ফিল্ম রিভিউ
অদিতি বসুরায়
তিনটি জীবন যেভাবে চলছে- তাতে নারীটি এগিয়ে যাওয়ার পথে, পায় বিস্মৃতির কুয়াশা। খানিক সে আছে, খানিক সে নেই। তার স্মৃতিকে খেয়ে নিতে আসছে ডিমেনশিয়ার গাড় পর্দা। তাই সে ফিরে যেতে চায়, শিশুকালের শহরে। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে। সে মফঃস্বল পাল্টায়নি বিশেষ। খুব বেশি কী সেখান থেকে বাইরে যায় না, কেউ আসেও না। সে গিয়েছিল। বেড়িয়েও এসেছে। তার বন্ধুরা, ইস্কুলের দিদিমনি – সবাই তাকে অভ্যর্থনা জানান। তাদের ফেলে যাওয়া লাল ইঁটের বাড়িটি – একখানা প্রাচীন কুয়ো বুকে অপেক্ষা করেছিল যেন তার জন্যে। এই কুয়োতেই মারা যায় তার ছোট বোন। সেই অন্ধকার আজও বুক পেতে ডাকে তাকে। শৈলজা ভুলে যেতে যেতে ফিরে আসতে চায় এইসব রংবাজির দুনিয়ায়। প্রদীপ কামাতের সঙ্গে দেখা করে সে, সস্বামী। প্রদীপ, শৈলজার ইস্কুলের বন্ধু। বন্ধু নাকি আরও খানিক বেশি? মনে পড়ে না তার। আমরাও দেখতে থাকি, তাদের নাজুক কথাবার্তা। ভোলা – না ভোলার মাঝের সরণীতে ঢুকে, দুই বন্ধু কথার মাঝে সেতু দিয়ে ফিরে যেতে চায় আগেকার দিনে। শৈলজা, পথে পথে – ঘোরে। এই এক দেশ আমাদের। যাকে পুনরায় দেখিয়ে দিয়ে যায় এই ছবি। যেখানে পঁচিশ বছর আগের বাড়িতে ফিরে এলে, সে বাড়ির বয়স্কা মহিলা জানান, যখন খুশি সেখানে ফিরে আসার কোনও মানা নেই। তাঁর কথায় সনাতন আতিথেয়তার এক চিত্রিত আত্মীয়তা রচিত হয় ছবি জুড়ে। এইটাই মূল সুর, থ্রি অফ আস সিনেমার। এই ফিরে আসা – এই দেখা পাওয়া – এই কাছে নেওয়া – এই চিরাচরিত যাতায়াতের অবিশ্রাম চলাচল – একেই তুলে ধরতে চেয়েছেন, পরিচালক অবিনাশ অরুণ। শৈলজার স্বামী, দীপঙ্কর দেশাই-এর ভূমিকায় অসামান্য কাজ করেছেন স্বানন্দ কিরকিরে। স্ত্রীর অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ সেই সঙ্গে স্ত্রীর ছেলেবেলার প্রেমিকের মুখোমুখি হওয়ার অন্তর্বেদনাকে খুব স্বল্প-নাট্যক্রিয়ায় মূর্ত করে তুলেছেন তিনি। প্রদীপ কামাতের চরিত্রে জয়দীপ আহলাট, যথারীতি অসামান্য! প্রদীপ এবং শৈলজার সম্পর্কের নানা মোড় দুরন্ত উপায়ে উঠে এসেছে ছবিতে। সামান্য সেতারের বাজনার মতো মৃদু অথচ শক্তিময়ী এই ছবির চরিত্রের ভেতরের সম্পর্ক। প্রতিটি সম্পর্কের উত্থান-পতনের কেবল শিশিরের শব্দ মিশে থাকে। অমোঘ এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে এই ছবির আর একটি চরিত্র, কোঙ্কন উপকূলের ছোট্ট জনপদটিও। যে কিনা বছরের পর বছর ধরে, একই ভাবে রাখে নিজেকে। গাছপালাময় পথ, লালমাটি, সমুদ্রের তীরে কুঠিরে থাকা এক রহস্যময়ী, বাসিন্দা, ইস্কুল বাড়ি, ঝোপঝাড়, আলো, মাটি, বাতাস – সব নিয়ে এই মফঃস্বল চির জাগরূক এক বাতিঘর। শৈলজার ফিরে আসা সেই বাতিঘরের আলোকশিখাকে জ্বালিয়ে দেয় নতুন ক’রে। প্রদীপের জীবনের তারে বেজে ওঠে এমন এক সুর, যা আর ফেরার কথা ছিল না। সেই সুরে, সে নতুন করে চিনতে শেখে তার জীবনসঙ্গিনীকেও। এ এক মায়ার সমীকরণ। মোলায়েম সুতির শাড়ির মতো কাজ করেছেন ছবির চরিত্রাভিনেতারা। শৈলজার চরিত্রে শেফালী শাহের মায়া-কাজল, আনত নজর, জায়মান উচ্চারণ – সব মিলিয়ে ছবিটিকে একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা দিয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য অভিনেতারাও পরিচালককে যোগ্য সঙ্গত করেছেন। থ্রি অফ আস – আসলে জীবনের গল্প।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন