ফিল্ম রিভিউ
অদিতি বসুরায়
দাহাদ নামের Amazon Prime এর ছবিটি কেবল এক নিছক ক্রাইম থ্রিলার নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েদের সার্বিক অবস্থান ও সেই সঙ্গে বিবাহ – সম্পকিত আর্থ –সামাজিক অবস্থাকে অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছেন পরিচালক রিমা কাগতি এবং রুচিকা ওবেরয়। রাজস্থানের খানিক অংশজুড়ে এই সিরিজের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করা হয়েছে। এ এমন এক ভারতবর্ষের চিত্র – যেখানে আজও মেয়েদের পরিবারের বোঝা মনে করা হয়, সেই সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিকতা পরিবারের যাবতীয় সম্মান-রক্ষার ভারও বাড়ির নারীদের কাঁধে চাপিয়ে রেখে মর্যাদা-রক্ষার ফানুশ ওড়াতে থাকে। বর্ণ এবং লিঙ্গ বৈষম্য – এই দুই বিষয় নিয়েই দাহাদ -এর মূল বক্তব্য। এ এক এমন রাজ্যের কথা – যেখানে বাড়ির মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও তার খোঁজ নেয় না পরিবার – তাকে মৃত ঘোষণা করতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। নকল সম্মান রক্ষার তাগিদ এমনই যে যে মেয়ে হারিয়ে গেছে – তার সন্ধানের জন্যও এরা ব্যস্ত হয় না। এ এক আজব দেশ আমাদের! যেখানে ভিকটিম-কে অপরাধীর থেকে বেশি দোষারোপের মুখোমুখি হতে হয়। নির্যাতনকারী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় – তার অত্যাচারের শিকার যে, সে বিষের পুরিয়া সন্ধান করে বা রেললাইনের ট্রাককেই পরিত্রাণ মনে করে নেয়। এসবই আমাদের সামাজিক অসাম্যের হাকিকত! এবং দাহাদ কেবল মেয়েদের বিরুদ্ধে সামাজিক অসাম্যের কথায় সোচ্চার – কেবল তাই-ই নয় – জাতপাতের ভিত্তিতে যে সাংঘাতিক অবিচার এ দেশের মানুষকে সইতে হয় – দাহাদ তার কথাও বলে। ঠিক এই ব্যাপারটা নিয়েই কাজ করেছেন দাহাদ-এর পরিচালক-দ্বয়। এই মেয়েদের বিপ্রতীপে আছেন ইন্সপেক্টর অঞ্জলি ভাট্টি। তার সমস্যা আর একটু বেশী কারণ সে দলিত – নিচু জাতের মেয়ে। বাবার উৎসাহে পড়াশুনা শেষে সে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ নেয়। কিন্তু সেখানে পদে পদে তাকে নিজের পদবীর কারণে হেনস্থা হতে হয়। পরিবার ও সমাজের কাছে বারবার জবাবদিহি করতে হয় – বিয়ে না করার কারণে। সম্ভাব্য খুনীর আসামীর বাড়িতে কী প্রবল স্পর্ধায় তার নিম্ন বর্ণ পরিবারে জন্মের কারণে তাকে ঢুকতে দিতে চান না আসামীর পিতা। এই অবস্থা দেখে হতাশ লাগে। তারপর হাজার বিরুদ্ধতা কাটিয়েও অঞ্জলির নিজের শর্তে যাপনটি ভরসা যোগায়। অঞ্জলির চরিত্রে সোনাক্ষী সিনহা অসাধারন। খুবই বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গীতে তিনি ‘ভাট্টি’কে পোট্রে করেছেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার – যে দৃশ্যে মায়ের বারবার মেয়েকে বিয়ের পাত্রদের ছবি দেখানোর পর, সোনাক্ষী শান্ত স্বরে মাকে জানাচ্ছেন, এবার তিনিও মাকে কিছু এমন মেয়ের ছবি দেখাবেন, যাদের শিশুকাল থেকেই বোঝানো হয় নারী-জীবনের মূল লক্ষ্য বিয়ে। এবং সেই সঙ্গে বিপুল পণের বৃতান্তও। ফলে বাবা-মাকে সেই ব্যয় থেকে বাঁচাতে যে লোকটি তাদের প্রথম বিয়ের প্রস্তাব দিল, তার সঙ্গেই সে পালালো এবং পরে তাদের লাশ পাওয়া গেল পাবলিক টয়লেটে।
গল্পের কথায় আসা যাক – ছবির শুরু থেকে দর্শক জেনে যাবেন – খুনী কে! এবং তা ধরেই পরপর আটটি এপিসোড এসেছে। টানটান কাহিনীর বুননে কোথাও তার কারণে চিত্রনাট্যের স্থলন চোখে পড়ে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল – থ্রিলার ছবিতে অপরাধীকে গোড়াতেই চিহ্নিত করে দেওয়ার পর, অতগুলো এপিসোড তৈরি করার জন্য যে অসামান্য দক্ষতা থাকা প্রয়োজন – তার প্রমাণ সবকটি পর্বে ছড়িয়ে আছে। এক্ষেত্রে শুধু পরিচালকদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা ঠিক হবে না – ছবির প্রতিটি অভিনেতা অত্যন্ত ভাল কাজ করেছেন। বিশেষ করে যাঁদের কথা বলা প্রয়োজন – ছবির মূল চরিত্রের কারবারী বিজয় বার্মা, যিনি আনন্দ স্বর্ণকারের ভূমিকায় কাজ করেছেন। ঠাণ্ডা মাথার খুনীর যে চাহনি বিজয় দিয়েছেন – তার তুলনা পাওয়া মুশকিল! একদিকে স্নেহশীল পিতা হিসেবে তিনি যেমন যথাযথ তেমনই সিরিয়াল কিলার রূপে তাঁর কাজ দুর্দান্ত। আনন্দ স্বর্ণকার নামের যে চরিত্রটি বিজয় ভার্মা করেছেন, সে এক সিরিয়াল কিলার। জেলার নানা জায়গার মেয়েদের সঙ্গে সে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারপর একদিন তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পরামর্শ দেয় এবং সঙ্গে কিছু গয়না বা টাকাও আনতে বলে। এর পর কোনও অনামা লজে তারা রাত্রিবাস করে এবং শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করার পরদিন তাদের নিয়ে বের হয় এবং আপদকালীন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বলে বিষ খাওয়ায়। এই সময় সে সঙ্গীকে পাবলিক টয়লেটে গিয়ে অসুধটি খাওয়ায় পরামর্শ দেয়। কারণ হিসেবে বলে এই ওষুধ খেলে বমি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই ভাবে সে বহু মেয়েকে হত্যা করে এবং মুখ মুছে ঘরে ফিরে আসে। স্ত্রীর প্রেমিককেও সেই হেয়ার ড্রায়ারের সাহায্যে খুন করে। অধ্যাপক হিসেবে সে, স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে সে প্রায় নিখুঁত একটি ইমেজ তুলে ধরে। ছুটির দিনগুলোয় সে ভ্যান নিয়ে গ্রামে গ্রামে বাচ্চাদের পড়াতে যায়। ভ্যানটি তার মোবাইল লাইব্রেরি। সমাজে তার এমন পরিচ্ছন্ন ইমেজ যে কেউ কল্পনাও করতে পারে না সে আদতে ওমন নিষ্ঠুর চরিত্রের খুনি। আর দাহাদ নিয়ে আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, গুলশান দেবিয়া অভিনীতি দেবীলাল সিং চরিত্রটির কথা অনুল্লেখ থাকলে। গুলশান এমন এক পুলিশ অফিসার যিনি স্বপ্নে সহকর্মী নারীকে দেখে অনুতাপে ভোগেন। পুত্র এবং কন্যার পিতা হিসেবে তাঁর ভূমিকা – স্মরণযোগ্য। স্ত্রীর সঙ্গে মতের অমিল হলেও মেয়েকে সে রাজধানী দিল্লিতে পাঠায় – পুত্র নীল ছবি দেখে জেনে তার সঙ্গে সুস্থ আলোচনায় বসে। পারগের চরিত্রটিও আশাব্যঞ্জক।
আদতে ছবিতে যতগুলি নারীর হত্যা দেখানো হয়েছে – তা প্রকৃতপক্ষে কোনও একজন বিকৃ্তকামী ব্যক্তির হাতে হলেও একটু বিস্তারিত দৃষ্টিভঙ্গীতে নজর করলে বোঝা যাবে, এ আসলে এক সামাজিক অপরাধ। যে সমাজ যুগযুগ ধরে লিঙ্গ এবং বর্ণের ভিত্তিকে মানুষকে (পড়ুন নারীদের) নানা ভাবে খুন করার ট্রাডিশন ধরে রেখেছে। দাহাদ সেই অন্ধকারে এই উজ্জ্বল উদ্ধার।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন