লুনা রাহনুমা
ছয়টি সন্তানকে নিজের হাতে মানুষ করেছেন সুফিয়া বেগম। নিম্নবিত্তের সামাজিকীকরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মাথা নিচু করেননি কোনোদিন। দৃষ্টি প্রসারিত রেখেছিলেন শুধু আগামীর দিকে। সুফিয়া বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রমে তার ছয়টি সন্তানই আজ একেকটি রত্ন। রত্নগর্ভা সুফিয়া বেগম সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে গিয়ে আজীবন শুধু লড়াই করতেই শিখেছেন। দারিদ্রের আঘাতে বারবার ভেঙে পড়লেও আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন পিঠ সোজা করে। বটবৃক্ষের ছায়ার মতো পাশে পেয়েছেন পরিশ্রমী স্বামী মোতাহার খন্দকারকে। শূন্য থেকে আরম্ভ করেছেন জীবন, তবু হাল ছাড়েননি একটিবারের জন্যেও। নিজের সন্তানদেরকেও সেইভাবে মানুষ করেছেন তিনি। অন্যায়ের সামনে তারা যেন কোনোদিন কিছুতেই মাথা নত না করে। বুক আগলে বড় করেছেন সবগুলো সন্তানকে মুরগির বাচ্চার লড়াকু মায়ের মতো আগলে রেখে। তবে মা হিসেবে সুফিয়া বেগম অনুভব করেন সন্তানদের প্রতি মমতার ব্যাপারে তিনি ঠিক নিরপেক্ষ নন। ছয়টি সন্তানের মধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবেই তিনি বিভাজন করে ফেলেন, প্রথম পুত্রটি তার সবচেয়ে বেশি প্রিয় সন্তান।
-আম্মা, তুমি কেমন আছো? ছোট মেয়ে সুরাইয়া প্রশ্ন করে টেলিফোনে।
তিন বছর আগে স্বামী মারা যাবার পর থেকে সুফিয়া বেগম এখন ঘুরে ঘুরে ছয় ছেলেমেয়ের কাছে থাকেন। এইমুহূর্তে তিনি আছেন অস্ট্রেলিয়ায় প্রিয় সন্তান বড় ছেলের বাড়িতে। ছয় মাসের ভিসা নিয়ে এসেছেন। মেয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর শোনা যায় না। টেলিফোনের অপরপাশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই। এরপর ওপাশে ফোঁপানির শব্দ শুনে মেয়ে আবার প্রশ্ন করে:
-কাঁদতেছ কেন আম্মা? কী হইছে?
সুফিয়া বেগমের একবার মনে হয় মন খুলে কথা বলেন আত্মজার সঙ্গে। বলেন যে, দুপুরে খাওয়ার পর প্লেট ধুয়ে রাখতে গিয়ে সাবান মাখা হাত থেকে পিছলে পড়ে কাচের প্লেটটি ভেঙে গিয়েছে। সাদার ওপর ছোট্ট নীল ফুলের প্লেটটি সুফিয়া বেগমের নিজেরও খুব পছন্দের ছিল। ইচ্ছে করে ভাঙেননি। কিন্তু তার হাতেই ভেঙেছে যে! তবু কাচের ভাঙা টুকরোগুলো সুফিয়া বেগমের কলিজায় অতটা আঁচড়াতো না যদি না বৌমা ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতো। একটা প্লেট ভাঙা নিয়ে সুফিয়া বেগমের বড় বৌমা ভীষণ গজগজ করেছে সমস্ত দুপুর। আর ঢাকাইয়া মেয়ের বিড়বিড় করে দেয়া গালাগালগুলোর বেশিরভাগের অর্থই তিনি বুঝতে পেরেছেন নির্ভুল।
মেয়ের কাছে মুখ খুলতে গিয়েও সুফিয়া বেগম ঘটনাটি গিলে ফেললেন। মনে মনে নিজেকে বোঝান, শুধু বৌমার দোষ দিলেই তো হবে না, এই নিয়ে ছয় সপ্তাহে তিনটি প্লেট ভেঙেছে তার হাতে। বৌমা বলেছে আজ থেকে তাকে প্লাস্টিকের প্লেটে খাবার দেয়া হবে। আর বৌমা এক কথার মানুষ, সত্যি সত্যি শোকেস থেকে একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের থালা বের করে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছে শ্বাশুড়ীকে দেখিয়ে। সুফিয়া বেগম নিজেও তো বোঝেন, তার ছেলে এখন মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছে বলেই কি এভাবে জিনিসপত্র ভেঙে ছেলের টাকা নষ্ট করা উচিত হচ্ছে তার? নাকি সেটি কি খুব সমীচীন কাজ কোনো মায়ের জন্য!
সুফিয়া বেগম ভুলে গিয়েছিলেন টেলিফোনের অন্যপাশে তার মেয়ে অপেক্ষা করে আছে মায়ের কথা শুনতে। অনেকক্ষণ পর সুফিয়া বেগম ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেন, আমার মায় আছিলো সাংঘাতিক রাগী মানুষ। মা`রে কোনোদিন কানতে দেখি নাই আমরা। সেই মায় যখন বুড়া হয়া গেল, দেখতাম সারাদিন খালি কান্দে আর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে। মারে জিগাইছি, কিগো, আপনি খালি কান্দেন কেন? আপনের কী হইছে? আমার মায় কইতো, কী জানিরে মা বুঝি না, আমার খালি কান্দন আসে।
কথা থামিয়ে আবার ফোঁপাতে থাকেন সুফিয়া বেগম। এক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এই বয়সে আইসা আমার মনে হয় আমারেও আমার মায়ের রোগে পাইছে। সারাদিন খালি কান্দন আসে। আমার শইল্যে আগের হেই রাগ, ঘিন্না সব কই যে গেল, কিচ্ছু বুঝি না!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন