পার্থ দে
স্মৃতি তো আসলে একটা ছোট্ট বেড়ালের মতো। আমাদের গায়ে পায়ে তার নাক মুখ ঘষে সোহাগ করে, আবার কখনও আঁচড়ে কামড়ে বিক্ষত করে। খুব জ্বালায়, চোখের জলে ভিজি আবার ভালও লাগে। ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসার অর্থ যে বুড়ো হচ্ছি তা বিলক্ষণ জানি। তবু বুকের ভেতর সংগোপনে রাখা আখরোট কাঠের বাক্সটা মাঝে মাঝে খুলে বসি। দেখি নানা রঙে ছোপানো ছবিগুলো কেমন সিপিয়া বর্ণের হয়ে গেছে। তাই ধুয়ে মুছে সামনে খুলে বসি, চালশে পড়া চোখেও লাগে খুশির ঝাপটা। নিজের সঙ্গে দেখা হলে মনটা খানিক ভাল হয়। তারপর কখন যে বেড়ালটা জানলা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যায়, আবার কবে আসবে কে জানে।
জানি, চাইলেই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে স্লাইড শোয়ের মতো চলে আসবে না একটার পর একটা। ওই বেড়ালটার মতো কোনো বিষণ্ণ দুপুরে জানলায় এসে ডাকবে ‘ম্যাঁও’। তখন আবার ছবিগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠবে, ঘুরে ফিরে বেড়াবে সামনে। আমার আশ্রমিক আবাসিক ইস্কুলের বারান্দায় ফের নিজের সঙ্গে দেখা হবে— কি রে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
— কিচ্ছু না। তুমি যাও তো, ম্যালা বোকো না।
— আরে কি হল, রাগিস কেন? এ মাসে বাড়ি থেকে কেউ দেখা করতে আসেনি বলে রাগ হয়েছে?
— ধুর, তোমার যেমন বুদ্ধি। মাথার চুলটা পাকিয়েছ, বুদ্ধিটা পাকেনি!
— তাহলে খামোখা রাগ করছিস কেন, মনখারাপের কারণটা বল?
— তুমি বেশি ব’কো না তো। নিজে তিরিশ বছর পর এলে আবার কথা বলছ!
— হ্যাঁ মানে… ইয়ে আসলে কাজে কম্মে সময় পাইনি… বুঝিসই তো…
আমি ওর দিকে তাকাই। এলোমেলো চুল। নারায়ণ দেবনাথের ‘হাঁদা’-র মতো হুবহু দেখতে। তবে মুখে চোখে চালু ভাবটা নেই, অভিমানী চোখমুখ। পায়ে নটিবয় শ্যুয়ের ফিতেটা বাঁধতে পারেনি ঠিক করে, জামার বোতামগুলো ভুলভাল লাগিয়েছে। সামনের ঘাসে একটা কমলা রঙের জলফড়িং উড়ছে, সেদিকে ও তাকিয়ে আছে অপলক, বুঝতে পারি আমার ওপর ভারি অভিমান হয়েছে ওর।
—তুমি মিথ্যে কথা বলছ। বড় হয়ে গেলে সবাই খুব মিথ্যে কথা বলে। তুমি আসলে ভুলে গেছ রাঢ়দেশের আমাদের এই আশ্রমিক ইস্কুলটাকে। চাইলে তুমি আসতেই পারতে, আমি এই ইস্কুলবাড়ির বারান্দায় তোমার জন্য কতদিন অপেক্ষা করছি জানো, তুমি তো কবেই পাশটাশ করে চলে গেছ। আমি তো রয়ে গেছি এই বারান্দায়, একটু পরে ফুটবল খেলতে নামব, তারপর সন্ধ্যে নামলে প্রার্থনাগৃহে যাব, ঝিঁঝিঁর ডাকে রাত নামবে, বইয়ের পাতা ঝাপসা হয়ে আসবে, ঘুমে ঢুলে পড়ব, বোঙ্গাবাড়ি গ্রাম থেকে ভেসে আসা ধামসা-মাদলের শব্দে রাত আরও গভীর হবে….ধুস, কাকে বলছি এসব! কি যেন বলে, হ্যাঁ, মনে পড়েছে— অরণ্যে রোদন। এই তো গেল-সপ্তাহে ফণীদা শেখালো বাগধারাটা। তুমি তো বাপু এখন বরফের মাছ হয়ে গেছ। মেছুনির ঝুড়িতে বরফের বিছানায় শুয়ে আছ। শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেছে, পাখনায় জোর নেই। স্রোতে সাঁতার কাটার স্বপ্নটাই হারিয়ে ফেলেছ।
— কি বললি, আমি বুড়ো হয়েছি! তবে রে…
আমার নাগাল এড়িয়ে নটিবয় শ্যু পরা হাঁদা গঙ্গারাম ছুটতে থাকে। আমি বেতো পা টেনে টেনে ওকে তাড়া করি। ও একটা দুরন্ত ছাগল ছানার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছোটে শাল, অর্জুন, আসানের ভুলভুলাইয়ার ভেতর দিয়ে, আম্রকুঞ্জের গহীনে। আমি ওর নাগাল পাওয়ার জন্য ঘেমে নেয়ে দৌড়ই, মনে মনে প্রার্থনা করি যেন আমাদের মধ্যের দূরত্বটা কমে আসে। আমরা দুজনে যে একই মানুষ।
দূরত্ব কমে না। ক্রমে বেড়েই চলে বিশ… তিরিশ… চল্লিশ বছর…
দাঁড়িয়ে পড়ি। হাঁটু চেপে ধরে হাঁফাতে থাকি, মনে মনে বলি, ইস্ অন্ধকার নেমে আসার আগে একবার যদি তোর নাগাল পেতাম!
এই সূর্যাস্তের পড়ন্ত বিকেলে এগারো বছরের ছায়াটাকে আমার চুয়ান্ন বছরের চেয়েও দীর্ঘতর দেখায়!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন