চোখের জল নাকের জল
(সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়)
প্রেম আর বেল একই স্বভাবের, সময় হলে পড়বেই। প্রেম কি যাচিলে মিলে, আপনি উদয় হয় শুভযোগ পেলে–এ সেই অর্ধকুম্ভ, পূর্ণকুম্ভের মতো, গ্রহে গ্রহে যোগ হবে তবেই হবে।
আমিই সেই পিয়ন, কোর্টের পেয়াদা, সমন আমি ধরাবই চিঠি আমি গুঁজবই !
যখন বাড়ি ফিরছে, তখন হবে না ধোলাইয়ের ভয় আছে !
যখন পাড়া ছেড়ে যাচ্ছে, তখন পেছন পেছন যেতে হবে। বে-পাড়ায় গিয়ে নির্জনে কুটুস।
এবার সুযোগ এসে গেল–সে চলছে, আমি চলছি–মাঝে হাত কুড়ির ব্যবধান–বেশ যাচ্ছিল ! হঠাৎ ঘুরে গেল ! আবার বাড়িমুখো আমার পাশে দিয়ে হনহন করে হেঁটে বাড়ি চলল–কিছু ভুলেটুলে গেছে হয়তো !
এরকম মেয়ে-ছেলে আমি লাইফে দেখিনি। এসব মেয়ে-ছেলে সংসার করবে কি করে ? যার কোন মতিই স্থির নেই।
আমিও যদি হঠাৎ ফিরি, তাহলে লোকে সন্দেহ করতে পারে। তাই অকারণে বেশ কিছুদূর সামনে হেঁটে গেলাম।
প্রেমের ভিত আর বাড়ির ভিত একই জাতের ব্যাপার ! খেটেখুটে তৈরি করতে হয় !
রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, বেকার একটা চক্কর মেরে আমি এলুম গোপীদার দোকানে। গোপীদার কচুরির দোকান।
গোপীদা বললে, কি হলো ? তুমি গেলে ওদিকে, ও এল এদিকে ! ধেড়িয়েছ নিশ্চয়ই ! কেসটা কি ?
বললাম, কেস আবার কি ? নেজে খেলছে। মহা ধড়িবাজ। আগেই বলেছিলুম মেয়েছেলে কি চিজরে বাবা !
শোন বসন্ত, তুমি একটা কাজ করো ! ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।
বসুন্ধরা মানে তো মেয়ে–
তুমি–তুমি, বীর হও !
বীর হও ? বীর হবো কী করে ? যুদ্ধ করবো ?
আরে শোন না আমাদের পাড়ায় একটা বড় বদমেজাজী ষাঁড় আছে জানো তো ?
ওই ষাঁড়টার পিঠে চেপে বসে তুমি পাড়া-মহল্লা প্রদক্ষিণ করো।
–প্রমাণ করো যে তুমি বীর।
তোমার খুব নাম হবে, আর সেই নামের টানে সে তোমার কাছে আসবে।
আমি জানি এরকম রসিকতা আমায় অনেক সহ্য করতে হবে–
গোপীদা বললে, শোন বসন্ত আর একটা কাজ তুমি করতে পারো।
তুমি এখন বেশ কিছুদিন শিবের মাথায় জল ঢালো–
মেয়েরা যদি শিবের মাথায় জল ঢেলে বর পায় তাহলে তুমিও বউ পাবে। কিন্তু, বউ পেলে খাওয়াবে কি ?
রোজগার -পাতি তো কিছু নেই !
–নাহ ,লোকটার মাথায় কিস্সু নেই ,সব গুলিয়ে ফেলেছে। প্রেম আর বিয়ে– সব গুলিয়ে ফেলেছে এক্কেবারে।
সারাটা জীবন ট্যাটে বসে পয়সা আর পয়সা —
আর ধামার মতো একটা ভুঁড়ি।
না পড়েছে কবিতা,না পড়েছে উপন্যাস। আরে প্রেম হচ্ছে গিয়ে খুকখুক কাশি,রক্ত,সমাধি,আধুনিক,গান–
তোমার সমাধি ফুলে-ফুলে ঢাকা
প্রেম বলে নেই,তুমি নেই–
প্রেমিক মরলে চিতায় পোড়ানো হয় না সমাধি দেওয়া হয় !
আর তার পাশে থাকে শিউলি ,বকুল —
গোপীটা যদি রবীন্দ্রনাথের গানটাও একটু শা মন দিয়ে শুনত !
তাহলে অনেক কিছু বুঝতে পার–তো !
আরে পড়তে হবে না,শুধু কানটা গানের দিকে রাখো।
এ গানটা প্রায়ই হয় ,”আমি জেনে -শুনে বিষ করেছি পান”।
গানটা আমার একটু একটু আসে –জানালা খুললে যেমন উনুনের ধোঁয়া আসে অটোমেটিক আসে!
বেশ ধরেছিলুম ,”জেনে -শুনে বিষ করেছি পান”। গলা পরিস্কার ,সুরটাও বেশ লেগেছিলো –গোপে পাঁঠা
বলল —
এ তো আত্মহত্যার কেস !
বুঝে গেলুম,গোপী যে লেভেলের লোক তাতে ওর বাপের ক্ষমতা হবে না এ গানের মানে বোঝার !
আরে প্রেম যে একটা কত্ত বড়ো কাজ,কী দহন,কী জ্বালা !
গোপীর একটাই জ্বালা ,ধারের পয়সা আদায়ের জ্বালা। পাওনাদারের কাছে তলব করার জ্বালা।
একেবারে কোর্স মেটেরিয়াল — কী আর করি !
নিজেই আপন মনে গাইতে লাগলাম–
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্ৰাণ
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান
যতই দেখি তারে ততই দহি —
আপন –মন জ্বালা নীরবে সহি
তবু পারিনে দূরে যেতে –মরিতে আসি
লইগো বুক পেতে অনল বাণ –আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান–
রবীন্দ্রনাথ ইজ রবীন্দ্রনাথ ,কি বোধ,পারসেপশন,কনসেপ্শন,রিয়্যালাইজেশন —
সকলের মনে ঢুকে বসে আছে–ঈশ্বরের মতো।এই গান তো আমার জন্যই লেখা
প্রেমের একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি,শরীরটাকে করে দেয় জলের ট্যাংক।
কথায় কথায় জল এসে যায় চোখে।
লংকা চিবোলে নাকের জল,আর প্রেমে পড়লে চোখের জল। আর সংসারে ঢুকলে চোখের জল নাকের জল দুটোই।