব গভীরে নয়। বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনটা দমে যাচ্ছে ইভানার। বাবা যদি সঙ্গে থাকত কত মজা হত!

সুগত আঙ্কল ছিল সামনে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। পিছন ফিরে ইভানাদের বলল, যেখানে যাচ্ছি, সেখানকার মিথ সম্বন্ধে একটু জানা দরকার।

বাকি তিনজন দাঁড়িয়ে গেল। বয়স্ক গাইডও দাঁড়াল। সুগত আঙ্কল বলতে থাকল, স্থানীয়রা মনে করে কালিপোখরি হচ্ছে সীতা মাঈয়ার এক ফোঁটা চোখের জল। সীতাকে যখন অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলা হয়, তিনি আকুল নয়নে কেঁদেছিলেন। যার এক ফোঁটা জল এখানে পড়ে। খুব পবিত্র এই পুকুরের জল। লোকে পুজো আচ্চা করে। জলের দিকে টানা তাকিয়ে থাকলে মনে পুষে রাখা সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যায়।

বলা শেষ করে সুগত আঙ্কল বলল, চলো যাওয়া যাক।

ইভানাদের দলটা এগোতে থাকল। এবার জঙ্গলের রাস্তা ক্রমশ সরু হচ্ছে। উঁচু নীচু পাথুরে রাস্তা। লাঠি ভীষণ কাজে লাগছে এখন।

রাস্তা এতটাই সরু দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে বেশ সমস্যা হচ্ছে। উল্টোদিক থেকে চার পাঁচজন ছেলের দল আসছে। সবার চোখ ইভানার দিকে। এদের জন্যই তো সাজ-গোজ করা। দেখছে দেখুক।

ছেলের দলটা পাস করে গেল। ইভানা ভাবে তার কেন আজ অবধি একটাও প্রেম হল না? একটা দুটো ছাড়া তার বেশির ভাগ বন্ধুরই প্রেম হয় নি। প্রেম ব্যাপারটা কি আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে?

মায়েদের ইয়াং বয়েসে প্রেমের অনেক বেশি গুরুত্ব ছিল। যার রেশ এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে মা, এবং সুগত আঙ্কল। এতদিন পর দেখা হওয়াটা দুজনকেই খুশি করেছে। দু’জনেই খুশিটা প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। কিন্তু প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।

এখন যেমন মা আর সুগত আঙ্কল পাশাপাশি হাঁটছে। গল্প করছে নিজেদের মধ্যে। অর্পিতা আন্টি একটু পিছিয়ে পড়েছে। ইভানা পা চালিয়ে আন্টির পাশে যায়। জানতে চায়, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

— না না, ঠিক আছি। বলল আন্টি। তারপরই ইভানার হাতটা ধরে নেয়। বলে, তোমাদের আসানসোলের বাড়িতে এখন কে কে থাকে?

–আমি আর মা।

–তুমি তো কলকাতায় পড়তে চলে আসবে। মা একা পারবে ও বাড়িতে থাকতে? চারপাশে তো বাবার স্মৃতি।

–জানি না কী হবে। এদিকে মা আবার আসানসোলের বাড়ি ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকতে পারে না। নিজের হাতে সংসার গুছিয়ে তো।

জঙ্গল এখন একটু পাতলা হল। আচম্বিতে ডেকে উঠছে নানান ধরনের পাখি। পোকার ডাক এখানে কম। সুগত আঙ্কল দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরল। পাশে মা আর গাইড। যাক, দম নেওয়ার একটু সুযোগ পাওয়া গেল। সুগত আঙ্কল বলছে বুঝলে অর্পিতা, এখান থেকে বাঁ দিকে এক কিলোমিটার মতো গেলে সুইসাইড পয়েন্ট। সেখানে বিশাল একটা খাদ। বছর কুড়ি আগে একটা ইয়াং কাপল পথ ভুল ওদিকে চলে যায়। তারা আর ফেরেনি। স্থানীয় লোকেরা মনে করে ওই খাদ থেকে পড়ে গেছে ওরা। পথ ভুলে যায়নি ওদিকে, সুইসাইড করতে গিয়েছিল।

বলার পর থামল সুগত আঙ্কল। গাইডকে বলল, ঠিক বলছি কিনা?

গাইড মাথা নেড়ে সায় দিল। সুগত আবার অর্পিতা আন্টিকে জিজ্ঞেস করল, যাবে নাকি ওদিকে একবার।

–কোনও দরকার নেই ওই অলুক্ষুনে জায়গায় যাওয়ার। বলল অর্পিতা আন্টি।

ইভানা জানতে চায়, আঙ্কল, তুমি এর আগে চটকপুর এসেছিলে নাকি? এত কিছু জানলে কী ভাবে?

–জেনেছি ভ্লগ দেখে। ট্যুর ভ্লগ দেখতে আমার দারুণ লাগে। তবে কি জানো ইভানা, আমার মনে হয় ওই কাপল সুইসাইড করেনি। ভাল্লুক বা চিতা ওদের মেরে দিয়েছে।

–অ্যাই, তুমি চুপ করো তো। এই কথাগুলো কি এখন না বললেই নয়! আগে যদি জানতাম এসব ঘটনা, আমি আসতামই না। বলল অর্পিতা আন্টি।

সুগত আঙ্কল হাঁটতে শুরু করল সামনে। বলতে থাকল, সেই জন্য তো আগে বলিনি। আরেঃ, জার্নির ভিতর একটু অ্যাডভেঞ্চার না থাকলে চলে।

এদিকে ইভানার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে সুইসাইড পয়েন্টটা দেখতে যেতে। কিন্তু যাবে কী ভাবে? এদের তো রাজি করানো যাবে না।

আরও সরু রাস্তায় এসে পড়ল ইভানারা। এখানে গভীর জঙ্গল। পাথুরে রাস্তার ধারে ছোট বড় গাছ পালা। তাদের ডাল পাতা লাগছে গায়। রাস্তাটা ছোট ছোট বাঁক নিচ্ছে আর নীচে নেমে যাচ্ছে। হঠাৎ চোখ থমকে যায় ইভানার চোখ, মা সুগত আঙ্কলের হাত ধরেছে। সাবধানে পার হচ্ছে রাস্তাটা। দৃশ্যটা দেখে অস্বস্তি হচ্ছে ইভানার, হাত ধরার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভাল লাগছে না অর্পিতা আন্টির। ইভানা মাকে সাহায্য করতে পা বাড়ায়, ওর হাত ধরে নেয় অর্পিতা আন্টি। বলে, কোথায় যাচ্ছ?

–মাকে একটু হেল্প করি। রাস্তাটা বড় খারাপ।

–তা হলে আমাকে কে হেল্প করবে? দিতির পাশে তো সুগত আছে। বলার পর অর্পিতা আন্টি ধরে নেয় ইভানার হাত।

ভারী বিস্ময় জাগে ইভানার। বর প্রাক্তন প্রেমিকার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে অর্পিতা আন্টির কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। আশ্চর্য মনের মানুষ তো অর্পিতা আন্টি!

এতক্ষণে রাস্তা চওড়া হল। সুগত আঙ্কলের হাত ছেড়ে দিয়েছে মা। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গল্প করে যাচ্ছে দু’জনে। অর্পিতা আন্টি কেন এতটা অ্যালাউ করছে, তা নিয়ে বিরাট ধন্ধ থেকে যাচ্ছে ইভানার!

উল্টোদিক থেকে আর একটা ছেলেদের দল এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকের হাতে লাঠি। যথারীতি ওদের সবার চোখ আটকেছে ইভানার উপর। দলটা ইভানাকে ক্রস করার সময় ওদের মধ্যে কেউ একজন সুর করে বলে উঠল, আর পারি না ক্যাটরিনা, এক ফোঁটাও দিবি না?

চকিতে ঘাড় ঘোরায় ইভানা, বুঝতে পারে কোন ছেলেটা টোন কাটল। দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটার দিকে আঙুল তুলে ইভানা বলে, অ্যাই শোন।

ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়ে পা চালায় সামনে। ফের ইভানা বলে, কী হল, দম শেষ! দাঁড়া বলছি।

পুরো দলটাই দাঁড়িয়ে পড়। সবার মুখ শুকনো। ইভানা এগোতে যায়, পাশ থেকে অর্পিতা আন্টি বলে, অ্যাই, ইভানা কী করছ, কী!

–দাঁড়াও না। দেখো কী করি। বলে ইভানা ছেলেটার সামনে যেতেই, সে বলে ওঠে, আমি কিছু বলিনি।

–তা হলে কে বলল?

দলটা ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে গেছে। হঠাৎ ইভানা অ্যা টিটিউট পাল্টে বলে, ছাড় এসব। ইয়াং বয়সে এ গুলো হয়েই থাকে। কালিপোখরি স্পটটা আর কত দূর রে?

ধড়ে যেন প্রাণ এল ছেলেটার। বলে, বেশি দূর না। আর দুটো বেন্ড পরেই।

–ঠিক আছে। যা। বলে অর্পিতা আন্টির পাশে ফিরে এসে হাঁটতে থাকে ইভানা।

ছেলেদের দলটাও নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে এগিয়ে যায়। টোন কেটেছিল যে ছেলেটা, তার পিছনে লাগছে বাকিরা।

দলটার সঙ্গে খানিকটা তফাত হতেই অর্পিতা আন্টি সবিস্ময়ে বলে ওঠে, তুমি তো সাঙ্ঘাতিক মেয়ে ইভানা। ছেলেগুলোকে পুরো গাধা বানিয়ে দিলে!

ইভানা মিটি মিটি হাসছে। ঘটনায় অর্পিতা আন্টি রীতিমতো এক্সসাইটেড। ইভানাকে ছেড়ে হাঁটতে লাগল জোরে। বলতে থাকল, অ্যাই, সুগত শোনো না, ইভানা কী কাণ্ড করল। ওকে দেখে কিন্তু কিছুই বোঝা যায় না।

#       #        #


কালিপোখরিতে পৌঁছে গেছে ইভানার। ছোট্ট একটা জলাশয়। তার মাঝে বিশাল একটা পাথর খণ্ড। জলাশয় ঘিরে লম্বা লম্বা সব গাছ। গাছের ছায়া পড়েছে জলে। বুড়ো গাইড হিন্দিতে যা বলছে, তার মানে করলে দাঁড়ায়, চারপাশে এত গাছ, তবু এই পুকুরে একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে না। পড়লেই কোনও না কোনও পাখি এসে নিয়ে যায়।

সত্যিই পুকুরের জল একদম টলটলে পরিষ্কার। কিচ্ছু পড়ে নেই। পুকুরের এক পাড়ে তিনটে বাঁশ দিয়ে একটা গেট করা আছে। যার মাথায় ছোট একটা ঘণ্টা। ঘণ্টাটা বাজিয়ে মা ওই গেটের তলা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইভানা মাকে অনুসরণ করে। খানিকটা এগোতেই একটা বিশাল প্রস্তর খণ্ডর নীচে দেখা গেল পর পর কিছু ফটো ফ্রেম মাটিতে রাখা। ফ্রেমে নানান ঠাকুরের ছবি। সামনে বিভিন্ন রঙের ফুল পড়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে, ঠাকুররা নিয়মিত পুজো পায়। এদিক ওদিক রঙিন কাগজের শিকল বা পতাকা বাঁধা আছে। জায়গাটা ভারী সুন্দর! প্রচুর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। তবে সেই পাখিটা নেই।

মা ঠাকুরের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করল। তারপর ঘুরে গিয়ে পুকুরের দিকে চলল। সুগত আঙ্কল, অর্পিতা আন্টি চলে এসেছে এখানে। মা এগিয়ে যাচ্ছে জলের দিকে। সুগত আঙ্কল বলে ওঠে, জলে নেমো না। কতটা ডিপ বোঝা তো যাচ্ছে না।

মা দাঁড়িয়ে গেল। চেয়ে রইল জলের দিকে। কিছুটা সময় কাটতে ইভানা ডেকে ওঠে, মা, চলে এসো। ফিরতে হবে তো।

মা কোনও উত্তর দেয় না। তাকিয়েই থাকে জলের দিকে। ইভানার মনে পড়ে এখানে আসার মুখে সুগত আঙ্কল বলেছিল, সীতার চোখের জল থেকে তৈরি হয়েছে এই পুকুর। জলের দিকে টানা তাকিয়ে থাকলে মনের সকল দুঃখ-কষ্ট ভোলা যায়। মা কি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে দুঃখ ভুলতে?

#       #        #


আজ হোমস্টের লোকেরা থাকতে থাকতেই ডিনার করে ফেলল ইভানারা। গত রাতে ওরা খাবার ক্যাসারোলে রেখে ঘুমোতে চলে গিয়েছিল। দিতি আর ইভানা ডাইনিং-এ গিয়ে খেয়েছে। গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে তখন। জেগেছিল শুধু টুনি বাল্বগুলো আর পোকারা। পোকাদের আওয়াজ বড় নিঝুম করে দিয়েছিল চারপাশটা। তখনই দিতি ইভানাকে বলে, কাল এরা থাকতে থাকতে খেয়ে নেব। কেমন যেন গা ছম ছম করছে।

আজ কালিপোখরি থেকে ফিরতে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। হোমস্টে থেকে পকোড়া আর চা বা কফি দেওয়ার কথা। দিতি ইভানাকে বলল, শুধু চা খাব। পাকোড়া খেলে তাড়াতাড়ি ডিনার করতে পারব না।

মায়ের কথাটা যুক্তি যুক্ত মনে হয়েছিল ইভানার। সে ডাইনিং–এ গিয়ে বারণ করে এল পাকোড়া দিতে। ওরা শুধু চা না দিয়ে সঙ্গে বিস্কুট দিল। চা খেতে খেতে ইভানা মা-কে বলেছিল, কাল তুমি আমি চলো না সুইসাইড পয়েন্টটা দেখে আসি। অর্পিতা আন্টি তো যাবে না। তাই সুগত আঙ্কলকে ঠিক হবে না ডাকা। আমরাই কোনও গাইডকে নিয়ে চলে যাব।

মা বলল, ওরকম কোনও জায়গাই নেই। সুগত মিথ্যে বলেছে।

ইভানা অবাক হয়ে বলেছিল, সে কী! মিথ্যে বলেছে? কিন্তু গাইড যে তখন সুগত আঙ্কলের কথায় সায় দিল!

–গাইড ওই গল্পটা প্রথম শুনল। এবার সেটা অন্য ট্যুরিস্টের কাছে চালাবে। বলল মা।

ইভানা বলেছিল, মিথ্যে বলেছে, তুমি জানলে কী করে? তোমাকে কি আলাদা করে বলেছে গল্পটা বানানো?

–না। ওর মিথ্যেগুলো আমি ধরতে পারি। এরকম বানিয়ে গল্প বলা ওর স্বভাব। বলেছিল মা।

ইভানা তখন বলে, তা হলে কি কালিপোখরি নিয়ে যে মিথটা বলল, সেটাও মিথ্যে?

মা মাথা হেলিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ, ওটাও মিথ্যে।

ইভানা কিছুক্ষণ থম মেরে বসেছিল। তারপর মাকে বলে, তুমি যে পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলে, আমি ভাবছিলাম মনের দুঃখ-কষ্ট গুলো ভোলার জন্য। সুগত আঙ্কল সে রকমই বলেছিল। ওই জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে দুঃখ-কষ্টগুলো ভোলা যায়।

–ওটা আমার উদ্দেশে বানিয়েছে। সুগত চাইছে প্রকৃতির এই শান্ত নির্জন পরিবেশে আমি যেন মনের কষ্টগুলো ধুয়ে ফেলি। সেটা কি এত সহজ? গাঢ় গভীর কষ্টগুলো যতই ধুই, যায় না। বলেছিল মা।

একটু সাহস করেই ইভানা তখন জানতে চেয়েছিল, বাবা চলে যাওয়া ছাড়া আর কী দুঃখ আছে তোমার? সুগত আঙ্কলকে জীবনে না পাওয়া?

ইভানার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিয়েছিল মা। ইভানা ফের বলে, তোমাদের, মানে তুমি, সুগত আঙ্কল, অর্পিতা আন্টির কথাবার্তা থেকে আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি তোমার আর সুগত আঙ্কেলের মধ্যে একটা ডিপ রিলেশন ছিল। সেটা ব্রেক হল কেন মা?

উত্তর দিচ্ছিল না মা। বোধহয় সঙ্কোচ বোধ করছিল। ইভানা প্রসঙ্গ থেকে সামান্য সরে গিয়ে বলেছিল, অর্পিতা আন্টির মনটা কিন্তু খুব ভাল। তোমাদের সম্পর্কটা সে জানে, তবু কালিপোখরি যাওয়ার পথে নিজের বরকে তোমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে দিচ্ছিল।

–আসলে তা নয়। নিজে কত মহৎ, উদার সেটাই প্রমাণ করতে চাইছিল আমার কাছে। খানিকটা তোর কাছেও। ওর বরের সাহচর্য ভিক্ষে দিচ্ছিল আমায়। অথচ আজ পর্যন্ত বরকে চিনতেই পারল না। বর কোনটা সত্যি বলছে, কোনটা বানিয়ে… ধরার ক্ষমতা নেই।

চা খাওয়া তখন শেষ। কাপ সুদ্ধ ট্রে-টা বিছানা থেকে তুলে ফ্লোরে নামিয়ে রেখে ইভানা মাকে বলেছিল, তোমার সঙ্গে সুগত আঙ্কেলের রিলেশন ছিল, সেটা তো এখন আমার কাছে ক্লিয়ার। এবার তুমি বলো রিলেশনটা ব্রেক হল কেন? গত দু’দিন ধরে আমি তোমাদের ওয়াচ করে দেখছি, তোমরা একে পরের প্রতি সমান সহানুভূতিশীল। তবু এতদিন কেউ কারুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখোনি। তোমাদের মাঝে একটা পাথরের মতো অভিমান অবস্থান করছে। কী সেই অভিমান? আমায় সব খুলে বলো। আমি তো এখন বড় হয়েছি। ধরে নাও আমি তোমার বন্ধু।

–বলছি। বলে অতীত রোমন্থনে গেল মা। সবটা বলল কিনা, জানে না ইভানা। তবে যতটুকু বলেছে, তা যথেষ্ট। এই রিলেশন ব্রেকের পিছনে মা বা সুগত আঙ্কলের কোন দোষ নেই। দোষ হচ্ছে ইভানার দাদুর। দাদু মাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল বিয়ে করতে যাওয়ার দিন। একথা মা সুগত আঙ্কেলের বন্ধু নবারুণ আঙ্কলকে বলতে পারেনি। তাতে নিজের বাবাকে ছোট করা হত। এদিকে সুগত আঙ্কল আজও জানে মা দাদুর কথা মেনে বিয়ে করতে যায়নি। মস্ত একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে গেছে দু’জনের মধ্যে। কিন্তু ইভানাকে যেটা সব চেয়ে ভাবাচ্ছে, দাদুকে বিয়ের খবরটা জানিয়েছিল কে? বুলবুলি মাসি নয়তো? মাকে সে কথা বলতে, মা বলল, মনে হয় না। আমার বিয়ে ভেঙে বুলবুলির কী লাভ?

ইভানা যুক্তি দিয়েছিল, হয়তো হিংসে। তুমি বড়লোকের মেয়ে। সুন্দরী। সুন্দর দেখতে ছেলের সঙ্গে তোমার প্রেম। তোমার প্রেম সফল হতে চলেছে। সেটাই হয়তো সহ্য হয়নি।

মা বলল, মনে হয় না। বুলবুলি যদি আমার ক্ষতি করতে চাইত, পরে আর রিলেশন রাখত না। কারণ, অপরাধ বোধ। কিন্তু বুলবুলি তো আজও আমার সঙ্গে রিলেশন রেখেছে। আসানসোলের বাড়িতেও ঘুরে গেছে বেশ কয়েকবার। একবার বরকে নিয়ে এল।

ইভান চিন্তায় পড়ে গেল। তা হলে দাদুকে বিয়ের খবরটা দিল কে? তা হলে কি দাদুর চেনা জানা কেউ? যার সুগত আঙ্কলের বাড়িতেও যাতায়াত আছে।

আর একটা ব্যাপারেও বেশ অবাক হয়েছে ইভানা। দাদুর মতো খোলামেলা আধুনিক মানুষ কী করে নিজের মেয়েকে ঘরে তালা দিয়ে রাখল? ইভানা তো দাদুর সঙ্গে সব কথাই শেয়ার করে। দাদুকে এখনই একটা ফোন করতে ইচ্ছে করছে ইভানার। জানতে চাইবে কেন মাকে আটকে রেখেছিলে? কিন্তু রাত দশটা বাজতে চলল এখন। দাদু ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছে। ডিনার করে শুতে যাবে। এই সময় দাদুকে ডিসটার্ব করা ঠিক হবে না। কাল বেলার দিকে দাদুকে ফোন করবে ইভানা।

মায়ের সব কথা শোনার পর ডিনার করতে গেল দু’জনে। খুব যত্ন করে খাওয়াল হোমস্টের লোকেরা। খুবই আন্তরিক ব্যবহার এদের। উদার প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকে বলেই হয়তো। ডিনার থেকে ফিরে মা ঢুকে গেল রুমে। ইভানা সেই যে বসল বারান্দার চেয়ারে, তার পর থেকে বসেই আছে। আকাশ জুড়ে ঝিকমিক করছে তারা। এখন ওয়েদার একদম ক্লিয়ার। হোমস্টের ডানদিকে একটা নীচু পাহাড়ের মাথায় কোনও এক শহরের আলো দেখা যাচ্ছে আজ। মনে হচ্ছে আকাশ থেকেই খসে পড়েছে কিছু তারা।

শেষ শয্যায় বাবা বলেছিল ‘তোর মায়ের উপর লক্ষ্য রাখিস। বাড়ি থেকে পালানোর ঝোঁক আছে ওর’ এখন বোঝা যাচ্ছে বাবা সুগত আঙ্কলের ব্যাপারটা জানত, কিন্তু মাকে কোনও দিন এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। একেই বলে আইডিয়াল হাজবেন্ড…কানে গাড়ির আওয়াজ আসে। বাঁ দিকে ঘাড় ফেরায় ইভানা, নীচের সেই দোকানের সামনে দিয়ে একটা গাড়ি উঠে আসছে। জ্বলছে হেডলাইট। এত রাতে কে এল? মনে হচ্ছে কোনও হোমস্টের মালিক বা কর্মচারী। কিন্তু এত রাতে আসাটা অস্বাভাবিক।

গাড়িটা থামল ইভানাদের হোমস্টের আড়াআড়ি রাস্তায়। সব গাড়িই থামে এখানে। সওয়ারি নেমে যাওয়ার পর গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে এসে ছোট মতো মাঠটাতে গ্যারেজ হয়।

এই গাড়ি থেকে যে নামল, মনে হচ্ছে ট্যুরিস্ট, তবে অল্পদিনের। পিঠে ব্যাকপ্যাক, হাতে বেশ বড় ক্যামেরার ব্যাগ। পরনে হুডি চাপানো জ্যাকেট। গাড়ির বাইরে এসে জানলা দিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কিছু কথা বলে লোকটা রাস্তা ধরে উঠে গেল উপরে। গাড়ি ব্যাক করতে থাকল। এত রাত করে এল কেন লোকটা?

–কীরে, এবার শুতে আয়। রুম থেকে ডাকল মা।




পরের দিন ভোর। বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইভানা। সূর্য উঠে পড়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। কী অসাধারণ দৃশ্য। শিখরগুলোর পাল্টে যাচ্ছে রং। যেন প্রকৃতির দেবতা আবির ছুঁড়ে দিচ্ছেন ওই বরফ শৃঙ্গগুলোতে।

আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইভানার। সেই পাখিটা ডাকছিল বাইরে। বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে জানলার পর্দা সরাতেই ইভানা বুঝেছিল আজ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবেই। ভায়োলেট কালারের একটা আভা আকাশে। সামান্য দু’এক টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।

মা গভীর ঘুম ঘুমোচ্ছে। শান্তির ঘুম। কত বছর পর। দেখা হয়েছে প্রেমিকের সঙ্গে। কথাও হয়েছে। না, মাকে নিয়ে এ সব কথা ভাবতে খারাপ লাগছে না ইভানার। দিতি চৌধুরী তার মা হতে পারে, এ ছাড়াও তো তার একটা স্বতন্ত্র সত্তা আছে। সেই সত্তার একজন মনের মানুষ থাকতেই পারে।… মাকে না ডেকে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস করে বাইরে এল ইভানা। তেমন মনে হলে একবার ওয়াচ টাওয়ার থেকে ঘুরে আসবে।

কিন্তু একা একা যেতে ইচ্ছে করছে না। বারান্দা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার শোভা দেখে যাচ্ছে ইভানা। এই তো আবার সেই পাখিটা ডাকছে। চি-ই-ই-প চি-ই-ই-প… পাখিটা যেন ইচ্ছে করেই ইভানার আশপাশে এসে ডাকে। কিন্তু তাকে দেখা যায় না কিছুতেই। পাখিটাকে খুঁজতে বারান্দা থেকে নেমে আসে ইভানা।

সামনে বাঁধাকপি খেতের মধ্যে বসে আছে কি? বেড়ার ফুলগাছগুলোর মধ্যেও থাকতে পারে। ডাকটা খুব কাছ থেকে আসছে। ঘাড় নিচু করে কপি খেতের মধ্যে তীক্ষ্ণ চোখ চালায় ইভানা। হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন ডাকল, হাই!

পুরুষ কণ্ঠ। ঘাড় ফেরাল ইভানা। একজন ইয়াং ভ্লগার। স্টিকে ধরা ক্যামেরার মুখ ইভানার দিকে রেখে ‘হাই’ বলেছে ছেলেটা। ইভানা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আঙুল নাড়িয়ে ‘হাই’ করে। ছেলেটা কিন্তু হেভি হ্যান্ডু! সে আবার জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগছ কাঞ্চনজঙ্ঘার রেঞ্জ?

ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ইভানা বলে, দারুন! সুপার্ব! অসাম…

ভ্রমণ জাতীয় ভ্লগে একটু বেশি উচ্ছ্বাস দেখাতে হয়, তেমনটাই দেখাল ইভানা। ছেলেটি ফের জিজ্ঞেস করে, কাঞ্চনজঙ্ঘা নিশ্চয়ই প্রথমবার নয়।

–না, আগে দেখেছি। ডিফারেন্ট প্লেস থেকে। তবে চটকপুর থেকে দেখা আজকের কাঞ্চনজঙ্ঘা জাস্ট ফাটাফাটি! কোনও কথা হবে না!

কথা শেষ হল ইভানার, ক্যামেরার মুখ কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে রাখল ভ্লগার। বলতে থাকল, আপনারা শুনলেন একজন পর্যটক কী বলছেন, আজকের কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ নিয়ে কোনও কথা হবে না। সত্যিই তাই। আসুন ভিউয়ার এবার আপনাদের চারপাশের পরিবেশটা দেখাই। বলার পর ক্যামেরা ঘোরাতেই থমকে গেল ছেলেটা। একটা টার্কি হেঁটে আসছে হোমস্টের বাগানের দিকে। টার্কিটাকে ফোকাস করেছে ভল্গার। ভিউয়ারদের উদ্দেশে বলে যাচ্ছে, দেখেছেন কীরকম গম্ভীর ভাবে হেঁটে যাচ্ছে টার্কিটা। বুঝিয়ে দিচ্ছে আমি মুরগিদের দাদা প্রজাতির।

বেশ মজা করে কথা বলে তো ছেলেটা! নিশ্চয়ই ওর অনেক সাবক্রাইবার। আপাতত ক্যামেরা অফ করে স্টিক ফোল্ড করে নিল ছেলেটা। ইভানা বলল, কী হল, চারপাশের পরিবেশ দেখাবেন বললেন, দেখাচ্ছেন না কেন?

–পরে শ্যুট করব। এডিট করে জুড়ে দেব। বলল ভ্লগার। তারপর বলে ওঠে, আমি সৌরিক। আপনি?

–ইভানা।

–নাইস নেম!

–আপনার নামটাও ভারী সুন্দর!

–থ্যাঙ্ক ইউ। আচ্ছা, এখানে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে না? কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হয় জানো? তুমিই বলছি কিন্তু।

–হ্যাঁ, জানি, তুমি জানো না কেন? কবে এসেছো তুমি? আমিও কিন্তু তুমিই বললাম।

–তুমিই ভাল। আমি কাল রাতে এসেছি।

–ও, তার মানে কাল রাত দশটা নাগাদ যে গাড়িটা আসতে দেখলাম, ওতে তুমিই ছিলে?

–ইয়েস।

–রাতের বেলা এলে কেন?

–আর বলো না! বিকেলেই ঢুকে যেতাম। জঙ্গলে ঢোকার মুখে ফরেস্ট গার্ডরা আটকে দিল। কী ব্যাপার, না একটা লেপার্ড বেরিয়েছিল জঙ্গলের লাগোয়া গ্রামে। বন্দুক দিয়ে ঘুমপাড়ানী গুলি মারা হয় তাকে। তার ঘুম ভাঙলে খাঁচায় পুরে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে আসা হবে। তেমন বুঝলে রিহ্যাবিটেশন সেন্টারেও নিয়ে যাওয়া হতে পারে। আমাদের গাড়ি যখন আটকাল গার্ডরা, বলেছিল ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে কাজটা হয়ে যাবে। তারপর ছেড়ে দেবে রাস্তা। কিন্তু কোথায় কী, বাঘের ঘুম আর ভাঙে না। চার ঘণ্টা পর আমাদের ছাড়লো। চোখের সামনে দিয়ে লেপার্ডটাকে খাঁচা বন্দি করে নিয়ে গেল রিহ্যাবে।

–বাঃ, দারুন এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে তো তোমার! বলার পর ইভানা ঘুরে দাঁড়ায় বলে, চলো তোমাকে ওয়াচ টাওয়ারে নিয়ে যাই।

খানিকটা এগিয়ে গিয়ে হোমস্টের পাশ থেকে দু’টো লাঠি তুলে নিল ইভানা। একটা লাঠি সৌরিককে দিয়ে ইভানা বলল, শর্টরুটে যাব। এটা কাজে লাগবে।

–আমার লাগবে না। অভ্যেস আছে। এক হাতে থাকবে ক্যামেরা, অন্য হাতে লাঠি ধরলে কাজ করব কী করে?

–ঠিক আছে। থাক তা হলে। বলে একটা লাঠি আগের জায়গায় রেখে দিল ইভানা। তারপর বলল, চলো, এসো আমার সঙ্গে।

হোমস্টের পাশ দিয়ে শর্টরুট ধরল ইভানা। পিছনে আসছে সৌরিক। সে ভ্লগিং চালু করে দিয়েছে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে যাচ্ছে, চটকপুর ওয়াচ টাওয়ারে যাওয়ার একটা কমন রুট আছে। আমরা এখন এক্সপ্লোর করব শর্ট একটা রুট। একটু ঝুঁকি পূর্ণ সেই রাস্তা। আর ঝুঁকি না থাকলে থাকলে পাহাড়ে আসাই বৃথা…

ইভানার খুব মজা লাগছে। ভ্লগারের সঙ্গে চলেছে স্পটে। ওয়াচ টাওয়ারে যাওয়ার জন্য একজন সঙ্গী দরকার ছিল। সঙ্গী হিসেবে ভ্লগারটি যথেষ্ট আকর্ষণীয়। সুন্দর কথা বলে। বেশ প্রাণবন্ত ভাব। হাইট ছ’ফুট তো হবেই। নির্মেদ চেহারা। ঝাঁকড়া চুল। ক্লিন সেভেন। চশমার ফ্রেমটা দারুণ!

কাল ইভানারা ফিরে যাবে, আর আজ দেখা হল ছেলেটার সঙ্গে। এটুকু সময়ে আলাপটা জমাতে পারবে তো ইভানা? আপাতত শুধু আলাপ, প্রেম নয় কিন্তু। প্রেম যে ঝামেলার বস্তু, মাকে দেখে সেটা বুঝছে ইভানা।

সৌরিক ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বকেই যাচ্ছে। ইভানা-এর সঙ্গে আলাপ করবে কখন? ওয়াচ টাওয়ারের কাছাকাছি চলে এসেছে ইভানারা। আঙুল তুলে ইভানা সৌরিককে বলে, ওই যে ওয়াচ টাওয়ার।

সৌরিক সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ঘোরায় ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, দেখো বন্ধুরা, ওয়াচ টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। প্রায় এসে গেছি। টাওয়ারের মাথাটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ। জাপানি মন্দির টাইপ ছাদ। মানে প্যাগোডাধর্মী। আশা করছি দূর থেকে যতটা ভাল লাগছে, কাছে গেলে আরও ভাল লাগবে।

ক্যামেরা অফ করে সৌরিক। ক্রমশ চড়াই উঠতে গিয়ে একটু হাঁপাচ্ছে। ইভানাকে বলে, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কি তোমাকে মাঝে মাঝে ক্যামেরার ফ্রেমে রাখতে পারি?

—তুমি এর মধ্যেই রেখেছো। আমার ইন্টারভিউ নিলে যে!

–সেটা ট্যুরিস্ট হিসেবে নিয়েছি। এখন তুমি এই ভিডিওর মডেল। তবে ক্লোজ শট নেবো না। সবই দূর থেকে অ্যান্ড ব্যাক সাইড। ইফ ইউ এগ্রি, তবেই…

–নো প্রবলেম। কিন্তু আমার ফিজ? মজা করার গলায় বলে ইভানা।

–অফ কোর্স দেব। অ্যামাউন্টটা নির্ভর করবে এই ভ্লগের ভিউ কেমন হয় তার উপর।

ইভানা অবাক গলায় বলে, তার মানে তো পেমেন্ট পেতে এখন অনেক দেরি। ভিউ তো হতেই থাকবে!

চড়াইয়ে উঠতে উঠতে হেসে ফেলে সৌরিক বলে, আমার ভ্লগের ভিউ হতে চায় না। এখন অবধি ইউটিউব থেকে একটা টাকাও পাইনি।

–টাকা পাওনি কেন? তুমি তো সুন্দর ভ্লগ করো। ভাষায় দখল আছে। ভয়েসও সুন্দর। দেখতেও হ্যান্ডসাম। তোমার তো অনেক ফলোয়ার থাকা উচিত।

–আমার সম্বন্ধে এত ভাল রিভিউ দেওয়ার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ। আসলে আমি রেগুলার ভ্লগার নই। অফিস থেকে ছুটি পেলে শ্যুট করতে বেরিয়ে পড়ি। এইভাবে কোনও ভ্লগারের ভিউ বাড়ে না, ইউ টিউব থেকে রোজগার করতে হলে রেগুলারলি ভিডিও আপ লোড করতে হয়। অফিসের জন্য আমার পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। বলতে পারো আমি একজন শখের ভ্লগার।

সৌরিকের পাশে হাঁটতে থাকা ইভানা জিজ্ঞেস করে, কী জব করো তুমি? কোন কোম্পানি?

–বাজে কোম্পানি। লোক খাটাতে হয়। চাকরি ছেড়ে দেব খুব তাড়াতাড়ি। তার পর ফুল টাইম ভ্লগার। বলার পর ওয়াচ টাওয়ারের মাঠে উঠে পড়ল সৌরিক। ওয়াচ টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল, ওহ, ইটস এন এক্সট্রা অর্ডিনারি ওয়াচ টাওয়ার। কী কালারফুল। সদ্য রং করেছে মনে হচ্ছে। আমার ভিডিওটা একদম জমে যাবে।

ফের শ্যুট করতে লাগল সৌরিক। স্টিক লাগানো ক্যামেরাটা নিজের জগিং শু-এর একটু দূরে রেখে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। তার সঙ্গে বকবক করে যাচ্ছে।

ওয়াচ টাওয়ারে চারপাশটা আজ সব চেয়ে ভাল লাগছে। মেঘের আড়াল তেমন নেই। দূর দূর পাহাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পিছন থেকে সৌরিক বলে ওঠে, ঠিক যে ভাবে দাঁড়িয়ে আছো, ওভাবেই থাকো। ক্যামেরার দিকে তাকাবে না। শুধু ব্যাক পোর্সানটা নিচ্ছি।

–ওকে। বলে ইভানা থামটা ধরে সামনের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

–ওকে, কাট। বলে সৌরিক। তারপর ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে এক্ষুনি তোলা ভিডিওটা। ইভানা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সত্যিই খুব ভাল তুলেছে ভিডিওটা। লোয়ার অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে ইভানা। দৃষ্টি দূর পাহাড়ের দিকে। সৌরিক জিজ্ঞেস করে, কী, ঠিক আছে তো?

–একদম বিন্দাস। বলার পর ইভানা জানতে চায়, আমার সামনে থেকেও তুলবে তো?

–না।

–কেন?

–ভিডিওটা তো প্রচুর পাবলিক দেখবে। তার মধ্যে তোমার চেনা জানা কেউ থাকতে পারে। তারা জিজ্ঞেস করবে, ওই ভ্লগারটা তোর কে হয়?

–কে হয় আবার! বলব বন্ধু।

–তাতে বিয়ে আটকে যাবে তোমার। যে বন্ধুকে তুমি ছবি তোলার পারমিশন দিচ্ছ, সে তোমার শুধু বন্ধু নয়, বিশেষ বন্ধু।

–ভারী বয়ে গেল আমার। তুমি আমার সামনে থেকে ছবি তুলবে।

–না, তুলব না। সেটা তোমার বিয়ে আটকানোর আশংকায় নয়, আমি গোটা ফুটেজ জুড়ে একটা কিউরিওসিটি তৈরি করব। তোমার ব্যাকের ছবি দেখতে দেখতে ভিউয়ার অপেক্ষা করবে সামনেটা দেখার। আমার ভ্লগ শেষ হয়ে যাবে। দেখতে পাবে না।

–ভারী শয়তান তো তুমি! বলে হাসতে থাকে ইভানা।

সৌরিক বলে, শয়তান নয়। আমি তোমাকে গোটা ভ্লগ জুড়ে রহস্যময়ী নারী হিসেবে দেখাতে চাইছি। বেশির ভাগ লং শট নেব। দূর দিয়ে তুমি হেঁটে যাচ্ছ আশপাশে কুয়াশা, সাদা মেঘ। তুমি যেন প্রকৃতিরই প্রতীক।

ইভানা ঠোঁট উল্টে বলে, উরে বাবা, তুমি তো দেখছি শিল্পী মানুষ হে!

সৌরিক হাসতে থাকে। বলে, একটা রিকোয়েস্ট করব?

–করো।

–তোমার চুলটা খুলে রাখবে? প্লিজ! ইটস্ এ নাইস, লং হেয়ার! খোলা চুলে হেঁটে গেলে পিছন থেকে দারুণ লাগবে।

–ওকে। বলে চুলের গার্ডার খুলতে থাকে ইভানা।

#       #        #


আগের দিন মায়ের উপর অভিমান করে যে বিশাল পাথর খণ্ডের সামনে বসেছিল ইভানা। এখন সে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মা সেদিন সব ভুলে ডুব দিয়েছিল অতীতে। মেয়ে কোথায় আছে, তা নিয়ে কোনও হুঁশই নেই। এখন মায়ের প্রতি আর কোনও অভিমান নেই ইভানার। মায়ের সুগত আঙ্কল সম্পৃক্ত অতীত সে জেনেছে।bইভানা বুঝেছে মায়ের কষ্টটা। সুগত আঙ্কলকে দেখে মায়ের ওরকম অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

সেদিন এই পাথরের আড়ালে এসে বেশ শান্তি পেয়েছিল ইভানা। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ, লোকে বলে শায়িত বুদ্ধ। মনে হচ্ছিল বাবা শুয়ে আছে। বাবার মৃতদেহর সামনে সে একা। একেবারে বিচ্ছিন্ন এক মানুষ।

আজ অবশ্য ততটা বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে না। সৌরিক ক্যামেরা হাতে ঘুরছে আশেপাশে। তার সম্ভাব্য দর্শকদের সঙ্গে কথা বলছে। কাজটা বেশ লাগছে ইভানার। সৌরিক যেমন চাকরি ছেড়ে এটাকে প্রফেশন করবে ভাবছে, ইভানার তেমনটাই ইচ্ছে করছে। সে অবশ্য চাকরি করে না। ইনকাম শুরু করবে এটা দিয়েই। নানান জায়গায় বেড়াতে যাবে, পাহাড়, নদী, জঙ্গল, ঐতিহাসিক শহর… কিন্তু ব্যাপারটা কতটা সেফ? বাংলা ট্রাভেল ভ্লগগুলোতে অনেক মেয়েকেই দেখেছে ইভানা সে ক্ষেত্রে তার পুরুষ সঙ্গী ছবি তোলে। সোলো ট্রিপে কোনও মেয়ে গেছে, এমন কাউকে তো মনে পড়ছে না। যদিও ইভানা নিয়মিত ট্রাভেল ভ্লগ দেখে না।… ফোন বাজছে ইভানার। জিনসের পকেট থেকে বার করে মোবাইল। মা কল করেছে। কানে নেয় ফোন। বলে, বলো?

অপর প্রান্ত থেকে মা জিজ্ঞেস করে, তুই কোথায়?

–ওয়াচ টাওয়ারে।

… একা একা চলে গেলি।

–না, যাওয়ার কী আছে! কতইবা দূর! প্রথমবার দূর মনে হয়েছিল। এখন আর মনে হচ্ছে না। যেন পাড়ার মধ্যে আছি। বলে হাসতে থাকে ইভানা। ফের বলে, তবে একা আসিনি। এক ভ্লগারকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে এসেছি।

— বাব্বা, দু’দিনের মধ্যেই তুই তো দেখছি গাইড হয়ে গেলি এখানকার। অল্প হেসে বলল মা। তারপর জানায়, তোর দাদু ফোন করেছিল। খবর নিল সব। বলল তোকে ফোনে পাচ্ছে না।

–যখন করেছিল, তখন হয়তো টাওয়ার ছিল না। ভিউপয়েন্টে টাওয়ার কানেকশন খুবই উইক।

— যাইহোক, দাদুকে একটা ফোন করে নিস। আর তাড়াতাড়ি নেমে আয়।

–আচ্ছা। বলে ফোন কাটল ইভানা।

দাদুকে তো ফোন করতেই হবে। জানতে হবে কেন মাকে দরজা বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল? সুগত আঙ্কলের সঙ্গে বিয়ে হতে দেয়নি। দাদু তো পিছিয়ে পড়া মানুষ নয়। এ ছাড়া বিয়ের দিনের খবরটা কে দিয়েছিল দাদুকে? সব খবর জানতে হবে।

–চলো, এদিকে যা কাজ করার, হয়ে গেছে। এবার নীচে যাই। সামনে এসে বলল সৌরিক।

ইভানা জানতে চায়, নীচে মানে লোয়ার চটকপুর?

–নানা, এখনই যাব না। ব্রেকফাস্ট সেরে যাব বা লাঞ্চের পর। আপাতত হোমস্টেতে ফিরব।

–আচ্ছা। শর্টরুটে ফিরবে, না লং…?

–লংরুট কোনটা? জানতে চায় সৌরিক।

ইভানা আঙুল তুলে বলে, ওই যে বাঁশের বেড়ার রাস্তাটা।

–চলো, তা হলে। শর্টরুটে এসেছি, লংরুটে যাই।

–আমার হবে না। এখনই ফোন করেছিল মা। ডাকছে।

ইভানার কথা শুনে একটুক্ষণ চুপ করে রইল সৌরিক। তারপর কী ভেবে বলল, চলো, তোমার সঙ্গেই ফিরি।

ইভানা ফেরার রাস্তা ধরল। চুলের গার্ডারটা কব্জিতে রেখেছিল। চুলটা গুটিয়ে গার্ডার বাঁধতে বাঁধতে পাশে হাঁটতে থাকা সৌরিককে বলল, আজকের ভিডিওটা আমি কীভাবে দেখব?

–ইউটিউবে ‘ইশারা ট্র্যাভেল ভ্লগ’ সার্চ দেবে, ওখানেই পেয়ে যাবে ‘চটকপুর’।

বাঃ, তোমার চ্যানেলের নামটা তো দারুন!

–বাবা দিয়েছে।

–ও, আচ্ছা। বলার পর ইভানা জানতে চায়, ভ্লগটা দেখার পর আমার কেমন লাগল, তোমাকে কীভাবে জানাব?

–ফোন নম্বরটা সরাসরি চাইলেই হয়, অত ঘুরিয়ে চাওয়ার কী আছে? বলে জিনস্-এর পকেট থেকে মানিপার্স বার করে সৌরিক। সেখান থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড নিয়ে এগিয়ে ধরে ইভানার দিকে।

ইভানা ছদ্ম অভিমানে বলে, দরকার নেই কন্টাক্ট করার। তবে এটা মনে রেখো তোমার এই ভ্লগটাতে আমার কন্ট্রিবিউশন আছে। তোমার নিজেরই উচিত ছিল আমাকে কন্টাক্ট নাম্বারটা দেওয়া।

–আমি তো দিতামই। তার আগে তুমি চেয়ে বসলে। প্লিজ, কার্ডটা রাখো। বাচ্চাদের মতো রাগ করো না।

ইভানা কার্ডটা নিল। কিন্তু পড়ল না। লালের উপর সাদা লেখা। বেশ ডিফারেন্ট টাইপ। জিনস্-এর পকেটে কার্ডটা চালান করে দিল ইভানা। ওয়াচ টাওয়ারের মাঠ থেকে নীচের সিঁড়িতে পা রাখল ইভানা। হঠাৎ তার মাথায় এল, এই রুটে না এলেই ভাল হত। সুগত আঙ্কলদের হোমস্টেটা পড়বে এই পথে। ভোরের দিকে ওরা ব্যালকনিতে ছিল না। এখন হয়তো চা খেতে বসবে। ইভানার সঙ্গে সৌরিককে দেখে কী ভাবে, কে জানে!

পিছন থেকে সৌরিক বলে, আমার সঙ্গে যাবে তো লোয়ার চটকপুর?

–না, আমার ঘোরা হয়ে গেছে। কালপোখরিও গেছি।

–প্লিজ, আর একবার চলো। এই ভ্লগে তোমার ছবি যখন যাচ্ছে, পুরোটাই যাওয়া উচিত। নয়তো খাপছাড়া লাগবে।

–ছবি কোথায় যাচ্ছে, যাচ্ছে তো ছায়া। বলার পর সৌরিকের কোনও সাড়া না পেয়ে পিছন ফেরে ইভানা। দেখে সৌরিক একটা ফুলের ক্লোজ শট নিচ্ছে। ইভানা ঠিক বুঝতে পারছে না সৌরিক তার ব্যাপারে কতটা ইন্টারেস্টেড? খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না ছেলেটা। সৌরিকের জায়গায় অন্য কোনও ছেলে হলে এতক্ষণে সাবানের মতো গলে যেত। এমনটাই অভিজ্ঞতা ইভানার। আচ্ছা, ও কি এনগেজড? মনে হচ্ছে তাই। কিন্তু একথা তো জিজ্ঞস করা যাবে না। খেলো করা হয়ে যাবে নিজেকে। তার চেয়ে ওকে ফেসবুক খুঁজে নিয়ে স্ট্যাটাসটা দেখতে হবে। আবার পিছন ফেরে ইভানা। সৌরিক এখন ঘাড়ের কাছে। ইভানা জিজ্ঞেস করে, তুমি ফেসবুকে আছো?

–আছি। ‘ইশারা সৌরিক’ নামে।

–আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাব। যদি মনে হয় অ্যাকসেপ্ট করো।

–আচ্ছা।

–‘আচ্ছা’ মানে কি? অ্যাকসেপ্ট করবে, না কি না?

–আমার সঙ্গে আজ লোয়ার চটকপুর গেলে তবেই করব।

ছেলেটার তো পেটে পেটে বদমাইশি। ইভানা আর উত্তর করে না। আর একটু নামলেই সুগত আঙ্কলদের হোমস্টে। ভগবান করুন ওরা যেন চা খেতে না বসে।

সৌরিকের ফোন বাজছে। রিং টোনটা দারুন! সেতারের ফিউশন। ফোন ধরে সৌরিক বলল, এই তো এসে গেছি।

সৌরিকের বউ ফোন করল কি? সৌরিক হয়তো বিবাহিত। বউ হোমস্টেতে অপেক্ষা করছে। পরক্ষণেই নিজেকে শোধরায় ইভানা। না, বউ কী করে হবে? কালরাতে সৌরিক তো একাই এসেছে এখানে। তা হলে কে ফোন করল ওকে? সৌরিক যখন বলল ‘এসে গেছি’, তার মানে যে ফোন করল সে সৌরিকের হোমস্টেতেই আছে।… ভাবতে ভাবতে সুগত আঙ্কলদের হোমস্টের বারান্দায় পা রাখল ইভানা। এবং যা ভেবেছে, তাই হল, সুগত আঙ্কলরা চা খেতে বসেছে। তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার মা-ও এখানে!

চোখাচোখি হয়ে গেল অর্পিতা আন্টির সঙ্গে। আন্টি অবাক হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলছে, আরেঃ, তোদের কি আগে থেকে আলাপ ছিল?

কথাটা শুনে থতমত খেয়ে যায় ইভানা, দেখে পাশ থেকে সৌরিক এগিয়ে যাচ্ছে অর্পিতা আন্টির দিকে। বলছে, আজকেই আলাপ হল। আমাকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে গেল ওয়াচ টাওয়ারে।

ইভানা পায়ে পায়ে চায়ের টেবিলের দিকে এগোতে থাকে। এখন তার কাছে সব ক্লিয়ার। সৌরিক সুগত আঙ্কল আর অর্পিতা আন্টির ছেলে। মায়ের সঙ্গে ছেলের মুখের মিলও যথেষ্ট। অর্পিতা আন্টি তার ছেলেকে বলছে, ইভানা হচ্ছে তোর বাবার কলেজ বান্ধবীর মেয়ে। এই যে দিতি আন্টি।

মাকে দেখালো অর্পিতা আন্টি। সৌরিক হাতজোড় করে নমস্কার জানায় মাকে। বলে, আমি সৌরিক।

হোমস্টের ছেলে আরও দুটো চেয়ার এনে দেয় টি-টেবিলের কাছে। একটাতে বসে সৌরিক। অন্য চেয়ারটা টেনে এনে মায়ের পাশে বসল ইভানা। গলা নামিয়ে মাকে বলে, তুমি এখানে?

–সুগত গিয়ে নিয়ে এল। বলল চলো আমাদের হোমস্টতে। একসঙ্গে চা খাই। বলল মা।

ইভানার মুখোমুখি বসে আছে সুগত আঙ্কল। ঠোঁটে লেগে আছে পাতলা একটা হাসি। সৌরিক মাকে বলে, অনেক বছর পর অ্যাক্সডেন্টলি আপনাদের দেখা হল? মানে বাবা আর আপনার।

মা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায় মা। সৌরিক ফের বলে, ব্যাপারটা খুব সুইট। কিন্তু কেন এতদিন পর দেখা হল? আপনারা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকেন?

উত্তের মা বলল, না, আসানসোলে থাকি। কলেজ লাইফ পেরিয়ে গেলে যা হয়, যে যার নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ওদের কথা চলতে থাকল। ইভানা লক্ষ করে সুগত আঙ্কল দুই ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় তাকে কী যেন একটা জিজ্ঞাসা করছে! ইভানা মুখের এক্সপ্রেশনে জানতে চায়, কী বলছ? এবার সুগত আঙ্কল চোখ দিয়ে নিজের ছেলেকে দেখায়। মুখভঙ্গিতে জানতে চায়, কেমন লাগল। ইভানা অস্ফুটে বলে, বাজে।

সুগত আঙ্কল রাগ রাগ চোখ করে তাকায়। ইভানা হেসে ফেলে।




ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে ওয়েদার একদম পাল্টে গেল। না, পাহাড়ের নয়। ইভানার মনের। তার মন এখন ভীষণ বিষণ্ণ এবং বিক্ষিপ্ত। এটা হল দাদুকে ফোন করার পর। আজ সুগত আঙ্কলদের হোমস্টেতে বসে চা খাওয়ার পর সবাই মিলে গ্রামটা ঘুরতে বেরনো হয়েছিল। সৌরিকের সঙ্গেই ইভানার গল্প হচ্ছিল বেশি। সৌরিকের চা-বাগানের ম্যানেজারের কাজটা ভাল লাগছে না। তাই সকালে বলেছিল বাজে কোম্পানিতে চাকরি করি। লোক খাটাতে হয়। লোক খাটাতে হয় মানে গরিব মানুষ গুলোকে কষ্ট দিতে হয়। এটা বোঝা গেল পরের পর্বে কথা বলতে গিয়ে। ও টি-গার্ডেন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়েছে পাহাড়ের সান্নিধ্যে থাকবে বলে। সৌরিক ইভানাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেন ইকনমিক্স নিয়ে পড়ছ? ইভানা বলেছিল, কিছু একটা নিয়ে পড়তে হবে বলে পড়ছি। আমার সেরকম কোনও গোল নেই।

কথায় কথায় ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল ইভানা আর সৌরিক লাঞ্চের পর যাবে লোয়ার চটকপুর আর কালিপোখরি। গেল না ইভানা। ব্রেকফাস্টের পর একটু আলাদা হয়ে গিয়ে দাদুকে ফোন করেছিল। দাদু ‘কেমন আছিস? কী করছিস? বলে নেওয়ার পর ইভানা বলেছিল, তোমাকে একটা প্রাইভেট কথা জিজ্ঞেস করব। তুমি পাল্টা কোনও প্রশ্ন করবে না।

–ঠিক আছে। বল? বলেছিল দাদু।

ইভানা তখন বলে, মা যখন বাড়ি থেকে পালিয়ে সুগত আঙ্কলকে বিয়ে করতে যাচ্ছিল, তুমি মাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলে কেন? সুগত আঙ্কলের কোন ব্যাপারটা তোমার অপছন্দ ছিল?

দাদু অবাক গলায় জানতে চাইল, তুই এ সব কোথা থেকে জানলি?

ইভানা বলল, বলেছি না, পাল্টা প্রশ্ন চলবে না।

–ও আচ্ছা। বলে দাদু শুরু করল, সুগতকে আমার এমনি খারাপ লাগত না। তাই তোর মাকে আমি ওর সঙ্গে মিশতে বাধা দিইনি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করছিলাম, সুগতর বিয়ে-থা করে সংসার করার কোনও ইচ্ছে নেই। সারা জীবন বাউন্ডুলে হয়ে কাটাতে চায়। তোর মাকেও সেই দিকে টানছিল। তাই আমি তোর মাকে মিছিমিছি বলি ওর বিয়ে দেব। পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।

–কেন এই মিথ্যেটা বলেছিল? জানতে চেয়েছিল ইভানা।

দাদু বলল, ভাবলাম, আমার কথা শুনে তোর মা যদি বিয়ের জন্য চাপ দেয় সুগতকে, তখন নিশ্চয়ই সুগত চাকরি বাকরি কিছু একটা খুঁজবে। ও মা, তা না করে সুগত বেকার অবস্থাতেই তোর মাকে বিয়ে করতে উদ্যোগী হল। আমায় কিছু জানালো না।

ইভানা জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কার থেকে জানলে?

–একটা উড়ো ফোন এল। সে-ই জানালো। বলল দাদু।

ইভানা তখন জিজ্ঞেস করে, কোন মেয়ে ফোন করেছিল কি?

–হ্যাঁ, তুই কী করে জানলি?

দাদুর প্রশ্নের উত্তরে ইভানা বলেছিল, ওয়াইল্ড গেস। গলাটা কি বুলবুলি মাসির?

–গলা শুনে লোক চেনার ক্ষমতা আমার নেই। তবে সেই কারণেও তোর মাকে আমি ঘরবন্দি করিনি। আমি তো আর হিন্দি সিনেমার ভিলেন বাবা নই। মেয়ে অ্যাডাল্ট হয়ে গেছে। সে যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে। আমি বাধা দেওয়ার কে? আমি দিতিকে আটকাতে বাধ্য হলাম অন্য কারণে। বলে থেমেছিল দাদু।

ইভানা জিজ্ঞেস করল কী কারণ?

দাদু বলতে থাকল, সুগতর সম্বন্ধে একটা বাজে ইনফর্মেশন পেলাম। তার প্রমাণও এল হাতে। যা আজও আমার কাছে রক্ষিত আছে।

–কীসের প্রমাণ দাদু? বিষম কৌতুহল নয়ে জানতে চেয়েছিল ইভানা। এরপর দাদু যা বলল, তাতে মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল ইভানার। সে কোনওক্রমে জিজ্ঞেস করে, সেই প্রমাণটাও নিশ্চয়ই ওই মেয়েটিই পাঠিয়েছিল?

–হ্যাঁ, তবে নিজে আসেনি। একজনের হাত দিয়ে পাঠায়।

এরপরই দাদুকে ফোন রাখতে বলে ইভানা। দাদু জানতে চায়, কেন এতদিন পর এসব জানতে চাইলি বলবি তো?

–বলব। নিশ্চয়ই বলব। এখন রাখি। বলে ফোন কেটেছিল ইভানা। তারপর থেকে মাথা পুরো গরম হয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে মা আর সুগত আঙ্কলের বিয়েটা পণ্ড করার জন্য কেউ একজন মিথ্যে প্রমাণ দিয়েছিল দাদুকে। এবং সে সফল হয়েছে। এখন দেখতে হবে সেই মহিলাটি কে? বার বার মাথায় আসছিল বুলবুলি মাসির কথা। এদিকে মা বলছে বুলবুলি মাসি দাদুকে বিয়ের দিনটা বলেনি। সে মায়ের ক্ষতি করবে না। করলে আজ অবধি মায়ের সঙ্গে লেগে থাকত না। মায়ের আর কোনও বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ নেই ইভানার। কারুরই ফোন নাম্বার নেই তার কাছে তা হল কীভাবে জানা যাবে মায়ের পণ্ড হওয়া বিয়ের পিছনে কে ছিল?

লাঞ্চের পর সৌরিক ডাকতে এসেছিল। শরীর খারাপের ভান করে বিছানায় পড়ে রইল ইভানা। মাকে বলল, ওকে বলে দাও কালিপোখরি যাওয়ার মতো অবস্থা নেই আমার।

বলে দিল মা। তার একটু পরেই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল ইভানা। দেখল সৌরিক একজন স্থানীয় লোককে, মনে হয় সে গাইড, তাকে নিয়ে পাকদণ্ডী ধরে নামছে নীচে।

মা ব্যালকনিতে এসে বলৈ, এই যে বললি শরীর খারাপ। বিছানায় না শুয়ে এখানে চলে এলি কেন? একটু রেস্ট নে।

–বিছানায় শুয়ে থাকার মতো শরীর খারাপ নয়। পা ব্যথা করছে বড্ড। তাই সৌরিককে অ্যাভয়েড করলাম। বলেছিল ইভানা।

মা চলে গেল রুমে। এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বুলবুলি মাসিকেই একবার ফোন করবে ঠিক করল ইভানা। মায়ের সব চেয়ে কাছের বন্ধু সে। সেই সময়ের অনেক কথাই বলতে পারবে।

চেয়ার থেকে উঠে রুমের পর্দা সরায় ইভানা। দেখে মা অঘোর ঘুমে। তবু এখানে বসে কথা বলা ঠিক হবে না। যদি ঘুম ভেঙে যায়। ইভানা ফোন হাতে নিয়ে চলে যায় হোমস্টের লাগোয়া চাতালটায়। ওখানে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা আছে।

একটা চেয়ারে বসে ইভানা। মিষ্টি একটা রোদ পড়েছে চাতালটায়। একটা মা মুরগি বেশ কিছু বাচ্চা সহ উঠে এল চাতালে। তারপর নেমে গেল সামনের খেতে। ইভানা মোবাইলে বুলবুলি মাসির নাম খুঁজে কল করে। রিং হচ্ছে। ধরল বুলবুলি মাসি, আরেঃ, ইভানা! হঠাৎ ফোন? কী ব্যাপার? তোরা তো চটকপুরে। দিতি বলছিল যাবে।

–হ্যাঁ চটকপুরে। তুমি এখন ফ্রি আছো? একটু কথা বলা যাবে?

–হ্যাঁ, বল না। আজ তো আমার অফ ডে। ডিউটি নেই নার্সিংহোমে। তোর গলাটা অমন গম্ভীর শোনাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?

প্রশ্নটা এড়িয়ে ইভানা জানতে চায়, তুমি সুগত সেনগুপ্তকে চেনো?

–কে? অভিনেতা সুগত সেনগুপ্তর কথা বলছি্স? তাকে কে না চেনে?

–না, আমি মায়ের কলেজ বেলার বন্ধু সুগত সেনগুপ্তর কথা বলছি। যাকে তুমি ভাল করেই চেনো। হ্যাঁ, তিনি সিরিয়ালে অভিনয় করেন।

–হঠাৎ তার কথা উঠছে কেন?

–কারণ আছে। সে সব পরে বলছি। তুমি আমায় বলো সুগত আঙ্কল আর মা বিয়ে করতে যাওয়ার আগে কোথায় ব্লাড টেস্ট করিয়েছিল?

–তা বলতে পারব না। দু’জনের ব্লাডেই কোনও সমস্যা ছিল না, এটুকু শুধু জানি।

–ঠিক আছে। বাদ দাও। পণ্ড হওয়া ওই বিয়ের দিন তুমি কোথায় ছিলে?

–সুগতদার বাড়ি। মেয়েপক্ষ হয়ে গিয়েছিলাম। বিয়ের সাক্ষী হিসেবে রেজিস্ট্রি পেপারে সই করার কথা ছিল আমার।

–তারপর?

–তারপর আর কি দিতি আসছে না দেখে সুগতদা আমায় বলল ওদের বাড়ি যেতে। গেলাম। আমাদের ঢুকতেই দিল না তোর দাদু।

–আমাদের বলতে? তোমার সঙ্গে আর কে ছিল?

–অর্পিতা ছিল। যার সঙ্গে পরে বিয়ে হয়েছে সুগতদার।

–অর্পিতা আন্টি কোন পক্ষের ছিল?

–বরপক্ষ বলা যায়। সুগতদাই নিশ্চয়ই আসতে বলেছিল ওকে। অর্পিতা তো আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ত। ওর অবশ্য সায়ন্স।

–অর্পিতা আন্টিকে কেন ডেকেছিল সুগত আঙ্কল? বিশেষ কোনও রিলেশন ছিল কি? ইউনিয়নে আরও তো অনেক স্টুডেন্ট ছিল।

–সুগতদার তোর মায়ের সঙ্গেই শুধু রিলেশন ছিল। কেন অর্পিতাকে ডেকেছিল বলতে পারব না। তবে অর্পিতার নজর ছিল সুগতদার উপর।

–সেটা কী করে বুঝলে।

–সুগতদার উপর অনেক মেয়েরই নজর ছিল। তবে অর্পিতা একেবারে মরিয়া হয়ে গিয়েছিল। যখন আমি আর অর্পিতা দিতি আসছে না কেন দেখতে তোর মামার বাড়ি গেলাম, মেসোমশাই আমাদের হাঁকিয়ে দেওয়ার পর যখন ফিরে আসছি, অর্পিতা আমাকে বলেছিল, দিতি তো আসতে পারবে না। ওদিকে সবাই ওয়েট করছে। একটু পরে ম্যারেজ রেজিস্টারও এসে যাবে। তুই একটু সুগতদাকে বল না আমাকে বিয়ে করে নিতে। আমি বলেছিলাম, তোর কি মাথা খারাপ! লগ্নভ্রস্টা হওয়ার হাত থেকে মেয়েদের বাঁচাতে আজ পর্যন্ত ছেলেদেরই এগিয়ে আসতে দেখেছি। এখানে দেখছি উল্টো। এই কথা শুনে অর্পিতা বলেছিল, যা মেয়েদের বেলায় হয়, তা ছেলেদের ক্ষেত্রে হবে না কেন? আমরা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করব।

একটানা কথা বলে থামল বুলবুলি মাসি। ইভানার এদিকে তর সইছে না। জানতে চায়, তারপর তুমি কী বললে?

–বললাম। এখানে তো লগ্ন দেখে বিয়ে হচ্ছে না।

রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হচ্ছে। তাই সুগতদা লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার ভয় নেই। এই শুনে অর্পিতা বলেছিল, কিন্তু অপমানের তো ব্যাপার আছে। যাকে বিয়ে করবে, সে এল না। উপস্থিত নিমন্ত্রিতদের কাছে, মাথা হেঁট হবে সুগতদার। আমি তাকে সেই অপমান থেকে বাঁচতে পারি।

থামল বুলবুলি মাসি। ইভানা জিজ্ঞেস করল, তাপর তুমি কী করলে?

–আমি ফিরে এসে সুগতদাকে বললাম অর্পিতার ইচ্ছের কথা। কাক তাড়ানোর মতো কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিল সুগতদা। অথচ শেষমেশ অর্পিতাকেই বিয়ে করল। মাঝে বেশ কিছুদিন নিরুদ্দেশ ছিল। বলে থামল বুলবুলি মাসি। ফের বলে উঠল, সুগতদাকে তো চাকরি দিয়েছিল অর্পিতার বাবা। উনি খুব বড় ডাক্তার।

–জানি। ওঁর পুরো নাম কি গো?

–ডাক্তার রজত মজুমদার। কলকাতার বড় বড় হসপিটালে ভিজিট দিতেন। এখন আর পারেন না। বয়স হয়ে গেছে।

–ওঁর কি কোনও নার্সিংহোম আছে?

–না তো। কেন রে?

–এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

–হ্যাঁ রে, আজ এতদিন পর তুই এই সব জানতে চাইছিস কেন? কী লাভ!

–দেখো মাসি, ব্যাপারটা জানবার পর থেকে আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি মায়ের বিয়েটা ষড়যন্ত্র করে ভাঙা হয়েছে। মা সরল সাদা সিধে মানুষ। এটা নিয়ে তেমন তলিয়ে কিছু ভাবেনি। তুমি, দাদু তোমরা সব মায়ের মতোই। টের পাওনি বদমাইশিটা।

–কিন্তু দীপঙ্করদাকে বিয়ে করে দিতি তো সুখী হয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক দীপঙ্করদা অকালে চলে গেল। সে যে কেউ যখন খুশি যেতে পারে। তার মানে এই নয় যে সুগতদার সঙ্গে বিয়ে হলে দিতি বেশি সুখী হত।

–হতেই পারত। মা ভালবাসত সুগত আঙ্কলকে। তাকে না পেয়ে কষ্ট চেপে বাবার সংসারে সুখী হওয়ার চেষ্টা করে গেছে এবং সব সময় বিশ্বস্ত থেকেছে নিজের দাম্পত্যে। লুকিয়ে যোগাযোগ রাখেনি প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে।

–আচ্ছা, তুই এত বড় বড় কথা বলছিস, সুগতদার সঙ্গে মায়ের বিয়ে হলে তুই তো জন্মাতিসই না। উপভোগ করতে পারতিস না এই সুন্দর পৃথিবীটাকে।

–জন্মে যখন গেছি, মায়ের উপর যে বঞ্চনাটা হয়েছে তার শোধ আমি নেবই। মা আমার জীবনে সব চেয়ে প্রিয় মানুষ।

–সত্যি, তোর মতো মেয়ে হয় না। আমার মেয়েটা যদি এরকম হত।

বুলবুলি মাসির কথা শুনে হেসে ফেলে ইভানা। বলে কেন, তোমারও মায়ের মতো কোনও কেস ছিল কি কলেজ লাইফে?

বুলবুলি মাসি অপ্রস্তুত গলায় বলে, আরে না না, আমি কি তোর মায়ের মতো অত সুন্দরী নাকি? আমার দিকে সে ভাবে কেউ তাকাতোই না।

–তুমি যথেষ্ট সুন্দর মাসি। উল্টো পাল্টা বকো না। এখন রাখছি।

–না, দাঁড়া। তোরা ফিরছিস কবে?

–কাল রওনা দেব। পরশু পৌঁছে যাব সকালে।

–তোরা ফিরে আয়। একদিন যাব তোর মামার বাড়ি। শুনবো দিতির ব্যাপারটায় কতদূর কী করতে পারলি।

–আচ্ছা। এসো। বলে ফোন কাটল ইভানা।

এখন আর রোদ নেই। ছায়া ছায়া চারপাশ। ইভানার পরনে প্লাজো আর কুর্তি। গরমের কিছু পরে নেই। শীত শীত লাগছে। আবার ডাকছে সেই পাখিটা, চিইইপ, চিইইপ। পাখিটাকে খোঁজার উৎসাহ পাচ্ছে না ইভানা। সে আন্দাজ করতে পারছে সুগত আঙ্কলের সঙ্গে মায়ের প্রেম ভাঙার পিছনে কে ছিল। এখন শুধু সেটা প্রমাণ করতে হবে। মোবাইল ফোনটা চোখের সামনে নিয়ে লক খোলে ইভানা। তারপর গুগল-এ সার্চ দেয়, ডক্টর রজত মজুমদার।




সকাল। আজ ইভানারা ফিরে যাবে। সুগত আঙ্কলরাও ফিরবে। তবে ওরা যাবে মেটেলি। সৌরিকের কোয়ার্টারে। মা আজ ওদের ব্রেকফাস্টে নেমতন্ন করেছে। ইভানাদের হোমস্টের লাগোয়া চাতালটায় মায়ের নির্দেশে টেবিল চেয়ার পেতে দিয়েছে হোমস্টের লোকেরা। সেখানকার দুটো চেয়ারে বসে আছে মা আর ইভানা। অপেক্ষা করছে সুগত আঙ্কেলদের জন্য।

আজ ভোর থেকেই মেঘ আড়াল করে আছে পাহাড় শৃঙ্গ। বেলা যত বাড়ছে নীচ থেকে উঠে আসছে মেঘ।

নিয়ম মতো আজ দশটাতেই চেক-আউট করার কথা ইভানাদের। এদিকে এন জে পি থেকে ট্রেন সেই রাতে। তার মানে অনেকক্ষণ এন জে পি স্টেশনে ইভানাদের বসে থাকতে হবে। সমস্যাটা গতকাল হোমস্টের মালিককে বলেছিল মা। তিনি বললেন, কই বাত নেহি, আপ লাঞ্চ করকে ইঁহা সে যাইয়ে। কাল মেরা ওহ রুম বুক নেহি হ্যায়।

তাই ইভানারা আজ লাঞ্চ করেই বেরোবে। গাড়ি বলে দেবে হোমস্টের মালিক। সুগত আঙ্কলরা কখন বেরোবে জানে না ইভানা।

ওই তো সুগত আঙ্কলরা আসছে সিঁড়ি ভেঙে।

কিন্তু ওদের সঙ্গে সৌরিক নেই কেন?

–গুড মর্নিং, গুড মর্নিং। বলতে বলতে চাতালে নেমে এল সুগত আঙ্কল। পাশে একমুখ হাসি নিয়ে অর্পিতা আন্টি।

মা জানতে চাইল, সৌরিক কোথায়? এল না কেন?

চেয়ারে বসতে বসতে অর্পিতা আন্টি বলল, আসবে, একটু পরে জয়েন করবে। বলল, তোমরা যাও আমি কিছু ছবি তুলে আসি।

সুগত আঙ্কল বসে পড়েছে চেয়ারে। মা বলে, এখন তা হলে আমরা চারজন মিলে একটু চা খাই। সৌরিক এলে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করতে বলব।

–সেই ভাল। বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল সুগত আঙ্কল।

ইভানা দেখল মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মানেটা বুঝে ইভানা চেয়ার ছেড়ে চাতালের পিছনে কিচেনের জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। হোমস্টের মহিলাটি সম্ভবত ইভানাদের ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে গ্যাস অভেনে। ইভানা বলে, হাম লোগো কো চার চায়ে দিজিয়ে গা।

–দেতা হুঁ দিদি। বলল মহিলা।

ফিরে আসছে ইভানা, শুনতে পায় অর্পিতা আন্টি মাকে বলছে দিতি, তোমার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ কবে? ওর কি কাউকে ঠিক করা আছে?

–কেন বলো তো? জানতে চায় মা।

অর্পিতা আন্টি বলে, সেটা পরে বলছি। আগে বলো ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে কিনা?

–ও কাউকে পছন্দ করে রেখেছে কিনা জানি না। তবে ওর বিয়ে নিয়ে এখনও কিছু ভাবিনি।

–কী, কাউকে কথা দেওয়া আছে নাকি? ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল সুগত আঙ্কল।

ইভানা বলল, না। কাউকে ঠিক করা নেই। কিন্তু কেন সব জানতে চাইছ বলো তো।

অর্পিতা হেসে নিয়ে বলল, ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে। এতক্ষণে বুঝে যাওয়া উচিত কেন জানতে চাইছি। আমরা তোমাকে বউমা হিসেবে পেতে চাইছি। সৌরিককে জিজ্ঞেস করেছি, ওর অমত নেই।

–কিন্তু তোমাদের ফ্যামেলিতে তো বিয়ে করা যাবে না। তোমাদের এডস আছে।

ইভানার কথা শুনে বাকি তিনজন চমকে ওঠে। দিতি বলে, এসব কী বলছিস তুই! পাগল হয়ে গেলি নাকি?

–আমি যে পাগলামি করছি না, সেটা এখানে একজন ভাল মতোই বুঝেছে। দাদু যে তোমাকে ঘরে তালা চাবি দিয়ে রেখেছিল, সেটা এই কারণেই। দাদুকে একজন সুগত আঙ্কলের ব্লাড রিপোর্ট পাঠায়। বিয়ের আগে তোমরা দু’জন যে ব্লাড টেস্ট করিয়েছিলে, যে রিপোর্টে কোনও সমস্যা ছিল না, তারই একটা দাদুর কাছে পাঠানো হয়, তাতে লেখা ছিল সুগত আঙ্কলের এডস্ আছে। দাদু জানত তুমি এতটাই সুগত আঙ্কলকে ভালবাস, এড্‌স শোনার পরও বিয়ে করবে। তাই তোমাকে রিপোর্ট সম্বন্ধে কিছু না বলে বিয়ের দিন আটকে রেখেছিল। এক নারী কণ্ঠ ফোনে দাদুকে বিয়ের দিন ও সময় বলে দিয়েছিল।

থামল ইভানা। বাকি তিনজনের মধ্যে দু’জন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইভানার দিকে। অর্পিতার মাথা নিচু। ফের ইভানা বলতে থাকে, লাইফ কেয়ার স্ক্যান সেন্টারে ব্লাড টেস্ট হয়েছিল তোমাদের। ওই ক্লিনিকটা অর্পিতা আন্টির বাবার।

–টেস্ট কোথায় হয়েছিল জানি না। রিহার্সাল রুমে এসে একটা লোক দু’জনের রক্ত নিয়ে গিয়েছিল। বলল দিতি।

ইভানা বলে, দাদুর কাছে এখনও সে রিপোর্ট আছে। ফোনে ছবি তুলে পাঠিয়েছে আমাকে। এই কারসাজিটা করেছে অর্পিতা আন্টি। যেহেতু ওদের ক্লিনিক আছে, তাই সুগত আঙ্কল হয়তো অর্পিতা আন্টিকে বলেছিল কাউকে পাঠিয়ে দুজনের ব্লাড নিয়ে যেতে। কী তাই তো?

ইভানা প্রশ্নটা করল সুগত আঙ্কলের দিকে তাকিয়ে। অল্প অল্প মাথা নাড়ছে সুগত আঙ্কল। অর্থাৎ অনুমান নির্ভুল।

কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করছে না ইভানার। কান মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। তবু বলতে তো হবেই। এত সহজে অর্পিতা আন্টিকে ছাড়া যাবে না। ইভানা বলতে থাকে, জানো মা, এখানে তোমাকে দেখার পর থেকে অর্পিতা আন্টি ভাল মানুষের মতো তার বরকে তোমার সঙ্গে আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। আমার কাছে ব্যাপারটা আশ্চর্য ঠেকেছিল। সবটা বোঝার পর এখন আর আশ্চর্য লাগছে না। অর্পিতা আন্টি নিজেদের ক্লিনিকের একটা ফলস রিপোর্ট দাদুকে পাঠায়, যাতে ওই রোগটা লেখা ছিল। তোমাদের কাছে আসে সঠিক রিপোর্ট। সেই অপরাধ বোধ থেকেই তোমার সঙ্গে এখন ভাল ব্যবহার করছে অর্পিতা আন্টি। আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছে ছেলের। কিন্তু এই অপরাধ বোধের আর তো কোনও মানে নেই। তুমি তো ফিরে পাবে না তোমার প্রাপ্য জীবন।

অর্পিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ইভানা তখনও তার মায়ের উদ্দেশে বলে যাচ্ছে, তুমি বিয়ের আসরে আসছ না দেখে বুলবুলি মাসি আর অর্পিতা আন্টি খবর নিতে গিয়েছিল তোমার। দাদু বাড়িতে ঢুকতে দেয় নি। ফেরার পথে অর্পিতা আন্টি বুলবুলি মাসিকে বলে তুই সুগতদাকে আমায় বিয়ে করে নিতে বল। সে হল এতটাই সুযোগ সন্ধানী। তার কাছে তোমাদের ভালবাসার কোনও মূল্য নেই।

–তুই চুপ করবি। বলে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল মা। এবার ইভানার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। উপচে আসছে চোখের জল। ঝাপসা চোখে ইভানা দেখে ফিরে যাচ্ছে অর্পিতা আন্টি। সুগত আঙ্কল হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মা-মেয়ের দিকে। এই সময় হোমস্টের মহিলা ট্রে-তে করে চা নিয়ে এল। ট্রে-টা নামিয়ে রাখল টেবিলে। চা না খেয়েই উঠে গেল সুগত আঙ্কল।




লাঞ্চ সেরে গাড়িতে উঠে পড়েছে ইভানারা। এবার ফেরার পালা। পাকদণ্ডী বেয়ে নামছে ইভানাদের গাড়ি। খাদ থেকে মাথা তুলে আছে পাইন ওক দেবদারু… সৌরিকরা সম্ভবত ব্রেকফাস্টের পরই চলে গেছে। ওদের বুক করা গাড়িটা দেখা যায়নি।

গাড়ির পিছনের সিটে ইভানার পাশে উদাসীন ভাবে বসে আছে মা। কী ভাবছে, কে জানে! সকালে মেয়ের ওই রূপ আগে কখনও দেখেনি। নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হয়েছে। তারপর থেকে মা দরকার ছাড়া একটা কথাও বলেনি ইভানার সঙ্গে। আচ্ছা, সকালে যখন অর্পিতা আন্টির উপর রাগ বর্ষণ করছিল ইভানা, তখন কি তাকে খুব নিষ্ঠুর লাগছিল দেখতে? তার রেশ কি এখনও রয়ে গেছে মুখে? কাঁধে ঝোলানো সাইড পার্সটা খোলে ইভানা, হাত আয়নাটা নেবে। কিন্তু হাতে উঠে এল সৌরিকের সেই লালরঙের ভিজিটিং কার্ড। কার্ডটা পড়েও দেখেনি ইভানা। পড়ার আর দরকারও নেই। গাড়ির জানলা দিয়ে কার্ডটা বাইরে উড়িয়ে দেয় ইভানা। এমন সময় কানে আসে চিইইপ, চিইইপ। সেই পাখিটার ডাক। জানলার বাইরে তাকায় ইভানা সৌরিকের লাল কার্ড হাওয়ায় ওলোট পালোট খেতে খেতে উড়ে যাচ্ছে, যেন সেই পাখিটা!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *