নন্দিনী নাগ
তাহলে কি সত্যিই একজন স্রষ্টা আছেন এই বিশ্ব সৃষ্টির মূলে? তিনিই কি তবে সেই, যাঁকে আমরা বলি ঈশ্বর?
ভারি সংকট উপস্থিত,কারণ বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা সম্প্রতি হাত মেলাতে চাইছে অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের সঙ্গে।
এই পরস্পরবিরোধী অবিশ্বাস্য কান্ডটা কিভাবে সম্ভব হল, তা বুঝতে গেলে কেবল একটা বক্তব্যই যথেষ্ট।
“আমার কাছে এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে, আমরা যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাস করছি সেটা পুরোপুরি পরিকল্পনা মাফিক তৈরি হয়েছে এবং দুনিয়াটা পরিচালিত হচ্ছে সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে। এই নিয়মগুলো তৈরি এবং রূপায়িত হয়েছে একজন সার্বজনীন বুদ্ধিমত্তার দ্বারা, আকস্মিকভাবে কোনো কিছুই ঘটে নি।”
এই বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে, আছড়ে পড়ছে একের পর এক বিতর্কের ঢেউ। কারণ, বক্তা তো যে কেউ নন, স্বয়ং মিসিও কাকু (Michio Kaku), স্বনামধন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী।
মিসিও কাকুর এই নতুন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করার আগে ওঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিশেষত কাজের বিবরণ দিয়ে দেওয়া ভালো, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন ওঁর এই বক্তব্য বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীদের মাথা ব্যথার কারণ।
ক্যালিফোর্ণিয়ার সান জোস এ জন্মেছেন মিসিও কাকু, বর্তমানে নিউইয়র্ক নিবাসী। ছিয়াত্তর বছর বয়সী (জন্ম ২৪শে জানুয়ারী, ১৯৪৭) এই তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রীটি পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানীদের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রথম জীবনে তিনি কাজ করেছেন কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি নিয়ে, পরবর্তীকালে তাঁর ‘স্ট্রিং থিয়োরি’, বলা ভালো ‘সুপার স্ট্রিং থিয়োরি’ নিয়ে কাজ বিজ্ঞানমহলে সুপ্রসিদ্ধ।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে তাঁর স্বীকৃত এবং সমাদৃত অনেকগুলি গবেষণাপত্র রয়েছে।
বিশেষ করে, আইনস্টাইনের বিশ্বভাবনা কিভাবে বর্তমানে স্থান-কাল (space-time)কে বোঝার জন্য পরিবর্তিত হয়েছে, সেই সংক্রান্ত গবেষণাপত্রের জন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর নামটি উজ্জ্বল।
হাইপার স্পেস, সমান্তরাল বিশ্ব, এবং ব্রহ্মান্ডে দশটি মাত্রা প্রয়োগের ধারণার জন্য ডক্টর কাকুকে বিজ্ঞান সারাজীবন স্মরণ করবে। প্রসঙ্গত,আমরা সাধারণ মানুষ তিনটি মাত্রার সঙ্গে পরিচিত, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা। পদার্থবিজ্ঞানে চতুর্থ যে মাত্রাটি প্রযুক্ত হয় সেটি হলো সময়।
আমরা যে বিশ্বের বাসিন্দা, সেই বিশ্বের সমান্তরাল অন্য একটি বিশ্বের ধারণা এবং সুদূর ভবিষ্যতে এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের, মানে আমাদের প্রিয় এই বিশ্বের অবস্থান কি হবে-এই নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রটির সুবাদে তিনি দারুণ জনপ্রিয় একজন মানুষ।
সাধারণ মানুষের মতে, পদার্থবিদ্যা একটা দূরূহ দুর্বোধ্য বিষয়। অথচ একজন লেখকের পদার্থবিজ্ঞানের কচকচানিতে ঠাসা বই নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার, তাও আবার তিন তিনবার! ভাবা যায়!
অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। ডক্টর কাকুর লেখা ‘Physics Of The Impossible’, ‘Physics Of The Future’ আর ‘The Future Of The Mind’ তুমুল সাড়া ফেলেছে পাঠকমহলে।
বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ এবং জনপ্রিয় করার কাজে সারাজীবন পরিশ্রম করে চলা এহেন একজন হেভিওয়েট বিজ্ঞানী যদি এমন একটা কথা বলেন, তাহলে তা নিতান্ত ফ্যালনা নয়।
ডক্টর মিসিও কাকুর প্রতিপাদ্যটি এবারে আরও একটু বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা যাক।
বেশ কয়েকবছর হল একদল বিজ্ঞানী ‘বায়োসেন্ট্রিজম’ এর পক্ষে সওয়াল করছেন। ‘বায়োসেন্ট্রিজম’ কথার মানে হল প্রাণকেন্দ্রিক বিশ্ব। তাঁদের বক্তব্য, আমাদের এই পৃথিবী এমনভাবে নিখুঁত হিসাব কষে সৃষ্টি হয়েছে যাতে, একদিন পৃথিবীতে জন্ম নিতে পারে প্রাণ। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রাণ আসা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, তা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল সূর্য থেকে পৃথিবী জন্ম নেবার আগে থেকেই।
বলাই বাহুল্য, বিজ্ঞানীরা যুক্তি প্রমাণ ছাড়া কোনো তত্ত্ব পেশ করেন না। তাঁদের এই বক্তব্যের স্বপক্ষেও আছে বহু যুক্তি, তবে সেইসব কথা আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই বলে, যুক্তি পেশ করা থেকে আপাতত নিজেকে বিরত রাখছি।
স্টিফেন হকিং এর অভিমতও খানিকটা এরকমই ছিল। ‘The Grand Design’ বইতে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কেমন নিখুঁত ভাবে ডিজাইন করে তৈরি হয়েছে আমাদের এই বিশ্ব। তাঁর বক্তব্য ছিল, এই ব্রহ্মান্ডের সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত। শুধু আমরা জানি না যে কি নির্ধারিত হয়ে রয়েছে।
পূর্বসূরীদের এই ধারণাকে আরও বেশি ব্যাপ্তি দিয়েছেন কাকু।
তাঁর এই নতুন তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলছেন, “One can conclude that god is a mathematician, and we are living in a simulation.”
তিনি আরও বলছেন, “The mind of god is cosmic music of strings resonating through 11-dimensional hyperspace.” এভাবেই তিনি মিলিয়ে দিচ্ছেন তাঁর হাইপারস্পেস, বিশ্বের এগারোটি মাত্রা এবং সুপারস্ট্রিং থিওরির ধারণার সঙ্গে বর্তমান তত্ত্বকে।
কাকুর এই তত্ত্বটি বুঝতে গেলে আগে আমাদের ‘সিমুলেশন’ ব্যাপারটা জানতে হবে।
কম্পিউটার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে তার সাহায্যে, যেকোনো ব্যক্তি কিংবা বস্তুর এমন হুবহু প্রতিরূপ বানিয়ে ফেলা সম্ভব যে আসল নকলের পার্থক্যই করা অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ২৩শে জানুয়ারির অনুষ্ঠানে এক প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি দর্শকের সামনে হাজির করা সম্ভব স্বয়ং নেতাজিকে, যিনি কেবল সকলের সামনে এসে দাঁড়াবেন না, বক্তৃতাও করবেন।
এই যে প্রযুক্তি, তার পোশাকি নাম সিমুলেশন, যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে তাদৃশ্যায়ন, মানে হবহু তারই মত তৈরি করা। কম্পিউটার সিমুলেশনের সাহায্যে আমাদের সামনে এনে হাজির করা যেতে পারে একেবারে আসলের মত তাজমহল কিংবা সোনার কেল্লা, এজন্য আগ্রা বা জয়সলমীরে ছোটার আর দরকার নেই। এই প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা তৈরি করে ফেলতে পারি গোটা দুনিয়াটাই, যাকে বলা যেতে পারে ‘মিথ্যেকারের সত্যি জগৎ’ বা ‘ভার্চুয়ালি রিয়াল ওয়ার্ল্ড’।
কাকু বলছেন, আমরা যে দুনিয়ার বাসিন্দা, যে জগতে আমরা নিজেদের সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিধর প্রাণী বলে মনে করি, সেটাও আসলে একটা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, একটা মিথ্যের জগৎ যাকে আমরা সত্যি বলে মনে করি। আর এই ‘মিথ্যেকারের সত্যি’ দুনিয়াটা আসলে সিমুলেটেড, কোনো একজন সার্বজনীন বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তৈরি করা।
অর্থাৎ কিনা ‘আমরা’ আসলে সত্যি সত্যি ‘কেউ’ নই, আর এই ব্রহ্মান্ড বলে যাকে জানি, সেটাও আসলে সত্যি সত্যি নেই। এই ‘আছে কিন্তু নেই’ দুনিয়াটির সৃজনকর্তা যিনি, নিয়ন্তা যিনি, তিনি আছেন অন্য কোথাও, এই সৃষ্টি কেবল তাঁর মায়ার খেলা মাত্র।
কাকুর এইরকম ধারণাকে সমর্থন করেন গণিতবিদেরাও। নিক বোস্ট্রম নামে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক, ২০০২ এ প্রকাশিত তাঁর এক গবেষণাপত্র,”Are you living in a computer simulation?” এ বিস্তর হিসাব কষে প্রমাণ করেছেন, ‘বর্তমানের আমরা’ সহ আমাদের তাবৎ দুনিয়াটা ‘অবাস্তব’ মানে সিমুলেটেড হওয়ার সম্ভাবনাই সবচাইতে বেশি।
সেই গবেষণাপত্রের বিষয়টি নিয়ে এবার আলোচনা করব।
আমাদের বর্তমানের যে মানবপ্রজাতি সেই প্রজাতির পরবর্তী এক মানবপ্রজন্মকে বোস্ট্রম কল্পনা করে নিয়েছেন, তাদের তিনি বলছেন পোস্ট হিউম্যান, এরাই তাঁর গবেষণার গিনিপিগ।
পোস্ট হিউম্যান কারা? আমাদের বর্তমান সভ্যতা এখন যেসব সংকটের মুখোমুখি সেগুলো পার করে যদি টিঁকে যেতে পারে মনুষ্যকূল, তবে ধরাধামে যে মানবপ্রজাতিকে পাওয়া যাবে তারাই পোস্ট হিউম্যান।
বোস্ট্রমের বক্তব্য, আজকের মানবসভ্যতার সামনে তিনটি রাস্তা খোলা আছে ভবিষ্যতে পৌঁছনোর জন্য।
প্রথম পথ,সভ্যতার সংকটের কাছে হেরে গিয়ে চিরবিদায় নেওয়া। সেক্ষেত্রে মানবসভ্যতা আর হয়ে উঠতে পারবে না মানবোত্তর সভ্যতা।
দ্বিতীয় উপায়,মানবসভ্যতা কোনোভাবে টিঁকে গিয়ে পৌঁছে গেল মানবোত্তর পর্যায়ে, কিন্তু কোনো কারণে তারা আমাদের মত কম্পিউটার সিমুলেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারল না বা করল না।
তৃতীয় সম্ভাবনা হল, মানবসভ্যতা পৌঁছে গেল মানবোত্তর পর্যায়ে এবং তারা আমাদের চাইতেও বেশি উন্নতমানের কম্পিউটার সিমুলেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম হল।
এই তিন নম্বর সম্ভাবনাটা তখনই সত্যি হওয়া সম্ভব যদি আমরা মেনে নিই যে আমরা এখনই কম্পিউটার সিমুলেশন এর মধ্যে বাস করছি।
বোস্ট্রম বিস্তর হিসাবনিকাশ করে দেখিয়েছেন, প্রথম দুটি পথে ভবিষ্যতে যাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি মানে ওইদুটো ঘটনা ঘটবে না বলেই ধরা যায়। আর তিন নম্বর রাস্তায় ভবিষ্যতে পাড়ি দেবার সম্ভাবনা একের কাছাকাছি, মানে এইটাই সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য।
অর্থাৎ এই গবেষণাপত্র ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আমরা একটা মিথ্যের জগতে বাস করি আর তাকেই সত্যি বলে ভেবে নিয়ে লম্ফঝম্প করি আমরা যত কল্প-মানুষের দল। আমরা সমেত গোটা বিশ্বটাই সিমুলেটেড,একটা ভার্চুয়াল প্রতিরূপ, যার প্রকৃত স্বরূপ আছে অন্য কোথাও, আমাদের জ্ঞানের পরিধির বাইরে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন