micro-story-samparko

সম্পর্ক
নীলা নাথদাস


“চা খাবে ভাই?”

আনিরুল জিজ্ঞাসা করতেই দুদিকে ঘাড় নাড়ায় জীর্ণ জামা-প্যান্ট পরা এলোমেলো চুলের ছেলেটি৷ আনিরুল যত্ন করে চা মাটির গ্লাসে চা ও দুটো বিস্কুট দেয়৷ খদ্দেরদের চা দেওয়ার ফাঁকে আড়চোখে দেখে জরিপ করে আনিরুল৷

কত হবে ছেলেটির বয়স? মেরে কেটে বাইশ কি তেইশ৷ একমুখ দাঁড়ি, রুক্ষ চুল, সারা গায়ে খড়ি ওঠা ছেলেটিকে দেখে প্রথম দর্শনেই বড্ড মায়া পড়ে গেল ওর৷ কে জানে কোন বাড়ির ছেলে, কোত্থেকে এসেছে? খাবার জোটেনি হয়ত বহুদিন৷ এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন৷ বাড়ির লোকের অজান্তেই বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েছে৷

ছেলেটিকে চা বিস্কুট দিয়ে নাম, বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে আনিরুল৷

“পতা নহী, পতা নহী” জোরে জোরে ব’লে মাটিতে নখ দিয়ে আঁকিবুকি করে৷

তারপর, গোগ্রাসে চা বিস্কুট খেয়ে গ্লাস ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে৷ তারপর, গুম হয়ে মাটিতে বসে থাকে৷ আনিরুল খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ ছেলেটি কখন চলে গেছে তা খেয়ালও করেনা৷ বিকেলে যখন বাড়িতে ফিরছে আনিরুল ছেলেটিকে রাস্তার মোড়ে একটা গাছের তলায় দেখতে পায়৷ যেন আনিরুলের জন্যই অপেক্ষা করেছিল৷ ওকে দেখতে পেয়েই উঠে দাঁড়াল৷ তারপর, বিনা বাক্যব্যয়ে আনিরুলের সঙ্গে হাঁটা শুরু করল৷ খানিকটা বাধ্য হয়েই পাগলকে বাড়ি নিয়ে আসে ও৷ সাবিনা ওর বেগমকে সব বলতে ও দ্বিধা দ্বিরুক্তি না করে হাসিমুখে মেনে নেয়৷ অভাবের সংসার, কোনমতে টেনেটুনে চলে৷ তবু, চারটে ভাতের জন্য কেউ মরে যাবে এটাও তো মানা যায় না৷৷ তাই, ওর ছেলের নয়া চাচা হয়ে ছেলেটি থেকে যায়৷ চুল দাঁড়ি সেলুন থেকে কাটায় আনিরুল৷ অনেকটা স্বাভাবিক দেখায় ওকে৷ ও কিন্তু মেহমান হয়ে থাকেনা৷ রীতিমত কাজে সাহায্য করে আনিরুলকে৷ খদ্দেরদের চা এগিয়ে দেয়৷ বাসন মাজে৷ আনিরুল আপত্তি জানালেও মানতে চায় না৷ ছেলেটির বিষয়ে কথা হয় বস্তীর কাসিম ভাইয়ের সাথে৷ কাসিম বলে যে ওকে মনের রোগের ডাক্তার দেখালে ভাল হয়৷ কথাটা মনে ধরে আনিরুলের৷ সত্যিই তো, ওর কোন চিকিৎসাই হয়নি৷

একদিন সময় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়৷ ডাক্তারবাবু ভরসা দেন নিয়মিত ওষুধ খাওয়ালে শিগগিরই সুস্থ হয়ে যাবে৷ হোলোও তাই৷ দুমাস যেতে না যেতেই ফল পেল৷ এক রাতে ভাত খেতে খেতে টুকটাক নিজেই কথা বলতে শুরু করল৷ আনিরুলের বিবিকে ভাবী বলে সম্বোধন করে বলল—–আপনি খুব ভাল৷ আপনার রান্নাও ভাল৷

আনিরুল এই মওকায় ওর সম্পর্কে নানান কথা জানতে চাইল৷ উত্তরও পেল৷

আনিরুলকে বলল–ভাইয়া, আমার স্মৃতি ফিরছে৷ আমার নাম মোহন, মোহনকৃষ্ণ দুবে, উত্তরপ্রদেশে বাড়ি৷ বাবা বচপনেই মারা গেছে৷ দাদারা বড় ছিল৷ ওরা বাবার ব্যবসাটা দুজনে ভাগ করে নেয়৷ কিন্তু আমি ওদের সংসারে বোঝা হয়ে থাকি৷ একসময় অবসাদ ঘিরে ধরেছিল৷ সেটাই ক্রমশঃ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, কখন যে তা চূড়ান্ত অসুস্থতার জায়গায় এল তা ও জানে না৷

“দুবে? তার মানে তুমি হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ?” আনিরুল সভয়ে জিজ্ঞাসা করে৷

“হ্যা, কিন্তু আপনি আমার প্রাণদাতা৷ আপনি জাতধর্ম নিয়ে বলবেন না৷ তাতে আমি বরং দুঃখ পাবো৷ আপনাদের পরিবার থেকে আমি শিখেছি সম্পর্কের অর্থ কি!”

“কিন্তু ভাই তোমাকে তো বাড়ি ফিরতে হবে৷ তোমার নিজের বাড়ি আছে৷ তাছাড়া, জেনেশুনে আমি মুসলিম হয়ে হিন্দুকে বাড়িতে রাখতে পারি না৷ তোমাদের সমাজ তোমাকে একঘরে করবে৷

“আমি আপনাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না৷ আমার নিজের দাদারা যা আমার জন্য করেনি, সেটা আপনি করেছেন৷ আমাকে অন্য কোথাও যেতে বলবেন না৷” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে মোহন৷

আনিরুলের চোখেও জল৷ শক্ত করে ও মোহনের হাত ধরে বলে,

—অজান্তে, আমি তোমাকে আমাদের ঘরের ভাত খাইয়েছি বলে অপরাধ নিও না৷

—-না, না এরকম বলবেন না, ভাইয়া৷ আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন৷ আপনি ঘরে ঠাঁই না দিলে আমি তো পথে পড়ে মারা যেতাম!

আর কোন কথা বলতে পারে না মোহন৷ দুজনেই অঝোরঝরে কেঁদে চলে৷ বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে আনিরুলের উঠোনে৷

দূর থেকে সন্ধ্যার আজানের সুর ভেসে ওঠে,

“আল্লাহ আকবর……..”

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *