অমৃতা মুখার্জি
রবিবারের ভোরবেলাটা রাই কারো সাথে শেয়ার করে না।
এটা তার নিজস্ব খুব প্রিয় মী টাইম। চুপি চুপি চোরের মত নিজের বাড়িতে ই খালি পায়ে ল্যাপটপ, ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে পা টিপে টিপে চাবি নিয়ে গ্যারাজ দিয়ে কেটে পড়ে সে। আর সবাই তখন ঘুমের দেশে। পাক্কা দশটার আগে কেউ ওঠে না। সলিড চার ঘন্টা আন ইন্টেরাপ্টেড।
ভোরের হিমেল কুয়াশা কেটে সে স্পীড তোলে ইচ্ছেমত। কোন পুলিশের বাবা জেগে থাকেনা এ সময় চরাচরে। টিকেটের ভয় নেই।
কাঁচের বাস্পমাখা জানালা আর ফ্রেশ হেজেল নাট কফির গন্ধ নিয়ে স্বপ্নের কাফে মারিএটা শুধু জেগে থাকে এক অলৌকিক দ্বীপ হয়ে। রাই বুক ভরে গন্ধ নেয়। তার প্রিয় কোনের টেবিলে বসলেই এই প্রভাতে সেই অলিখিত রাণী। মুচমুচে পেস্ট্রীর সাথে উষ্ণ কফি প্রথম চুমুর মত স্বাদু লাগে। বুলেটের গতিতে কাজ সারে সে। আইপড রিমঝিম করে আরিয়ানা গ্রান্ডের মদালস সুরে। ফেরার পথে চকোলেট ক্রোশান্ট নিয়ে গেলে সোমের গম্ভীর মুখ দেখতে হবে না।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে সুর কাটছে। প্রায় নিয়ম করে রাই এর জায়গা টা নিয়ে নিচ্ছে একটা উটকো হোমলেস লোক। কেমন মেজাজ খারাপ হয়? দরজা খুলে ঢুকেই দেখে ব্যাটা টেবিল টা নিয়ে নিয়েছে! উফফ! সংসার এত জটিল কেন? কেউ কি একটুও শান্তিতে থাকতে পারবে না? এই একটু জিরোবার জায়গা। সারা সপ্তাহ ভূতের খাটনি ঘরে বাইরে, পঁচিশ টা ডেডলাইন মীট করে কুকুরের জীবন কাটে। গোটা কাফে তে ওই একটাই টেবিল যেখানে প্লাগ পয়েন্ট আছে। ফোন, ল্যাপটপ চার্জ হয়। কিরকম শত্রুতা দেখ! দাঁত কেলিয়ে ব্যাটা বসে আছে। আবার বলে গুড মর্নিঙ।
রাই নিমপাতা খাবার মত মুখ করে সরে যায়। মনে মনে লোকটার চোখে লাল লংকার গুঁড়ো আর পিছনে নাগাল্যান্ডের বেনু সেট করে। কফিতে স্ট্রীকনিন বা আর্সেনিক গুলে দেয়। মরে না কেন আপদ? গায়ে বিচ্ছিরি ঢোলা কোট, ধুয়েছিল বোধহয় সিরাজোদ্দৌল্লার আমলে। গন্ধে র্যাকুন পালাবে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে ঘোলাটে চশমা, মাথায় ছিরকুটে ছাই রঙের টুপি।
খকখক করে মাঝেমধ্যে কাশে। টিবি থাকতেই পারে। একটা তাপ্পি দেওয়া ব্যাগ থেকে নোংরা কাগজ বার করে সারা টেবিল ছড়িয়ে রেখে এমন ভাব করে যেন কি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত।
রাই কানাঘুষা শুনেছে ও সারাদিন এক কাপ কফি কিনে ওখানে বসে থাকে। রাত হলে দোকান বন্ধ হলে বাড়ি যায়। ম্যানেজার অনেক চেষ্টা করেও তাড়াতে পারেনি। সবার হাড় জ্বালিয়ে রোজ ভোর না হতে উদয় হয়।
কদিন ধরে রাই দের অফিসে খুব কাজের চাপ বেড়ে গেছে। কিভাবে যেন একটা সিস্টেমে বাগ ঢুকেছে। কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছে না। ক্লায়েন্টদের সমস্ত হেলথ ডাটা আর ফাইনানশিয়াল ইনফরমেশন লীক হয়ে যাচ্ছে। অনেক সিকিউরিটি কোড দিয়েও ফিক্স করা যচ্ছে না। আই টির লোকেরা হিমশিম খাচ্ছে। কিভাবে গোটা ব্যাপারটা হ্যাক হচ্ছে নো ক্লূ। তাই এই সিকিউরিটি আপডেট গুলোর মাঝে মাঝে কোনরকমে কাজ সারতে হচ্ছে। উইক এন্ডে সারাক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকলে বাড়িতে সবার মুখ অন্ধকারে হয়। তাই রাই পড়িমরি করে আজ বের হল।
তখনো বাইরে অন্ধকার। ভোর হয়নি। আজ তাকে কোনার টেবিল পেতেই হবে। দুটো কোড পুরো চেক করে রান করাতে হবে। ল্যাপটপের চার্জ ফুরিয়ে না যায়। কাফে খোলার আগেই সে পৌঁছে যাবে। হোমলেসের আজ চান্স নেই।
কাফের সামনে এসে রাই এর মাথায় রক্ত ঊঠে গেল। শয়তানটা দরজায় নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবা যায়না। কিরকম চালু পুরিয়া। রাই কে দেখে ফিক করে হাড় জ্বালানী হাসি দিল। রাই যদি পারত দু চোখের আগুন দিয়ে ব্যাটাকে ভস্ম করে দিতে। সে বাধ্য হয়ে অনেক দূরের টেবিলে গিয়ে বসল। বড়জোর ঘন্টাখানেকের মত পাওয়ার আছে ল্যাপটপে। হে ঠাকুর পরের সপ্তাহে বদমাশ টার যেন কোভিড হয়।
মিনিট চল্লিশ কাজ করার পর হঠাৎ টীমে মেসেজ আসতে লাগল। সিস্টেম ক্রাশড। নো কানেকশন টু রাউটার। বিপ বিপ।
ল্যাপটপের স্ক্রীন কালো হয়ে গেল। রাগে দু:খে রাই এর চোখ দিয়ে জ্বল পড়ো পড়ো। সবে কোড টা রান করছিল। হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে সে কাউন্টার এর দিকে গেল।
প্লীজ আ টোস্টেড বেগেল আন্ড কাপুচিনো উইথ ওয়ান শট।
মেয়েটি মধুর মত হাসল।
ক্যান আই হ্যাভ ইয়োর রীওয়ার্ড ফোন নাম্বার? ইউ গেট পয়েন্টস।
কানের কাছে তীব্র সাইরেনের মত কি যেন বেজে উঠল। রাই এর হতভম্ব চোখের সামনে দড়াম করে কাফের দরজা খুলে চার জন পুলিশ অফিসার রিভলবার আর টেঠার নিয়ে লাফ দিয়ে কাঊন্টারের উপর ঝাঁপিয়ে উঠে মেয়েটির হাত বেঁকিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। বিদ্যুতের গতিয়ে নীল লাল আলো জ্বেলে চারটে পুলিশ কার কাফের এন্ট্রান্স আর এক্সিট ব্লক করে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়েছে। লোক জন হুড়মুড় করে পালাতে গিয়ে গ্লাস, প্লেট, কাঁচ ভেঙ্গে ছত্রখান। কান্নাকাটির বোল। পুলিশ আরো কয়েকজন কে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ফেলেছে। রাই হামাগুড়ি দিয়ে একটা টেবিলের তলায় ঢুকে পড়ল। ভয়ে ঠকঠক করে সে কাঁপছে। কি হয়েছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।
তার হতবুদ্ধি চোখের সামনে হোমলেস লোক টা উঠে দাঁড়িয়ে একটানে পরচুলা আর জ্যাকেট খুলে ফেলল। রাই অবাক হয়ে দেখল হ্যারিসন ফোর্ডের মত টান টান চাবুক মার্কা একটা লোক, নীল চোখ, এক লাফে গিয়ে ম্যানেজার কে দু কাঁধ ধরে দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে।
সেদিন রাতে টিভি তে সব প্রকাশ পেল। কাফে মারিএটা নামেই কাফে, আসলে কিউবার একদল গুপ্তচর এই কাফে চালায়। পয়েন্টস আর ফ্রী খাবারের নাম করে সবার ফোন নাম্বার আর গাড়ীর প্লেট রেকর্ড করে। সেই ডাটা পাচার হয় ইন্টার ন্যাশ্নাল হ্যাকারদের কাছে। তারা সুচতুর কৌশল মতে দুয়ে দুয়ে চার করে। খুব পার্সোনাল ইনফরমেশন, ফাইনানশিয়াল স্ট্যাটাস, ব্যানক কোড পাচার হয়ে যায়। খুব কম ছোট ছোট ট্রান্সাকশন করে হাজার হাজার ডলার পার্সোনাল আকাউন্ট থেকে তুলে নেয়। লোকে খেয়াল করে না।
সেই হোমলেস লোক আসলে সি আই এর স্পেশাল অফিসার। অনেক দিন হোমলেসের ছদ্মবেশে ওয়াচে ছিল। একদিন বামাল সমেত ধরেছে। সব কটা জেলে গেছে। এলাকায় রইরই কান্ড। রাই এর অফিসে তুলকালাম অবস্থা। অনেক লোকাল ব্যাংক আর হসপিটালের ডাটা চুরি গেছে।
কাফে মারিএটা বন্ধ। দরজা সীল করা। দু সপ্তাহ পরে রাই ভোর বেলা বাধ্য হয়ে ম্যাকডোনাল্ডে গেল। অনেক কাজ জমে আছে। রবিবারে সেরে না ফেললে বিপদ। ল্যাপটপ খুলে সবে কফিতে চুমুক দিয়েছে, ও মাই গড সামনের টেবিলে সেই হোমলেস টা না? রাই ভয়ে জমে যাচ্ছিল।
লোকটা মুচকি হাসল। রাই এর ফোনে অজানা নম্বর থেকে টেক্সট এল।
খুব জোরে জোরে বলতে তোমার নম্বর পয়েন্টস এর লোভে। মুখস্ত হয়ে গেছে। আর ও ভুল টা কোর না। আর বাই দা অয়ে। লক ইয়োর কার অলোয়েজ। যদি দামী কিছু নাও থাকে।
রাই আর তাকাল না। ভয়টা কেটে গেছে। বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে। সাম ওয়ান ইস দেয়ার টু প্রোটেক্ট। সে কাজে মন দিল। লোকটার কোট থেকে বোঁটকা গন্ধটা আজ আর খারাপ লাগছিল না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
কি যে দারুণ লাগল ! সবচেয়ে মজার রাই এর মনের কথা, আর বিরক্তির সলিলকি গুলো ।শেষের টুইস্ট টা অনবদ্য!
গতকাল আমার ফোনের সব হোয়াটসঅ্যাপ এর মেসেজ অজানা কারনে উড়ে গেলো। কত ফিল্ড ডাটা, বন্ধুদের আলাপচারিতা, ভয়েস ডাটা স্টোর ছিলো। গত কয়েক বছরের ডাটা। সব গেলো। আর এখন এই লাখাটা পড়লাম। আর ভাবছি আমার মত ছাপোষা মানুষের ফোনে কি কেউ হ্যাক করবে? রাই ব্যস্ত মানুষ… কিন্তু আমি তো অলস। আস্তে গাড়ি চালাই। কফি শপে যাচ্ছি না। তাহলে?… নাহ গল্প টা আরেকবার পড়ি।
খুব ভাল নির্মাণ। টেনে নিয়ে গেল শেষ অবধি।
কি মনকাড়া লেখা👌 একদম অন্যরকম। খুব ভালো লাগলো❤