রাখী নাথ কর্মকার
এ কথা তো সর্বজনস্বীকৃত যে, মানুষ গল্প শুনতে ভালবাসে, আর গল্পের প্রতি মানুষের এই সহজাত আকর্ষণের জন্ম কিন্তু সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই। সাধারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর, সহজসরল মাটির মানুষের সুখদুঃখ, আনন্দবেদনা, ভালমন্দের ধ্যানধারণা, তাদের স্বতন্ত্র ধর্ম বিশ্বাস ও সামাজিক রীতিনীতিকে উপজীব্য করে গড়ে ওঠে যে লোক-সাহিত্য, তা আসলে স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও সনাতন পরম্পরারই এক সমৃদ্ধ আকর। যুগের পর যুগ ধরে মানুষকে মোহিত করা সেই বৈচিত্র্যময় লোক-কথার নানা রূপ, নানা চেহারা, নানা চরিত্র রয়েছে। কিছু কিছু লোক-কথা আছে, যা কোনও নির্দিষ্ট স্থানে কোনও এক সময় ঘটে যাওয়া কোনও অলৌকিক, আশ্চর্যজনক ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে আমাদের সামনে। এই ধরনের লোক-কথাকে অনেক স্থানেই ‘local tradition’ বলা হয়ে থাকে। আবার যে সব লোক-কথার উপজীব্য বিষয় মনুষ্য চরিত্র ও পশু-পক্ষীর চরিত্র, সেই সব লোক-কথাকে ‘অ্যানিমল টেল’ বলা হলেও যখন সেই সব গল্পের শেষে নীতিউপদেশ তুলে ধরা হয়, তখন সেগুলি হয়ে যায় ‘নীতিকথা’! ঠিক যেমন আমাদের ‘পঞ্চতন্ত্র’, বা ‘হিতোপদেশ’। বস্তুত, পৃথিবী বা ঐশ্বরিক/ অতিমানবীয় জগতের বা মানব সভ্যতার সূচনার পূর্বে কোনও জাতির সৃষ্টির রহস্য তুলে ধরা হয় যে লোকাতীত কল্পকাহিনী দ্বারা, তাকে ইংরেজীতে ‘মিথ’ বা বাংলায় ‘পুরাকাহিনী’ বলা হলেও কোনও অঞ্চলের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যময় প্রাকৃতিক জগতের উৎপত্তি গল্প যা অলৌকিক বিশ্বাস, অতিপ্রাকৃত বা দৈব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়, তা ‘অরিজিন মিথ’ বলেই সবিশেষ পরিচিত।
অবশ্য অনেক গবেষকই মিথকে লোক-সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করার প্রতি এক মৃদু অনীহা প্রদর্শন করেন। এই সব মিথ বা অতিকথাগুলিকে নিতান্তই অসম্ভব, অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব মনে হলেও সেইসব আদিম জনজাতিগোষ্ঠীর মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস প্রোথিত থাকে, যে সেগুলি আক্ষরিক অর্থেই সত্য ও নির্ভুল। বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুবাদে সেখানকার বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী, নেটিভ ইন্ডিয়ান আমেরিকান গাইড বা পার্ক রেঞ্জারদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। সেই সময়, সেইসব স্থানবিজিড়িত তেমনই কিছু অত্যাশ্চর্য অরিজিন মিথ ও কিংবদন্তী তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম আমি। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় খেয়াল করেছিলাম, আজও সেইসব কাল্পনিক ঘটনা বা কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে রচিত কল্প-কাহিনী বা সেই সব কিংবদন্তী … এই সব আদিম আদিবাসী গোষ্ঠীরা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। তাদের মধ্যেই কয়েকটি কৌতূহলউদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক অরিজিন মিথ ও কিংবদন্তী তুলে ধরলাম আমি এখানে।
ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক
বিশ্বের প্রথম ও প্রাচীনতম ন্যাশনাল পার্ক হল ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের বেশিরভাগ অঞ্চল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইয়োমিং রাজ্যে অবস্থিত হলেও কিছু অংশ পার্শ্বরাজ্য মন্টানা ও আইডাহোতেও রয়েছে। ইয়েলোস্টোনের সমৃদ্ধ ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশটি নেটিভ আমেরিকান উপজাতি এসে তাদের বসতি স্থাপন করেছিল এই অঞ্চলে! এই অঞ্চলে বসবাসকারী নেটিভ আমেরিকান উপজাতিদের অনেকেরই নিজস্ব অরিজিন মিথ রয়েছে, যা মূলত ইয়েলোস্টোনের অরিজিন মিথেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঠিক যেমন ‘কিওয়া’ উপজাতির মানুষজন ইয়েলোস্টোনকেই তাদের উপজাতির উৎপত্তিস্থল হিসেবে দাবী করে। তাদের পুরা-কথা বলে, সৃষ্টির সূচনাপর্বে, পৃথিবী তৈরির মুহূর্তে কিওয়াদের কোনো নিজস্ব বাসভূমি ছিল না। তাদের সৃষ্টি করেছিলেন যে দেবতা, সেই দেবতা ‘দো কি’ তাদের বসতি স্থাপন করার জন্যে উত্তপ্ত সালফারযুক্ত ও গরম জলে পরিপূর্ণ একটি অনুর্বর মরুভূমির দিকে যাত্রা করতে বলেছিলেন। অবশেষে এক দীর্ঘ যাত্রার শেষে কিওয়ারা যখন একটি ফুটন্ত জলাশয়ের পাশে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারা স্থির করেছিল সেখানেই তারা তাদের বসতি স্থাপন করবে। ঐ ফুটন্ত জলাশয়টি তাদের কিওয়া ভাষায় ‘তুং সাউ দাহ’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। সেই সুবিস্তীর্ণ, অনুর্বর অঞ্চলটিকেই দেবতা ‘দো কি’ তাদের বাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই ‘কিওয়া’ উপজাতির মানুষজন বিশ্বাস করে থাকে, এই ইয়েলোস্টোনেই তাদের উপজাতির উৎপত্তি হয়েছিল।
আবার ইয়েলোস্টোনের উৎপত্তি নিয়ে ‘শোশোন’ উপজাতিদের পুরা-কথাটিও ভারি সুন্দর। এই পুরা-কথা মতে, একবার পৃথিবী মাতা তাঁর নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেই সময় এক ধূর্ত কয়োটি এক ক্ষুধার্ত ভ্রমণকারীর ছদ্মবেশে পৃথিবী মাতার কাছে এসে কিছু মাছ সিদ্ধ করে দিতে অনুরোধ জানায়। পৃথিবীমাতা দয়াপরবশ হয়ে সেই কয়োটিকে জানান –“আমি অবশ্যই তোমায় মাছ সিদ্ধ করে দেব। কিন্তু সাবধান, তুমি যেন ভুলেও আমার মাছের পাত্র স্পর্শ না করো!” কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী! কয়োটির জন্যে পৃথিবীমাতা মাছ সিদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই ধূর্ত কয়োটির আর তর সইল না, সে হুড়মুড়িয়ে মাছের পাত্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই সেই উলটে পড়া পাত্রের মাছ, জলটল সমস্ত চারিদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে গিয়ে জন্ম হল ইয়েলোস্টোন লেক ও স্নেক রিভারের।
এছাড়াও ‘ক্রো’ উপজাতিদের কিংবদন্তীতেও লুকিয়ে রয়েছে ইয়েলোস্টোনের সৃষ্টি রহস্য। একদা এক বৃদ্ধ মহিলার নাতি নাকি এই অঞ্চলের প্রচুর জীবজন্তুর সঙ্গে বীর বিক্রমে লড়াই করে তাদের সকলকে পরাজিত করেছিলেন। তার এমন অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, যে তিনি সেইসব পরাজিত প্রাণীদের সকলকেই পর্বত আর পাহাড়ে পরিণত করে দিয়েছিলেন। তার কিছু পরে একটি বাইসন আর একটি পাহাড়ি সিংহের সঙ্গে তার লড়াই হলে তাদেরও মহা বিক্রমে পরাস্ত করেছিলেন তিনি। তারপর সেই বাইসন আর পাহাড়ি সিংহকে তিনি জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন। সেই সব প্রাণীদের গরম শ্বাসপ্রঃশ্বাস থেকেই নাকি জন্ম হয়েছিল পার্কের দুটি গীজারের! ইয়েলোস্টোনের উৎপত্তি নিয়ে আদিম বিভিন্ন উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত আশ্চর্য সব মিথ ও কিংবদন্তী ঘাঁটতে বসলে তার আর তলই খুঁজে পাওয়া যাবে না, তাই আপাতত ইয়েলোস্টোনের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে এবার না হয় পা রাখা যাক অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়নের তরঙ্গময় গুহাগহ্বরে!
অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়ন
অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়নে পৌঁছেই আমরা আমাদের গাইড হিসেবে পেয়েছিলাম বছর কুড়ির নাভাহো যুবক আস্কিকে। নাভাহো উপজাতির মানুষদের কাছে এই অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়ন অঞ্চলটি গভীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যবিশিষ্ট এক পবিত্র স্থান। তাই অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়নে প্রবেশ করার আগে ঠিক আমাদের মন্দিরে প্রবেশ করার মতোই ক্যানিয়নের প্রবেশপথে কয়েক সেকেন্ড শ্রদ্ধায় নতমস্তকে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা জানিয়েছিল সে। নাভাহোদের কাছে, এই গিরিখাত আসলে প্রকৃতিমায়ের উপহার, প্রকৃতির অনন্ত শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক। আস্কি আমাদের জানিয়েছিল, প্রতি মরসুমের শুরুতেই সে প্রকৃতিমায়ের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ আনুষ্ঠানিক প্রার্থনার আয়োজন করে যাতে তার যাত্রাপথের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
অ্যারাইজোনার অবিশ্বাস্য সুন্দর প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পদশালী এক শহর পেজ। পেজের সুপ্রাচীন স্যান্ডস্টোন অঞ্চলে অবস্থান করছে বিশ্বের দুটি ‘মোস্ট ফটোগ্রাফড ল্যান্ডমার্কস ইন দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ – অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়ন এবং হর্সশু বেন্ড। এই দুটি স্থানের সৌন্দর্য ভাষায় অবর্ণনীয়। ‘নাভাহো’ শব্দটির মানে হল ‘প্লেস অফ লার্জ প্ল্যান্টেড ফিল্ডস’। এই অঞ্চলে বসবাসকারী নাভাহো উপজাতিদের লোক-কথা অনুসারে, বহু বহু যুগ আগে, যখন পৃথিবীতে প্রথম মানব এবং প্রথম মানবী আবির্ভূত হয়েছিল, তখন দেবী স্পাইডার ওম্যান তাদের কীভাবে বুনন করতে হয় তা শিখিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি আকাশ থেকে সূর্যরশ্মি, স্ফটিক এবং বিদ্যুতের সাহায্যে একটি তাঁতযন্ত্র তৈরি করেছিলেন। সেই বুননের সরঞ্জামগুলি প্রাথমিকভাবে সূর্যের আলো থেকে তৈরি হয়েছিল। আর স্পিন্ডলগুলি তৈরি হয়েছিল বজ্র এবং বিভিন্ন মূল্যবান পাথর থেকে। তিনি পৃথিবীর প্রথম পিতামাতাকে একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন – যদি তারা বুনতেই থাকে তবে তাদের বাচ্চাদের লালনপালনের জন্যে কোনদিনই কোন চিন্তা করতে হবে না। নাভাহো উপজাতির মধ্যে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন জটিল সৃষ্টি রহস্য বা ‘অরিজিন মিথ’। সেই গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন এই স্পাইডার ওম্যান। স্পাইডার ওম্যান হলেন আসলে এক আধ্যাত্মিক ধাত্রী, একজন অভিভাবক যিনি প্রথম মানুষের বিবর্তনে সহায়তা করেছিলেন। মানুষকে যত্ন সহকারে শিখিয়েছিলেন বছরের পর বছর ধরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিব্রাজনের মধ্য দিয়েও কীভাবে চারপাশের সমস্ত প্রাণী ও জড় বস্তুগুলির সাথে মিল রেখে জীবনযাপন করা যায়। নাভাহোদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই স্পাইডার ওম্যানই রহস্যজনকভাবে পার্থিব জগত এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বকে তাঁর সূক্ষ্ম সিল্কের সুতোর সাহায্যে একসঙ্গে বুনে রেখেছেন। একটি নাভাহো লোক-কথা মতে, যতক্ষণ মানুষ হাজার বিশৃঙ্খলার মাঝেও এইভাবে প্রতিটি বস্তু, ব্যক্তি, প্রাণীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সংযুক্ত থাকবে, ততদিনই তারা সাফল্য লাভ করবে। নাভাহোদের কাছে তাই অত্যন্ত পবিত্র স্থান হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের জন্যে এই অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়নের দ্বার সবসময়েই উন্মুক্ত, কারণ নাভাহোরা মনে করে, বহির্বিশ্বের মানুষজনের কাছেও প্রকৃতির এই মহিমান্বিত আশ্চর্য তুলে ধরা প্রয়োজন।
ব্রাইস ক্যানিয়ন
এবার নেমে আসা যাক দক্ষিণ ইউটার পনসাগান্ট মালভূমির পূর্বপ্রান্ত জুড়ে অবস্থিত ব্রাইস ক্যানিয়নের মায়াবী নগরীর বুকে। এই ক্যানিয়নের উত্তরভাগ জুড়ে যে পরিমাণ হুডূ দেখা যায়, পৃথিবীর আর কোত্থাও তা এমন পর্যাপ্ত ও বহুল পরিমাণে দেখা যায় না! জিওলজিক্যাল সংজ্ঞাঅনুযায়ী হুডূ আসলে লম্বা, শীর্ণপাথরের সূচ্যগ্রভাগ যা রুক্ষশুষ্ক উপত্যকা ও অসমতল ভূমি থেকে বহিঃসারিত হয়েছে। ব্রাইসের উচ্চতা, প্রাকৃতিক শক্তিগুলির ক্ষয়সাধনের তীব্রতা, আবহাওয়া, পাথরের প্রকৃতি…এইসব উপাদান একদম সঠিক অনুপাতে মিলিয়েমিশিয়েই প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে পাথুরে শৃঙ্গসমূহের এই অদ্ভুত, অনুপম, বিরল সব ভাস্কর্য।
পালিও ইন্ডিয়ানস থেকে শুরু করে আনাসাজি, ফ্রেমন্ট পিপল, পাইউট ইন্ডিয়ান –অনেকেই ব্রাইস ক্যানিয়নে একসময় বসবাস করে গিয়েছে। পাইউট মিথ অনুসারে ব্রাইস ক্যানিয়নের অরিজিন মিথটি বেশ আকর্ষণীয়। পাথরশরীরের এইধরনের অদ্ভুত আকৃতির জন্যেই হয়ত ব্রাইস ক্যানিয়নের প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠী পাইউট ইন্ডিয়ানরা মনে করত, ক্যানিয়নে এই অদ্ভুত লাল পাথরের হুডূগুলো আসলে একসময় এই অঞ্চলে বসবাসকারী ‘Evil legend People’ বা ‘To-when-an-ung-wa’। পাইউট ইন্ডিয়ানরা এই রহস্যময় শিলাকৃতিগুলোকে বলত Anka-ku-was-a-wits, যার মানে ‘রেড পেইন্টেড ফেস’। তারা বিশ্বাস করত, এইসব ‘Evil legend People’… এরা মানুষের মতো দেখতে হলেও আসলে তারা ঠিক মানুষ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল নানা ধরনের পশুপাখী, জন্তুজানোয়ার। তারা যখন যেমন ইচ্ছে তেমন রূপ ধারণ করার অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল। স্বভাবে কিন্তু তারা মোটেই সুবোধ ছিল না, বরঞ্চ ভয়ানক দুষ্ট ছিল। তাই একটা সময় তাদের ব্যবহারে রুষ্ট হয়েই নাকি মহান আত্মা কয়োটি এইভাবে সেইসব ‘Evil legend People’দের পাথরে পরিণত করে দিয়েছিলেন।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন
দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন আসলে বৈচিত্র্যময় ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের এক অনুপম মেলবন্ধন। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে কেন্দ্র করেও ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতিদের মধ্যে বিভিন্ন আশ্চর্য লোক-কথা, নানা ‘অরিজিন মিথ’ প্রচলিত আছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – হাভাসুপাই উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত এক সুন্দর মিথ, যা প্রকারান্তরে হাভাসুপাই উপজাতি ও সমগ্র মানবজাতিরই ‘অরিজিন মিথ’!
সে ছিল বহু বহু যুগ আগের কথা। পৃথিবীর সূচনালগ্নে যখন পৃথিবীতে কোনও মানুষের জন্ম হয়নি, তখন সেখানে বাস করতেন দুই দেবতা। ভালোর দেবতা ছিলেন তোচাপা আর মন্দের দেবতা ছিলেন হোকোমাতা। তোচাপার পু-কে-এ নামের একটি কন্যা ছিল। তোচাপা মনে করতেন, একদিন তাঁর এই মেয়েই একদিন পৃথিবীর সমস্ত জীবের জন্ম দেবে। কিন্তু দুষ্ট দেবতা হোকোমাতা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন যে এমন কিছু ঘটতে দেওয়া যাবে না। এবং সে কারণেই হঠাৎই তিনি এক বিধ্বংসী, ভীষণ বন্যায় পৃথিবীকে প্লাবিত করে দিলেন। তোচোপা হোকোমাতার দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই শক্তপোক্ত দেখে একটা বড় গাছ কেটে সেটির কাণ্ড ফাঁপা করে দিলেন। এরপর তিনি পু-কে-একে ঐ ফাঁপা গাছের কান্ডের মধ্যে সঙ্গোপনে রেখে দিলেন। তারপর একটা সময় সেই ভয়ঙ্কর বন্যা যখন পৃথিবীর সমস্ত কিছুই প্লাবিত করে দিল, সেই শক্তপোক্ত নৌকায় কিন্তু নিরাপদেই বেঁচে রইলেন পু-কে-এ।
অবশেষে বন্যার নেমে এল, যত পাহাড়পর্বত বন্যার জলে ডুবে গিয়েছিল, সে সবের চূড়া এক এক করে জলের তলা থেকে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করল। বিভিন্ন নদীর সৃষ্টি হল, এবং তাদের মধ্যে একটি নদীর গভীর ক্ষয়কার্যে জন্ম নিল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন।
পু-কে-এর নৌকা তাঁকে এখন পৌঁছে দিল এক নতুন পৃথিবীতে। নৌকা থেকে বেরিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে পু-কে-এ উঁকি মেরে দেখলেন, এই নতুন পৃথিবীতে কেউ কোত্থাও নেই!
অবশেষে যখন মাটি শুকিয়ে এল, তখন আকাশের পূর্ব দিকে একটি মহান সোনালী সূর্য উদিত হল এবং সেই সূর্যের রশ্মি পৃথিবীকে উষ্ণ করে পু-কে-একে সন্তানসম্ভবা করে তুলল। ফলে, নির্দিষ্ট সময় পরে, তিনি একটি পুরুষ সন্তানের জন্ম দিলেন। কিছুদিন পরেই একটি জলপ্রপাতের সঙ্গে মিলিত হলেন পু-কে-এ এবং এবার একটি মেয়ের জন্ম দিলেন। হাভাসুপাই লোক-কথা অনুযায়ী, এই দুই মরণশীল শিশুর মিলন থেকেই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এসেছিল। মানুষের প্রথম জাতিটিই ছিল হাভাসুপাই। হাভাসুপাইদের আবির্ভাবের সেই শুভ মুহূর্তে তোচোপা তাদের সাথে কথা বলেছিলেন এবং তাদের উপদেশ দিয়েছিলেন সেই উর্বর মাটি এবং বিশুদ্ধ জলের গিরিখাতে চিরকাল শান্তিতে থাকতে। সেই সঙ্গে তিনি তাদের এও বলেছিলেন, এখানে থাকলে তারা কখনও জলের অভাব বোধ করবে না।
বলাই বাহুল্য, এই ‘অরিজিন মিথ’টি শুনলেই এটি আমাদের ‘নোয়ার আর্কে’র সেই বহুশ্রুত গল্পটির কথা মনে করিয়ে দেয়। বস্তুত, পৃথিবীর সূচনালগ্নে বহুকথিত সেই বিশ্বব্যাপী বন্যার এটিও একটি স্বীকৃত সংস্করণ। এ ক্ষেত্রে, পু-কে-এহকে যদি আমরা নোয়া হিসেবে ধরে নিই, তাহলে আশ্চর্যজনকভাবে এটা সেই থিয়োরিকেই সমর্থন করে যে, পৃথিবীর প্রতিটি জাতিই নোয়ার বংশধর এবং প্রত্যেকটি জাতি/উপজাতিরই এক সাধারণ সাংস্কৃতিক পটভূমি রয়েছে। এই থিয়োরি কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে বাড়তে থাকা যত হিংসা-দ্বেষ, হানাহানি…সমস্ত কিছুই ভুলিয়ে দিয়ে মানুষকে এক সৌভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে। জন্ম দেয় এক নিটোল, নির্মল মানবিকতাবোধের!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অসাধারণ